ভবঘুরেকথা
সাত্তার ফকির

-মূর্শেদূল মেরাজ

কি একটা নিয়ে দুই নারীতে ততক্ষণে চুলোচুলি শুরু হয়ে গেছে। সাথে গালাগালি বোনাস। নারীদ্বয়ের চুলোচুলি দেখেও বাজান হাসছে। মানুষও ভিড় করে সেই তামাশা দেখছে। কেউ ছাড়াতে যাওয়ার উৎসাহ দেখাচ্ছে না। বরঞ্চ নিজ নিজ আসনে বসেই উচ্চস্বরে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছে। নবীন ছোকরা পুলিশ দুটিও এক পাশে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে।

মধ্য দুপুরে আমি চলে এসেছি বাজানের কাছে। গত রাতে শব্দের জন্য কথা বেশি এগোয় নি। লোকজন বেড়ে যাওয়ায় হাঁসফাঁস লাগছিল। আমিও হাঁটতে বের হয়েছিলাম। তাই আজ দুপুর দুপুর এসেছি। এসে দেখি মা সেবা নিয়ে একটু গা গড়িয়ে দিয়েছেন।

এই ফাঁকে বাজানকে নিয়ে অনেকটা হেঁটে মঞ্চের পেছনে এসে চায়ের দোকানে বসেছি। এ দিকটায় গাছের ছায়ায় রোদটা কম অনুভব হচ্ছে। দুপুরের কড়া রোদে সবকিছু মচমচে হয়ে উঠেছে। মানুষজন এখন অনেকটাই কম। মেলার দিকটায় লোকজন থাকলেও এদিকটায় যারা আছে তাদের বেশিভাগই ঘুমিয়ে কাদা।

এরই মধ্যে মারামারি-চুলোচুলি চলছে। তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে পাশাপাশি দোকান বসানো নিয়ে এই বাকবিতণ্ডা। হাসি হাসি মুখে বাজান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো, বুঝইল্যে বাজান নারী হইলো চার প্রকার- পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী আর হস্তিনী। এর প্রথম দুইটা হইলো ভালোর দিকে আর পরের দুইটা হইলো মন্দের দিকে।

-বাজান একটু বুঝিয়ে বলবেন?

-পদ্মিনী আর চিত্রিণী নারী সঙ্গীনি হিসেবে হইলো উত্তম। তাদের চলন, বলন, গড়ন, আহার, বিহার, ভাষা, ঘ্রাণ সবই মধুর। সত্যভাষী হয়, ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকে, গুণী হয়, গুণের কদর করে, বিশ্বাসী হয়। তবে সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের নারী হইলো বাজান পদ্মিনী নারী।

আর শঙ্খিনী হস্তিনী নারীদের আকর্ষণ ক্ষমতা বেশি। অন্যেরে যেমন তারা নিজের দিকে আকর্ষণ করে। তেমনি নিজেও অন্যর প্রতি আকর্ষিত হয়। শঙ্খিনী নারীর প্রকৃতি চঞ্চল, কু-বুদ্ধিমতী, ভোজনবিলাসী, ক্ষুদার্থ, ভক্তিভাবহীন। কপট হৃদয়ের অধিকারী শঙ্খিনী নারী ধর্মে মতিহীন, নিরন্তর শৃঙ্গারে উন্মত্ত হয়ে পরপুরুষের প্রতি আসক্ত থাকে। এরা হইলো বাজান মধ্যম প্রকৃতির।

তবে হস্তিনী নারী হইলো চার প্রকার নারীর মধ্যে সর্ব নিম্ন। কণ্ঠস্বর কর্কশ ও তীব্র, স্বার্থপর, স্বার্থান্বেষী, মিথ্যা কথায় পটু। নির্লজ্জ স্বভাবের হস্তিনী নারীরা প্রচুর খাইতে আর ঘুমাইতে ভালবাসে। এরা পরকীয়ায় আসক্ত, বিপথগামিনী, ব্যভিচারিণী হয়। ধর্মকর্ম বা গুরুজনে তাদের ভক্তি থাকে না। পাপ প্রবণতা বেশি। সকল সময় কামনায় ডুইবে থাকে।

-আর পুরুষ? তাদের মধ্যে কি ভাগ বাজান??

