রাজা কৃষ্ণানন্দের পুত্র নরোত্তম ঠাকুর তীব্র গৌর বিরহ আর বৃন্দাবনের টানে ঘর থেকে বেরিয়ে ভজনের উদ্দেশ্য ব্রজে লোকনাথ গোস্বামীর কাছে আসিলেন।মহাবৈরাগী বিরক্ত সাধু ছিলেন লোকনাথ গোস্বামী।মহাপ্রভুর কৃপা নিয়ে উনি রূপ সনাতন এদের সবার আগে বৃন্দাবনে এসে একান্তে ভজন করিতেন।মানসে রাধাকৃষ্ণের সেবা।
তিনি মঞ্জুলালী মঞ্জুরী স্বরূপে নিজেকে রাধারাণীর শ্রী চরনে সঁপে দিয়েছিলেন। একদিন একান্তে ভজন করছেন কিশোরী কুণ্ডের কাছে,সাক্ষাৎ রাধাবিনোদজী যুগল বিগ্রহ রূপে ওনার কাছে প্রকট হন।ওনার কোনো কুটিয়াও নাই। গাছতলায় ভজন করেন।এই বিগ্রহ কিভাবে সেবা করবেন? রাধারাণীর আদেশে উনি বিগ্রহ তুলে নিলেন আর গাছের কোটরে রেখে সেবা করতেন।
যখন কোথাও যেতেন গাছের ডাল বেঁধে বুকের কাছে রেখে ঠাকুরকে নিয়ে যেতেন। লোকনাথ গোস্বামীর এই বৈরাগ্য আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হয়! সত্যিই ধন্য তাদের বৈরাগ্য।
নরোত্তম ঠাকুর এই লোকনাথ গোস্বামীর কাছে আসিলেন দীক্ষা নেবার জন্য। কিন্তু বাবা তো দীক্ষা দেবেন না।দীক্ষা দিলে শিষ্য তার সেবা করবে,পূজা করবে-তা তিনি মোটেই চাইতেন না। কিন্তু নরোত্তমও ছাড়বার পাত্র নন। লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার সেবা করতে লাগলেন। শুকনো কাঠ এনে দেওয়া,জল এনে দেওয়া,ফুল তুলে দেওয়া এইসব।কিন্তু লোকনাথ গোস্বামী তা জানতে পারলেন, আর নরোত্তম কে দূর করে তাড়িয়ে দিলেন।
অনেকদিন পর লোকনাথ গোস্বামীর মনে উদয় হলো-“আচ্ছা, আমি যে ভোরবেলা বিষ্ঠা ত্যাগ করি/মলমূত্র ত্যাগ করি-সেই জায়গাটা রোজ পরিষ্কার থাকে কিভাবে?কোনো ব্রজবাসী পরিষ্কার করেনা তো?তার পরের দিন তিনি খুব ভোরে উঠে সেই বিষ্ঠা ত্যাগের জায়গায় গিয়ে দেখেন-নরোত্তম নিজের হাতে সেই মলমূত্র ফেলে ঝাঁটা দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে সেই ঝাঁটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে”।
আর থাকতে পারলেন না তিনি। বলে উঠলেন-“নরোত্তম তুই রাজার পুত্র,আর তুই কিনা এই কাজ করছিস! তোর এত গুরু ভক্তি!আজই আমি তোকে দীক্ষা দিব। তবে তুইই হবি আমার প্রথম ও শেষ শিষ্য।” এইভাবে ত্যাগ বৈরাগ্য ও গুরুনিষ্ঠার দ্বারা নরোত্তম ঠাকুর দীক্ষা পেলেন লোকনাথ গোস্বামীর থেকে।মানসে রাধাকৃষ্ণ যুগল সেবার জন্য চম্পক মঞ্জুরী স্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে ভজন করতে লাগিলেন। কতো ভজন অনুভূতি হতে লাগলো।
রাধারানীকে মানসে গরম দুধ সেবা দিতে গিয়ে সেটা হাতে পরে সাক্ষাতে হাত পুড়ে গিয়েছিল। এত উচ্চ স্তরে ভজনের আবেশ হতো। সেই নরোত্তম কীর্তন লিখতে লাগিলেন। অসংখ্য ভজন কীর্তন। আহা-
“বৃন্দাবনে দুইজন চতুর্দিকে সখিগণ,পরম যে সেবাসুখ ধরে;
এই মনে আশা মোর, ঐছে রসে হইয়া ভোর, নরোত্তম সদাই বিহারে”।
শেষে গুরু আজ্ঞায় খেতুরী গ্রামে এলেন। কতগুলি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিলেন। জান্হবা মা অভিষেক করিলেন। গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী আদি অনেক ভক্তকে তিনি দীক্ষা দিয়েছেন।তিনি ভজনে বসলে কখনো ৩/৪ দিনও উঠতেন না।এমনই ভজন আবেশ হতো। একবার ৭ দিন আসন থেকে উঠলেন না। কিছু দুষ্ট লোক মৃত ভেবে নরোত্তমকে চিতা সাজিয়ে তুলে দিয়েছিলেন।
শিষ্যদের কান্নায় তিনি ধ্যান ভাঙলেন।তখন সবাই তাঁর চরণে পরে গেল।এইভাবে ভজন আবেশে থাকতেন তিনি। একদিন দেহ ছাড়বেন বলে শিষ্যদের বললেন “আমায় পদ্মানদীতে নিয়ে চলো। ওখানেই আমি গৌরপ্রেমের অশ্রুকৃপা পেয়েছি।
“নরোত্তমকে পদ্মায় নিয়ে যাওয়া হলো।
তাঁকে শিষ্যরা জলে ভাসিয়ে দিতেই তিনি দুধ হয়ে পদ্মায় মিশে গেল।”
আজকের যুগে যেটুকু ভজন বেঁচে আছে সাধুদের কাছে,সেসব তাঁদেরই কৃপা। তাঁর “প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা” উচ্চ রাধাদাস্য মঞ্জুরী ভাব সাধনের এক উচ্চ গ্রন্থ।কিন্তু দুর্ভাগ্য এই ভাব নেবার মতো মানসিকতা আজকের বেশিরভাগ ভক্তদেরই নাই। মঞ্জুরী স্বরূপ, সিদ্ধপ্রণালী, মানসে রাধাকৃষ্ণ সেবা-এগুলি সব আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। ভজনের জন্য আজ আমরা একবিন্দু জড় সুখ ছাড়তে রাজি নই। ভজন কি বুঝবো! ধন্য রূপ রঘুনাথ নরোত্তম।
………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন