ভবঘুরেকথা
ফকির সামসুল সাঁইজি

লালন সাধনায় গুরু : তিন

-ফকির সামসুল সাঁইজি

লেখালিখির কাজটা মনিরুদ্দিন শাহ্ আর মানিক পণ্ডিত করতেন। তখন সাঁইজি বলতেন, কইগো তোমরা? প্রস্তুতি নাও পোনা মাছের ঝাঁক আসছে। পোনা মাছের ঝাঁকে কত পোনা থাকে। অর্থাৎ এখন সাঁইজির ভাব হৃদয়ের মধ্যে এসে গেছে।

এখন যা বলবেন শুধু লিখতে হবে। তারাই লিখার কাজটা করতেন। তখন একএক চালানে যে কয়টা পদ আসতো, সে কটা পদ লিখতেন। এটাই পোনা মাছের ঝাঁক। তো ভাব যে কখন আসবে!

ভাব হচ্ছে বিশাল ব্যাপার বাবা। ভাব ছাড়া ভক্তিতে কি হয়? যার হয়েছে ভাব, সেই জানতে পায়। ভাবুকের হাঁটা, চলা, বলা, খাওয়া সবকিছু ভাবের ঊর্দ্ধে। এটা আর আমাদের মত জীবের সঙ্গে মিলবে না। সাধুর তাকানো আমাদের সঙ্গে মিলবে না। হাসিও মিলবে না। চলাও মিলবে না। খাওয়াও মিলবে না। কোনটাই না।

প্রত্যেকটার মধ্যে ভাব থাকতে হবে, ‘ভাব শূন্য হলে হৃদয়, বেদ পড়িলে কি ফল হবে।’ ভাব সৃষ্টি হতে হবে। ভক্তি, ভাবে হতে হবে। সেটিই তো প্রকৃত ভক্তি। দেখা দেখি ভক্তি, এটাতো ভক্তি নয়। ভক্তিটা ভেতরে সৃষ্টি হতে হবে।

একজন ভক্ত হলো, ভাই কই যাও, সে তো আমার গুরু বটে। ভাই আমিও যাবো! তুমি যখন ধরেছো, আমিও ধরবো। এরা ভজে লাভ করতে চায়, কিন্তু হয় না। কয়দিন পর দেখবো যে, ঐ ভক্ত আর নাই, দুর্নাম গায়ে বেরাচ্ছে। ঠিক আছে? দেখা দেখি হলেও সেটাও বিপদ।

আমার সাঁইজিকে এক গুরু ভাই বলেছিলেন, ‘সাঁইজি! এই যে চাইল নিয়ে এসে দিলাম।’ কথাটা একটু মোটা মোটা কথা। ‘আপনিতো আর ধান চাষ করেন না! আলু চাষ করেন না! পান চাষ করেন না! এই যে দিলাম বসে বসে খাবেন। অপচয় করেন না।

তো সাঁইজি হাইসে উঠে বললো যে, তোমাদের এইটে দিয়ে কি আমি ঘরবাড়ি ইট দিয়ে করেছি গো? তোমরা যা দাও, আমিতো মানুষকেই সেবা দিই। এটাই নয় যে, ধান চাষও করলাম না। কোন চাষইতো করলাম ? তো তরমুজ চাষও করিনি। আবার খেতে পাচ্ছি আমরা, কি একটা অসম্ভব ব্যাপার। মাছ চাষও করিনি, এই যে মাছও পেলাম। ঠিক না? তো চাষতো আমার করা লাগলো না। বসে বসে তো সেবা নিচ্ছি।

‘পেলে ভজি, কি ভজে পায়’-পেয়ে ভজি না ভজে পায়। তাঁকে পাইতে হবে। তার এই পাওয়াটা আগের অর্জন, তারপরে ভজা। না পাইলে আমি ভজবো কি? যার জন্য, ভক্ত গুরুকে খুঁজবে, পাওয়ার জন্য। সেই পাওয়ার ক্ষমতাটা আগে অর্জন করা লাগে।

তাতে লাগবে যে, দুটোরই অর্থ সুন্দর অর্থ। না ভজলে পাবো কি? কত প্যাঁচের কথা সাঁইজি, ‘পেয়ে ভজি না ভজে পায়।’ তো… তার ভাগ্যে গুরু জুটবে বাবা। যার অর্জন করা আছে। সেটিই পেয়ে ভজা। হ্যাঁ, ঐ যে সাঁইজি বললো না যে, দেখা দেখি সাধুরও জোট ঘটবে বিপদ, বাড়িবে রোগ।

একজন ভক্ত হলো, ভাই কই যাও, সে তো আমার গুরু বটে। ভাই আমিও যাবো! তুমি যখন ধরেছো, আমিও ধরবো। এরা ভজে লাভ করতে চায়, কিন্তু হয় না। কয়দিন পর দেখবো যে, ঐ ভক্ত আর নাই, দুর্নাম গায়ে বেরাচ্ছে। ঠিক আছে? দেখা দেখি হলেও সেটাও বিপদ।

এক দমের ভরসা নাই
কখন কি করবেন গো সাঁই
তখন কার দিবি দোহাই কারাগারে।।

তো কারাগারে গেলাম বললেই যে হয়। সাঁইজির কারাগার তো চুরাশি লক্ষ যোনী, তখন আমি কার দোহাই দিবো? আমারতো গুরু নাই। অন্তিম মূহুর্তে আমাকে কে নিয়ে যাবে? নিশ্চিত চুরাশির যম।