অশ্ব পুরুষরা হয় অধার্মিক, মিথ্যাবাদী, রাগী, বাচাল ও দূরাচারী ও মদন-কাতর। পরনিন্দা, পরিচর্চা করতে ভালোবাসে। দ্রুত চলাচল কইরতে পারে। অল্প আহারে মন ভরে না। মেজাজ ও কণ্ঠস্বর মেঘের গর্জন। নিজ স্বার্থসিদ্ধি ও কাম-তৃষ্ণা চরিতার্থ করবার জন্যে সর্বদা লিপ্ত থাকে।

-পুরুষও ঐ চার প্রকার। প্রথম দুই প্রকার ভালোর দিকে আর পরের দুই প্রকার মন্দের দিকে। এরা হইলো- শশক, মৃগ, বৃষ ও অশ্ব পুরুষ।

শশক পুরুষরা হইলো শান্তশিষ্ট, আত্মসম্মান সম্পন্ন ও পরোপকারী। এরা দেখতে সুশ্রী, গম্ভীর বচন, সদা প্রফুল্ল ও হাস্য-পূর্ণ। পরের উপকারেই এদের আনন্দ। মন কাম-গন্ধহীন ও পাপমুক্ত। এরা একনিষ্ঠ ও উচ্চ মানসিকতার প্রেম বেশি পছন্দ করে। একাধিক নারীতে আকৃষ্ট হয় না। গুরু ও জ্ঞানীজনে ভক্তি, ধ্যান ও উপাসনা ভালোবাসে।

মৃগ পুরুষরা সেবাকে পরম ধর্ম মানে। পুরাপুরি পাপমুক্ত না হইলেও এদের মন নির্মল-বিশুদ্ধ। এরা বহুভোজী ও ভোজনবিলাসী হয়। গান খুব ভালোবাসে। গুরুভক্তি ও স্রষ্টার প্রতি প্রেম তাদের মধ্যেও দেখা যায়। ধর্ম পরায়ণ হলেও মনে ছল থাকে। এদের প্রেম পুরাপুরি শুদ্ধ না; প্রেমে কিছুটা কামগন্ধ থাকে! নারীসঙ্গ পছন্দ করে।

আর বৃষ পুরুষরা খুবই খাইতে ভালোবাসে। অন্যায় কথা বা কাজ করতে দ্বিধা করে না। কর্কশ কণ্ঠস্বর, গতি হয় চঞ্চল। মন সর্বদা পাপে ডুবে থাকে। নির্লজ্জ ও অধার্মিক হয়ে থাকে। কামের জন্য এরা সব কিছুই করতে পারে।

অশ্ব পুরুষরা হয় অধার্মিক, মিথ্যাবাদী, রাগী, বাচাল ও দূরাচারী ও মদন-কাতর। পরনিন্দা, পরিচর্চা করতে ভালোবাসে। দ্রুত চলাচল কইরতে পারে। অল্প আহারে মন ভরে না। মেজাজ ও কণ্ঠস্বর মেঘের গর্জন। নিজ স্বার্থসিদ্ধি ও কাম-তৃষ্ণা চরিতার্থ করবার জন্যে সর্বদা লিপ্ত থাকে।

সাঁইজির একটি গানে আছে না-

সবে কি হবে ভবে ধর্মপরায়ণ।
যার যা ধর্ম সেই সে করে
তোমার বলা অকারণ।।

কাঁটার মুখ কেউ ছাঁচে না
ময়ূর চিত্র কেউ করে না,
এমনি মতে সব ঘটনা
যার যাতে আছে সৃজন।।

চিন্তামণি পদ্মিনী নারী
তারাই পতিসেবার অধিকারী,
হস্তিনী শঙ্খিনী নারী
তারা কর্কশ ভাষায় কয় বচন।।

শশক পুরুষ সত্যবাদী
মৃগপুরুষ উর্ধ্ধভেদী,
অশ্ব বৃষ বেহুশ নিরবধি
তাদের কুকর্মেতে সদাই মন।।

ধর্ম কর্ম আপনার মন
করে ধর্ম সব মোমিনগণ,
লালন বলে কর ধর্ম
প্রাপ্তি হবে নিরঞ্জন।।

-এই ভাগ কি সাঁইজি করছেন, বাজান?

