-মূর্শেদূল মেরাজ
‘আত্মা: দুই’
বৌদ্ধধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
বৌদ্ধধর্ম অনুসারে, জীবন হল মহাবিশ্বের একটি মহাজাগতিক শক্তি যা মৃত্যুর পর মহাবিশ্বের সাথে পুনরায় জুড়ে যাবে। আর যখন জীবনের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে পায় তখন জন্ম লাভ করে। যেকোন জীবনের এই দশটি জীবনাবস্থা রয়েছে- নরক, ক্ষুধা, রাগ, পশুবৃত্তি, পরমানন্দ, মানবিকতা, শিক্ষণ, বোধগম্যতা, বোধিসত্ত্ব এবং বুদ্ধত্ব। এগুলোর মধ্যে যে অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, পুনরায় সেই অবস্থাতেই আবার জন্মলাভ করে।
মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম লাভ হয় যেখানে আত্মা এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যায়। পুনর্জন্মের ধরণ কৃতকর্মের উপর নির্ভর করে। ক্ষতিকর কাজ করলে নিম্নজগৎ বা নরকে অর্থাৎ পশু বা ভূত হয়ে জন্মাতে হয়। আর ভাল কাজ করলে সুখের বা স্বর্গীয় জগতে অর্থাৎ মানুষ হয়ে জন্মানোর সুযোগ লাভ করে।
ইসলাম ধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
কোরানে আত্মাকে উল্লেখ করা হয়েছে রুহ্ বা নফ্স নামে। দেহ বা আত্মা একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করে। আত্মা বা রুহ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, বলে দিন রুহ্ আমার পালনকর্তার আদেশে ঘটিত। এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে। (সুরা বনী ইসরাঈল, ৮৫)
রুহ এমন অশরীরী বস্তু, যা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীর শক্তি ও সামর্থ্য এই রুহের মধ্যেই লুক্কায়িত। এর প্রকৃত স্বরূপ কেউ জানে না। (বুখারি)
মহানবী বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষ তার মায়ের পেটে ৪০ দিন বীর্যরূপে জমা থাকে। তারপর পরিবর্তিত হয়ে রক্তপিণ্ডের আকার হয়। এরপর পরিবর্তিত হয়ে মাংসপিণ্ড হয়। অতঃপর আল্লাহ তার কাছে ফেরেশতা পাঠিয়ে রুহ ফুঁকে দেন। আর তার প্রতি চারটি নির্দেশ দেওয়া হয়। লিখে দেওয়া হয় তার আয়ু, তার জীবিকা, তার আমল এবং সে দুর্ভাগা, না সৌভাগ্যবান।’ (সহিহ বুখারি, ৩৩৩২)
কোরানে অন্তত বিশবার ‘রুহ্’ শব্দটি তিনটি প্রসঙ্গে এসেছে। ‘রুহ্’ হলো সেই বস্তু যা মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা হয়। কোরানে আল্লাহ এর প্রসঙ্গে বলছেন, ‘আমি মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছি, যখন আমি তাকে সুঠাম করবো ও তার মধ্যে আমার রুহ্ সঞ্চার করবো তখন তোমরা তাকে সিজদা করবে। ফেরেশতারা সকলেই সেজদা করলো, ইবলিস ছাড়া, সে সিজদা করতে অস্বীকার করলো।’ (সুরা হিজর, ২৮-৩১)
রুহ, নফ্স বা আত্মার ছয়টি স্তরের কথা জানা যায়-
১. নফসে আমবারা– এই আত্মা অসৎ কাজের প্ররোচনা দেয়।
২. নফসে রহমানি– এই আত্মিক স্তরে কু-প্রবৃত্তি দমন করতে শেখে।
৩. নফসে মুলহামা– এই স্তরে মানব আত্মা নিজের কল্যাণে বিকশিত হয়।
