ভবঘুরেকথা
লালন বলে কুল পাবি না

লালন বলে কুল পাবি না : পর্ব ছয়

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

-জীবন দা’ আরেকটা প্রশ্ন করবো?

-করেন।

-আপনি গাঁজা খান?

-না বাপ!

-কেনো? লালন সাধক সবাই তো খায় দেখি।

-বাপ! যে খায়া সাধন করতে পারে সে খায়। যে না খায়া সাধন করতে পারে না সেও খায়। আর বাকিরা না বুঝেই খায়। সেটা ঠিক না।

-তারমানে আপনি গাঁজা খাওয়া সমর্থন করেন?

-বাপ! আমি, সমর্থন করা না করার কেউ না। আপনি জীবন চালাতে বা সাধনায় কোন কোন উপকরণ ব্যবহার করবেন সেটা আপনার বিবেচনা। তবে যাই করবেন তা সচেতনভাবে করতে হবে। কেনো করছেন তা জানতে হবে। বুঝতে হবে।

উপলব্ধি করতে হয়। অন্যে করছে তাই আপনি করছেন এটা ঠিক না। আর গাঁজা খাওয়া না খাওয়া দিয়ে তো আর কারো ভালোমন্দ বিবেচনা করা যায় না।

যদি যাইত তাইলে বলা যাইত দুনিয়ায় যারা গাঁজা খায় না তারা সবাই ভালো মানুষ। তা কিন্তু না বাপ। ধরেন আপনি সিগারেট খান তাই আপনার কাছে এটা খারাপ না। কিন্তু যে খায় না তার কাছে কিন্তু এটা চরম খারাপ। এখন যদি বলা হয় যারা সিগারেট খায় তারা সকলেই খারাপ তাহালে কি সেটা বিবেচনার কথা হইলো?

আবার ধরেন আপনার মা বা বাবা পান খায়, আয়েশ কইরাই খায়। কিন্তু যারা পান খায় না তারা যদি বলে আপনার মা বা বাবা ভালো না তাহলে কি সেটা ঠিক হইল?

যেখানে কোনো কিছু নিষিদ্ধ করা হয় সেখানে তার চাহিদা বেড়ে যায়। জ্ঞানচর্চায় কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকতে নেই। সব পথ মুক্ত রাখতে হয়। যিনি জ্ঞানের পথে যাত্রা করেন তিনি জ্ঞানের সন্ধান পান। তিনিই দিব্য জ্ঞানী হন। আর অন্ধকার থেকেই তো আলোর আবিষ্কার করতে হয়। আলোতে আলো খুঁজে লাভ কি?

-কিন্তু গাঁজা তো একটা নেশা। আপনি শুদ্ধতার চর্চা করেন বললেন আবার নেশাকে সমর্থন করছেন এই দ্বৈত আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করবেন কি।

-বাপ! আমি কখনো বলি নাই গাঁজা ভালো। আর সাধনার জন্য এটা অতিঅবশ্যই দরকার তাও বলি নাই। সাধনার সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তাও বলি নাই। আর লালন সাধনার সাথে এর কি সম্পর্ক তাতেও কোনো মন্তব্য করি নাই।

আসলে ঘটনা কি বাপ জানেন যে যা খুঁজতে যায় সে তাই পায়। যারা গাঁজা নিয়ে বেশি নিন্দা করে বেড়ায় তারা নিজেরাই বেশিভাগ ক্ষেত্রে গাঁজায় আসক্ত; নইলে গাঁজা খেতে চায় কিন্তু পারে না বা পায় না।

একটা বাজারে বহু জিনিস বিক্রি হয়। যার যা দরকার সে সেই জায়গায় যায়। তা খুঁজে বের করে তাই কিনে ফিরে আসে। যিনি সবজি কিনতে যায় তিনি মাছের বাজারে ভিড় করে না। আবার যিনি ফল কিনতে যায় তিনি মাংসের দোকানে ভিড় করে না।