-আরে না। সাঁইজি কোনো ভাগাভাগির মধ্যে নাই। এইটা করছে ঋষি… ঋষি… দাঁড়াও বাজান নামটা মনে কইরা বইলতেছি।

এক চুমুকে বাকি চা’টুকু শেষ করে বাজান বলে উঠলো- মনে পরছে মনে পরছে- বাৎসায়ন ঋষি। নারী-পুরুষের কামতত্ত্ব নিয়ে এতো বিস্তারিত আর এতো গভীরে কেউ গবেষণা করে নাই বাজান।

বাজানের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এই মানুষগুলো কি পরিমাণ জ্ঞান নিয়ে কত সাধারণ জীবন যাপন করে। সত্যিই অবিশ্বাস্য। জ্ঞান আসলেই অন্য বিষয়। এটা বই পড়ে অর্জন করা যায় না, এটুকু আমি গত তিন দিনে বিশ্বাস করে নিয়েছি। এতে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।

বই পড়ে যদি জ্ঞানী হওয়া যেত। মানুষ হওয়া যেত। তাহলে শহরে এতো অবিবেচনার কাজকর্ম হতো না। দেশে এই লাগামহীন দুর্নীতি হতো না। শিক্ষিত মানুষগুলো দেশটাকে খোকলা করে ফেলতো না।

আমি বা আমার মতো মানুষগুলো প্রতিযোগীতার নামে… লোক দেখানোর নামে যে জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলছি তার জাতাকলে কত জীবন যে, আর যাপন করতে পারছে না, তার হিসেব কে দেবে?

সভ্যতার নামে কি সব রচনা করে চলেছি প্রতিদিনের জীবনে তা কি আদৌ আমাদের ভাবায়? আমরা কি ভাবি?? নাকি নিজেকে প্রমাণ করতে যেয়ে আমরা মানুষরূপে জন্ম নিয়েও থেকে গেছি জন্তু-জানোয়ারের বেশেই?

কেবল কোটা পূরণ করতে পারে না বলে কত সম্ভবনাময় তরুণকে যে প্রতিদিন কর্ম হারাতে হয়, শুধু তাই তো নয়। হারাতে হয় সর্বস্ব। আমি নিজেই তো কাজের এমন বোঝা আমার কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেই, যাতে করে তারা কেবল দৌড়ে বেড়ায়।

আর সে সেই কাজ উদ্ধার করতে আমরা সকলে যেসব ব্যবস্থা নিয়ে থাকি সময়ে সময়ে, তা কি আমরা সভ্য সমাজে স্বীকার করি? বা করার সাহস রাখি??

আবার সেই পথে উপার্জিত অর্থ দিয়েই আমরা এমন একটা পরিবার… এমন সন্তান গড়ে তুলতে চাই… যা হবে সোনার সংসার… সন্তান হবে সোনার সন্তান… আবার চাই সেই সোনার সন্তানও যেন সকল প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়।

আর সেই প্রথম হওয়ার বা সর্বোচ্চতা প্রমাণ করতে আমাদের সন্তানরা যে কি সব পথ অবলম্বন করে, তা তারাই ভালো জানে। নাহ্ আর ভাবতে পারছি না। নিজের মুখোমুখি হলেই আজকাল এসব কথা মাথার মধ্যে লেখা করে।

সভ্যতার নামে কি সব রচনা করে চলেছি প্রতিদিনের জীবনে তা কি আদৌ আমাদের ভাবায়? আমরা কি ভাবি?? নাকি নিজেকে প্রমাণ করতে যেয়ে আমরা মানুষরূপে জন্ম নিয়েও থেকে গেছি জন্তু-জানোয়ারের বেশেই?

সাধুগুরুরা তিন দিনের অনুষ্ঠান শেষ করেই যান। অনেকে থেকে যান আরো কিছু দিন। ভক্তদের অনেকে নিজ নিজ গুরুবাড়ির পথ ধরেন। সেখানে দিন কয়েক কাটিয়ে তবে বাড়ি ফেরা। আমি অবশ্য মনে মনে একটা মতলব ভাজছি। বাজানের সাথে ঝুলে পরার তালে আছি… আর কি।

ঝনঝন করে হাতের বালা বাজিয়ে রাসু পাগলা দৃশ্যমান হলো চোখের সামনে। এসেই বললো- কি রে চা খাওয়াবি? একটা বিস্কুট? একটা সিগারেট? একটা পান? দুইটা কলা? দুইটা…

আমি বাস্তবে ফিরে এসে কি জানি কি ভেবে রাসুকে জড়িয়ে ধরলাম। জেনো কত জনমের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। রাসু পাগলা আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার পা ছুঁয়ে ভক্তি দিতে গেলো। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাকে বিরত রাখতে পারলাম না। এমন বিশালদেহী মানুষকে কি আর আয়াত্তে আনা আমার কর্ম!

