শিল্প ও দেহতত্ত্ব : এক
-অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কিছুর নোটিস যে দিচ্ছে, ঘটনা যেমন ঘটেছে তার সঠিক রূপটির প্রতিচ্ছায়া দেওয়া ছাড়া সে বেচারা অনন্যগতি; সে যদি ভাবে সে একটা কিছু রচনা করছে তো সেটা তার মস্ত ভ্রম। ডুবুরি সমুদ্রের তল ঘেঁটে মুক্তার শুক্তি তুলে আনে, খুবই সুচতুর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার, কিন্তু সে কি বলাতে পারে আপনাকে মুক্তাহারের রচয়িতা, না, যে পাহাড় পর্বত দেশে বিদেশে ঘুরে’ ফটোগ্রাফ তুলে আনছে সে নিজেকে চিত্রকর বলে’ চালিয়ে দিতে পারে আর্টিষ্ট মহলে?
একটুখানি বুদ্ধি থাকলেই আর্টের ইতিহাস লেখা চলে, কিন্তু যে জিনিষগুলো নিয়ে আর্টের ইতিহাস তার রচয়িতা ইতিহাসবেত্তা নয় রসবেত্তা- নেপোলিয়ান বীর রসের আর্টিষ্ট, তাঁর হাতে ইউরোপের ইতিহাস সৃষ্ট হল, সীজার আর্টিষ্ট গ’ড়লে রোমের ইতিহাস। যে ডুবে’ তোলে সে তোলে মাত্র বুদ্ধিবলে; আর যে গড়ে’ তোলে সে ভাঙাকে জোড়া লাগায় না শুধু, সে বেজোড় সামগ্রীও রচনা করে’ চলে মন থেকে।
ইতিহাসের ঘটনাগুলো পাথরের মতো সুনির্দিষ্ট শক্ত জিনিষ, এক চুল তার চেহারার অদল বদল করার স্বাধীনতা নেই ঐতিহাসিকের, আর ঔপন্যাসিক কবি শিল্পী এঁদের হাতে পাষাণও রসের দ্বারা সিক্ত হয়ে কাদার মতে নরম হয়ে যায়, রচয়িত তাকে যথা ইচ্ছা রূপ দিয়ে ছেড়ে দেন।
ঘটনার অপলাপ ঐতিহাসিকের কাছে দুর্ঘটনা, কিন্তু আর্টিষ্টের কাছে সেটা বড়ই সুঘটন বা সুগঠনের পক্ষে মস্ত সুযোগ উপস্থিত করে দেয়। ঠিকে যদি ভুল হয়ে যায় তবে সব অঙ্কটাই ভুল হয়; অঙ্কনের বেলাতেও ঠিক ওই কথা।
কিন্তু পাটিগণিতের ঠিক আর খাঁটি গুণীদের ঠিকের প্রথা স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র;- নামতা ঠিক রইলো তে অঙ্ককর্তা বল্লেন, ঠিক হয়েছে, কিন্তু নামেই ছবিটা ঠিক মানুষ হলো কি গরু গাধা বা আর কিছু হলো, রসের ঠিকানা হলো না ছবির মধ্যে, অঙ্কনকর্তা বলে’ বসলেন, ভুল!
