তার পরদিনই এলাহাবাদ পরিত্যাগ করে কাশীর ট্রেন ধরলাম। গুরুদেবের বাড়ি পৌঁছেই আমি কুম্ভমেলার সেই অপূর্ব সাধুটির সমস্ত বিবরণ তাঁর কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।
শুনে লাহিড়ী মহাশয়ের চোখ দুটি আনন্দে নেচে উঠল, বলে উঠলেন, আরে তাঁকে চিনতে পারলে না- ওঃ, দেখছি যে তা তো তুমি পারবে না কারণ তিনি ইচ্ছা করেই ধরা দেন নি। তিনিই হচ্ছেন আমার অদ্বিতীয় গুরুদেব- পরম ভাগবত বাবাজী মহারাজ!
স্তম্ভিত হয়ে বললাম- বাবাজী! বলেন কি গুরুদেব, যোগিশ্রেষ্ঠ বাবাজী, আমাদের পতিতপাবন বাবাজী মহারাজ!- যিনি কখনও দৃশ্য কখনও অদৃশ্য! হায় হায়, একবার যদি সে দিন আজ ফিরে আসে আর তাঁর দর্শন পাই, তাহলে তাঁর চরণকমলে ভক্তি নিবেদন করে যে একেবারে ধন্য হয়ে যাই!
লাহিড়ী মহাশয় সান্তনা দিয়ে বললেন, যাক, কিচ্ছু ভেবো না- তিনি তো তোমায় দেখা দেবেন প্রতিজ্ঞা করেছেন, তবে আর ভাবনা কি?
তারপর বললাম, গুরুদেব! বাবাজী মহারাজ আপনাকে একটি খবর দিতে বলেছেন। তিনি বললেন, লাহিড়ীকে বোলো যে এ জীবনের সঞ্চিত শক্তি সব ফুরিয়ে আসছে- প্রায় শেষ হয়ে এল বলে!
মাঝে মাঝে তাঁরা কোন লোক মারফৎ অত্যন্ত সাধারনভাবে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রেরণ করেন, যাতে করে ভবিষ্যতে তাঁদের কথাগুলি ফলে গেলে পর, ঘটনাগুলো যারা শুনবে তাদের দৈবে আরও প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মায়।
এই রহস্যময় কথাগুলো উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই লাহিড়ী মহাশয়ের দেহ থর থর করে কাঁপতে লাগল- যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ স্পর্শ করেছে। মুহূর্ত মধ্যে তাঁর চারিদিকে সবকিছু একেবারে নীরব হয়ে গেল, তাঁর সদাহাস্যময় আনন অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন হয়ে উঠল।
আসনের উপর কাঠের মূর্তির মত গম্ভীর আর নিশ্চল তাঁর দেহ একেবারে বর্ণহীন হয়ে পড়ল। দেখে শুনে ভয় পেয়ে গিয়ে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেল। এমন সদানন্দময় পুরুষের এমন ভীতিপ্রদ গাম্ভীর্য আমি জীবনে আর কখনও দেখি নি। উপস্থিত অন্যান্য শিষ্যেরাও ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল।
গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে তিন ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর লাহিড়ী মহাশয় পুনরায় তাঁর স্বাভাবিক প্রফুল্লভাব ধারণ করলেন, প্রত্যেক চেলার সঙ্গেই সস্নেহে কথাবার্তা কইতে লাগলেন। সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।
গুরুদেবের এই প্রতিক্রিয়াতে আমি বুঝতে পারলাম যে, বাবাজী মহারাজের সংবাদে এমন একটা নিশ্চিত ইঙ্গিত ছিল যাতে করে লাহিড়ী মহাশয় টের পেয়েছিলেন যে তাঁকে শীঘ্রই দেহরক্ষা করতে হবে।
তাঁর ভয়ঙ্কর গাম্ভীর্যে প্রমাণিত হল যে আমাদের গুরুদেব তৎক্ষণাৎ সঙ্গে সঙ্গে আত্মসংযম করে এখানকার পার্থিব আকর্ষণের শেষ বন্ধনটুকু ছিন্ন করে সেই পরমপুরুষের অনন্তসত্তার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তিনি যেমন বলে থাকেন, বাবাজীর উক্তিতে সেটাই ছিল, আমি তোমার সঙ্গে সর্বদাই থাকব।
যদিও বাবাজী আর লাহিড়ী মহাশয় উভয়েই সর্বজ্ঞ, আর আমার বা অন্য কোনও মধ্যস্থের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করবার তাঁদের কোন আবশ্যকতাও ছিল না, তবুও এই সব বড় বড় মহাগুরুগণ প্রায়ই এই সংসারের নাট্যাভিনয়ে সাধারণ মানবচরিত্রের অংশই গ্রহণ করে থাকেন।
মাঝে মাঝে তাঁরা কোন লোক মারফৎ অত্যন্ত সাধারনভাবে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রেরণ করেন, যাতে করে ভবিষ্যতে তাঁদের কথাগুলি ফলে গেলে পর, ঘটনাগুলো যারা শুনবে তাদের দৈবে আরও প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মায়।
কি আর করি, অগত্যা আর কোন উপায় না দেখে কাতর নয়নে তাঁকে নিবেদন করলাম, পরমগুরু মহারাজ, দয়া করে এখানে একটু অপেক্ষা করুন, কিছু ভাল মিষ্টি নিয়ে আমি এখুনিই ফিরে আসছি!
শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী বলে যেতে লাগলেন, কাশী ছেড়ে শীগগিরই শ্রীরামপুরে ফিরলাম, বাবাজীর অনুরোধে শাস্ত্র সম্বন্ধে লেখা শুরু করবার জন্যে। লেখা শুরু করবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই অমরগুরুর নামে এক কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম।
কলমের মুখ দিয়ে বিনাপ্রয়াসেই শ্রুতিমধুর পদগুলি বেরিয়ে এসে একটি সুন্দর কবিতা রচিত হয়ে গেল- আশ্চর্যের বিষয় এই যে এর পূর্বে আমি সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করবার জন্যে কখন চেষ্টা পর্যন্তও করি নি।
নীরব নিশীথে, বাইবেল আর সনাতন ধর্মশাস্ত্রের তুলনামূলক বিচার আরম্ভ করলাম। প্রভু যীশুখ্রিষ্টের বাণী উদ্ধৃত করে দেখালাম যে, বেদের অন্তর্নিহিত সত্যের সঙ্গে তাঁর শিক্ষা মূলতঃ এক। আমার পরমগুরুর কৃপাতেই আমার বই দি হোলি সায়েন্স-এর রচনা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
গুরুদেব বলতে থাকেন, লেখা শেষ হবার পরদিন সকালে এখানকার রায়ঘাটে গেলাম গঙ্গাস্নান করতে। ঘাটে তখন কেউ ছিল না; খানিকক্ষণ চুপচাপ রোদে দাঁড়িয়ে একটু আরাম উপভোগ করলাম। তারপর জলে গোটাকতক ডুব দিয়ে বাড়িমুখো হলাম।
পথঘাট জনহীন, কোন সাড়াশব্দ নেই। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে একমাত্র শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে আমার গঙ্গা নাওয়া ভিজে কাপড়ের শপশপ শব্দ। গঙ্গার তীরে একটা খুব বড় বটগাছ ছিল; সে জায়গাটা পেরিয়ে আসতেই মনে কেমন যেন একটা প্রবল ইচ্ছার উদয় হল- পিছন ফিরে একবার তাকাই। ফিরে দেখি- সেই প্রকাণ্ড বটগাছের ছায়ায় বসে বাবাজী মহারাজ, আর তাঁকে ঘিরে বসে তাঁর গুটিকতক শিষ্য!
স্বাগত, স্বামীজী! মহাগুরুর মধুর কণ্ঠস্বর কর্ণে প্রবেশ করতে নিশ্চিত হলাম যে সত্যি সত্যি আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না। বাবাজী মহারাজ বলতে লাগলেন, দেখছি যে ভালভাবেই বইখানি লেখা শেষ হয়েছে- যাক, কথা দিয়েছিলাম যে আসব, তাই আজ এসেছি তোমায় ধন্যবাদ দিতে।
দ্রুতস্পন্দিতহৃদয়ে, তাঁর চরণতলে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে করজোড়ে নিবেদন করলাম, পরমগুরুজী, এই কাছেই আমার বাড়ি; আপনি আর আপনার চেলারা দয়া করে সেখানে একটু পায়ের ধূলো দিয়ে কি আমায় কৃতার্থ করবেন না?
মহানগুরু মৃদুহাস্যে তা প্রত্যাখ্যান করলেন, না বাছা! আমাদের এই গাছতলাটুকুই ভাল; কেন, এ জায়গা তো বেশ আরামের- কোনই কষ্ট নেই।
কি আর করি, অগত্যা আর কোন উপায় না দেখে কাতর নয়নে তাঁকে নিবেদন করলাম, পরমগুরু মহারাজ, দয়া করে এখানে একটু অপেক্ষা করুন, কিছু ভাল মিষ্টি নিয়ে আমি এখুনিই ফিরে আসছি!
বাবাজী অতি স্নিগ্ধ মধুর হেসে বললেন, আমি শুধু বলেছিলাম যে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব- কিন্তু কতক্ষণ ধরে থাকব, তা’ তো আমি কিছুই বলিনি। তুমি তখন খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলে। তবে আমি একথা বলব যে তোমার চঞ্চলতার দাপটে আমি প্রায় শূন্যেই মিলিয়ে গিয়েছিলাম আর কি!
মিনিটকতক বাদেই আমি কিছু মিষ্টি নিয়ে ফিরে এলাম। এসে দেখি, কি আশ্চর্য! সেই বিরাট গাছতলায় বাবাজী বা তাঁর দলবলের চিহ্নমাত্রও নাই! ঘাটের চারিদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম- নাঃ, কোথাও আর তাঁদের দেখতে পেলাম না, মনে মনে বুঝলাম যে তাঁরা শূন্যে অদৃশ্য হয়েছেন!
অন্তরে গভীর আঘাত পেলাম। মনে মনে বললাম, যাক, আবার আমাদের দেখা হলে তাঁর সঙ্গে কথাই বলব না! নিতান্তই নিষ্ঠুর তিনি, এমনভাবে হঠাৎ চলে যাওয়ার মানে কি? অবিশ্যি এটা অভিমানের রাগ, তার বেশি আর কিছু নয়।
মাস কতক বাদে কাশীতে লাহিড়ী মহাশয়কে দর্শন করতে গেলাম। ছোট্ট বৈঠকখানাটিতে ঢুকতেই গুরুদেব একটু হেসে আমায় বললেন- এসো এসো যুক্তেশ্বর! আচ্ছা আসবার সময় কি তুমি ঘরের দোরগোড়ায় বাবাজী মহারাজকে দেখতে পেলে?
আশ্চর্য হয়ে বললাম, কই, না তো!
আচ্ছা, তাহলে কাছে এসো, বলে লাহিড়ী মহাশয় আমার কপালের মাঝখানে হাত দিয়ে মৃদুস্পর্শ করলেন; সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাবাজীর জীবন্তমূর্তি- একটি পরিপূর্ণ শতদলের মতই প্রস্ফুটিত।
আমার সেই পুরানো আঘাতের কথা মনে পড়ল। প্রণাম করলাম না। লাহিড়ী মহাশয় অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বাবাজী মহারাজ তাঁর অতল স্নেহকোমল চোখ দুটি আমার ওপর স্থাপন করে বললেন, তুমি আমার উপর বড়ই বিরক্ত হয়েছ, তাই না?
আমি বললাম, কেনই বা হব না বলুন! আপনার ভোজবাজির দলবল নিয়ে আপনি শূন্য থেকে উড়ে এলেন আবার সেই শূন্যেতেই মিলিয়ে গেলেন!
বাবাজী অতি স্নিগ্ধ মধুর হেসে বললেন, আমি শুধু বলেছিলাম যে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব- কিন্তু কতক্ষণ ধরে থাকব, তা’ তো আমি কিছুই বলিনি। তুমি তখন খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলে। তবে আমি একথা বলব যে তোমার চঞ্চলতার দাপটে আমি প্রায় শূন্যেই মিলিয়ে গিয়েছিলাম আর কি!
এই সরল উত্তরে আমার মনের সকল ক্ষোভ তৎক্ষণাৎ দূর হয়ে গেল। তাঁর চরণতলে নতজানু হয়ে বসলাম; বাবাজী মহারাজ সস্নেহে আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
তারপর বাবাজী আমায় বললেন, বাবা, আরও ধ্যান কর, আরও ধ্যান কর- তোমার দৃষ্টি এখনও বেশ নির্দোষ হয় নি; সূর্যের আলোর পিছনে যে আমি লুকিয়ে আছি, তা’ তো তুমি আমায় দেখে বার করতে পারলে না।
স্বর্গীয় মধুর বংশীধ্বনির মত এই কথাগুলো বলেই বাবাজী মহারাজ অনন্ত জ্যোতিঃর মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন।
…………………………
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে : ভারতের সাধক-সাধিকা
যোগী-কথামৃত (Autobiography of a Yogi) শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত।
মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই।- পরমহংস যোগানন্দ
পুণঃপ্রচারে বিনীত- প্রণয় সেন
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………
আরও পড়ুন-
যোগীবর শ্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়
মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী
ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কিছু কথা
গাঁধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি
তারা মায়ের আদরের দুলাল ‘বামাক্ষেপা’
মহর্ষি মহেশ যোগীর কথা
স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরের দর্শনলাভ : যোগী-কথামৃত থেকে
‘বাবাজী’ আধুনিক ভারতের মহাযোগী
বিনিদ্র সাধু
রামদাস বাবাজী
সীতারাম
তারাপীঠের ‘বামদেব’
বহুবর্ষজীবি শ্রীশ্রী বরফানী দাদাজি
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: এক
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: এক
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: তিন