বাজান হাসতে হাসতে বললো- দাও দাও ভক্তিটা দিতে দাও। ভক্তিতেই তো মুক্তি।

আজ শেষ দিন দোলের মেলার। যা বুঝলাম, সাঁইজিকে ঘিরে এখানে অনুষ্ঠান হয় দুই ভাবে। সাঁইজির ধামে হয় প্রথম চব্বিশ ঘণ্টার সাধুসঙ্গ। অধিবাস দিয়ে শুরু হয়ে পরদিন দুপুরে পূর্ণসেবা দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টার সাধুসঙ্গ শেষ হয়। সাধুগুরুরা বিশেষ করে যারা অডিটোরিয়ামের নিচে বা ধামের মধ্যে অবস্থান নেয় তারা এটি পালন করে।

মঞ্চের অনুষ্ঠান আর মেলা চলে তিন দিন। তাই বলা, আজ মেলার তৃতীয় বা শেষ দিন। দূরদূরান্ত থেকে যারা এসেছে তাদের অনেকেই সকাল থেকে যাওয়া শুরু করেছে বাক্স-প্যাটরা নিয়ে। অনেকে আগামীকাল যাবে।

সাধুগুরুরা তিন দিনের অনুষ্ঠান শেষ করেই যান। অনেকে থেকে যান আরো কিছু দিন। ভক্তদের অনেকে নিজ নিজ গুরুবাড়ির পথ ধরেন। সেখানে দিন কয়েক কাটিয়ে তবে বাড়ি ফেরা। আমি অবশ্য মনে মনে একটা মতলব ভাজছি। বাজানের সাথে ঝুলে পরার তালে আছি… আর কি।

অবশ্য রাসু পাগলা ধরেছে সে নাকি এক সাধুর বাড়ি নিয়ে যাবে। সেই সাধু বছর দুয়েক আগে দেহ ছেড়ে দিয়েছেন। দেহ ছেড়ে দেয়া শব্দটা শুনে কেমন চমকে উঠেছিলাম। শব্দের ভেতর দিয়েই বলে দিচ্ছে দেহ আর আত্মা দুটি পৃথক বিষয়। আর দেহ থেকে আত্মা ছেড়ে গেলে দেহের নাম হয় লাশ। আর আত্মা যে কোথায় যায় কে জানে। এসব তথ্য অবশ্য রাসু পাগলাই দিয়েছে।

খেয়াল করলাম বাজানের চোখে জল জল ভাব। কোথায় জানি ডুবে গেলেন তিনি। আমি মনে মনে অনুতপ্ত হতে থাকলাম। ইস্ বাজানের কোনো কষ্টের ফোল্ডার কি খুলে ফেল্লাম না বুঝেই! মাথা নিচু করেই বাজান গুণগুণ করে গুইতে শুরু করলো-

সে কড়া গলায় এও বলেছে- শোন! কখনো বলবি না সাধুগুরুরা মারা গেছে। আরে মারা তো যাই আমরা। কারণ মরার পর আমরা কই যাই তার ঠিকানা আমরা জানি না। কিন্তু সাধুগুরুরা জানে তারা কোথায় যাবে। কি তাগো কাম। তাই তারা দেহত্যাগ করে। তাগো ওফাত হয়। তিরোধান হয়। মৃত্যু হয় না।

তর কি মনে হয়? এই যে এতো মানুষ মিলছে ছেঁউড়িয়ায়… তারা কি লালন একাডেমীর অনুষ্ঠানের লেইগ্গ্যা আসছে? নারে পাগল… তারা আসছে সাঁইজির কাছে। সাঁইজির ভরসায়… সাঁইজির চরণে আশ্রয়ের আশায়। ঠিক কিনা তুই বল??

কিছুই বলতে পারি না। আমি আরেক দফা চায়ের অর্ডার দেই। রাসু চায়ের কাপে বিশাল সাইজের টোস্ট বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছে। বাজান হাসি হাসি মুখ করে সেই দৃশ্য দেখছে। সেই নারীদের চুলোচুলি চুকেছে। তারা পাশাপাশি বসে গজ গজ করতে করতে পিঠার দোকান সাজাচ্ছে।

-আচ্ছা বাজান… জ্ঞানের কথা বলার সময় আপনার কথায় আঞ্চলিকতার টান কম থাকে কেন? এটা কি ইচ্ছা করে বলেন?

-হা হা হা… বাজান হাসাইলে। জ্ঞানের কথা কি আর আমি জানি বাজান। সে তো জানে লালন সাঁইজি… সে তো জানে আমার গুরুজী। আর গুরুজ্ঞানের কথা বলতে গেইলে গুরু ভাষা চইলে আসে জবানে। হা হা হা…

-বাজান আপনার গুরুর কথা বলেন না?

