ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ ২

-ড. এমদাদুল হক

৩৬
সবার আমি ছাত্র এটি যেমন ঠিক, তেমনি সবার আমি শিক্ষক এটিও ঠিক। ভালো হোক, মন্দ হোক, সঠিক হোক, বেঠিক হোক আমরা অবিরাম শিখছি এবং শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই বা না চাই- আমাদের প্রত্যেকটি কাজ, কথা, আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি থেকে কেউ না কেউ, কিছু না কিছু শিখছে।

প্রত্যেক মানুষ একটি প্রমাণ, প্রত্যেক ব্যক্তি একটি দৃষ্টান্ত। জীবন মানেই শেখা এবং শেখানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা। গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা যা শিখতে চাই, তা শিখছি কিনা এবং যা শেখাতে চাই তা-ই শেখাচ্ছি কিনা।

জীবনের প্রতিটি ক্ষণ জগৎকে শিক্ষাদান করার সুযোগ। প্রতিটি ক্ষণে প্রত্যেক ব্যক্তি প্রমাণ রেখে যায়- সে কে, কী তার পরিচয়।

আমরা যেখানে স্পর্শ করি সেখানেই লেগে থাকে হাতের ছাপ-বহন করে প্রমাণ। আমাদের প্রতিটি কথা থেকে যায় ইথারে। আমাদের প্রতিটি আচরণ অস্তিত্বের সাক্ষী। প্রতিটি আচরণ বহন করে আমার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, আমার জীবনবেদ।

জীবনের কোনো ঘটনাকে শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা অসম্ভব। আমরা কথা দিয়ে যা শিখাই, তা একেবারেই তাৎপর্যহীন। শিক্ষার ক্ষেত্রে কথার তাৎপর্য তখনই আছে যখন কথা কাজ ও চিন্তার মধ্যে শতভাগ মিল থাকে। কথা সত্য প্রকাশের একটি মাত্রা মাত্র। মূল মাত্রাটি হলো আচরণ।

যে যা নয়, সে যদি অবিরাম তা বলতে থাকে, তবে সে শেখায় আত্মপ্রবঞ্চনা এবং শিখেও আত্মপ্রবঞ্চনা। একজন আত্মপ্রবঞ্চক আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারে না- শেখাতেও পারে না।

আমরা যেখানেই যাই না কেন, যা-ই করি না কেন স্মরণে রাখা চাই যে আমরা কিছু শিখাচ্ছি, আমার কাছ থেকে কেউ না কেউ, কিছু না কিছু শিখছে। প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা শেখাই এবং শিখি। যতক্ষণ শিক্ষা পূর্ণ না হয় ততক্ষণ শিখতেই থাকি।

একটি বিষয়ে শিক্ষা কখন পূর্ণ হয়? যখন জীবনযাপনের মধ্যে শিক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে এবং ব্যক্তি স্বয়ং বচনের প্রমাণ হয়ে উঠে।

৩৭
জগতে নিরক্ষর মানুষ বহু আছে। কিন্তু অশিক্ষিত মানুষ নাই। যে যা করতে পারে সে সেই ব্যাপারে শিক্ষিত। প্রত্যেকেই কিছু একটা করতে পারে। সুতরাং প্রত্যেকেই শিক্ষিত।

কৃষক চাষাবাদ করতে পারে, রিক্সাওয়ালা রিক্সা চালাতে পারে, নাপিত চুল কাটতে পারে। সুতরাং তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে শিক্ষিত। শুধু নিরক্ষর হওয়ার কারণে কাউকে অশিক্ষিত বলা যায় না।

বাবুই পাখিও শিক্ষিত। কারণ নিজের বাসা তৈরিতে সে দক্ষ কারিগর। কোকিল বাসা তৈরি করতে জানে না কিন্তু বাবুই পাখি থেকে অনেক বেশি শিক্ষিত। কারণ সে অন্যের বাসায় নিজ সন্তান লালন-পালনের কৌশল জানে।

অতিশিক্ষিত বলেই কোকিল সংসারের ঝামেলায় না জড়িয়ে, মগডালে বসে গান গায়, আর এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে বেড়ায়। উত্তরাধুনিক শিক্ষিত মানুষও এখন কোকিলের অনুসারী হয়ে উঠছে।

মোদ্দাকথা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ-শিক্ষা নয়। শিক্ষা মানেই হলো স্বশিক্ষা। কেবল স্বশিক্ষাই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর জগতে নিয়ে যেতে পারে- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়।

স্বশিক্ষায় সার্টিফিকেট অর্জনের তাগিদ নেই- আছে অন্তরের তাগিদ। স্বশিক্ষায় বাধ্যবাধকতা নেই- আছে আনন্দ। বাংলায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে হলে পাঠ্যসূচি অনুসরণ করে পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। এখানে বাধ্যবাধকতা আছে-আনন্দ নাই।

কবিতা লিখতে পাঠ্যসূচি অনুসরণ করতে হয় না, পরীক্ষাও পাশ করতে হয় না। এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই যেখান থেকে ‘কবি’ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কবিতা লেখায় বাধ্যবাধকতা নাই-আনন্দ আছে।

এক কথায়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একটি অত্যাচারমূলক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগী হওয়ার শিক্ষা দেয়। প্রতিযোগিতার চোটে মন বিষিয়ে উঠে, মানবিকতা হারিয়ে যায়, আত্মা লুকিয়ে থাকে।

তাই শিক্ষা শেষে বৈরিতা রক্তের সঙ্গে মিশে যায়; শিক্ষিতরা হয়ে উঠে সহানুভূতিহীন স্বার্থপর- কোকিল অনুসারী। যে শিক্ষায় মান বাড়ে, কিন্তু হুঁশ হারিয়ে যায়, সে শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নাই।

মান হলো, গর্ব। হুঁশ হলো চৈতন্য। হুঁশহীন ডাক্তার কসাই বরাবর। আমরা কসাই ডাক্তার চাই না, মানহুঁশ ডাক্তার চাই। আমরা সেই ডাক্তার চাই- যে সহযোগিতা করে আনন্দ পাবে- সততা, করুণা ও মমতায় ভরা থাকবে যার হৃদয়।

৩৮
শোনা কথা: এক রাজা ঘোষণা করলেন- যদি কেউ গীতা পাঠ করে আমার মধ্যে ভক্তি জাগ্রত করতে পারে, তবে তাকে রাজত্ব দিয়ে দিবো- শর্ত হলো, না পারলে কিছুকাল কারাগারে কাটাতে হবে।

রাজ্যের নামকরা পুরোহিতরা রাজদরবারে এলো, গীতা পাঠ করলো; রাজার মনে ভক্তি জাগ্রত হলো না। সবশেষে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত রাজ্যের সেরা গীতাপাঠক তার স্ত্রীর কাছে রাজদরবারে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। স্ত্রী বললো, ‘তুমি বৃদ্ধ হয়ে গেছো, কণ্ঠে আগের মাধুর্য নেই, পারবে না, যেয়ো না’।

তবু বৃদ্ধ গেলেন, গীতা শোনালেন। রাজা বিরক্ত হয়ে তাকেও কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। সবাই ব্যর্থ। কিন্তু যেখানে চ্যালেঞ্জ আছে, সেখানে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তো থাকবেই। সংবাদ পৌঁছলো এক মুক্তপুঁরুষের কাছে।

রাজ্যের প্রতি তার কোনো লোভ নেই, এতোগুলো নিরপরাধ মানুষ কারাগারে বন্দী, এটি শুনে তার দুঃখ হলো। তিনি উপস্থিত হলেন রাজদরবারে। তার উপস্থিতিতেই রাজার ভেতরটা কেমন যেন আনচান করে উঠলো। তিনি পাঠ করলেন- “সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরনংব্রজ। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচং।”

রাজা ভক্তিতে লুটিয়ে পড়লেন তার পদকমলে। বললেন- ‘আমার রাজ্য আপনাকে দিলাম প্রভু’। যুবক বললেন, ‘তোমার রাজ্য তুমি চালাও, তাতে আমার প্রয়োজন নাই। পুরোহিতদের মুক্ত করে দাও’।

পুরাহিতরা মুক্ত হলো। একজন বললো, ‘আমরা যা পারলাম না, বটতলার এই ছোকরাটা তা পারলো কেমন করে’?