৪. নফসে মুত্মাইন্না– এই স্তরে আত্মা আল্লাহর স্থায়ী অস্তিত্ব লাভ করে, তাঁকে ছাড়া এক মুহূর্ত ও থাকতে পারে না।
৫. নফসে রাজিয়া– পরিতৃপ্ত আত্মা।
৬. নফসে মারজিয়া– আল্লাহর নিকট প্রীত আত্মা।
ইবনুল কাইয়্যিম তাঁর ‘রুহ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সাধারণভাবে বলা হয়, আত্মার মৃত্যু মানে শরীর থেকে তা আলাদা হওয়া ও বের হয়ে যাওয়া। এটাকে মৃত্যু ধরা হলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী। আর যদি বলা হয় যে আত্মার মরে যাওয়া মানে তা বিলীন হয়ে যাওয়া, একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া-এই দৃষ্টিকোণে আত্মা মরে না। বরং তা শরীর থেকে বের হওয়ার পর নিয়ামত বা আজাব ভোগের স্থানে অবশিষ্ট থাকে।’
আফ্রিকান ধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
আফ্রিকান শিকারী সমাজে পরকাল সম্পর্কে বিশেষ বিশ্বাসের কথা জানা যায় তা। তারা বিশ্বাস করে মৃত্যু হলো জীবনের পূর্ণসমাপ্তি। আফ্রিকান সমাজে স্বর্গ-নরক সর্ম্পকিত স্বচ্ছ না থাকলেও আত্মার যে বিচার হবে সেই বিশ্বাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
আফ্রিকান সমাজে মৃত পূর্বপুরুষদের ঘিরে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান-উৎসবের কথা জানা যায়। তাদের প্রায় সকল উৎসবের সূচনাই হয় মৃত পূর্বপুরুষদের আর্শিবাদ নিয়ে, তাদের পূজা-অর্চনা করে। তাদের বিশ্বাস এই আচারে মৃত পূর্বপুরুষ পুনরায় জীবিতাবস্থায় পরিবারে ফিরে আসে। এতে নতুন প্রজন্ম তার পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য লাভ করে কিন্তু তার আত্মা লাভ করে না। তাদের বিশ্বাস, প্রতিটি আত্মাই আলাদা এবং একেকটি জন্ম একেকটি নতুন আত্মার প্রকাশ।
মেন্ডেরা জাতিরা বিশ্বাস করে, মানুষের দুইবার মৃত্যু হয়। একবার মৃত্যু হয় মেন্ডেদের গোপন সমাজে যোগদানের আগে আর দ্বিতীয়বার মৃত্যু হয় যখন সে আসলেই মারা যায়। দ্বিতীয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ পূর্বপুরুষ হয়ে যায়। পূর্বপুরুষরা জীবিতদের জগতেরই অংশ এবং জীবিতদের সাথে তাদের সম্পর্কও থাকে।
তারা এও বিশ্বাস করে, স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্টির পর তারা পরপর দশটি জীবনযাপন করেছিল আর এই প্রত্যেকটি জীবনই একেকটি ক্রম অবরোহী জগতে।
ইহুদি ধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
সকলে বিশ্বাস না করলেও ইহুদিদের মধ্যে পুনর্জন্মে বিশ্বাস অপ্রচলিত নয়। যদিও তাদের তালমুদ বা এর আগের ধর্মগ্রন্থে জন্মান্তরের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
আব্রাহাম আরিয়েহ ট্রাগম্যান বলেন, বিগত পাঁচ শতকে ইহুদিদের মাঝে পুনর্জন্মের কথা প্রকাশ পায়। এর আগে ব্যাপারটি লুক্কায়িত ছিল। শ্রাগা সিমোনস বলেন, বাইবেলেও ডিউটোরমি ২৫:৫-১০, ডিউটোরমি ৩৩:৬ এবং ইসাইয়াহ ২২:১৪,৬৫:৬ এ পুনর্জন্মের ধারণা দেয়া আছে।
