-গৌতম মিত্র
পতিত পাবন শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ মতুয়া মত প্রচারক ভক্ত-গোঁসাই ছিল ১২ জন। তারা সর্বাধিক পরিচিত গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই নামে। তার নির্দেশ মতো তারা বিভিন্ন জেলায় নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে মতুয়া মত প্রচারের পাশাপাশি শিক্ষা আন্দোলন ও সামাজিক সচেতনতায় কাজ করতেন। এই বারো গোঁসাই হলেন-
১. শ্রী দেবীচাঁদ গোঁসাই।
২. শ্রী গোপাল সাধু ঠাকুর।
৩. শ্রী যাদব গোঁসাই।
৪. শ্রী যাদব বিশ্বাস।
৫. শ্রী অশ্বীনি গোঁসাই।
৬. শ্রী হরিবর সরকার।
৭. শ্রী রমনী গোঁসাই।
৮. শ্রী নকুল গোঁসাই।
৯. শ্রী বিপিন চাঁদ গোঁসাই।
১০. শ্রী হরি পাল।
১১. শ্রী রাধাক্ষ্যাপা।
১২. শ্রী বিচরণ পাগল।
১. শ্রী দেবীচাঁদ গোঁসাই
দেবীচাঁদ গোঁসাইদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ থানার মাচন্দপুর গ্রামে। অবশ্য তার জন্ম হয় বরিশাল জেলার নয়নাভিরাম অঞ্চল পাটগাতী গ্রামের মণ্ডল পরিবারে। তিনি সরকারি গোমস্তায় চাকরি করতেন বলে জানা যায়। তিনি গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম প্রধান সাধক।
শ্রী তাঁরকচন্দ্র সরকারের কাছে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের অপার মহিমা শুনে তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরের দর্শন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। এই ব্যাকুলতা দেখে তারক সরকার তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান শ্রীধাম ওড়াকান্দির বারুণীতে। দেবীচাঁদ সেখানে গিয়ে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরকে দেখে আনন্দে দিশাহারা হয়ে উঠেন। তার উৎফুল্ল চিত্ত দেখে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন-
প্রভু কহে দেবী তোর চিন্তা নাহি আর।
ঘরে ঘরে করগো হরি নাম প্রচার।।
শুধু এক দেশে নয় দেশ দেশান্তরে।
হরিনামে ডাংকা মেরে বেড়া তুই ঘুরে।।
তোর সাথি আমি আছি কোন ভয় নাই।
ডংকা মেরে বেড়া ঘুরে আমি তাই চাই।।
এ কথা শুনে দেবীচাঁদ চাকরি ছেড়ে হরিনামের কাঙ্গাল হয়ে দেশ দেশান্তরে ছুটে হরিনাম প্রচারে রত হন। কেনুভাঙ্গা, টুঙ্গিপাড়া ও রাজনগরসহ দক্ষিণ বাদাবনে হরিনামের হিল্লোলে মাতিয়ে তুলেন। এই নিষ্পেষিত জাতির মধ্য দেবীচাঁদ প্রথমে গুরুচাঁদ ঠাকুরের আদেশে বিধবা বিয়ের প্রচলন করেন।
২. শ্রী গোপাল সাধু ঠাকুর
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক গোপাল সাধু ১২৮০ বঙ্গাব্দে খুলনা জেলার লক্ষ্মীখালী গ্রামে হাওলাদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্রী রামচন্দ্র, মাতা কালী দেবী। ১৬ বছর বয়সে তাকে আড়ংঘাটা গ্রামের গোবিন্দের কন্যা কাঞ্চনময়ীর সাথে বিয়ে দেয়া হয়।
গোপালের শ্যালিকা কামিনী ছিল ওড়াকান্দির ভক্ত। কামিনী খুব সুন্দর গান গাইতো। একদিন শ্যালিকা কামিনীও স্ত্রী কাঞ্চনময়ীর কণ্ঠে ওড়াকান্দির গান শুনে বিমোহিত হয়ে গেলেন গোপাল সাধু। শ্যালিকা কামিনীকে বললেন-
ওড়াকান্দি কিবা আছে গাও কার গান।
গান শুনে কেঁদে কেঁদে ওঠে কেন প্রাণ।।
তখন কামিনী বললো-
ওড়াকান্দি এসেছিল মানুষ রতন।
শ্রীহরিচাঁদ নাম তাঁর রেশম বরণ।।
এ কথা শুনে গোপাল সাধু ওড়াকান্দি যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। গোপাল সাধু দেবীচাঁদের সাথে ওড়াকান্দি যান। শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে দেখে গোপাল মত্ত হন হরিনামে। পরবর্তিতে এই গোপাল সাধু মতুয়াদের অন্যতম ভক্ত হয়ে ওঠেন।
