-ড. এমদাদুল হক
১
জীবনে ভুল করা সম্ভব না। এমনকি ‘ভুল হয়ে গেছে’-এই চিন্তাটিও ভুল না। যা হওয়ার দরকার ছিল, তা-ই হয়েছে। যা হওয়া দরকার তাই হবে। ভুল শুধু দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। ভুলের অভিজ্ঞতাগুলো বাস্তবে মনের খেলা। যদি কথিত ভুলগুলো ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে দেখি, তবে তা আর ভুল থাকে না। ভুল প্রতিভাত হয় শুধু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরে ভুলও শুদ্ধ।
জীব-জন্তু, পশু-পাখিরা ভুল করে না। জিন কোডে ভুল নাই। জৈব নির্দেশে ভুল থাকতেই পারে না। জৈব নির্দেশের অনুবাদ করে মানুষের মন এবং আবিষ্কার করে ভুল। কেন? কারণ মন তার সক্রিয়তা বজায় রাখতে পারে না, আবিষ্কার ছাড়া। কারো ভুল ধরা মানে তার বিরোধিতা করা, বিচ্ছিন্নতা উৎপন্ন করা। এগুলো অসুস্থ অহং-এর কাজ। অহং বিরোধিতা চায়। যেখানে বিরোধিতা নাই-সেখানে অহং নাই।
যেহেতু কোথাও ভুল নেই, সেহেতু শুদ্ধ করারও কিছু নেই। যা আছে, তা আছে। যা আছে, তাই বাস্তব-তাই সত্য। সুতরাং কুয়া খনন করার দরকার নাই। পাহাড় বানানোরও দরকার নাই। ডিম পাড়ার দরকার নাই। ডিমে তা দেওয়ারও দরকার নাই। পতাকার দরকার নাই-পতাকার উড়ানোর বাঁশেরও দরকার নাই।
যুদ্ধের দরকার নাই-শান্তিরও দরকার নাই। ধর্মের দরকার নাই-অধর্মেরও দরকার নাই। আর নতুন গির্জা বানানোর দরকার নাই। মানুষ ঈশ্বরের জন্য বহু ঘর তৈরি করে দিয়েছে। এবার ঈশ্বর নিজের ঘরটি নিজে তৈরি করে নিক।
২
ঠাকুর বলেছিলেন, “নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে”। সুখ এপারেও নাই, ওপারেও নাই। ডাক্তার মনে করে উকিল সুখি। উকিল মনে করে ডাক্তার সুখি। এমপি মনে করে মন্ত্রী সুখি। মন্ত্রী মনে করে প্রধানমন্ত্রী সুখি। অবিবাহিতরা মনে করে বিবাহিতরা সুখি। বিবাহিতরা মনে করে অবিবাহিতরা সুখি।
“সবাই তো সুখি হতে চায়, তবু কেউ সুখি হয়, কেউ হয় না”। কেন? কারণ আমরা সুখ খুঁজি বাহ্য জগতে। সুখের উৎস বাহ্যজগৎ নয়-অন্তর্জগৎ। সুখ একটি মানসিক অবস্থার নাম।
ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়দিকেই মনের সামর্থ্য অপরিসীম। দুঃখ উৎপন্ন করা মনের নেতিবাচক সামর্থ্য। সুখ উৎপন্ন করা মনের ইতিবাচক সামর্থ্য।
অরণ্যে, পাহাড়ে, মরুভূমিতে, সৈকতে, অন্তরীক্ষে যেখানেই যাই না কেন, মন আমাদের সঙ্গেই থাকে। আর মনের সঙ্গে থাকে রাগ, তিক্ততা, ঈর্ষা, আবেগ, লোভ, ভয়, লিপ্সা, কামনা, বাসনা, অস্থিরতা, অসন্তুষ্টি।
বাড়ি গাড়ি সঙ্গী পরিবর্তন করে সুখ পাওয়া যাবে না-যদি মন থেকে এসব দূর না হয়। স্থান-কাল-নাম কিংবা লেবাসের পরিবর্তন কোনো পরিবর্তনই না, যদি মনের পরিবর্তন না হয়।
যদি মন শুদ্ধ শান্ত হয়, তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন-এখন এখানেই সুখ। যদি এখন এখানে সুখ না পাওয়া যায়, তবে কখনো কোথাও তা পাওয়া যাবে না।
৩
আমরা এতো কথা বলি কেন? সাড়া দেওয়ার জন্য কথা খুব কম। কোনো ধারণা কিংবা সংবাদ প্রেরণের জন্য কথাও সামান্যই।
আমাদের বেশিরভাগ কথা জুড়ে থাকে জগতের সঙ্গে সংযোগ করার বাসনা। ফেসবুকে লাইক-কমেন্ট পেলে আমরা খুশি হই। কেন? কারণ লাইক-কমেন্ট সংযোগের বার্তা দেয়। যাকে ভালোবাসি, ইচ্ছে করে সারাদিন তার সঙ্গে কথা বলি। কেন? কারণ ভালোবাসা হলো সংযোগ।
অন্য যে কোনো বাসনা রোধ করার চাইতে কথা বলার বাসনা রোধ করা কঠিন। কেন? কারণ সবগুলো জ্ঞানেন্দ্রিয় বাহ্যজগতের সঙ্গে সংযোগ করার জন্য উদগ্রীব। চোখ দিয়ে আমরা বাহ্যজগতের দৃশ্য দেখি, কান দিয়ে বাহ্যজগতের শব্দ শুনি, ত্বক দিয়ে বাহ্যজগৎ স্পর্শ করি, জিহ্বা দিয়ে বাহ্যজগতের স্বাদ গ্রহণ করি, আর কথা দিয়ে বাহ্যজগতের সঙ্গে সংযোগ করি।
কেন আমরা অস্তিত্বের বার্তা শুনতে পাই না? নীরব হতে পারি না বলে। চুপ থাকলেই কি নীরবতা হয়? মন তো কথা বলতেই থাকে, বলতেই থাকে। নীরবতা মানে চিন্তার নীরবতা। যদি চিন্তাজগতে নীরবতা না থাকে, তবে বেশি কথা ও কম কথা বলার মধ্যে পার্থক্য শুধু স্বরের প্রাবল্যে।
বাহ্যজগতের সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টায় যেমন কথা বলার বাসনা উৎপন্ন হয় তেমনি অন্তর্জগতের সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টায় নীরবতা উৎপন্ন হয়।
আত্মোপলব্ধির উপায় কি?