ঐতিহাসিকের কারবার নিছক ঘটনাটি নিয়ে, ডাক্তারের কারবার নিখুঁত হাড়মাসের anatomy নিয়ে, আর আর্টিষ্টদের কারবার অনির্বচনীয় অখণ্ড রসটি নিয়ে। আর্টিষ্টের কাছে ঘটনার ছাঁচ পায় না রস, রসের ছাঁদ পেয়ে বদলে যায় ঘটনা, হাড়মাসের ছাঁচ পায় না শিল্পীর মানস কিন্তু মানসের ছাঁদ অনুসারে গড়ে’ ওঠে সমস্ত ছবিটার হাড় হদ্দ, ভিতর বাহির।
একটা গাছের বীজ, সে তার নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি যেমনটি পেয়েছে সেই ভাবেই যখন হাতে পড়লো, তখন সে গোলাকার কি চেপ্টা ইত্যাদি, কিন্তু সে থলি থেকে মাটিতে পড়েই রসের সঞ্চার নিজের মধ্যে যেমনি অনুভব করলে অমনি বদলে চল্লো নিজেই নিজের আকৃতি প্রকৃতি সমস্তই;
যার বাহু ছিল না চোখ ছিল না, যে লুকিয়ে ছিল মাটির তলায় নীরস কঠিন বীজকোষে বদ্ধ হ’য়ে, সে উঠলে মাটি ঠেলে, মেলিয়ে দিলে হাজার হাজার চোখ আর হাত আলোর দিকে আকাশের দিকে বাতাসের উপরে, নতুন শরীর নতুন ভঙ্গি লাভ করলে সে রসের প্রেরণায়, গোলাকার বীজ ছত্রাকার গাছ হয়ে শোভা পেলে, বীজের anatomy লুকিয়ে পড়লো ফুলের রেণুতে পাকা ফলের শোভার আড়ালে।
ঐতিহাসিককে রচনা করতে হয় না, তাই তার মাপকাঠি ঘটনাকে চুল চিরে’ ভাগ করে দেখিয়ে দেয়, ডাক্তারকেও জীবন্ত মানুষ রচনা করতে হয় না, কাযেই জীবন্মৃত ও মৃত মানুষের শবচ্ছেদ করার কাযের জন্য চলে তার মাপকাঠি, আর রচয়িতাকে অনেক সময় অবস্তুকে বস্তুজগতে, স্বপ্নকে জাগরণের মধ্যে টেনে আনতে হয়, রূপকে রসে, রসকে রূপে পরিণত করতে হয়, কাযেই তার হাতের মাপকাঠি সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের, রূপকথার সোণার রূপোর কাটির মতো অদ্ভুত শক্তিমান।
বীজের হাড় হদ্দ ভেঙে তার anatomy চুরমার করে’ বেরিয়ে এল গাছের ছবি বীজকে ছাড়িয়ে। গাছ যে রচলে তার রচনায় ছাঁদ ও anatomyর দোষ দেবার সাহস কারু হল না, উল্টে বরং কোন কোন মানুষ তারই রচনা চুরি করে’ গাছপালা আঁকতে বসে গেল- বীজতত্ত্বের বইখানার মধ্যে ফেলে রেখে দিলে যে অস্থি-পঞ্জরের মতো শক্ত পিঞ্জরে বদ্ধ ছিল বীজের প্রাণ তার প্রকৃত anatomyর হিসেব।
বীজের anatomy দিয়ে গাছের anatomyর বিচার করতে যাওয়া, আর মানুষী মূর্তির anatomy দিয়ে মানস মূর্তির anatomyর দোষ ধরতে যাওয়া সমান মূর্খতা। Anatomyর একটা অচল দিক আছে, যেটা নিয়ে এক রূপের সঙ্গে আর রূপের সুনির্দিষ্ট ভেদ, কিন্তু anatomyর একটা সচল দিকও আছে সেটা নিয়ে মানুষে মানুষে বা একই জাতের গাছে গাছে ও জীবে জীবে বাঁধা পার্থক্য একটুখানি ভাঙে- কোন মানুষ হয় তাল গাছের মতো, কেউ হয় ভাঁটার মতো, কোন গাছ ছড়ায় ময়ূরের মতো পাখা, কেউ বাড়ায় ভূতের মতো হাত!