জীব ম’লে যায় জীবান্তরে
জীবের গতি মুক্তি রয় ভক্তির দ্বারে।।

নচেৎ জীবান্তরে যেতে হয়।

জীব ম’লে যায় জীবান্তরে
জীবের গতি মুক্তি রয় ভক্তির দ্বারে,
জীবের কর্ম বন্ধন না হয় খণ্ডন
প্রতিবন্ধন কর্মের ফেরে।।

সমস্ত সৃষ্টি গুলোন হচ্ছে, জীবের এটিই কর্মবন্ধন। ততক্ষণ খণ্ডন হবে না, যতক্ষণ গুরু ভজনা শুরু হবে। চলতেই থাকবে, প্রতিবন্ধন চলতে থাকবে।

ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুত-ব্যোম
এরা দোষী নয় দোষী আদম,
বেহুঁশে খেয়ে গন্ধম
তাইতে এলো ভাবনগরে।।

এগুলো দিয়ে তো বানানো, এরা তো চিজ- ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুত-ব্যোম। ক্ষিতি মানে মাটি। অব মানে পানি। তেজ মানে আগুন। মরুত মানে বাতাস। বম- আকাশ, আত্মা।

এই যে দুনিয়াতে কখন থেকে আসা হলো। এই যে আদম যে ভুল করলো, সেই ভুল করার পরে ভবনগরে আদমকে পাঠানো হলো। আদম আর হাওয়া। কেন তার আগে তারা ভবে ছিল না? স্বর্গে রাখা হয়েছিল। শান্তিময় পরিবেশকে যখন ভঙ্গ করা হলো। কাম আবেশে লিপ্ত হয়ে রতি স্খলন করলো। এটিই গন্ধম ভক্ষণ করা। সাজা স্বরূপ তাদেরকে বিছিন্ন করে রাখা হলো, দুনিয়াতে জেদ্দার সংলগ্ন।

আত্মা আর পরম-আত্মা
ত্রিসংসারে জগৎকর্তা,
ভুলে আত্মা জগৎকর্তা
লক্ষ যোনী ঘুরে মরে।।

সবই তো কলবের কাছ থেকে আসে। নিস্তার পাওয়ার কি উপায়?

গুরু ধরে জ্যান্তে মরে
বসাও গুরুর হৃদমাঝারে,
সিরাজ সাঁইয়ের চরণ ভুলে
লালন মিছে কেন বেড়াও ঘুরে।।

ঐ যে ছয়টা রিপুকে দমন করা। একটা গুরু না থাকলে ঐ প্রকৃয়া পাওয়া যাবে না। কেন লালন তুমি মিছে ঘুরছো চুরাশি, জীবান্তর কেন তুমি ঘুরছো? এক্ষুনি গুরু ধরে জ্যান্তে মরো। রিপু ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করো। তবেই তুমি পরিত্রাণ পাবে। নচেৎ চলতেই থাকবে জীব; আরেক জীবে যাবে, আরেক জীবে যাবে, জীবান্তরে যাবে। এই তো প্রয়োজন গুরু ধরার।

কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা
দেখায় আসমানে,
আছে কোথায় স্বর্গপুরে
কেউ নাহি তার ভেদ জানে।।

পৃথিবী গোলাকার শুনি
অহর্নিশি ঘোরে আপনি,
তাইতে হয় দিন রজনী
জ্ঞানীগুণী তাই মানে।।

একদিকে নিশি হলে
অন্যদিকে দিবা বলে,
আকাশ তো দেখে সকলে
খোদা দেখে কয়জনে।।

তাহলে আর আকাশ থাকলো আলাদা ভাবে? ঘুরছে যে; একবার আকাশ উপরে একবার নিচে। দেহের দিন এবং রাত কোন সাইড জানো? এ সাইডে যখন নিশি হয় (বাম দিক), তখন ও সাইডে (ডান দিক) দিন হয়। পৃথিবীরও ঠিক তেমনি। তাহলে কোথায় এখন খোদা? এই যে টাসটা দিচ্ছে সাঁই-

আপন ঘরে কে কথা কয়
না জেনে আসমানে তাকায়,
ফকির লালন বলে কেবা কোথায়
বুঝোরে দিব্যজ্ঞানে।।

তাহলে কোথাও আল্লাহ্ পাওয়া যাবে না। আছে এ হৃদয়ের মাঝে। মম হৃদয়ও মন্দিরে। আমার হৃদয়ও মন্দিরে। তাই তাকে জাগ্রত করতে। তাকে অবলোকন করতে হলে গুরু সুরাতের প্রয়োজন বাবা। গুরুর রূপের সাধনার দ্বারা। গুরু স্বরূপ, ভক্ত স্বরূপ। এক স্বরূপ না হলে আরেক স্বরূপ লাভ হবে না বাবা।

লালন সাধনায় গুরু: তিন-

……………………….
ফকির সামসুল সাঁইজি
বাগলপাড়া, সাঁইনগর রাজশাহী।
শ্রুতি লেখক : মাশফিক মাহমুদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই “সাধু পঞ্জিকা” দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন


লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই

লালন ফকিরের নববিধান: তিন

লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই


মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস
লালন গানের বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
কে বলে রে আমি আমি
ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁই


বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্
ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?

লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!