পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ
প্রথম সঙ্গীতের পর
উদ্বোধন
যিনি সুখে দু:খে আমাদের একমাত্র সহায় ও আশ্রয়, যিনি নিয়ত জ্ঞান ও অজ্ঞাতসারে আমাদিগকে পুণ্যের দিকে লইয়া যাইতেছেন, সেই সর্ব্বশক্তিমান অনন্ত মঙ্গলের প্রস্রবন পরমেশ্বরের উপাসনাতে আমরা প্রবৃত্ত হই। এমন কল্যাণকর কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে আমরা সকলে শান্ত ও সমাহিত চিত্তে সেই দীনবন্ধুর উপর আত্মসমর্পণ করি।
শিথিলভাবে, অন্যমনষ্ক হইয়া, কোন কার্য্যই সম্পন্ন করা যায় না; উপাসনারূপ মহৎ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে আমাদের কত আগ্রহের সহিত ও ব্যাকুল প্রার্থনার সহিত তজ্জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত। একান্ত নির্ভরের সহিত তাঁহাকে ডাকিলে এবং অকিঞ্চন হইয়া তাঁহার দ্বারে উপস্থিত হইলে, কখনই তিনি আমাদিগকে বিমুখ করিয়া ফিরাইয়া দিবেন না। তিনি অনাথশরণ ও কাঙ্গালের বন্ধু। তাঁহার পূজা করিয়া আমরা জীবনে কৃতার্থতা লাভ করি।
তৎপরে আরাধনাসূচক একটি সঙ্গীত হইবে। সঙ্গীতান্তরে সমস্বরে সকলে নিম্নলিখিত আরাধনা-মন্ত্র পাঠ করিবেন-
সত্যম্ জ্ঞান মনন্তম্ ব্রহ্ম,
আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি,
শান্তং শিবমদ্বৈতম্
শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্
আরাধনা
হে সত্যস্বরূপ, তুমিই একমাত্র সার ধন। পৃথিবীতে আর যাহা কিছু দেখিতে পাই, সমস্তই রূপান্তর ও পরিবর্ত্তিত হইতেছে ; একমাত্র তুমিই ধ্রুব সত্য হইয়া আমাদের সহায় রূপে আমাদের সঙ্গে আছ। তন্য প্রকারের সাহায্য কখনও মিলে, কখনও মিলে না। একমাত্র তুমিই অটল ও নিশ্চিত সহায়। তুমি বন্ধু, তুমি পরম সখা। সকল সময়ে সকল অবস্থায় নিত্যসহচররূপে তুমিই আমাদের কাছে থাক এবং তুমিই রক্ষাকর্ত্তা হইয়া সকলকে রক্ষা কর। তুমিই একমাত্র আশ্রয় ও সহায়।
তুমি জ্ঞানময়। এই বিশাল বিশ্ব তোমারই জ্ঞানের পরিচয় দিতেছে। তুমি সর্ব্বদা চৈতন্যময় রূপে সর্ব্বত্র বর্ত্তমান থাকিয়া, এই বিশ্ব সংসার প্রতিপালন করিতেছ। তুমি সর্ব্বজ্ঞ ও সর্ব্বসাক্ষী রূপে আমাদিগের প্রাণে সর্ব্বদা বর্ত্তমান থাকিয়া অভাব সকল হইতে- যে সকল রোগ বা বিপদের কথা আমরা জানিতেও সমথী নই, সে সকল হইতে-আমাদিগকে রক্ষা করিতেছ।
তোমার দৃষ্টির বাইরে কিছুই নাই বা থাকিতে পারে না। তুমি প্রতি মুহুর্ত্তে সকলের অবস্থা পরিজ্ঞাত হইতেছ। কোথায় কোন্ ক্ষুদ্র কীট, আর কোথায় কোন্ বৃহৎ প্রাণী কি অবস্থায় আছে, সকলের তত্ত্বই তুমি জানিতেছ। হে জ্ঞানময় পরমেশ্বর, তুমি নিত্য ক্রিয়াশীল রূপে জগৎ কার্য্যের চালক হইয়া বর্ত্তমান রহিয়াছ। তোমার শুভদৃষ্টি আমাদিগকে সর্ব্বদাই শাসন করিতেছে, তুমি শাসনকর্ত্তা ও সংশোধনকর্ত্তা। তুমি সদা জাগ্রত এবং সর্ব্বদাই আমাদের রক্ষক।
তুমি অনাদি অনন্ত। আমরা তোমার কি বুঝিব? আমরা চারি দিকে সীমাবিশিষ্ট যাহা কিছু দেখিতেছি, তাহারই তত্ত্ব পাই না, তোমার তত্ত্ব কি বুঝিব! তুমি মহান। সৃষ্টিতে যাহার যে কোনরূপ শক্তি আছে, সে তাহা দ্বারা তোমারই মহিমা প্রকাশ করিতেছে। কিন্তু কিছুতেই তো তোমার অন্ত হয় না। “অন্ত নাই, অন্ত নাই” এই কথাই তো সকলকে বলিতে হইতেছে।
হে প্রভু তোমার অন্ত না পাই, তাহাতে ক্ষতি কি? তোমাকে জানিতে জানিতেই আমরা বড় হইতে থাকিব এবং তাহাতেই আমাদের উন্নতি হইবে। তোমারই অনন্ত প্রেমের আশ্রয়ে যে আমরা আছি, তাহাতেই আমাদের আরাম ও শান্তি।
অদ্বিতীয় মহান প্রভু তুমি। তুমিই আমাদের স্রষ্টা এবং পালনকর্তা। সমস্ত সংসার তোমারই সৃষ্ট, তোমারই রাজ্য; আমাদের আর কেহ প্রভু নাই। আমাদিগের আশ্রয় এবং সম্বল তুমি। ইহ পরকালে তুমি ভিন্ন আমাদের গতি নাই ; আমাদের প্রাণের দু:খ বুঝিতে পারে এমনও কেহ নাই। দু:খ দূর করিবার শক্তিও আর কাহারও নাই। তুমিই সর্ব্বেসর্ব্বা, মঙ্গলময় বিধাতা।
তুমি আনন্দময়। এই দু:খশোক পূর্ণ সংসারে আমরা যে বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে থাকিয়া সুখি হই, তাহা তোমারই প্রসাদে। তুমি রসস্বরূপ, তৃপ্তির হেতু হইয়া সকলের প্রাণে আছ বলিয়াই তাহাদের সঙ্গ আমাদের এত মিষ্ট। তাহাতেই সংসারে বাসের উপযুক্ত স্থান হইয়াছে। হে অমৃতময়, তোমাতেই একমাত্র তৃপ্তি এবং আরাম। মানুষ চিরদিন সংসারে থাকিবার জন্য সৃষ্টি হয নাই।
সে অমৃতের অধিকারী। অমৃতরূপে তুমি সকলের আত্মাতে আছ। তাই মৃত্যু কাহারও নাই। মৃত্যু হইতে তুমিই সকলকে রক্ষা করিয়াছ। তুমিই প্রাণের শান্তির কারণ। তোমার আস্বাদন পাইলে মানুষ তাহা ভুলিতে পারে না।
হে দয়াময়, প্রেমময়, তোমার অপার দয়া, অতুল প্রেম। তুমি দয়া করিয়া তোমার অমৃতময সহবাসে থাকিতে আমাদিগকে অধিকারী করিয়াছ। আমরা ক্ষুদ্র হইয়াও যে তোমার কাছে বসিতে পারি- তোমার মহিমান্বিত নাম লইয়া কৃতার্থ হইতে পারি , সে কেবল তোমারই অপার দয়া গুণে। আমাদের কি শক্তি আছে যে তোমার পূজা করিব? প্রভু, কতবার আমরা তোমার দিকে না যাইয়া এবং বিপরীত দিকেই যাইয়া থাকি ; কিন্তু তুম্ দয়া করিয়া আমাদিগকে তোমার দিকে লইয়া যাও।
এমন আর কে আছে যে বিরোধী হইলেও আমাদের আদর করে, আমাদের কল্যাণ করে? তুমি আমাদের নিকট হইতে নিয়ত বিরুদ্ধাচরণ ও উপেক্ষা পাইতেছ; কিন্তু এক দিনের জন্যও তো তোমার বিরাগভাজন হইলাম না। তোমারই দয়াগুণে আমরা তোমার দিকে যাইবার জন্য ব্যাকুল হই।
অদ্বিতীয় মহান প্রভু তুমি। তুমিই আমাদের স্রষ্টা এবং পালনকর্তা। সমস্ত সংসার তোমারই সৃষ্ট, তোমারই রাজ্য; আমাদের আর কেহ প্রভু নাই। আমাদিগের আশ্রয় এবং সম্বল তুমি। ইহ পরকালে তুমি ভিন্ন আমাদের গতি নাই ; আমাদের প্রাণের দু:খ বুঝিতে পারে এমনও কেহ নাই। দু:খ দূর করিবার শক্তিও আর কাহারও নাই। তুমিই সর্ব্বেসর্ব্বা, মঙ্গলময় বিধাতা।
সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তোমারই মহিমা প্রচার করিতেছে ; সর্ব্বত্র তোমারই রাজত্ব। তোমার সদৃশ আর কেহ নাই। তোমার কাহারও সাহায্য লইবার প্রয়োজন নাই। তুমি একমেবাদ্বিতীয়ম্।
অসত্য হইতে আমাদিগকে সত্যেতে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাদিগকে জ্যোতিতে লইয়া লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাদিগকে অমৃতেতে লইয়া যাও। হে সত্যস্বরূপ, আমাদিগের নিকট প্রকাশিত হও। দয়াময়, তোমার যে অপার করুণ তাহা দ্বারা আমাদিগকে সর্ব্বদা রক্ষা কর।
পবিত্রস্বরূপ পরমেশ্বর তুমি। তোমারই সহবাসের আস্বাদ পাইয়া পাপীর পরিবত্তিত হইয়া যায়। পাপীর উদ্ধারের আর দ্বিতীয় উপায় নাই। হে পরম সুন্দর পরমেশ্বর, তুমি কৃপা করিয়া তোমার অতুল শোভার এক কণা যদি পাপীকে না দেখাও, তবে পাপী কোন্ ভরসায় এবং কাহার আকর্ষণে পাপ পথ পরিত্যাগ কররিবে? চিরসুন্দর তুমি, তোমার সৌন্দর্য্য প্রাণে অনুভুত হইলে আর কি দু:খ থাকে?
পৃথিবীর সকল শোভা এক দিকে পড়িয়া থাকে, আর সেই তোমার সৌন্দর্য্যের এক কণার লোভে তোমার ভক্ত সন্তান পাগল হইয়া বেড়ায়। আমাদের উদ্ধারকর্ত্তা তুমি। পাপ তোমাকে স্পর্শ করিতে পারে না। তুমি অপাপবিদ্ধ, নিষ্কলঙ্ক। হে পরম সৌন্দর্য্যের আধার, তুমিই আমাদের আশা ভরসা, ইহ পরকালের সম্বল ও আশ্রয়। আমাদের এমন আর কে আছে, যে পাপী বলিয়া ঘৃণা না করিয়া উদ্ধার সাধন করে? প্রভু, তুমি ভিন্ন আর আমাদের গতি নাই। আমরা তোমার শরণাপন্ন হই। তোমাকে বার বার প্রণাম করি।
আরাধনার পর সকলে কিছুকাল নিস্তব্ধ ভাবে ধ্যান করিয়া সমস্বরে নিম্নলিখিত প্রার্থনা উচ্চারণ করিবেন।
অসত্য হইতে আমাদিগকে সত্যেতে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাদিগকে জ্যোতিতে লইয়া লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাদিগকে অমৃতেতে লইয়া যাও। হে সত্যস্বরূপ, আমাদিগের নিকট প্রকাশিত হও। দয়াময়, তোমার যে অপার করুণ তাহা দ্বারা আমাদিগকে সর্ব্বদা রক্ষা কর।
ইহার পর একটি সঙ্গীত হইবে। তৎপরে আচার্য্য কোনও ধর্ম্মগ্রন্থ হইতে কিছু পাঠ করিবেন কিংবা নিজেই আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য উপদেশ দিবেন এবং উপদেশের পর উপাসকগণের অভাবানুরূপ প্রার্থনা করিবেম। তাহার পর শেষ সঙ্গীত হইবে।
…………………………
ব্রাহ্মধর্ম্ম ও ব্রাহ্মসমাজ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………
আরও পড়ুন-
ব্রাহ্মসমাজ
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হইবার যোগ্যতা
ব্রাহ্ম ধর্মের মূল সত্য
ব্রহ্ম মন্দিরের ট্রাস্টডিড
ব্রাহ্মধর্ম্মের মূল সত্য
আত্মা
মানুষের ভ্রাতৃত্ব
উপাসনা ও প্রার্থনা
শাস্ত্র
গুরু
মধ্যবর্ত্তী ও প্রেরিত
সুখ-দু:খ : দু:খবাদ ও আনন্দবাদ
পাপ ও পুণ্য
পুনর্জ্জন্ম
পরকাল
স্বর্গ ও নরক
ধর্ম্ম রক্ষা
পরিবারে পুরুষ ও নারীর অধিকার-সাম্য
ব্রাহ্মসমাজের প্রতি ব্রাহ্মদিগের কর্ত্তব্য
সমবেত উপাসনা
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ
স্তুতি
বিবিধ অবস্থায় প্রার্থনা
নৈমিত্তিক অনুষ্ঠান
সন্তান জন্ম
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ
ধর্ম্মসাধন ব্রতে দীক্ষা
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ধর্ম্মদীক্ষা
বিবাহ ও তাহার আনুসঙ্গিক অনুষ্ঠান
বিবাহের বাগদান
বিবাহ
মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া
শ্রাদ্ধ
গৃহ প্রবেশ
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মের স্বরূপ
ব্রহ্ম ধ্যান
ব্রাহ্মধর্ম
সকলেই কি ব্রাহ্ম?
ব্রাহ্মোপসনা প্রচলন ও পদ্ধতি
আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও “নব হিন্দু সম্প্রদায়”
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