ইরমিয়াহু আলম্যন লিখেছেন, পুনর্জন্ম ইহুদিধর্মে একটি প্রাচীন ও মূলধারার বিশ্বাস। জোহারে পুনর্জন্মের ব্যাপারে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।
“স্রষ্টা একজন মানুষের সাথে এসব দুইবার বা তিনবার করে করে যাতে আত্মা অন্ধকূপ থেকে জীবনের আলোয় ফিরে আসে।” (জব ৩৩:২৯,৩০)
গিলগুল নামে পরিচিত পুনর্জন্মের ধারণায় ইহুদি লোকোবিশ্বাসে জনপ্রিয়। ১৩শ শতকের কিছু কাব্বালিস্টদের গ্রন্থে উল্লেখ আছে, কিছু মানব আত্মা অ-মানবীয় দেহে জন্ম নিবে।
সাদিয়া গাওন তার এমুনথ ভে ডেওথ গ্রন্থে লিখেছেন, “যেসকল ইহুদিরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে তারা অ-ইহুদীয় বিশ্বাস ধারণ করে।”
খ্রিস্ট ধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, স্বর্গে এবং নরকে আত্মা বাস করে। (তিমোথি ৩:১৬, ৪:১) আধ্যাত্মিক বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করে, আত্মা মানুষের সাথে কথা বলতে পারে এবং পৃথিবীর যে কোন জিনিসকে বদলে দিতে পারে। অনেক ধর্ম এ ধরনের আত্মার সাথে সকল অবস্থায় যোগাযোগ করতে নিষেধ করে (লেভিটিকাস ১৯:৩১) কিন্তু কিছু ধর্ম আবার একে তাদের রীতিনীতির অংশ হিসেবে চর্চা করে।
পবিত্র বাইবেল (কেরী ভার্সন)-এ উল্লেখ আছে, আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন। পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন, এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। (আদিপুস্তক ১/১-৪)
এইরূপে যখন ভূমণ্ডলে মনুষ্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল ও অনেক কন্যা জন্মিল, তখন ঈশ্বরের পুত্রেরা মনুষ্যদের কন্যাগণকে সুন্দরী দেখিয়া যাহার যাহাকে ইচ্ছা, সে তাহাকে বিবাহ করিতে লাগিল। তাহাতে সদাপ্রভু কহিলেন, আমার আত্মা মনুষ্যদের মধ্যে নিত্য অধিষ্ঠান করিবেন না, তাহাদের বিপথগমনে তাহারা মাংসমাত্র; পরন্তু তাহাদের সময় একশত বিংশতি বৎসর হইবে। (আদিপুস্তক: নোহ ও জলপ্লাবনের বৃত্তান্ত ৬.৩/১-৩)
তখন ফরৌণের ও তাঁহার সকল দাসের দৃষ্টিতে এই কথা উত্তম বোধ হইল। আর ফরৌণ আপন দাসদিগকে কহিলেন, ইঁহার তুল্য পুরুষ, যাঁহার অন্তরে ঈশ্বরের আত্মা আছেন, এমন আর কাহাকে পাইব? তখন ফরৌণ যোষেফকে কহিলেন, ঈশ্বর তোমাকে এই সকল জ্ঞাত করিয়াছেন, অতএব তোমার তুল্য সুবুদ্ধি ও জ্ঞানবান কেহই নাই। (আদিপুস্তক: যোষেফের উন্নতি ও বিবাহ ৪১:৩৮/৩৭-৪০)
তখন তাঁহাদের পিতা যাকোবের আত্মা পুনর্জীবিত হইয়া উঠিল। আর ইস্রায়েল কহিলেন, এই যথেষ্ট; আমার পুত্র যোষেফ এখনও জীবিত আছে; আমি গিয়া মরিবার পূর্বে তাহাকে দেখিব। (আদিপুস্তক: ৪৫:২৭/২৭-২৮)
তখন সদাপ্রভু মোশিকে কহিলেন, তুমি যাহাদিগকে লোকদের প্রাচীন ও অধ্যক্ষ বলিয়া জান, ইস্রায়েলের এমন সত্তর জন প্রাচীন লোককে আমার কাছে সংগ্রহ কর; তাহাদিগকে সমাগম-তাম্বুর নিকটে আন; তাহারা তোমার সহিত সেই স্থানে দাঁড়াইবে।
পরে আমি সেই স্থানে নামিয়া তোমার সহিত কথা কহিব, এবং তোমার উপরে যে আত্মা অধিষ্ঠান করেন, তাঁহার কিয়দংশ লইয়া তাহাদের উপরে অধিষ্ঠান করাইব, তাহাতে তুমি যেন একাকী লোকদের ভার বহন না কর, এই জন্য তাহারা তোমার সহিত লোকদের ভার বহিবে।