তাই যারা বলে বেড়ায় লালন মানেই গাঁজা তারা আসলে লালনকে না, লালনের দর্শনকে না, লালনের জ্ঞানকে না, তারা প্রকৃতপক্ষে খুঁজতে যায় গাঁজাকেই, তাই তারা তাই পায়। তিনি অসীম দয়ালু যে যা খোঁজ করে তিনি তাকে তাই দর্শন করান। তাই গাঁজা বা জ্ঞান কোনোটার দোষ বা গুণ খুঁজে লাভ নেই।

ভালো বা মন্দ খুঁজে লাভ নেই। আপনার কোনটা দরকার সেটা নির্ধারণ করেন। সেটা নিয়ে ভাবেন। অন্যে কি করলো সেটা ভাববার কাজ তো আপনার না। আপনার খাইতে স্বাদ হয় বইলাই আপনি তা খুঁজে বেড়ান বাপ। এতে লালন বা মহতের দোষ দেয়া অপরাধ।

-আপনি যাই বলেন এসব বন্ধ হওয়া উচিত। যেখানে শুদ্ধতার চর্চা হবে সেখানে এসব কি ঠিক আপনিই বলেন?

-বাপ! যেখানে কোনো কিছু নিষিদ্ধ করা হয় সেখানে তার চাহিদা বেড়ে যায়। জ্ঞানচর্চায় কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকতে নেই। সব পথ মুক্ত রাখতে হয়। যিনি জ্ঞানের পথে যাত্রা করেন তিনি জ্ঞানের সন্ধান পান। তিনিই দিব্য জ্ঞানী হন। আর অন্ধকার থেকেই তো আলোর আবিষ্কার করতে হয়। আলোতে আলো খুঁজে লাভ কি?

-আচ্ছা বুঝলাম আপনার কথা। তা লালন ফকির কি গাঁজা খেতেন?

-লালন ফকির গাঁজা খেতেন নাকি খেতেন না সে প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানা নাই বাপ। আর গাঁজা তো নিষিদ্ধ বন্তু না। নব্বইয়ের দশকে যখন বিদেশী মাদক দেশে ঢুকানো প্রয়োজন হয়ে পরেছিল তখন দেশী সস্তা দরের গাঁজা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। 

ফলে দেশের মানুষ আর্ন্তজাতিক মাদকের ফাঁদে পরেছে এই আর কি। এটাকে যদি আপনি সভ্যতার যাত্রা বলেন তাহলে আর কি বলার আছে।

-আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেনো সরাসরি বলেন। হ্যা বা না?

-বাপ! আপনি তো জানতে চান না। আপনি চান আপনি যা ভাবছেন তা আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে। তাই যদি হয় আপনি বলেন কি বললে আপনি খুশি হবেন। আমি তাই বলে দেই।

-মানে?

-মানে আর কি বাপ। খুনের শাস্তি ফাঁসি এখনো আমাদের দেশে বলবদ আছে; সেটা তো সত্য তাই না? তাই বলে খুন কলেই কি ফাঁসি হয়? হয় না বাপ। কোন ঘটনায় খুন হইছে-কে খুন করছে-কাকে খুন করেছে-কেনো খুন করেছে সকল ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে তারপর বিচারক শাস্তি ঘোষণা করেন।

তাই সরাসরি উত্তর বলে আসলে সত্য পৌঁছানো যায় না। সত্য বুঝতে হইলে দেশ-কাল-পাত্র জানতে হয়। সাঁইজির একটা জ্ঞান আছে বাপ একটু মনোযোগ দিয়ে শুনেন-

পাপ পুণ্যের কথা আমি
কারে বা শুধাই,
এই দেশে যা পাপ গণ্য
অন্য দেশে পুণ্য তাই।।

তিব্বত নিয়ম অনুসারে
এক নারী বহু পতি ধরে,
এই দেশে তা হলে পরে
ব্যাভিচারী দণ্ড হয়।।