প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বইখানাতে দেখবে মেঘের সুনির্দিষ্ট গোটাকতক গড়নের ছবি দেওয়া আছে- বৃষ্টির মেঘ, ঝড়ের মেঘ- সবার বাঁধা গঠন কিন্তু মেঘে যখন বাতাস লাগলো রস ভরলো তখন শাস্ত্র-ছাড়া সৃষ্টি-ছাড়া মূর্তি সব ফুটতে থাকলো, মেঘে মেঘে রং লাগলো অদ্ভুত অদ্ভুত, সাদা ধোঁয়া ধুমধাম করে সেজে এল লাল নীল হলদে সবুজ বিচিত্র সাজে, দশ অবতারের রং ও মূর্তিকে ছাড়িয়ে দশ সহস্র অবতার!
সচিত্র প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পুঁথি খুলে সে সময় কোন্ রসিক চেয়ে দেখে মেঘের রূপগুলোর দিকে? এই যে মেঘের গতিবিধির মতো সচল সজল anatomy, একেই বলা হয় artistic anatomy, যার দ্বারায় রচয়িতা রসের আধারকে রসের উপযুক্ত মান পরিমাণ দিয়ে থাকেন।
মানুষের তৃষ্ণা ভাঙতে যতটুকু জল দরকার তার পরিমাণ বুঝে জলের ঘটি এক রকম হ’ল, মানুষের স্নান করে’ শীতল হ’তে যতটা জল দরকার তার হিসেবে প্রস্তুত হ’ল ঘড়া জালা ইত্যাদি; সুতরাং রসের বশে হ’ল আধারের মান পরিমাণ আকৃতি পর্যন্ত। যার কোন রসজ্ঞান নেই সেই শুধু দেখে পানীয় জলের ঠিক আধারটি হচ্ছে চৌকোনা পুকুর, ফটিকের গেলাস নয়, সোণার ঘটিও নয়।
গোয়ালের গরু হয়তো দেখে পুকুরকে তার পানীয় জলের ঠিক আধার, কিন্তু সে যদি মানুষকে এসে বলে, ‘তোমার গঠন সম্বন্ধে মোটেই জ্ঞান নেই, কেন না জলাধার তুমি এমন ভুল রকমে গড়েছ যে পুকুরের সঙ্গে মিলছেই না’, তবে মানুষ কি জবাব দেয়? ঐতিহাসিকের মাপকাঠি ঘটনামূলক, ডাক্তারের মাপকাঠি কায়ামূলক, আর রচয়িতা যারা তাদের মাপকাঠি অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়ামূলক।
ঐতিহাসিককে রচনা করতে হয় না, তাই তার মাপকাঠি ঘটনাকে চুল চিরে’ ভাগ করে দেখিয়ে দেয়, ডাক্তারকেও জীবন্ত মানুষ রচনা করতে হয় না, কাযেই জীবন্মৃত ও মৃত মানুষের শবচ্ছেদ করার কাযের জন্য চলে তার মাপকাঠি, আর রচয়িতাকে অনেক সময় অবস্তুকে বস্তুজগতে, স্বপ্নকে জাগরণের মধ্যে টেনে আনতে হয়, রূপকে রসে, রসকে রূপে পরিণত করতে হয়, কাযেই তার হাতের মাপকাঠি সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের, রূপকথার সোণার রূপোর কাটির মতো অদ্ভুত শক্তিমান।
রসকে ধরবার উপযুক্ত জিনিষ বিচিত্র রং ও রেখা সমস্ত গাছের ডালের মতো, ফুলের বোঁটার মতো, পাতার ঝিলিমিলির মতো তারা জীবনরসে প্রাণবন্ত ও গতিশীল। ফটোগ্রাফারের ওখানে ছবি ওঠে- সীসের টাইপ থেকে যেমন ছাপ ওঠে- ছবি ফোটে না।
