ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ বিবর্তন সৃষ্টিতত্ত্ব

-ড. এমদাদুল হক

৯১
আমরা সবাই অভিনেতা।

জীবন কি তবে? একটি নাটক!

গল্পটি কি? সিরিয়াল নাটক এক পলক দেখে কি পুরো গল্প বুঝা যায়?

কিছু লোক হাঁটছে আর গান গাইছে, ছেলেটি মেয়েটিকে বললো, ‘খাম্বাকে আমার কাছে দাও’। এই খন্ডাংশ থেকে বুঝার উপায় নেই, এটি নাটকের শুরু, নাকি শেষ। এটি বুঝতে হলে ‘কালা কইতর’ নাটকটি পুরো দেখা চাই। জীবনও এমনই।

যে দৃশ্যে আমরা অভিনয় করছি, তা বিশাল নাটকের খন্ডাংশ মাত্র। আমরা দুঃখ পাই, কারণ নাটকের সবটা জানি না।

মানুষ জানতে চায়, নাটকটি শুরু হলো কোত্থেকে? কখন, কীভাবে শুরু হলো জীবনের অভিযাত্রা? এর শেষ কোথায়? এই নাটকের ডাইরেক্টর কে? গল্পকার কে?

একদল বলে, নাটক যেহেতু আছে ডাইরেক্টর, গল্পকার, ক্যামেরাম্যানও আছে। আরেক দল বলে, এই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনে- কোনো ডাইরেক্টর-ফাইরেক্টর নেই।

সাড়ে চারশ কোটি বছর কেটে গেছে- আমরা জানতে পারলাম না, জীবনের নাটকটি শুরু হলো কোত্থেকে? কে এর ডাইরেক্টর?

একেকবার একেকজন মানুষ আসে, একেকটা অনুমান প্রচার করে। আমরা কি করি?

অনুমান নিয়ে নাচানাচি, মারামারি করি। কাউকে বলি আস্তিক- কাউকে বলি নাস্তিক। কাউকে বলি অবতার, কাউকে বলি বিজ্ঞানী। আমরা বুঝতেই পারছি না যে, এটিও নাটক- মহা সিরিয়াল নাটকের একটি খন্ডাংশ মাত্র।

৯২
মানুষ কি পশু হতে পারে? পশু কি মানুষ হতে পারে?

যে পুরুষ ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করতে পারে, সে মানুষ নাকি পশু?

যে মা তার শিশু সন্তানকে হত্যা করতে পারে, সে মানুষ নাকি পশু?

যে হরিণ নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জীবন রক্ষা করে, সে পশু নাকি মানুষ? যে কুকুর নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বন্ধুর জীবন রক্ষা করে, সে পশু নাকি মহামানব?

শনিদেবের ভক্ত কাক। মাতা ছায়ার জীবনভিক্ষা চাইতে তিনি কৈলাস শিখরে যাচ্ছেন। সম্মুখে আগুনের নদী। কাক বললো, `আমার পিঠে উঠুন প্রভু‘। কাকের পিঠে চড়ে শনিদেব ওপাড়ে গেলেন ঠিকই কিন্তু অগ্নিদগ্ধ হয়ে কাকের মৃত্যু হলো।

মহাদেবের সম্মুখে উপস্থিত শনি, মাতা ও কাকের জীবন ভিক্ষা চাইলেন। মহাদেব বললেন, ‘যে কোনো একজনের জীবন তুমি চাইতে পারো শনি, মাতা কিংবা ভক্ত শনির।’

শনিদেব চেয়েছিলেন কাকের জীবন। কারণ কাকের মহত্ব অতিক্রম করেছিল মানুষের মনুষ্যত্ব, এমনকি দেবতাদের দেবত্বও।

পশুদের মনুষ্যত্ব এবং মানুষের পশুত্ব দেখে বিস্ময় প্রকাশের ভাষাও হারিয়ে যায় মাঝেমধ্যে। তবে কি কিছু পশু মানুষ হয়ে জন্ম নেয়? কিছু মানুষ কি পশু হয়ে জন্ম নেয়? হতেও তো পারে!

আচ্ছা! শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হয় কেন?

শুঁয়োপোকা যখন প্রজাপতি হয় তখন শুঁয়োপোকাটির কি হয়? মৃত্যু নাকি রূপান্তর? মৃত্যু নাকি পুনর্জন্ম?

বিজ্ঞানের সকল শাখা মেনে নিয়েছে, পশুর বিবর্তনে মানুষের জন্ম। এটি যদি সত্য হয়, তবে অর্ধসত্য। পুরোসত্য হলো- পশুর বিবর্তনে যেমন মানুষের জন্ম হয় তেমনি মানুষের রূপান্তরে পশুর জন্ম হয়।

পশু থেকে মানুষের জন্ম, এটি মানতে যদি সমস্যা না হয়, তবে মানুষ থেকে পশুর জন্ম- এটি মানতে সমস্যা কোথায়?

পৃথিবী যেই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে, সেই সূর্যও তো ঘুরছে আপন কক্ষপথে। ইলেকট্রন, প্রোটন, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি সবাই ঘুরছে, সবই ঘুরছে। সমগ্র মহাবিশ্ব ঘুরছে। জীবন কেন ঘুরবে না?

৯৩
শাস্তিও নেই, পুরস্কারও নেই। আছে শুধু কর্মফল। কর্মফল শাস্তি নয়, পুরস্কার নয়, পারিশ্রমিকও নয়।

কর্মফল মানে কর্মফল- এর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এটি স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু লোকে তা মানতে চায় না। প্রশ্ন উঠে- যে লোকটি সারাজীবন চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করলো; ১২০ বছর চুটিয়ে বাঁচলো; অবশেষে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আরামের মৃত্যুবরণ করলো; রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় যার দাফন হলো, দাফনের পর মহা আড়ম্বরে যার কুলখানিও হলো- সে কর্মফল পেলো কোথায়?

কারো জন্ম হয় সোনার চামচ মুখে দিয়ে, কেউ বা জন্ম নেয় বস্তিতে- কোন কর্মফলের কারণে?

কারো জন্মের পর সারাদেশে উৎসব হয়, কাউকে ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে- কোন কর্মফলের কারণে?

কেউ পদ্মলোচন- কেউ জন্মান্ধ- কোন কর্মফলের কারণে? এইসব অসংখ্য প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না যদি মেনে নেই যে জন্ম দিয়ে জীবনের শুরু, আর মৃত্যু দিয়ে শেষ।

সুতরাং মানতেই হয়- জীবন এক অভিযাত্রা।

জীবনের মূলে রয়েছে ডিএনএ। ডিএনএ’র সুপ্ত তথ্যগুলো হলো ‘প্রারব্ধ’, যা নিয়ে শুরু হয় জীবনের যাত্রা। ডিএনএ আমরা প্রাপ্ত হই জনক-জননীর মাধ্যমে। ‘প্রারব্ধ’ স্বরচিত। প্রারব্ধ গঠিত হয় ব্যক্তির সেইসব কর্ম দ্বারা, যার ফল ভোগ করা হয়নি।

প্রারব্ধ যে আছে এর প্রমাণ কি? প্রমাণ নেই- অনুমান। বিজ্ঞান বলছে একজন মানুষের ডিএনএর তথ্যগুলো ছাপালে নাকি সারা পৃথিবী বইয়ে ছেয়ে যাবে। প্রমাণ কি? কে ছেপে দেখেছে? প্রমাণ নেই- অনুমান।

মানবদেহে নাকি সাড়ে ৩৭ ট্রিলিয়ন কোষ আছে, প্রমাণ কি? কে গুণে দেখেছে? প্রমাণ নেই- অনুমান। পৃথিবীর বয়স যে সাড়ে ৪শ কোটি বছর, এর প্রমাণ কি? প্রমাণ নেই- অনুমান।

বিজ্ঞান বলছে, ‘বস্তু হলো শক্তির স্পন্দন’। তার মানে যে চেয়ারটিতে বসে আছি তাও চেয়ার নয়- অনুমান। বসে আছি অনুমানের উপর, চলছি অনুমানের উপর। এতো অনুমান নিয়ে বাস করতে যদি সমস্যা না হয়- ‘প্রারব্ধ’ অনুমান নিয়ে বাস করতে সমস্যা কোথায়?

