ভবঘুরেকথা
ভক্ত লালবাবু

ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়কে রাঢ় বলা হয় ইতিহাসের আদিপর্ব থেকে। মুর্শিদাবাদ জেলার মাঝখান দিয়ে উত্তর থেক দক্ষিণে এই ভাগীরথী নদী প্রবাহিত। মুর্শিদাবাদ জেলার অর্ধাংশ রাঢ় এলাকায় অবস্থিত। এই রাঢ় অংশের প্রধান শহর কান্দি। কান্দির সিংহবংশীয় রাজারা প্রায় হাজার বছরের প্রসিদ্ধ রাজবংশ। এই বংশের সবথেকে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ব্যক্তি লালাবাবু।

এই লালাবাবুর পিতৃদত্ত নাম হলো কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ। এই কৃষ্ণচন্দ্র ছোটবেলা থেকেই খুব ভক্তিমান ছিলেন। তাঁদের কূলদেবতা রাধাবল্লভের মন্দিরে গিয়ে তিনি প্রত্যহ ধ্যানজপ করতেন অল্প বয়স থেকেই।

অল্প বয়স থেকেই তাঁর দয়ালু স্বভাব ও সরলতার খ্যাতি আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। একদিন রাজবাড়ির কাছে কন্যাদায়গ্রস্ত একজন ব্রাহ্মণ এসে তাঁর কাছে হাজার টাকা ভিক্ষা চায়। যুবরাজ কৃষ্ণচন্দ্র কোষাধ্যক্ষকে গিয়ে বললেন, সেই টাকা দিয়ে দিতে। কিন্তু কোষাধ্যক্ষ এত বিপুল পরিমাণ টাকা দিতে ইতস্তত করে। তখন সস্তার বাজার।

টাকায় কুড়ি কেজি চাল পাওয়া যেত। কোষাধ্যক্ষ রাজা প্রাণকৃষ্ণের (কৃষ্ণচন্দ্রের বাবা) কাছে গিয়ে অনুমতি চাইলো। প্রাণকৃষ্ণ পুত্রকে গিয়ে বললেন – ‘আগে নিজে রোজগার করো। নিজের রোজগার থেকে দানছত্র করো। রাজকোষের টাকা এভাবে অপব্যয় করা যাবে না’।

এই ঘটনায় যুবক কৃষ্ণচন্দ্র প্রচণ্ড অভিমানাহত হন। পরদিন তিনি গৃহত্যাগ করে (১৭৯২ খ্রি) বর্ধমানে চলে যান। বর্ধমানে গিয়ে সম্যকভাবে পারসি ভাষা শিক্ষা করেন। তখন বর্ধমানের রাজপরিবারের আশ্রয়ে থেকে তিনি লেখাপড়া শিখে বর্ধমান জেলা আদালতের সেরেস্তাদারের চাকরি পান। সেখানে চাকরি করে বিশালাক্ষ্মীপুরের জমিদারী কেনেন।

পরে তিনি উড়িষ্যায় যান দেওয়ানের কাজ নিয়ে (১৮০৩ খ্রি) । এই সময়ে তিনি কয়েকটি পরগণার দায়িত্ব পান এবং বিপুল পরিমাণে অর্থ ও সম্পদের মালিক হন। ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাণকৃষ্ণ মারা যান। তারপর কৃষ্ণচন্দ্র কান্দিতে ফিরে আসেন। বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক রীতি মেনে পিতৃশ্রাদ্ধ করেন।

এর কয়েক বছর পরে তিনি রসোরার ঘোষ পরিবারের কন্যা কাত্যায়নীকে বিয়ে করেন। বাবার বিপুল সম্পত্তি ও নিজের কেনা জমিদারী নিয়ে তার মনে কোনো তৃপ্তি ছিল না। তার মন ধীরে ধীরে বৈরাগ্যের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এই সময় একদিন তিনি পালকি করে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ পথিমধ্যে একটি সুমধুর গান শোনেন। চলন্ত পথে গানের একটি কলি তাঁর মনে খুব প্রভাব বিস্তার করে।

তারপরে পারিবারিক উকিল কলকাতার চোরাগানের নীলমণি বসুর হাতে নাবালক পুত্র ও সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনার ভার দিয়ে তিনি বৃন্দাবন যাত্রা করেন। সঙ্গে নিয়ে যান প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা। পথিমধ্যে সেই টাকার কিছু অংশ চুরি হয়ে যায়। কিছুদিন কৃষ্ণের লীলাভূমিতে থাকতে থাকতে তাঁর মনে প্রবল বৈরাগ্য উপস্থিত হয়।

পালকি থেকে নেমে দেখেন — তাদেরই প্রজা একজন ধোপার মেয়ে একটি গান গাইছে – ‘বেলা যে যায়, জলকে চল’। কারও মতে গানের কলিটি ছিল – ‘বেলা যে যায় বাসনা কখন জ্বালাবে !’

ধোপারা কাপড় রঙ করবার জন্যে কলাগাছের পাতার গোড়ার অংশ বা বাস্‌না জলে সেদ্ধ করে। একে ‘বাস্‌না জ্বালানো’ বলা হয়। কৃষ্ণচন্দ্র বাস্‌না কথার অর্থ করলেন — বাসনা বা কামনা, আকাঙ্ক্ষা।

তিনি ভাবলেন — বাসনা তো ত্যাগ করা গেল না। সংসারে শুধুই বন্ধন আর বাসনার বেড়ি চারদিকে। অহরহ সেই বাসনার রজ্জুতে আবদ্ধ হতে হচ্ছে তাকে। সেই পরমপুরুষের সন্ধান তো পাওয়া গেল না।

তারপরে পারিবারিক উকিল কলকাতার চোরাগানের নীলমণি বসুর হাতে নাবালক পুত্র ও সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনার ভার দিয়ে তিনি বৃন্দাবন যাত্রা করেন। সঙ্গে নিয়ে যান প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা। পথিমধ্যে সেই টাকার কিছু অংশ চুরি হয়ে যায়। কিছুদিন কৃষ্ণের লীলাভূমিতে থাকতে থাকতে তাঁর মনে প্রবল বৈরাগ্য উপস্থিত হয়।

এই সময় বৃন্দাবনের একটি এলাকা সরকারের নিলামে ওঠে। স্থানীয় শেঠরা সেই সম্পত্তি নিলামে ডেকে অধিকার করে। তিনি তাঁর বালিশের মধ্যে লুকানো বেশি মূল্যের একটি আঙ্‌টি দিয়ে সেই সম্পত্তি কিনে নেন। গড়ে তোলেন বিশাল মন্দির। তার চারপাশে অপরূপ ফুলের বাগান। তখন তার দীক্ষাগ্রহণের বাসনা জাগে মনে।

স্থানীয় বৈষ্ণবগুরু কৃষ্ণদাসের কাছে যান। কিন্তু তিনি বলেন – ‘তোমার এখনো সময় হয়নি’। কবি কালিদাস রায়ের ভাষায় –

‘লালাবাবু বৈরাগী গুরুকরণের লাগি
সারা পথ ভরি ভেট উপহার পুঞ্জ।
বাবাজি কৃষ্ণদাস যেখানে করেন বাস
একদা এলেন সেই নিভৃত নিকুঞ্জে’।

এরপর কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ সকল টাকাকড়ি বৃন্দাবনের পথে বিলি করে দেন। যাকে পান তাকেই কৃষ্ণকথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কৃষ্ণদাস বলেন – ‘এখনও সেই লগ্ন আসেনি’। এবার তিনি বৃন্দাবনের পথে পথে ভিক্ষা করতে থাকেন। মাধুকরী থেকে পাওয়া অন্ন ভোজন করেন তিনি। কিন্তু ‘অহং’ যায় না। রূপের, রাজত্বের, সম্পদের অহমিকা তাকে ছাড়ে না।

একদিন বৃন্দাবনের পথে মাধুকরী করতে গিয়ে দীর্ঘদিনের শত্রু, প্রতিযোগী শেঠদের বাড়ির সামনে উপস্থিত হন। ভাবেন এই ‘অহমিকা’ তো এখনও যায় নি। এদের বাড়িতে তো ভিক্ষা করা হয় নি।

কবি কালিদাসের ভাষায় –

‘এত ভাবি একেবারে শেঠের তোরণ দ্বারে
হাঁকিলেন লালাবাবু শ্রীরাধে গোবিন্দ
শেঠেদের ঘরে ঘরে সে ধ্বনি সাড়া পড়ে
ছুটে আসে পরিচর পরিজন বৃন্দ’।

এতদিন উভয়ে উভয়ের শত্রু ছিল কিন্তু উভয়েই ছিল কৃষ্ণভক্ত। আগে ঐশ্বর্য্যের প্রতিযোগিতায় কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে হেরে গিয়েছে জগত শেঠ। আজ অন্যভাবে মিলন হলো দুজনে—

‘শেঠ কয় জুড়ি পাণি আজ পরাজয় মানি
ইহলোকে পরলোকে জিতে গেলে বৈরি’।

তার কিছুদিন পরে গুরু কৃষ্ণদাস এসে হাজির হলেন কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। বললেন –‘এবার তোমার সময় হয়েছে দীক্ষার। তোমার সকল বাসনা পুড়ে তুমি এখন পরম বৈষ্ণব’।

এরপর তাঁর নাম হলো লালাজি। যারা আগে থেকে তাকে বাবু বলে ডাকতো, এখন তারা বললো লালাবাবু। চারদিকে তখন তার নাম প্রচারিত হলো। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা তাকে দশজন প্রধান বৈষ্ণব তালিকায় স্থান দেন। তাঁর জন্মভূমি কান্দি পর্যন্ত সেই ‘লালাবাবু’ নাম প্রচারিত হয়। এখন সকলেই তার আসল নাম ভুলে গিয়েছে। লোকে তাকে লালাবাবু বলে। সাধারণে বলে-

‘বাবু তো লালা/ আর সব—’

লালাবাবু মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর অনুরাগী ছিলেন গোয়ালিয়রের রানী। তাঁর অজান্তে তাঁরই ঘোড়ার পায়ের আঘাতে বৃন্দাবনের পথে লালাবাবুর অকালমৃত্যু হয়। তখন তাঁর ছেলে শ্রী নারায়ণ সিংহ নাবালক। তাঁর স্ত্রী কাত্যায়নী বিদূষী ও ভক্তিমতি নারী ছিলেন।

তিনি এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাদীক্ষা, উন্নয়নের জন্যে প্রায় ষোল লক্ষ টাকা দান করেছিলেন। প্রত্যেক বছর তিনি ‘অন্নমেরু’ উৎসব করতেন। এই উৎসবে এলাকার সকল মানুষ কয়েকদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া করত। অন্যান্য অতিথিরা বিভিন্ন দান গ্রহণ করত। ১৮৬২ খ্রিষ্ঠাব্দে তিনিও মারা যান।

………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!