তিনি শুনলেন। দুই পুরোহিতকে বাঁধলেন দুটি গাছে, বললেন, ‘এবার তোমরা একজন আরেকজনকে মুক্ত করো তো’। সকলেই হতবাক!

একজন বদ্ধ আরেকজন বদ্ধকে মুক্ত করতে পারে না। বদ্ধরাও গীতা মুখস্থ করতে পারে, কিন্তু গীতার প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে না। ভক্তি জাগ্রত হয়- প্রমাণে- সুরেলা কণ্ঠের আবৃত্তিতে নয়।

৩৯
গুরু কে? যারা ‘এক’ হওয়ার চেষ্টায় রত আছেন, তাদের সবাই গুরু। এক হওয়া মানে- মনে মুখে কাজে এক হওয়া, আমি তুমি এবং সে এক হওয়া। যে এক হতে চায় সে নিজেকে জগৎ থেকে পৃথক ভাবে না; জাতিভেদ, গোত্রভেদ মানে না।

ধনী, গরিব, হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি, আস্তিক-নাস্তিক সব তার কাছে এক। সে নতুন কোনো গোত্র গড়ে তুলে না, পুরাতন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয় না। নিজের স্বাধীনতা হারায় না, অন্যের স্বাধীনতাও হরণ করে না।

যে একত্ব চায়, তার ভিশন স্পষ্ট। ভিশন স্পষ্ট হওয়া মানেই হলো, অন্ধকারে একটি আলো জ্বলে উঠেছে। আলো যার কাছে আছে সে-ই পথপ্রদর্শক হতে পারে। এবার সে যে ধর্মেরই হোক।

শিষ্য কে? যিনি নিজের গুরু, তিনিই শিষ্য। গুরু এবং শিষ্য জ্ঞানের আঙিনায় একত্রিত হয় যথা স্থানে, যথা কালে। গুরু-শিষ্য একত্রিত হলেই শুরু হয় প্রকৃত শিক্ষণ প্রক্রিয়া।

গুরু কি শিক্ষা দেন, আর শিষ্য কি শিখে? বিশেষ কিছুই না। তারা গড়ে তুলেন সম্পর্ক। যে সম্পর্কে মিথ্যাচার নেই, প্রবঞ্চনা নেই, চালাকি নেই। যে সম্পর্ক শুদ্ধ, পবিত্র। সত্যের আবির্ভাব ঘটে সম্পর্কের মধ্যে। শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে সম্পর্কের মধ্যেই।

সম্পর্ক স্থাপনের শিল্পকলায় ধীরে ধীরে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, সাধ, প্রয়োজন, আগ্রহ, কৌতুহল এক হতে থাকে। এক যোগ এক যখন এক হয়ে যায় তখন সম্পর্কের ভেতর থেকে উদ্ভাসিত হয় একত্ব। এবং যিনি শিষ্য তিনিই গুরু হয়ে উঠেন।

৪০
এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে থেকে গুরু শিক্ষা গ্রহণ করেন না। এমন কেউ নেই যাকে তিনি শিক্ষা দেন না। এর অর্থ এটি নয় যে, তিনি সব মানুষের কাছে যান কিংবা সব মানুষ তার কাছে আসে। এর অর্থ হলো- তিনি যেখানেই যান, শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই থাকেন।

মানুষ আসে, মানুষ যায়। যে পরীক্ষা করতে আসে, সে পরীক্ষা করে চলে যায়। যে দেখতে আসে, দেখা হয়ে গেলে চলে যায়। যে শুনতে আসে, শোনা হয়ে গেলে চলে যায়। যে সম্পর্ক করতে আসে সে থেকে যায়।

পরীক্ষা করার কিছু নাই, দেখার কিছু নাই, শোনারও কিছু নাই- যাকিছু আছে তার সবই ‘পবিত্র’ সম্পর্কের মধ্যে। সম্পর্ক, তা যদি ১মিনিটের জন্যও হয়, ১মিনিটের জন্যও যদি উপলব্ধি হয় যে, তুমি-আমি এক- তবে ভেতরে প্রবেশ করে প্রেমের স্ফূলিঙ্গ।

লালন-পালন করলে এই স্ফূলিঙ্গ থেকেই জ্বলে উঠে অগ্নিশিখা। অন্যথায়, শুধু আসা আর যাওয়া। যাওয়া আর আসা।

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!