আর তুমি লোকদিগকে বল, তোমরা কল্যের জন্য আপনাদিগকে পবিত্র কর, মাংস ভোজন করিতে পাইবে; কেননা তোমরা সদাপ্রভুর কর্ণগোচরে রোদন করিয়াছ, বলিয়াছ, ‘আমাদিগকে মাংস ভোজন করিতে কে দিবে? (গণনা পুস্তক: সত্তর জন প্রাচীন লোক ১১:১৭/১৬-১৯)
শিখ ধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
শিখরা বিশ্বাস করে, আত্মা আধ্যাত্মিক জগতের অংশ; যার উৎপত্তি স্রষ্টা থেকে। শিখদের মধ্যে পরকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে বিশ্বাস করে, ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিবের স্তবক অনুযায়ী পরকালে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বিশাল সংখ্যার শিখরা মনে করে সেইসব স্তবকগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত।
শিখ ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, মানুষের আকার হল স্রষ্টার সবচেয়ে নিকটবর্তী আকার এবং স্রষ্টার সাথে পুনরায় যুক্ত হবার জন্য সবচাইতে ভাল সুযোগ। শিখ গুরুরা বলেন, কিছুই মরে না। কিছুই জন্মায় না। সবকিছুই চিরকাল বর্তমান থাকে। এরা শুধু নিজেদের আকৃতি বদল করে।
এটা অনেকটা পোশাকের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মত। একটি পোশাক পড়বেন এবং এরপর একে ত্যাগ করবেন, তারপর আরেকটা পড়বেন। আপনি কেবল একটি আকার থেকে আরেকটি আকারে পরিবর্তিত হচ্ছেন। আসলে, আপনার আত্মা কখনই জন্মলাভ বা মৃত্যুবরণ করে না। আপনার আত্মা স্রষ্টার একটি অংশ এবং তাই তা চিরকাল জীবিত থাকে।
আহ্মদীয়া ধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
আহমাদিরা বিশ্বাস করে, পরকাল কোন বস্তুগত বিষয় নয়। এর প্রকৃতি আধ্যাত্মিক। এই ধারার প্রবর্তক মির্জা গুলাম আহমেদের মতে, আত্মা আরেকটি বিরল অস্তিত্বের জন্ম দেবে। আত্মা পৃথিবীতে মানব অস্তিত্বের সাথে যেরকম সম্পর্ক রাখ, এই অস্তিত্বও আত্মার সাথে ঠিক সেরকম সম্পর্ক রাখবে।
ব্রাহ্মসমাজ মতাদর্শে আত্মা প্রসঙ্গ
আমি আছি, এ জ্ঞান সকল মানুষেরই আছে। এই ‘আমি’ শরীর নাই, রক্ত মাংস নই, চক্ষু কর্ণ বা কোন ইন্দ্রিয় নই। কিন্তু আমিই চক্ষুর দ্বারা দেখি, কর্ণের দ্বারা শ্রবণ করি, শরীরের দ্বারা সমুদয় অভিপ্রেত কার্য্য সম্পন্ন করি। যে আমি এইরূপে দর্শন করি শ্রবণ করি, চিন্তা করি, যে আমি হিতাহিত বুঝিতেছি, যে আমি সৌন্দর্য্য অনুভব করিতেছি, যে আমি পূর্ণের দিকে যাইবার জন্য লালায়িত, সেই আমিই আত্মা।
যাঁহারা পুনর্জ্জন্মে বিশ্বাস করেন, তাঁহারা বলেন, এই শরীর পরিত্যাগ করিয়া আত্মা পুনরায় এই পৃথিবীতেই আসিবে ; আসিয়া পশুপক্ষী প্রভৃতি জীব রূপে কিংবা নব-জাত মানবশিশু রূপে, শরীরান্তর গ্রহণ পূর্ব্বক এ জন্মের পাপপুণ্যের ফল ভোগ করিবে এবং পূর্ব্বতন কোনও জন্মের ফল ভোগ করিবার জন্য আমরা এই জন্মলাভ করিয়াছি। ব্রাহ্মগণ এ প্রকার শরীরান্তর গ্রহণে বিশ্বাস করেন না।