শূকর গরু দুইটি পশু
খাইতে বলেছেন যিশু,
শুনে কেন মুসলমান হিন্দু
পিছেতে হটায়।।

দেশ সমস্যা অনুসারে
ভিন্ন বিধান হতে পারে,
সূক্ষ্মজ্ঞানে বিচার করলে
পাপ পুণ্যের আর নাই বালাই।।

পাপ করলে ভবে আসি
পুণ্য হলে স্বর্গবাসী,
লালন বলে নামে উর্বশী
নিত্য নিত্য প্রমাণ পাই।।

-হুমম এক দেশে যা পাপ অন্য দেশে তা পূণ্য কথাটা সত্য। ঠাণ্ডার দেশে মদ খাওয়াটা নেশা বা ফ্যাশন নয়। যদিও আমরা ভাবি সে দেশে সবাই সারাদিন মদ খায় তাও নয়। কিন্তু সেখানে সেটা প্রয়োজন। আর আইনও তাতে কোনো বাঁধা নয়। কেনিয়ার রাস্তার পাশে এমন সব দোকান দেখেছিলাম সেখানে দুর্লভ দুর্লভ বন্য প্রাণী খাঁচা বন্দি করে রাখা।

মানুষজন যেটা পছন্দ করে; তাই তৎক্ষণাৎ গরম তেলে ভেজে খেতে দেয়া হয়। পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে এটা মারাত্মক অপরাধ। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া সম্ভব। আপনার কথা গ্রহণযোগ্য। আচ্ছা তাহলে বলেন আপনি কেনো গাঁজা খান না?

-আমার গুরু খেতেন না। তাই আমিও খাই না বাপ।

-তারমানে গুরু খেলে আপনি খাইতেন।

-গুরুকে অনুসরণ করাই শিষ্যের কর্ম বাপ।

-তারমানে গুরু খারাপ কাজ করলেও তাকে অনুসরণ করা লাগবে?

-বাপ! সদগুরু কখনো এমন কাজ করে না যাতে শিষ্য শুদ্ধ জ্ঞান প্রাপ্ত হবে না। গুরু শিষ্যকে পরীক্ষার মাঝে রাখে। দেখে শিষ্য কি গ্রহণ করে- জ্ঞান না অজ্ঞান। যে জ্ঞান গ্রহণ করতে পারে ব্যক্তি-বস্তু-পরিস্থিতি থেকে। গুরু তাকেই শুদ্ধতার চূড়ান্ত শিক্ষা দেয়। আর যে অজ্ঞান গ্রহণ করে তার জন্য অন্য পরীক্ষা। তাকে জ্ঞান দিয়ে বোঝানো যাবে না। তাকে দিতে হবে কর্ম।

-তারমানে গুরু পক্ষপাতিত্ব করে শিষ্যদের সাথে?

-বিষয়টা পক্ষপাতিত্ব না। সকলের বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা বোধ সমান থাকে না। এক একজনের একএক ভাবে শিক্ষা দিতে হয়। যে জ্ঞানযোগে জ্ঞান নিতে পারে তার জন্য জ্ঞানযোগ। আর যে তা পারে না তারজন্য কর্মযোগ। আর ভক্তিযোগ তো সবক্ষেত্রেই লাগে।

-বাহ্! ভালো তো। তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন সবার জন্যই সুযোগ আছে?

-অবশ্যই আছে। যে রোগের যে অসুধ বাপ। সকলের জন্য এক পদ্ধতি না। এক কর্ম না। এই ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বাংলা বিষয় নিয়া যারা পড়াশুনা করে তারা কিন্তু সকলেই সাহিত্যক বা বাংলা ভাষা নিয়া কাজ করে না। কিন্তু যারা ডাক্তারি লাইনে পড়াশুনা করে আমরা ধরে নেই তারা সকলেই ডাক্তার হবে।

কিন্তু গুরু পাওয়া নিশ্চিয়ই সহজ নয়। আমর কন্যার জন্য একজন ভালো শিক্ষক খুঁজে পাচ্ছি না গত কয়েক বছর ধরে। প্রথমে ভালো লাগে কিন্তু কয়েকদিন পরেই বোঝা যায় কেবল টাকা কামানোর ধান্ধা মাত্র। আচ্ছা তাহলে আপনাদের লাইনে তো গুরুর সন্ধান পাওয়া আরো মুশকিল তাই না?

যেমন যে চিত্রকলা নিয়ে পড়াশুনা করছে তাকে চিত্রকরই হতে হবে এমন কিন্তু কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই সাধনায় গেলে সকলেই গুরু হবে তা কিন্তু নয়। সকলেই নির্বানের আশায় যায় না। সকলেই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না।

-তাহলে?

-যারা নিষ্কাম কর্মভাব নিয়ে যায়। মানে কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা যারা করে না তাদেরই প্রাপ্তিযোগ ঘটে।

-আপনি বরাবরের মতোই উলট-পালট করে দিলেন।

-গাছে যখন মুকুল আসে তখন তা পুরো গাছে ছেয়ে যায়। কিন্তু সবকয়টি মুকুলেই কি আর আম হয়? সবকয়টা ডিমেই কি আর বাচ্চা হয় বাপ? যেটা উপযুক্ত তাতেই ফল পাওয়া যায় বাপ। কুমার মাটি দিয়ে পাত্র বানায় কিন্তু সব পাত্র কি আর তৈরি হয়?

কিছু পাত্র সবঠিকঠাক থাকার পরও আগুনের দেয়ার পর ফেটে যায়। তাই না? সাধনার অনেকদূর এগিয়েও অনেকে লোভের বশে মুখ থুবড়ে পরে।

-তাহলে এ দোষ কার? গুরু সঠিক শিক্ষা দিতে পারে না? নাকি শিষ্য যথাযথভাবে শিক্ষা নিতে পারে না? কার দোষ?

-এখানে বাপ দোষ বিচার করা মুশকিল। তবে এটা ঠিক যে শিষ্য দেখেই গুরুর সাধনার স্তর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কারণ গুরুর গুণ নির্ণয় করা কেবল মুশকিল না প্রায় অসম্ভব কাজ বাপজি। শিষ্য দেখেই গুরুকে চিনতে হয়। সকল শিষ্য নির্বাণ পাবে এমন কথা নাই। সকল শিষ্য সিদ্ধি পাবে এমন কথাও নেই। কিন্তু তারা শুদ্ধতার দিকে স্থিরতার দিকে যাচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হয় বাপ।

ধরেন বড় মাপের কোনো গুরুর শিষ্যদের মাঝে যদি অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয় তাহলে গুরুর প্রতি আস্থা রাখা মুশকিল। তাই বলে গুরুকে দোষ দেয়া যাবে না বাপ। হয়তো তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। তা আপনি ধরতে পারছেন না। গুরুকে অসম্মান করার চিন্তাধারা সাধন পথে যারা থাকে বা যায় বা আসতে চায় তাদের করতে নেই।

কোন গুরু ভালো কোন গুরু খারাপ। কোন গুরুর চেয়ে কোন গুরু ভালো বা খারাপ তা বিবেচনা করা সাধকের কর্ম্ম নয়। সাধকের কাজ হলো নিজের মনের মতো গুরুর সন্ধান করা। অন্যের গুরুকে দেখে নিজের গুরুর সমালোচনা করা বা নিজের গুরুকে বড় করতে যেয়ে অন্যের গুরুকে নিচু করা বিবেচনার কথা না।

-কিন্তু গুরু পাওয়া নিশ্চিয়ই সহজ নয়। আমর কন্যার জন্য একজন ভালো শিক্ষক খুঁজে পাচ্ছি না গত কয়েক বছর ধরে। প্রথমে ভালো লাগে কিন্তু কয়েকদিন পরেই বোঝা যায় কেবল টাকা কামানোর ধান্ধা মাত্র। আচ্ছা তাহলে আপনাদের লাইনে তো গুরুর সন্ধান পাওয়া আরো মুশকিল তাই না?

-বাপ! কিছু না বুঝে যারা সারাজীবন গুরু খুঁজে বেড়ায় তারা গোলে পরে থাকে। গুরুর খোঁজ করে পাওয়া যায় না। নিজে তৈরি হলে গুরু আপনাআপনি মেলে।

-মানে কি? আপনাআপনি মেলে?

-জ্বি বাপ! নিজেকে তৈরি করতে হয়। মনে গুরু খোঁজার কামনা থাকতে পারে কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে সারাজীবন কাটায়া দেয়ার চেয়ে নিজেকে প্রস্তুত সঠিক সিদ্ধান্ত।

-নাহ্! জীবন দা’ মাথা কাজ করতেছে না বিকেলও হতে চলল চলেন চায়ের দোকানে যাই পরপর দুইকাপ চা খাবো সিগারেট খাবো তারপর বাড়ির দিকে যাওয়া যায় কিনা ভাবতে হবে। চলেন।

-চলেন বাপ!

রাস্তার জ্যাম আরো বেড়েছে বলেই মনে হলো অগ্নির। ফোনটা অন করে কয়েকটা ফোন সেরে জীবন দা’র মুখোমুখি চায়ের ধোয়া উঠা কাচের কাপটা নিয়ে বসল অগ্নি।

-একটা প্রশ্ন ছিল জীবন দা’ করবো?

জীবন দা’ হাসি দিয়ে সম্মতি দিলো।

-নিজেকে বা নিজের চিন্তাকে কি চাইলে পুরোপুরি শুদ্ধ করা যায়? যদি করা যায় তাহলে কি প্রকৃয়ায় করা যায়? বলবেন কি?

-করা যায় একথা তো সত্য বাপ। দেখেন ডাকু রত্নাকর কিন্তু ঋষি বাল্মিকী হয়েছিল। বাটপার নিজামুদ্দীন আউলিয়া হয়েছিল। এই রকম উদাহরণের শেষ নাই। খুঁজলে হয়তো তালিকা বড় হইবো। কিন্তু আপনি বলবেন এতো ২/১টা ঘটনা; তা ব্যতিক্রম আর ব্যতিক্রমকে ধরা ঠিক না তাই না?

কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্যতিক্রম প্রমাণ করে এরকমও হতে পারে। ব্যতিক্রম আসলে আমাদের সাহস সঞ্চার করে প্রচলিত ধ্যান-ধারনাকে প্রশ্ন করে। কিন্তু যারা সব কিছুকে সংখ্যায় গুণে তারা বলে বলে প্রমাণ করে দিয়েছে যে ব্যতিক্রম কোনো ঘটনাই না। কিন্তু একটু খেলায় করলে দেখবেন পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে কিন্তু ব্যতিক্রম মানুষরাই।

যারা নয়টা পাঁচটা অফিস করে সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা মেনে মেনে জীবন কাটায়। তারা পৃথিবীর জন্য ধারিত্রীর জন্য কেবল শ্রমিক মাত্র। ধারিত্রীর বা ব্রহ্মাণ্ডরে বিকাশে তাদের ভূমিকা কিন্তু সেই অর্থে নেই। যদিও প্রত্যেকেই প্রয়োজনীয়। তাই ব্যতিক্রমকে বাদ দেয়া ঠিক না।