৯৪
জীবনের বিকাশ সূত্রে বংশগতি ও পরিবেশ সমান গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের চরিত্র বহুলাংশে বংশগতি দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। এই সূত্রে মনুষ্য জীবনের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা পরমাপ্রকৃতি নির্ভর। যদি তাই হয়, তবে: প্রথমত, মানুষকে তার কর্মের জন্য দায়ী করা যায় না।

দ্বিতীয়ত, যদি বংশগতি নির্ধারণে ব্যক্তির কোনো ভূমিকা না থাকে, তবে মানুষকে ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া বৃথা।

তৃতীয়ত, কেউ জন্ম নেয় রাজার ঘরে, কেউ জন্ম নেয় বস্তিতে। কেউ জন্ম নেয় সুস্থ সুন্দর দেহ নিয়ে, কেউ জন্ম নেয় অসুস্থ, কদর্য দেহ নিয়ে। উপযুক্ত কারণ ব্যতীত পরমাপ্রকৃতির এই বৈষম্যমূলক আচরণ অন্যায়। এটি ন্যায় হতে পারে যদি এবং শুধু যদি জীবনের পূর্বেও জীবন থাকে; জীবনের পরেও জীবন থাকে এবং ব্যক্তি স্বয়ং তার কর্ম দ্বারা ডিএনএ গঠন করে এবং জন্মের পরিবেশ স্ব-নির্ধারিত হয়।

সোজা কথা, বংশগতি যদি স্বনির্ধারিত না হয়, তবে জীবনের ভিত্তি হবে অন্যায়। যদি জীবনের ভিত্তিতেই অন্যায় থাকে, তবে ন্যায় খোঁজার সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা।

সুতরাং প্রমাণ না থাকলেও এটি মেনে নিতেই হয় যে- জীবন ছিল, জীবন আছে, জীবন থাকবে। জীবনই ঈশ্বর। ঈশ্বরই জীবন। এবং নাই কোনো ঈশ্বর, জীবন ছাড়া।

৯৫
চেষ্টায় কোনো ত্রুটি নেই, তবু কেন বারবার ব্যর্থতা আসে? অনেক ভালোবেসে, অনেক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে বিবাহ। এখন অশান্তি। কেন এমন হয়?

আমি এতো চেষ্টা করেও পেলাম না- তুমি কোনো চেষ্টা না করেই পেয়ে গেলে। আমার বড়শিতে একটি মাছও ঠোকর দেয় না- তোমার থালা ভরে গেছে। আমার প্রতি এই অবিচার কেন?

পরমাপ্রকৃতিতে কোনো অবিচার নেই। ঘূর্ণিঝড় হঠাৎ করে উৎপন্ন হয় না। আজ যেই ঝড় সবকিছু তছনছ করে দিলো- অনেক দিন আগে গাছ কাটা, পরিবেশ দূষণ, জল দূষণ, বায়ু দূষণ এর জন্য দায়ী।

আমরা কার্যের কারণ খুঁজি ঘটনার সংকীর্ণ বৃত্তে। অথচ ঘটনা শুরু হয়েছে আরো অনেক আগে। তার মানে, বিবাহ ব্যর্থ, কারণ ভালোবাসায় খাদ ছিল। প্রচেষ্টা ব্যর্থ কারণ ব্যর্থতা প্রথম পদক্ষেপটিতেই ছিল।

সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি কাজ পায় না, অথচ অসৎ ও অযোগ্যরা মোটা বেতনের চাকরি করে। কেন এমন হয়? কারণ সম্ভবত এই যে, কোনো এক কর্মময় জীবনযাপনে সে অবসর থাকার স্বপ্নে বিভোর ছিল।

পরমাপ্রকৃতিকে যা ঘটে, তা যৌক্তিক কারণেই ঘটে। আমাদের জীবনে যা ঘটে, তারও রয়েছে যৌক্তিক কারণ। কার্য কারণেরই পরিণাম। উৎপত্তির পূর্বে কার্য, কারণের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। পেষণ দ্বারা তিল থেকে তেল বের হয়, কারণ পেষণ শুরু করার পূর্বেই তিলে তেল ছিল।

সমস্যা হলো, তিলে তেল থাকার মতো সরল নয় জীবনের পথ চলা। জীবন খুবই জটিল। অসংখ্য সংযোগ ও ঘটনা অবিরত ঘটতে থাকে জীবন চলার পথে। তাই আমরা বুঝতে পারি না, কোন কার্যের কারণ কোনটি।

আজকের কার্য ভবিষ্যতে কোন কার্যের কারণ হয়ে উঠবে, তা আমরা জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে, আমরা এখন যেমন আছি, তা অতীত কর্মের ফল। ভবিষ্যতে যা হবো, তা বর্তমান কর্মের ফল।

(চলবে…)

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!