-গুরুর কথা অন্য সময় বলতে হইবো। অনেক অনেক কথা। তুমি বাসায় চইল্যো আইসো, সেখানে বলবো গুরুর কথা।

খেয়াল করলাম বাজানের চোখে জল জল ভাব। কোথায় জানি ডুবে গেলেন তিনি। আমি মনে মনে অনুতপ্ত হতে থাকলাম। ইস্ বাজানের কোনো কষ্টের ফোল্ডার কি খুলে ফেল্লাম না বুঝেই! মাথা নিচু করেই বাজান গুণগুণ করে গুইতে শুরু করলো-

গুরুপদে ডুবে থাকরে আমার মন।
গুরুপদে না ডুবিলে জনম যাবে অকারণ।।

গুরু-শিষ্য এমনি ধারা
চাঁদের কোলে থাকে তারা,
আয়নাতে লাগায়ে পারা
দেখে তারা ত্রিভুবন।।

শিষ্য যদি হয় কায়েমী
কর্ণে দেয় তার মন্ত্রদানী,
নিজ নামে হয় চক্ষুদানী
নইলে অন্ধ দুই নয়নে।।

ঐ দেখা যায় আন্‌কা নহর
অচিন মানুষ অচিন শহর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন রে তোর
জনম গেল অকারণ।।

-বাজান আপনার মনটা কি খারাপ করে দিলাম?

-না না বাজান। মন খারাপ না বাজান। লোকে বলে না, সন্তান না হইলে যেমন সন্তানের মর্ম বোঝা যায় না। তেমনই গুরু কাছে মাথা না দিলে গুরু কি জিনিস তা বুঝবা না বাজান। বুঝবা না। গুরু হইলো বটবৃক্ষ… বটবৃক্ষ… তার কথা মনে পরলে জন্ম-জন্মান্তরের কথা স্মরণ হইয়া যায় বাজান…

চা-বিস্কুট খেয়ে রাসু রাজ ঘাটের পাশে গাছের গোড়ায় বাধানো অংশে টানটান হয়ে শুয়ে পরলো। নাক ডাকার আগে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো- ‘রাতে শ্মশানে চইল্ল্যা আসিস।’

আমরাও উঠে পরলাম। বাজানকে ধামে পৌঁছে দিয়ে আমি হাঁটাহাঁটি করতে বের হলাম। সকলের ঘুম দেখে আমারো একটু ঘুমিয়ে নেয়ার ইচ্ছাটা চাগার দিলো। চাইলে বাজানের পাশে জায়গা করে আমিও শুয়ে পরতে পারতাম। আবার হোটেলে গিয়েও ঘুমানো যায়।

কিন্তু কি করব কিছুই ভেবে না পেয়ে, ধামের বাইরে পাতা বেঞ্চিতে বসে পরলাম। সূর্য হেলে যাওয়ায় রোদটা এদিকে আর পরছে না। কিন্তু তেজ কমেনি এক ফোটা। হিসেবে ঋতুর এই সময়টায় এতোটা গরম পরবার কথা না। তাও বেশ গরম।

গরমে হাঁসফাঁস করছি চা খাওয়ার রিক্সটাও নিতে পারছি না। মানুষজন ধীরে ধীরে জমছে। তবে কারোরই তাড়াহুড়ো নাই। সকলে হেলেদুলে চলছে। ছোট ছোট জটলায় আড্ডা জমাচ্ছে। আমার ভঙ্গিতে ক্লান্তি ভাব ফুটে উঠায় কিনা জানি না বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানের ফেরিওয়ালা কলাপাতায় করে মিষ্টি ঘ্রাণের আইসক্রিমের মতো একটা জিনিস হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, খান… গরমে আরাম পাবেন। কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি।

কুষ্টিয়ার কুলিফির কথা আগেও শুনেছি। এই প্রথম তার দরশন হলো। তবে এভাবে যারা আগে প্যাকেট খুলে কিছু খেতে দেয়। বেশিভাগ সময় দেখা যায় খাওয়ার পর কয়েক গুণ দাম আদায় করে নেয়। বাণিজ্য মেলায় একবার এক প্লেট ফুচকা খেয়ে তিনশো টাকা দিতে হয়েছিল। আর চিড়িয়াখানায় একটা বোতল কোক খেয়ে দিতে হয়েছিল আড়াই শো টাকা।

উত্তরে তিনি হেসে বললেন- ক্ষতি হইবো কেন? এটাতো সেবা। কুলফি বেঁচা তো বড় কথা না। মানুষ ভালো জিনিস খেয়ে আরাম পায়, তা দেখেও তো সুখ। খানা-খাদ্য খাওয়ানো তো সেবার কাজ। পারলে তো সবই ফ্রি খাওয়াইতাম। …ভালো থাকবেন ভাইজান। এখন বিদায়।

সেই অভিজ্ঞতায় কুলফিওয়াকে জিজ্ঞাস করলাম- এর দাম কত?

কুলফিওয়ালা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো- এর দাম লাগবো না। খায়া ভালো লাগলে এর পরে কিনা খাবেন। বড়টা বিশ টাকা, ছোটটা দশ টাকা।

বিষয়টা বেশ লাগলো। যদিও এটা ব্যবসার একটা কৌশল হতেই পারে, কিন্তু কুলফিওয়ালার চোখে যে আন্তরিকতা ঝলকে উঠলো তা অস্বীকার করি কি করে। খেয়ে বুঝলাম এ জিনিস সত্যিই অপূর্ব। অপার্থিবও বলা যায়। কয়েক দফায় খেতে গিয়ে ভদ্রলোকের সাথে কিঞ্চিৎ আলাপ জমে গেলো।

কি করে, কোথা থেকে দুধ আনে, সেই দুধ কত সময় চুলায় জ্বাল করে কি কি প্রকৃয়ায় এই কুলফি বানান তার পুরো ফিরিস্তি দিলেন। কথায় বুঝলাম তিনিও সাধক মানুষ। তার গায়ের লুঙ্গি, শার্ট সবই কালো রঙের। এমনকি মাথায় একটা কালো পট্টি বেঁধেছেন। দুই হাত জুড়ে অসংখ্য বালা। বেশ ভাব আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা তার নিয়মিত পোশাক। অনুষ্ঠানের জন্য সেজে আসেনি। তবে তার চোখ দুইটা অদ্ভুত আকর্ষণীয়। তা ভোলা যায় না।

কিছুতেই যখন প্রথমবারের কুলফির টাকা তিনি নিলেন না তখন জানতে চাইলাম এতে তার ব্যবসার ক্ষতি হবে না?

উত্তরে তিনি হেসে বললেন- ক্ষতি হইবো কেন? এটাতো সেবা। কুলফি বেঁচা তো বড় কথা না। মানুষ ভালো জিনিস খেয়ে আরাম পায়, তা দেখেও তো সুখ। খানা-খাদ্য খাওয়ানো তো সেবার কাজ। পারলে তো সবই ফ্রি খাওয়াইতাম। …ভালো থাকবেন ভাইজান। এখন বিদায়।

প্রতিদিনই তাকে ধামের আশেপাশে কুলফি বিক্রি করতে পাওয়া যাবে, এই বলে তিনি ভ্যান টেনে এগিয়ে গেলেন। আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম। জীবনে যা কিছু করেছি সবই তো প্রাপ্তির জন্যই। বিনিময়ে কিছুর প্রত্যাশা না করে সেবা মনোভাবে আসলেই কি জীবনে কিছু করেছি???

প্রাপ্তির হিসাব তো কড়ায়গণ্ডায় জীবন থেকে ঠিকই বুঝে নিয়েছি। ছাড় দেইনি কাউকে। কিন্তু সেবা তো করা হলো না। এই সেবা কি আমাকে দিয়ে হবে??? যখন বেঞ্চিতে এসব ভাবছিলাম তখন দূরে কোথাও কেউ গাইছিল-

আমি কী করিতে কী করিলাম।
দুগ্ধেতে মিশালেম চোনা
দেখে শুনে জ্ঞান হলো না।।

মদন রাজার ডঙ্কা ভারি
হলাম তার আজ্ঞাকারি,
যাঁর মাটিতে বসত করি
চির দিন তারে চিনলাম না।।

রাগের আশ্রয় নিলেরে মন
কী করিতে পারে মদন,
আমার হলো কামলোভী মন
মদন রাজার গাঁঠরি টানা।।

উপর হাকিম একদিনে
কৃপা করলে নিজগুণে,
দ্বীনের অধীন লালন বলে
যেত মনের দোটানা।।

(চলবে…)

<<লালন বলে কুল পাবি না: দুই ।। লালন বলে কুল পাবি না: চার>>

…………………………………………..
স্থিরচিত্র: ফাহিম ফেরদৌস

.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই

লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!