আত্মা অপূর্ণ, ঈশ্বর পূর্ণ ; ঈশ্বরের দিকে, পূর্ণের দিকে, আত্মা অনন্দকাল চলিতে থাকিবে। সে গতির বিরাম নাই। ‘মুক্তি’ নামক কোন চরম অবস্থা নাই। ব্রাহ্মধর্ম্ম মানবাত্মার অনন্ত উন্নতিতে বিশ্বাস করেন।
জন্মহেতু কোনও মানুষ উচ্চ বা নীচ নহে। সকল মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরদত্ত আত্মা আছে ; প্রত্যেক মানুষেরই ঈশ্বরদত্ত সমুদয় সম্পদ লাভের অধিকার আছে। এই স্বাভাবিক অধিকার হইতে কোনও মানুষকে বঞ্চিত করিলে ঘোর অপরাধ হয়।
সুফিবাদে আত্মা প্রসঙ্গ
ইমাম গাজ্জালী, ইমাম রাজি এবং বেশির ভাগ সুফি দার্শনিকের অভিমত হলো, রুহ কোনো যৌগিক পদার্থ নয়; বরং এটি একটি সূক্ষ্ম মৌলিক পদার্থ।
সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী বলছেন, “বাংলা বা ইংরেজি ভাষার মধ্যে রুহের কোন প্রতিশব্দ নাই। অবশ্য ইংরেজিতে Spirit কে বাংলায় আত্মা বলা হইয়া থাকে। কিন্তু Spirit বা আত্মা কথা দ্বারা রুহকে বুঝায় না। আত্মা বা Spirit কথা দ্বারা আমরা যাহা বুঝিয়া থাকি কোরানে রুহ শব্দ দ্বারা তাহা বুঝায় না।
রুহের স্বরূপ আত্মা হইতে ভিন্ন। আমরা আত্মা বলিতে যাহা বুঝিয়া থাকি তাহা সকল মানুষেরই আছে। কিন্তু কোরানে উল্লেখিত রুহ কোন মানুষের নাই বা থাকে না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করিয়া তাহা তাহাঁর খাস কোন দাসকে দান না করেন।
চিত্তবৃত্তির সামগ্রিক অভিব্যক্তিকে কোরান মাজিদ ‘নফস’ বলিয়াছে। আমরা যাহাকে প্রাণ (Life) বলি তাহা নফসের চলৎশক্তি বা জীবনীশক্তি। জীবন আর মৃত্যু (Life & death) নফসের দুইটি অবস্থা মাত্র। নফস নানারূপ পরিবর্তিত অবস্থার অধীন কিন্তু রুহ উহার উর্ধ্বে। নফস আল্লাহর সৃষ্টি। রুহ সৃষ্টির অন্তর্গত নয়।
মানুষ ও ইতরপ্রকৃতি জীবজন্তু সকলেরই নফস আছে। নফসের চেতনা ও অভিব্যক্তি কাহারও অধিক জাগ্রত, কাহারও কম- এই যা প্রভেদ। কিন্তু একমাত্র মানুষের নফসই রুহ ধারণ করার যোগ্যতা রাখে। তাহা কেবল বিশেষ আশীর্বাদ প্রাপ্ত মানুষের নফস রুহের বাহন হইয়া থাকে। অবশ্য রুহ ধারণ করার মত যোগ্যতা লাভের জন্য নফসকে উপযুক্ত শোধন করার শক্তি সকল মানুষের মধ্যে সমভাবে সুপ্ত রাখা হইয়াছে।”
বাবা কালান্দার জাহাঙ্গীর বলেছেন, “যে আত্মা দেখা যায় না, অর্থাৎ চোখে দেখা যায় না, সেই আত্মাকে ভিত্তি করে যে জ্ঞান সেই জ্ঞানের নাম হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান। এই জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মাকে চেনা যায়, জানা যায়। তাই এই চেনা ও জানার আরো এক নাম হলো নিজেকে চেনা ও জানা।
…দেহ যদি রুহ তথা আত্মা না হয় তবে রুহ তথা আত্মার আকার আছে কি? আত্মা দেহ হতে বিদায় গ্রহণ করলে দেহের নাম লাশ দেওয়া হয় কেন? দেহের আকার ধরে নিলাম সাড়ে তিন হাত, কিন্তু আত্মার আকার কী? আত্মার যদি কোনাে আকার না থাকে তবে আত্মা কি নিরাকার? তবে কি মানুষও নিরাকার? আল্লাহ যে নিরাকার এটা অতি সাধারণ মানুষও জানে, কিন্তু মানুষেরও যে কোনাে আকারই নেই এ কথা কয়জন বুঝতে পারে?”