নীরবতা।
নীরবতার উপায় কি?
জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোকে অন্তর্মুখী করা।
৪
১৭ বছরে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি শিখেছি আমরা? আমরা ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করতে শিখেছি-নিজের ব্যবচ্ছেদ শিখিনি। আমরা শিখেছি-পলাশির আম্রকাননে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ইতিহাস। মীরজাফরি ছাড়তে শিখিনি।
আমরা চক্রবৃদ্ধি সুদের অঙ্ক শিখেছি-দরদ শিখিনি। আমরা প্রতিযোগিতা শিখেছি-সহযোগিতা শিখিনি। মুরগী পালন, মৎস্য পালন, ছাগল পালনও শিখেছে কেউ কেউ-শিশু পালন কেউ শিখিনি। আমরা বৃত্তের কেন্দ্র নির্ণয় শিখেছি-শিখিনি জীবনের কেন্দ্র নির্ণয়।
আমরা ব্যাকরণ শিখেছি-কার্যকারণ শিখিনি। আমরা সম্প্রদান কারকে সপ্তমী বিভক্তি শিখেছি-দীনে দয়া শিখিনি। আমরা ম্যানেজমেন্ট শিখেছি-ভালোবাসতে শিখিনি। মার্কেটিং শিখেছি-বিশ্বাস শিখিনি। গণিতের কতো জটিল সূত্র শিখেছি আমরা। শিখিনি সম্পর্কের সরল সূত্র।
আমরা শিখেছি- ‘আলী জ্ঞান নগরীর দরজা’। কিন্তু ডুবে আছি অজ্ঞানে।
কুতুবুদ্দিন আইবেক কে ছিলেন, তা আমরা বেশ ভালোভাবেই শিখেছি। ‘আমি কে’ তা তো শিখিনি। আমরা সব শিখেছি-বাঁচতে শিখিনি।
“আমরা দেখিতে গিয়াছি পর্বত মালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।”
৫
মানুষ কাজ চায়। যদি কাজ না থাকে, তবে ‘কী করা যায়’ এটি চিন্তা করাই বড় কাজ। মানুষ শান্তিতে ঘুমোতেও পারে না। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন হলো মনের সক্রিয়তা। সুতরাং স্বপ্ন দেখাও কাজ বৈকি!
বসে থেকেও আমরা বসে নেই। স্মৃতি আমাদের নিয়ে যায় ধূসর অতীতে। কল্পনা নিয়ে যায় ভবিষ্যতের রঙিন জগতে। চিন্তা উৎপন্ন করে নতুন-নতুন সমস্যা। বুদ্ধি কিছু একটা শুরু করার মন্ত্রণা দেয়। আবেগ উৎপন্ন করে বেগ ।
মনুষ্যের সমগ্র দেহ-মনে রয়েছে ‘কিছু একটা’ করার এষণা। আর ধ্যান হলো ‘কিছু না করা’। অথচ অনেকেই ধ্যান ‘করার’ বিবৃতি দেয়! লোকে বোকার মতো প্রশ্ন করে-ধ্যান ‘করা’ যায় কীভাবে? অনেকেই টাকা দিয়ে ‘কিছু না করা’ শিখে। তাজ্জব ব্যাপারই বটে!
‘করা’ শেখা যায়-‘কিছু না করা’ শিখা যায় কীভাবে?
‘কিছু না করা’-‘করা যায়’ কীভাবে?
করা কঠিন নয়-দিবা-নিশি আমরা তো করার মধ্যেই আছি।
‘কিছু না করা কি কঠিন’?
‘কিছু না করা’ কঠিন হয় কেমন করে?
তবে কি ‘কিছু না করা ‘সহজ’? সহজ হলে আমরা ‘কিছু না করে’ থাকতে পারি না কেন?
আসলে ‘কিছু না করা’ সহজও না, কঠিনও না।
এটি প্রাকৃতিক। এটি স্বতঃস্ফূর্ত।
এটি অস্তিত্ব। এটি আনন্দ।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব
2 Comments