১৩২৩ বঙ্গাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের মতাদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে তারক সরকার রচিত ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ প্রকাশিত হয়। এই শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত ছাপানোর পিছনে গোপাল সাধু বিশেষ অবদান রাখেন। জানা যায়, তিনি এর প্রকাশনার জন্য কাঞ্চন দেবীর সহযোগিতায় তৎকালীন সময় ৫০০ টাকা প্রদান করেন।
গোপাল সাধু গুরুচাঁদ ঠাকুর ও দেবীচাঁদের আদেশে খুলনা জেলায় বিধবা মহিলাদের বিয়ের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। খুলনার মাতুয়াখালীতে দরিদ্র ও নিষ্পেষিত মানুষদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রী হরিগুরুচাঁদ আশ্রম’। এই মহান সাধক ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে দেহত্যাগ করেন।
৩. শ্রী যাদব গোঁসাই
যশোর জেলার কালিয়া থানার লোহারগাতী গ্রামে ১২৮০ বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক মাসে গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক যাদব চন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। যাদব খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। একদিন শ্রী তারক সরকার যাদবকে বলে-
যাদবেরে বারে বারে গোস্বামী কহিল।
আমার সঙ্গেতে তুমি ওড়াকান্দি চল।।
যাদব চন্দ্রের মনে ওড়াকান্দি নিয়ে তেমন কোনো ভক্তিভাব ছিল না। সে ভাবতো, ওড়াকান্দি গিয়ে কি হবে? তবে যাদবের স্ত্রী যখন গ্রহণী রোগে আক্রান্ত হয়ে দিন দিন ক্ষীণ হতে লাগল। তখন তাকে দেখে তারক সরকার যাদব গোঁসাইকে বলল, এবার বারুনীর সময় তুমি আমার সাথে শ্রীধাম ওড়াকান্দি চল। যাদব কি ভেবে রাজি হয়ে গেলো। শ্রীধামে ওড়াকান্দি গিয়ে দেখে-
দিকে দিকে শোনা যায় সোর শব্দ গোল।
আর কিছু নয় শুধু ‘বল হরিবল’।।
কিছু সময় পরে তারক যাদবকে বলল, যদি মানুষ দেখতে চাও তাহলে আমার সাথে এসো। এই বলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে যাদবকে নিয়ে গেল। যাদক গুরুচাঁদ ঠাকুরকে প্রণাম করে দেখে-
যাদব চাহিয়া দেখে গুরুচাঁদ কই!
চতুর্ভুজ মূর্তিধারী কবে বসে অই!!
কনক বরণ ছবি চতুর্ভুজ ধারী।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চারি হস্তে ধরি।।
যাদব গুরুচাঁদ ঠাকুরকে প্রণাম করে এক বিরাট রূপ দেখতে পেল। যাদব গোঁসাইকে গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছিল, বৈষ্ণব গুরুদের মতো নারী শিষ্য দিয়ে জল-তেল ঘষাঘষি করা নিষেধ। নারীদেরকে মাতৃজ্ঞানে দেখিতে হবে।
৪. শ্রী যাদব গোঁসাই
গোপালগঞ্জ জেলার তালতলা গ্রামে গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক সাধক যাদব বিশ্বাস জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সর্বদাই হরিনাম গুণগানে মত্ত থাকতেন। যাদব গোঁসাই মানুষকে দেখলে বুঝতে পারতেন কার শরীরে কি রোগ আছে।
গোঁসাই গাছগাছাড়া দিয়ে সে সব রোগের ব্যবস্থাপত্র দিতেন। নৈতিক চরিত্র সংশোধনের জন্য মানুষকে উপদেশ দিতেন। মতুয়া ভক্তরা অসুস্থ হলে যাদব গোঁসাইর কাছে যেত। পাতলা, ঘৃতকান্দি, কৃষ্ণপুর ও লোহারগাতি প্রভৃতি গ্রামের মধ্যে হরিচাঁদ ঠাকুরের আর্দশ প্রচার করার সাথে সাথে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন গঠনে ভূমিকা রাখেন তিনি।
(চলবে…)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া
বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
2 Comments