কাশেম বাবা চিশতী বলেন, পঞ্চ আত্মা একাত্র করলে, পাক পাঞ্জাতন জাইগা উঠে।
প্যারাসাইকোলজিতে আত্মা প্রসঙ্গ
১৮৮২ সালে পরকাল এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করার জন্য সোসাইটি ফর সাইকোলজিকাল রিসার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিজিশিয়ান ডানকন ম্যাকডুগাল মানুষের আত্মা আছে কিনা তা পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের দেহে আত্মা একটি নির্দিষ্ট জায়গা দখল করে। তাই তার নির্দিষ্ট ভর কিংবা ওজন থাকতে পারে। জীবিত এবং মৃত মানুষে তফাৎ কেবল আত্মায়।
বিজ্ঞানীদের সামনে তিনি মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ও পরের মুহূর্তে হাসপাতালের মোট ৬ জন রোগীর ওজন করেন। ডানকানের ভাষ্যমতে, ওজন পরিমাপক যন্ত্রটির কাঁটা ভারসাম্য অবস্থা থেকে সশব্দে একটু নিচে নেমে গেলো! হিসেব করে দেখলাম ওজন হ্রাসের পরিমাণ এক আউন্সের তিন-চতুর্থাংশ কিংবা ২১.৩ গ্রাম প্রায়। দেহের আর্দ্রতা কমে যাওয়া কিংবা ঘাম শুকানোর কারণে সেকেন্ডের ব্যবধানে ওজনের এই হ্রাস সম্ভব নয়।
এভাবে ম্যাকডুগাল এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, মানুষের আত্মার ভর ২১ গ্রাম! ১১ মার্চ ১৯০৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে গবেষণাটি ‘চিকিৎসক মনে করেন, আত্মার ওজন আছে’ খবরের শিরোনাম হয়েছিল। এর পরের মাসেই জার্নাল অব দ্য আমেরিকান সোসাইটি ফর ফিজিক্যাল রিসার্চ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত জার্নাল আমেরিকান মেডিসিনে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞানে আত্মা প্রসঙ্গ
এরিস্টটল তার De Anima গ্রন্থে মানুষের আত্মা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাসমূহকে সুসংবদ্ধ ও সুবিস্তৃত করেন। গ্রিক দার্শনিকরা আত্মাকেই জীবের মূল সত্তা বলে জানতেন। মনে করা হত, আত্মা চলে গেলে জীবদেহ জড় পদার্থে পরিণত হয়। মধ্যযুগীয় দার্শনিকরাও মানুষের দেহ ও আত্মা বলে দুটি পৃথক ও স্বাধীন সত্তার কল্পনা করেছিলেন।
আইনস্টাইন আত্মা ও মৃত্যু-পরবর্তী আর এক ধরনের অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখতেন। তবে ব্যক্তিগত আত্মার অমরত্বে তার বিশ্বাস ছিল না। তিনি আত্মা সম্পর্কিত ধর্মীয় ধারণা নয় বরং দার্শনিক ধারণা দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন। আত্মাকে তিনি শরীর থেকে আলাদা কিছু বলে মনে করতেন না। তিনি মূলত আত্মা ও ঈশ্বর সম্পর্কিত স্পিনোজার দার্শনিক ধারণার অনুগামী ছিলেন।
টমাস হাক্সলি বলেছেন, “এই বিশ্বে একটি তৃতীয় পদার্থ রয়েছে অর্থাৎ চেতনা। যাকে আমি আদপেই কোনো জড় পদার্থ বা শক্তি বলে মনে করি না।”
মরগ্যান ফ্রিম্যানের উপস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রে দ্যা সায়েন্স চ্যানেলে ২০১৮ সালে তথ্যচিত্র ‘থ্রু দ্যা ওয়ার্মহোলে’ অংশগ্রহণ করেন দুই মার্কিন পদার্থবিদ ডক্টর স্টুয়ার্ট হ্যামারহফ এবং পদার্থবিদ স্যার রজার পেনরোজ। তথ্যচিত্রে ডক্টর হ্যামারহফ বলেন, ‘ধরুন হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রক্ত প্রবাহও থেমে গেছে। তখন মাইক্রোটিবিউলগুলোও তাদের তথ্য ধরে রাখার সক্ষমতা হারাতে থাকে। কিন্তু মাইক্রোটিবিউলগুলোতে থাকা কোয়ান্টাম তথ্য একেবারে হারিয়ে যায় না। কারণ সেটাকে ধ্বংস করা যায় না। তা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
…কোমায় থাকা ব্যক্তি যদি চেতনা ফিরে পান তখন ওই কোয়ান্টাম তথ্য আবার কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। ওইরকম সময়েই কোমা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা বলেন যে তারা মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। আর যদি ব্যক্তিটি কোমা থেকে ফিরে না আসেন, সেক্ষেত্রে তার মস্তিষ্কে থাকা কোয়ান্টাম তথ্য তার শরীরের বাইরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছড়িয়ে পড়ে আত্মা হিসেবে।’
এই তত্ত্ব আত্মা নিছক মস্তিষ্কের নিউরনের মিথস্ক্রিয়া নয় বরং তা সময় সৃষ্টিরচক্রের পূর্ব থেকেই বিদ্যমান বলে ইঙ্গিত দেয়।
আত্মা সম্পর্কে বহু মুনির বহু মত। আত্মাকে কেউ স্বীকার করেন কেউ করেন না। অনেকে দেহের মাঝে আত্মার অস্তিত্বকে মানলেও দেহের বাইরে আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না। রহস্যমণ্ডিত এই শব্দকে ঘিরে জল্পনাকল্পনার অন্ত নেই।
হজরত জান শরিফ শাহ সুরেশ্বরী বলেছেন, স্বপ্ন জগৎ একটি রুহানি এলাকা। মানুষ যখন নিদ্রা যায়, তখন রুহ বা আত্মার বোধশক্তি প্রসারিত হয়ে যায় এবং মূল সত্তার কৌশলীক রূপ প্রকাশ পায়। হাকিকতে রুহিয়া বা আত্মার সত্য রূপ যা সমগ্র পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে, তার মাধ্যমে সর্বত্র আপন অস্তিত্ব প্রদর্শন করে।
এই অন্তহীন সত্তাকে ব্যাখ্যা করা যেমন সম্ভব নয়। তেমনি এক লাইনে তা ব্যক্ত করাও সম্ভব নয়। তারপরও আত্মার এই লেখা বেদের এই মহাবাক্য দিয়ে সমাপ্তি টানলাম-
অয়ং আত্মা ব্রহ্ম-
“আমিই সেই আত্মা যা ব্রহ্ম।”
…………………………………..
[টিকা:
মহাবাক্য: মহাবাক্যের সংখ্যা অসংখ্য হলেও সচরাচর প্রতিটি বেদ থেকে একটি উদ্ধৃতিকে মহাবাক্য ধরা হয়। সে হিসেবে মহাবাক্য চারটি। প্রথম মাহাবাক্যটি নেয়া হয়েছে: মাণ্ডুক্য উপনিষদ্, অথর্ববেদ, ১।২ থেকে ]
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২
চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১
চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি