আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, অপঘাত মৃত্যু প্রভৃতিতে যাহাদের পরলোকে অসদ্গতি ঘটে, বংশধরদের কিরূপ কার্য্য দ্বারা তাহাদের সদগতি লাভ হয়? ঠাকুর বলিলেন, শাস্ত্রে আছে, গয়াতে যথামত পিন্ডদান করলেই, তাদের সদ্গতি হয়ে থাকে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, গয়াতে পিন্ড দিলে সত্যই কি প্রেত তাহা গ্রহণ করে? ঠাকুর বলিলেন, হাঁ, ব্যবস্থামত দিলে পরলোকগত আত্মা তা গ্রহণ করে।
আমি যখন গয়ায় ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচার করতে গিয়েছিলাম, তখন আকাশগঙ্গা পাহাড়ে অনেক সময় থাকতাম। ঐ সময়ে একবার একটি আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটেছিল। আমার একটি ব্রাহ্মবন্ধু, বিলাতফেরত ডাক্তার সে সময় গয়ায় গিয়েছিলেন। তাঁর পরলোকগত পিতা তাঁকে একদিন স্বপ্নে বললেন, বাপু! যদি গয়ায় এসেছ, আমাকে একটি পিন্ড দাও; আমি বড়ই কষ্ট পাচ্ছি।
তিনি ব্রাহ্ম, ওসব কিছুই বিশ্বাস করেন না, তাই উড়িয়ে দিলেন। পরদিন রাত্রিতে আবার স্বপ্নে দেখলে্ন, পিতা অত্যন্ত কাতরভাবে বলছেন, বাবা! তোমার কল্যাণ হবে, আমাকে একটি পিন্ড দিয়ে যাও। দু’বার স্বপ্নে দেখেও তিনি তা গ্রাহ্য করলেন না। আমাকে এবিষয়ে এসে বললেন। আমি তাঁকে বললাম, পুনঃ পুনঃ যখন এরূপ দেখছেন, তখন পিন্ড দেওয়াই উচিৎ।
তিনি আমার উপর বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারক হয়ে, এরূপ কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন? আমি তাঁকে বললাম, আপনি ত আর আপনার বিশ্বাসমত দিবেন না, আপনার পিতার বিশ্বাসমত দিবেন, তাতে বাঁধা কি? তিনি তাতেও সম্মত হলেন না। পরে আর একদিন শুয়ে আছেন, সামান্য একটু তন্দ্রা এসেছে, দেখলেন পিতা জোড়হাত করে বলছেন, বাপু আমাকে একটি পিন্ড দিলে না?
বন্ধুটি তখন আমাকে এসে বললেন, মশায়, আজ আবার পিতাকে স্বপ্নে দেখলাম, তিনি করজোড়ে কাতর হয়ে বলছেন, বাপু, আমাকে একটি পিন্ড দিলে না? আমি বড়ই কষ্ট পাচ্ছি।
আমার যথার্থ উপকার করলে, তুমি সুখে থাক, ঠাকুর তোমার কল্যাণ করুন। আহা, আগে যদি আমি জানতাম পিতা এভাবে এসে পিন্ড গ্রহণ কর্বেন, তা হলে আমি নিজেই খুব যত্ন করে পিন্ড দিতাম। এ সকল ব্যাপার কি যুক্তি-তর্কে বুঝানো যায়?
শুনে আমার কান্না এল। আমি তখন বললাম, আপনি নিজে না দেন, প্রতিনিধি দ্বারাও ত দেওয়াইতে পারেন। তিনি চুপ করে রইলেন। আমি দুটি টাকা নিয়ে একটি পান্ডাকে ওঁর প্রতিনিধি হয়ে পিন্ড দিতে ব্যবস্থা করে দিলাম। এই পিন্ডদানের দিন বন্ধুটিকে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে বিষ্ণুপাদপদ্মে উপস্থিত হলাম। প্রতিনিধি পান্ডা যখন পিন্ডদান করলেন, তখন দেখলাম বন্ধুটির চোখ দিয়ে দরদরধারে জল পড়ছে।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে পরলেন। পরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, মশায়! যখন পিন্ড দেওয়া হয় তখন আমি পরিষ্কার দেখলাম, আমার পিতা খুব আগ্রহের সহিত দুই হাত পেতে পিন্ড গ্রহণ করলেন। এবং হাত তুলে আমাকে আশির্ব্বাদ করে বললেন, বাপু! আমার যথার্থ উপকার করলে, তুমি সুখে থাক, ঠাকুর তোমার কল্যাণ করুন।
আহা, আগে যদি আমি জানতাম পিতা এভাবে এসে পিন্ড গ্রহণ কর্বেন, তা হলে আমি নিজেই খুব যত্ন করে পিন্ড দিতাম। এ সকল ব্যাপার কি যুক্তি-তর্কে বুঝানো যায়?