হিসাব কইরা দেখেন লালন ফকির তো একজনই। হাসন রাজা, জালালুদ্দিন খাঁ, শাহ্ আব্দুল করিম, জালালুদ্দিন রুমি, সক্রেটিস এইরকম গুটিকয়েক মানুষই কিন্তু পুরো লোক ধারাটা আমাদের কাছে ভিন্ন জীবন দর্শন দিয়ে উপস্থাপন করেছে।

এই তালিকা করতে গেলে আরো অনেক অনেক নাম আসবে তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু দেখবেন যারাই আছে তালিকায় তারা ব্যতিক্রম মানুষ। এক হিটলার, একজন গ্যালেলিও, একজন আইননিস্টাইন, একজন নিউটন, একজন ভিঞ্চি, একজন ভ্যানগগ, একজন শেক্সপিয়ার তারাই কিন্তু ইতিহাস পাল্টেছে। এই তালিকাও দীর্ঘ কিন্তু মানুষের সংখ্যার বিচারে তা কত শতাংশ বাপ?

-দূর! আপনি একটা অসহ্য। কোনো চিন্তা ঠিক দাঁড়াতে দেন না। আমি ভাবি এক ভাবে আর আপনি বলেন আরেক দিক থেকে। একটু সহজ করে বলেন না কি করে শুরু করা যায়?

-বাপ! শুরুর পদ্ধতি বা কার্যক্রম বড় কথা না আগে। প্রথম কথা হইল আপনি সত্য সত্য করতে চান কিনা। যদি চান তাহলে কেন চান? এই চাওয়া যদি পাওয়া হয় তাহলে আপনি কি করবেন? আপনার এই জ্ঞান জানার উদ্দেশ্য কি? এসব সবকিছু আগে আপনার পরিষ্কার হতে হবে। নাইলে হতাশা বাড়বে। একুলও থাকবে ঐকুলও থাকবে না বাপ।

-হুমম। তাহলে আরেকটা প্রশ্ন করি। যদি আমি সিদ্ধান্ত নেই যে আমি জানতে চাই। তাহলে কি আপনি আমাকে জানাবেন?

-বাপ এই জ্ঞান তো আমি আবিস্কারও করি নাই তার সন্ধানও এখনো ঠিকঠাক মতো পাই নাই। এই নিয়া ব্যবসাও করি না। তাবিজ-কবজও বিক্রি করি না। গুরুর নির্দেশ আছে উপযুক্ত পাত্র না তৈরি করতে পারলে যাতে এই জ্ঞান দান না করি। তবে যদি উপযুক্ত পাত্র তৈরি হয় তাতে সেই জ্ঞান দিতে কোনো বাঁধা নাই। তবে সমস্যা কিছু থেকেই যায়।

-কি সমস্যা?

-আমিতো বায়াত বা দীক্ষা দেয়ার উপযুক্ত হই নাই। সাধারণ বিষয়গুলো আলোচনা করা যেতেই পারে। তা অবশ্যই একটা গণ্ডী পর্যন্ত। তবে এই জ্ঞান নেয়ার কিছু শর্ত আছে। এই যেমন এই জ্ঞান গবেষণাগারে প্রমাণিত জ্ঞান না। এই জ্ঞান হইল উপলব্ধির জ্ঞান।

গবেষণাগারে যেমন প্রমাণ করতে পারে আপনার হইয়া অন্যজন। কিন্তু এই জ্ঞান নিজেকেই সাধনার মাধ্যমে উপলব্ধিকে জাগ্রত করে নিজে নিজে প্রমাণ করতে হয়।

দুই জায়গাতেই প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। দুই জায়গাতেই কিছু বিষয়কে অংকের মতো এক্স-ওয়াই-জেড ধরে ধরে এগিয়ে যেতে হয়। তারপর মানতে হয় কিছু সূত্র-কিছু তত্ত্ব। সেই হিসেবে আগাতে হয়। সূত্র-তত্ত্ব মেনে এক্স-ওয়াই-জেড ধরে ধরে এগিয়ে গেলে একে একে উপলব্ধি দিয়ে সবই প্রমাণ পাওয়া যায় কিন্তু অধৈর্য হইলে সর্বনাশ।

তাই রাখতে হয় শ্রদ্ধা-ভক্তি। তবে এখানে কোনো অন্ধবিশ্বাস নাই; নাই কোনো কু-সংস্কার। মনে শ্রদ্ধা-ভক্তি রেখে এগিয়ে গেলে নিজেই উপলব্ধ করা যায় সব। তখনই জ্ঞানের উদয় হয়। এ অসম্ভব নয় সহজ পথ। কিন্তু সহজ জিনিস বুঝতে আমাদের সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয় এ কথা তো স্বীকার করবেন আপনি তাই না?

-বলতে থাকেন জীবন দা’ আমি শুনছি…

-শুনেছি তাজমহলের গায়ে লেখা আছে- ‘আগার ফেরদৌস বে-রোহী যামীন আস্ত্। হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্।’ মানে সম্ভবত ‘এ ধরার বুকে যদি থাকে বেহেশতের বাগান, এই সেই স্থান এই সেই স্থান এই সেই স্থান।’

আমি প্রথম যেদিন সাঁইজির মাজারে গিয়েছিলাম সেদিন আমার এই কথাটা মনে আসছিল। মনে হয়েছিল কত জনমের ভাগ্যে আমি তার সমাধি পর্যন্ত যাইতে পারছি। এক জনমের সুকীর্তি দিয়া কি আর তারা পাওয়া যায় বাপজি-

আমি ঐ চরণে দাসের যোগ্য নই।
নইলে মোর দশা কি এমন হয়।।

ভাব জানিনে প্রেম জানিনে
দাসী হতে চাই চরণে,
ভাব দিয়ে ভাব নিলে মনে
সেই সে রাঙ্গা চরণ পায়।।

নিজগুনে পদারবিন্দু
দেন যদি সাঁই দীনবন্ধু,
তবে তরি ভবসিন্ধু
নইলে না দেখি উপায়।।

অহল্যা পাষানী ছিল
প্রভুর চরণ ধূলায় মানব হলো,
লালন পথে পড়ে র’লো
যা করে সাঁই দয়াময়।।

(চলবে…)

<<লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ ।। লালন বলে কুল পাবি না: সাত>>

.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই

লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

Related Articles

4 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Limon , রবিবার ২৭ অক্টোবর ২০১৯ @ ৬:৫৯ অপরাহ্ণ

    সাঁইজির মাজার দেখা আমার ভাগ্যে এখনো হয় নি। কবে যে সাঁইজি কৃপা করবেন, সে আশায় আছি।

    • ভবঘুরে , রবিবার ৩ নভেম্বর ২০১৯ @ ৭:২৪ অপরাহ্ণ

      “সাধুর দরশনে যায় মনের ময়লা
      পরশে প্রেমতরঙ্গ।”
      -ফকির লালন

  • উজ্জল , রবিবার ৩ নভেম্বর ২০১৯ @ ৭:৩৮ অপরাহ্ণ

    নিজেকে প্রস্তুত করতেছি

  • Arifin sha , বৃহস্পতিবার ৭ নভেম্বর ২০১৯ @ ১:২৭ অপরাহ্ণ

    দেখে শুনে ঘোর গেল না।
    কী করিতে কী করিলাম দুগ্ধেতে মিশিল চোনা।।

    মদন-রাজার ডাঙ্গা ভারি
    হলাম তার আজ্ঞাকারী
    যার মাটিতে বসত করি
    চিরদিন তারে চিনলাম না।।

    রাগের আশ্রয় নিলে তখন
    কী করিতে পারে মদন
    আমার হলো কামলোভী মন
    মদন রায়ের গাঁটরি টানা।।

    উপর হাকিম একদিনে
    কৃপা করতো নিজ গুণে
    দিনের অধীন লালন ভণে
    যেত মনের দোটানা।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!