ঘটনা যাকে কুড়িয়ে ও খুঁড়ে তুলতে হয়, ঠিক ঠিক খোন্তা হল তার পক্ষে মহাস্ত্র, মানুষের ভৌতিক শরীরটার কারখানা নিয়ে যখন কারবার, ঠিক ঠিক মাংসপেশী অস্থিপঞ্জর ইত্যাদির ব্যবচ্ছেদ করার শূল ও শলাকা ইত্যাদি হ’ল তখন মৃত্যুবাণ, কিন্তু রচনা প্রকাশ হবার আগেই এমন একটি জায়গার সৃষ্টি হয়ে বসে যে সেখানে-
কোদাল, কুড়ুল, শূল, শাল কিছু চলে না, রচয়িতার নিজের অস্থিপঞ্জর এবং ঘটাকাশের ঘটনা সমস্ত থেকে অনেক দূরে রচয়িতার সেই মনোজগৎ বা পটাকাশ, যেখানে ছবি ঘনিয়ে আসে মেঘের মতো, রস ফেনিয়ে ওঠে, রং ছাপিয়ে পড়ে আপনা আপনি।
সেই সমস্ত রসের ও রূপের ছিটেফোঁটা যথোপযুক্ত পাত্র বানিয়ে ধরে’ দেয় রচয়িতা আমাদের জন্যে। এখন রচয়িতা রস বুঝে’ রসের পাত্র নির্বাচন করে’ যখন দিচ্ছে তখন রসের সঙ্গে রসের পাত্রটাও স্বীকার না করে’ যদি নিজের মনোমত পাত্রে রসটা ঢেলে নিতে যাই তবে কি ফল হবে?
ধর রৌদ্ররসকে একটা নবতাল বা দশতাল মূর্তির আধার গড়ে’ ধরে’ আনলেন রচয়িতা, পাত্র ও তার অন্তর্নিহিত রসের চমৎকার সামঞ্জস্য দিয়ে, এখন সেই রচয়িতার আধারকে ভেঙে রৌদ্ররস যদি মুঠোম হাত পরিমিত anatomy-দোরস্ত আমার একটা ফটোগ্রাফের মধ্যে ধরবার ইচ্ছে করি তো রৌদ্র হয় করুণ নয় হাস্যরসে পরিণত না হয়ে যাবে না; কিম্বা ছোট মাপের পাত্রে না ঢুকে রসটা মাটি হবে মাটিতে পড়ে’।
হারমোনিয়ামের anatomy, বীণার anatomy, বাঁশীর anatomy রকম রকম বলেই সুরও ধরে রকম রকম; তেমনি আকারের বিচিত্ৰতা দিয়েই রসের বিচিত্ৰতা বাহিত হয় আর্টের জগতে, আকারের মধ্যে নির্দিষ্টতা সেখানে কিছুই নেই।
হাড়ের পঞ্জরের মধ্যে মাংসপেশী দিয়ে বাঁধা আমাদের এতটুকু বুক, প্রকাণ্ড সুখ প্রকাণ্ড দুঃখ প্রকাণ্ড ভয় এতটুকু পাত্রে ধরা মুস্কিল। হঠাৎ এক-এক সময়ে বুকটা অতিরিক্ত রসের ধাক্কায় ফেটে যায়; রসটা চাইলে বুককে অপরিমিত রকমে বাড়িয়ে দিতে, কিম্বা দমিয়ে দিতে, আমাদের ছোট পিঁজ্রে হাড়ে আর তাঁতে নিরেট করে বাঁধা স্থিতি-স্থাপকতা কিম্বা সচলতা তার নেই, অতিরিক্ত ষ্টিম্ পেয়ে বয়লারের মতো ফেটে চৌচির হয়ে গেল।
রস বুকের মধ্যে এসে পাত্রটায় যে প্রসারণ বা আকুঞ্চন চাইলে, প্রকৃত মানুষের anatomy সেটা দিতে পারলে না; কাজেই আর্টিষ্ট যে, সে রসের ছাঁদে কমে বাড়ে ছন্দিত হয় এমন একটা সচল তরল anatomy সৃষ্টি করে’ নিলে যা অন্তর এবং বাইরে সুসঙ্গত ও সুসংহত।
রসকে ধরবার উপযুক্ত জিনিষ বিচিত্র রং ও রেখা সমস্ত গাছের ডালের মতো, ফুলের বোঁটার মতো, পাতার ঝিলিমিলির মতো তারা জীবনরসে প্রাণবন্ত ও গতিশীল। ফটোগ্রাফারের ওখানে ছবি ওঠে- সীসের টাইপ থেকে যেমন ছাপ ওঠে- ছবি ফোটে না।
আঁকে বাঁকে, প্রকৃতির সব জিনিষের মতো- গাছের ডালের মতো, বৃন্তের মতো, পাপড়ির মতো, মেঘের ঘটার মতো, জলের ধারার মতো। রসের বাধা জন্মায় যাতে এমন সব বস্তু কবিরা টেনে ফেলে দেন,–নিরঙ্কুশাঃ কবয়ঃ। লয়ে লয়ে না মিল্লে কবিতা হ’ল না, এ কথা যার একটু কবিত্ব আছে সে বলবে না; তেমনি আকারে আকারে না মিল্লে ফটোগ্রাফ হল না বলতে পারি, কিন্তু ছবি হল না একথা বলা চলে না।
পারিজাতের মতো বাতাসে দাঁড়িয়ে আকাশে ফুল ফোটানো আর্টিষ্টের কাজ, সুতরাং তার মন্ত্র মানুষের শরীর-যন্ত্রের হিসেবের খাতার লেখার সঙ্গে এমন কি বাস্তব জগতের হাড়হদ্দের খবরের সঙ্গে মেলানো মুস্কিল। অভ্র-বিজ্ঞানের পুঁথিতে আবর্ত সম্বর্ত ইত্যাদি নাম-রূপ দিয়ে মেঘগুলো ধরা হয়েছে- কিন্তু কবিতা কি গান রচনার বেলা ঐ সব পেঁচালো নামগুলো কি বেশী কাযে আসে?
মেঘের ছবি আঁকার বেলাতেও ঠিক পুঁথিগত ঘোরপেঁচ এমন কি মেঘের নিজমূর্তিগুলোর হুবহু ফটোগ্রাফও কাযে আসে না। রচিত যা তার মধ্যে বসবাস করলেও রচয়িতা চায় নিজের রচনাকে। সোণার খাঁচার মধ্যে থাকলেও বনের পাখী সে যেমন চায় নিজের রচিত বাসাটি দেখতে, রচয়িতাও ঠিক তেমনি দেখতে চায় নিজের মনোগতটি গিয়ে বসলো নিজের মনোমত করে’ রচা রং রেখা ছন্দোবন্ধ ঘেরা সুন্দর বাসায়।
কোকিল সে পরের বাসায় ডিম পাড়ে–নামজাদা মস্ত পাখী। কিন্তু বাবুই সে যে রচয়িতা, দেখতে এতটুকু কিন্তু বাসা বাঁধে বাতাসের কোলে- মস্ত বাসা। আমাদের সঙ্গীতে বাঁধা অনেকগুলো ঠাট আছে, যে লোকটা সেই ঠাটের মধ্যেই সুরকে বেঁধে রাখলে সে গানের রচয়িতা হল না;
সে নামে রাজার মতো পূর্ব্বপুরুষের রচিত রাজগীর ঠাটটা মাত্র বজায় রেখে চল্লো ভীরু, কিন্তু যে রাজত্ব পেয়েও রাজত্ব হারাবার ভয় রাখলে না, নতুন রাজত্ব জিতে নিতে চল্লো সেই সাহসীই হল রাজ্যের রচয়িতা বা রাজা এবং এই স্বাধীনচেতারাই হয় সুরের ওস্তাদ। সুর লাগাতে পারে তারাই যারা সুরের ঠাট মাত্র ধরে’ থাকে না, বেসুরকেও সুরে ফেলে।
মানুষের anatomyতেই যদি মানুষ বদ্ধ থাকতো, দেবতাগুলোকে ডাকতে যেতে পারতো কে? কার জন্যে আসতো নেমে স্বর্গ থেকে ইন্দ্ররথ, পুষ্পক রথে চড়িয়ে লঙ্কা থেকে কে আনতো সীতাকে অযোধ্যায়? ভূমিষ্ঠ হয়েই শিশু আপনার anatomy ভাঙতে সুরু করলে, বানরের মতো পিঠের সোজা শিরদাঁড়াকে বাঁকিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো- দুই পায়ে ভর দিয়ে গাছে গাছে ঝুল্তে থাক্লো না।
প্রথমেই যুদ্ধ হল মানুষের নিজের anatomyর সঙ্গে, সে তাকে আস্তে আস্তে বদলে’ নিলে আপনার চলনবলনের উপযুক্ত করে। বীজের anatomy নাশ করে যেমন বার হ’ল গাছ, তেমনি বানরের anatomy পরিত্যাগ করে’ মানুষের anatomy নিয়ে এল মানুষ; ঠিক এই ভাবেই medical anatomy নাশ করে আর্টিষ্ট আবিষ্কার করলে artistic anatomy, যা রসের বশে কমে বাড়ে;
আঁকে বাঁকে, প্রকৃতির সব জিনিষের মতো- গাছের ডালের মতো, বৃন্তের মতো, পাপড়ির মতো, মেঘের ঘটার মতো, জলের ধারার মতো। রসের বাধা জন্মায় যাতে এমন সব বস্তু কবিরা টেনে ফেলে দেন,–নিরঙ্কুশাঃ কবয়ঃ। লয়ে লয়ে না মিল্লে কবিতা হ’ল না, এ কথা যার একটু কবিত্ব আছে সে বলবে না; তেমনি আকারে আকারে না মিল্লে ফটোগ্রাফ হল না বলতে পারি, কিন্তু ছবি হল না একথা বলা চলে না।
বড় পা’কে ছোট জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে চীনের রাজকন্যার যা ভোগ ভুগতে হয়েছে সেটা কসা জুতোর একটু চাপ পেলেই আমরা অনুভব করি- পা বেরিয়ে পড়তে চায় চট্ করে’ জুতো ছেড়ে, কিন্তু হায়! ছবি- সে কিনা আমাদের কাছে শুধু কাগজ, সুর- সে কিনা শুধু খানিক গলার শব্দ, কবিতা- সে শুধু কিনা ফর্মা বাঁধা বই; তাই তাদের মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে চুরে চামড়ার থলিতে ভরে দিতে কষ্টও পাইনে ভয়ও পাইনে।
‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’ শুনতে বেশ লাগলো, ‘ছেলেটি কার্তিকের মতো’ দেখতে বেশ লাগলো, কিন্তু কবিতা লিখলেই কি কাশীদাসী সুর ধরতে হবে, না ছেলে আঁকতে হলেই পাড়ার আদুরে ছেলের anatomy কাপি করলেই হবে? গণেশের মূর্তিটিতে আমাদের ঘরের ও পরের ছেলের anatomy যেমন করে ভাঙা হয়েছে তেমন আর কিছুতে নয়।
হাতী ও মানুষের সমস্তখানি রূপ ও রেখার সামঞ্জস্যের মধ্য দিয়ে একটা নতুন anatomy পেয়ে এল, কাযেই সেটা আমাদের চক্ষে পীড়া দিচ্ছে না, কেন না সেটা ঘটনা নয়, রচনা। আরব্য-উপন্যাসের উড়ন্ত সতরঞ্চির কল্পনা বাস্তবজগতে উড়োজাহাজ দিয়ে সপ্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কি আমাদের কাছে নগণ্য হয়েছিল, না, অবাধ কল্পনার সঙ্গে গল্পের ঠাট মিলছে কিন্তু বিশ্বরচনার সঙ্গে মিলছে না দেখে’ গালগল্প রচনার বাদশাকে কেউ আমরা দুষেছি?
প্রত্যেক রচনা তার নিজের anatomy নিয়ে প্রকাশ হয়; ঠাট বদলায় যেমন প্রত্যেক রাগরাগিণীর, তেমনি ছাঁদ বদলায় প্রত্যেক ছবির কবিতার রচনার বেলায়। ধর যদি এমন নিয়ম করা যায় যে কাশীদাসী ছন্দ ছাড়া কবিরা কোনো ছন্দে লিখতে পারবে না-
যেমন আমরা চাচ্ছি ডাক্তারি anatomy ছাড়া ছবিতে আর কিছু চলবে না- তবে কাব্যজগতে ভাবের ও ছন্দের কি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়,- সুরের বদলে থাকে শুধু দেশজোড়া কাশী আর রচয়িতার বদলে থাকে কতকগুলি দাস। কাযেই কবিদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ‘কবয়ঃ নিরঙ্কুশাঃ’ বলে’, কিন্তু বাস্তবজগৎ থেকে ছাড়া পেয়ে কবির মন উড়তে পারবে যথাসুখে যথাতথা, আর ছবি আট্কে থাকবে ফটোগ্রাফারের বাক্সর মধ্যে- জালার মধ্যে বাঁধা আরব্য-উপন্যাসের জিন্-পরীর মতো সুলেমানের সিলমোহর আঁটা চিরকালই, এ কোন্দেশী কথা?
ইউরোপ, যে চিরকাল বাস্তবের মধ্যে আর্টকে বাঁধতে চেয়েছে সে এখন সিলমোহর মায় জালা পর্যন্ত ভেঙে কি সঙ্গীতে, কি চিত্রে, ভাস্কর্যে, কবিতায়, সাহিত্যে, বাঁধনের মুক্তি কামনা করছে; আর আমাদের আর্ট যেটা চিরকাল মুক্ত ছিল তাকে ধরে ডানা কেটে পিঁজ্রের মধ্যে ঠেসে পুরতে চাচ্ছি আমরা।
বড় পা’কে ছোট জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে চীনের রাজকন্যার যা ভোগ ভুগতে হয়েছে সেটা কসা জুতোর একটু চাপ পেলেই আমরা অনুভব করি- পা বেরিয়ে পড়তে চায় চট্ করে’ জুতো ছেড়ে, কিন্তু হায়! ছবি- সে কিনা আমাদের কাছে শুধু কাগজ, সুর- সে কিনা শুধু খানিক গলার শব্দ, কবিতা- সে শুধু কিনা ফর্মা বাঁধা বই; তাই তাদের মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে চুরে চামড়ার থলিতে ভরে দিতে কষ্টও পাইনে ভয়ও পাইনে।
মনে হবে অপ্রাকৃত কিছু নেই এখানে, কিন্তু কালো শুধু বলা চল্লো না, কোমল কালো না হ’লে ভেসে চলতে পারলো না আকাশে বাতাসে রংএর স্রোত বেয়ে কবির মানসকমল থেকে খসে-পড়া সুর-বোঝাই পাপড়িগুলি সেই দেশের খবর আনতে যে দেশের বাদল বাউল একতারা বাজাচ্ছে সারা বেলা।
অন্যথা-বৃত্তি হল আর্টের এবং রচনার পক্ষে মস্ত জিনিষ, এই অন্যথা-বৃত্তি দিয়েই কালিদাসের মেঘদূতের গোড়া পত্তন হল, অন্যথা-বৃত্তি কবির চিত্ত মানুষের রূপকে দিলে মেঘের সচলতা এবং মেঘের বিস্তারকে দিলে মানুষের বাচালতা। এই অসম্ভব ঘটিয়ে কবি সাফাই গাইলেন যথা- “ধূমজ্যোতিসলিলমরুতাং সন্নিপাতঃ ক্ব মেঘঃ, সন্দেশার্থাঃ ক্ব পটুকরণৈঃ প্রাণিভিঃ প্রাপণীয়াঃ”।
ধূম আলো আর জল-বাতাস যার শরীর, তাকে শরীর দাও মানুষের, তবে তো সে প্রিয়ার কাণে প্রাণের কথা পৌঁছে দেবে? বিবেক ও বুদ্ধি মাফিক মেঘকে মেঘ রেখে কিছু রচনা করা কালিদাসও করেন নি, কোন কবিই করেন না।
যখন রচনার অনুকূল মেঘের ঠাট কবি তখন মেঘকে হয়তো মেঘই রাখলেন কিন্তু যখন রচনার প্রতিকূল ধূম জ্যোতি জল বাতাস তখন নানা বস্তুতে শক্ত করে, বেঁধে নিলেন কবি। এই অন্যথা-বৃত্তি কবিতার সর্ব্বস্ব, তখনো যেমন এখনো তেমন, রসের বশে ভাবের খাতিরে রূপের অন্যথা হচ্ছে-
“শ্রাবণ মেঘের আধেক দুয়ার ঐ খোলা,
আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন পথভোলা
ঐ যে পূরব গগন জুড়ে, উত্তরী তার যায় রে উড়ে
সজল হাওয়ার হিন্দোলাতে দেয় দোলা!
লুকাবে কি প্রকাশ পাবে কেই জানে,
আকাশে কি ধরায় বাসা কোন্ খানে,
নানা বেশে ক্ষণে ক্ষণে, ঐ ত আমার লাগায় মনে,
পরশখানি নানা সুরের ঢেউ তোলা।”
ভাব ও রসের অন্যান্য বৃত্তি পেয়ে মেঘ এখানে নতুন সচল anatomyতে রূপান্তরিত হল। এখন বলতে পারো মেঘকে তার স্বরূপে রেখে কবিতা লেখা যায় কি না? আমি বলি যায়, কিন্তু অভ্র-বিজ্ঞানের হিসেব মেঘের রূপকে যেমন ছন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখায়, সে ভাবে লিখলে কবিতা হয় না, রংএর ছন্দ বা ছাঁদ, সুরের ছাঁদ, কথার ছাঁদ দিয়ে মেঘের নিজস্ব ও প্রত্যক্ষ ছাঁদ না বদলালে কবিতা হ’তে পারে না, যেমন-
“আজি বর্ষা রাতের শেষে
সজল মেঘের কোমল কালোয়
অরুণ আলো মেশে।
বেণু বনের মাথায় মাথায়
রং লেগেছে পাতায় পাতায়,
রঙের ধরায় হৃদয় হারায়
কোথা যে যায় ভেসে।”
মনে হবে অপ্রাকৃত কিছু নেই এখানে, কিন্তু কালো শুধু বলা চল্লো না, কোমল কালো না হ’লে ভেসে চলতে পারলো না আকাশে বাতাসে রংএর স্রোত বেয়ে কবির মানসকমল থেকে খসে-পড়া সুর-বোঝাই পাপড়িগুলি সেই দেশের খবর আনতে যে দেশের বাদল বাউল একতারা বাজাচ্ছে সারা বেলা।
(চলবে…)
………………………
বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
………………………
আরও পড়ুন-
শিল্প ও দেহতত্ত্ব : এক
শিল্প ও দেহতত্ত্ব : দুই
মত ও মন্ত্র
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………….
আরও পড়ুন-
দর্শনের ইতিহাস বিচার
আইয়োনীয় দর্শন
টোটেম বিশ্বাস
নির্ধারণবাদ
বিতণ্ডাবাদী
অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ
জনগণের দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন
লোকায়ত ও সাংখ্য
লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকবৃন্দ