গুরু আর শিষ্যর সম্পর্কে থাকে এক অদৃশ্য বন্ধন। যাকে এককথায় বলা যায় মুক্তিরবন্ধন। প্রতিটি শিষ্যের জন্যে একজন গুরু নির্দিষ্ট থাকেন আর সেই শিষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় গুরুকেই। শিষ্যকে যে গুরু দীক্ষা দেন তার নেপথ্যে গুরুর নিজস্ব কোন স্বার্থ থাকে না। থাকে একটাই লক্ষ্য- শিষ্যকে তার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া। আর সেখানে শিষ্য পৌঁছতে পারাই হচ্ছে গুরুর একমাত্র গুরুদক্ষিণা।
গুরু যখন শিষ্যকে দীক্ষা দেন তখন আপন সাধনশক্তি দিয়ে সৃষ্ট উর্জাশক্তিকে মন্ত্রের সাথে শিষ্যের ভেতরে প্রতিষ্ঠা করে দেন। এজন্যে কম শক্তি ব্যয় হয় না। এর ফলে দীক্ষার পর শিষ্যের একটা প্রারব্ধের অংশ গুরুকে টেনে নিতে হয়। জগতের অন্য কোনো সম্পর্ক কিন্তু কারোর প্রারব্ধ নেয় না কোন কারণেই। একমাত্র গুরুই এই প্রারব্ধ টানেন। শুধু তাই নয়।
এরপর শিষ্য অনেক সময়েই নানা ভুল করে, অন্যায় করে আর তার শাস্তির একটা বড় অংশ গিয়ে পরে গুরুর উপর। দোষ করে শিষ্য আর প্রারব্ধ ভোগেন গুরু। তাই দীক্ষার পর প্রতিটি শিষ্যের উচিত- কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে গুরুর থেকে মত নেয়া। গুরুর প্রতি কখনোই অসম্মান প্রদর্শন করতে নেই। তাতে ইষ্ট রুষ্ট হয়ে যান।
আর গুরু যদি কখনো শিষ্যের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তার মন্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হন তখন শিষ্যের প্রতি যে ঘর বিপত্তি নেমে আসে তা সামাল দেয়ার শক্তি কিন্তু জগতে কারোরই থাকে না। এমনকি ইষ্ট নিজেও সেই শিষ্যকে বাঁচাতে যান না।
সাধারনত শিষ্য যখন অসুস্থ হয়ে পরে তখন গুরু তাঁর জপ বাড়িয়ে দেন যাতে শিষ্য তার জপের শক্তিতে তাড়়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে। একইভাবে শিষ্যের কর্তব্য- গুরু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের জপের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া যাতে গুরু সুস্থ হয়ে ওঠেন। কারণ গুরুর অধিকাংশ ভোগ আসে শিষ্যের দুর্ভোগ থেকে।
তাই শিষ্যের কর্তব্য- সেটি যথাসম্ভব কম গুরুর উপর চাপানো। উত্তম শিষ্যরা এটাই করে থাকেন। যেমন কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী করে দেখিয়েছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জন্যে।
সেখানে দুজনেই পিছিয়ে পরবে। তাই শিষ্যের সবসময়ে উচিত- গুরুর প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে অত্র দেখানো প্রণালীতে ঠিকমত জপ ধ্যান এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবেই সার্থক হয় গুরু শিষ্যের অমৃতের পথে যাত্রা।
আসলে শিষ্য এবং গুরুর মধ্যে একটা জ্যোতির সংযোগ সৃষ্টি হয়ে যায় যা গুরুর সাথে শিষ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলে আলোর দিকে। তাই এই যাত্রায় দুজনের সাধনশক্তিরই প্রয়োজন পরে। যেখানে একইসাথে দ্রোনের মত গুরু আর অর্জুনের মত শিষ্য থাকে সেখানে অগ্রগতি হয় দ্রুত দুজনের মিলিত শক্তিতে।
কিন্তু যেখানে গুরু আছেন, তিনি দেখবেন, আমি যা করার করি ভাবনা নিয়ে শিষ্য চলে সেখানে বুঝতে হবে গুরু দিকপাল হলেও শিষ্যের জন্যে তার ফাটা কপাল। অর্থাৎ সেখানে দুজনেই পিছিয়ে পরবে। তাই শিষ্যের সবসময়ে উচিত- গুরুর প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে অত্র দেখানো প্রণালীতে ঠিকমত জপ ধ্যান এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবেই সার্থক হয় গুরু শিষ্যের অমৃতের পথে যাত্রা।
……………………………………………..
(কুলদানন্দের ডায়েরী থেকে)
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : জয় ভগবান্ পত্রিকা।
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন