ভবঘুরেকথা
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব

অখন্ডমন্ডলেশ্বর শ্রী শ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব এক অনন্যসাধারণ ধর্ম বিপ্লবী-ভেদ বিসম্বাদ বিমর্দ্দনকারী মহামিলনের পথ প্রদর্শক। বঙ্গীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষ প্রান্তে পূণ্য পৌষের এক মঙ্গলবার চাঁদপুর শহরের পুরাতন আদালত পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন এই অলোকসামান্য মহামানব।

শৈশবেই বল্টুর জীবনে কিছু অসাধারণ লক্ষ্মণ ফুটে উঠতে থাকে। ধ্যান করার বিষয়ে অপরিসীম আগ্রহ , সর্বজীবে শ্রীভগবানের উপলব্ধি, জাত পাতের বিচারে চরম বিরাগ-এই সবই বল্টুর চরিত্রের অঙ্গ।

পিতা প্রখ্যাত সাধক, কবি ও গায়ক সতীশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। মাতা পূজনীয়া মমতা দেবী। পিতামহ তদানীন্তন চাঁদপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ধর্মজ্ঞ আইনজীবি হরিহর গঙ্গোপ্যাধ্যায়-যাঁকে প্রখ্যাত সাধক শ্রীমৎ ভোলানন্দ গিরি মহারাজ ‘কলির বশিষ্ঠ’ এই উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তাঁর পূর্ব নিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুর পরগণার কুমারভোগ গ্রাম।

মাতামহ ঢাকার দোয়াল্লী গ্রামের নিষ্ঠাবান উদারচেতা ব্রাহ্মণ রাজমোহন চক্রবর্ত্তী। শ্রী শ্রী স্বরূপানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। ডাক নাম বল্টু। শৈশবেই বল্টুর জীবনে কিছু অসাধারণ লক্ষ্মণ ফুটে উঠতে থাকে। ধ্যান করার বিষয়ে অপরিসীম আগ্রহ , সর্বজীবে শ্রীভগবানের উপলব্ধি, জাত পাতের বিচারে চরম বিরাগ-এই সবই বল্টুর চরিত্রের অঙ্গ।

বল্টু পাঠশালায় যায় সব ছাত্র ছাত্রীরা বল্টুকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে ,মান্য করে। একদিন বেশ কয়েকজন মিলে বল্টুকে ধরল “চল খেলতে যাই”। বল্টু সকলকে নিয়ে মাঠে গেল-কি খেলা হবে? বন্ধুরা বললেন – “বল্টু যা বলবে সে খেলা হবে”। এবার বল্টু মাঠে একটা বড় ত্রিভুজ আঁকল নিজে বড় দুই বাহুর শীর্ষ বিন্দুতে বসে সাথীদের লাইন করে সাজিয়ে ত্রিভুজের তিন বাহুতে বসিয়ে দিল। এবার বল্টু বলল “সবাই আসন করে ভাল হয়ে বস”।

সবাই আদেশ পালন করল। বল্টু বলল-এখন সবাই চোখ বোজ। এ আদেশও প্রতিপালিত হলে বল্টু বলল- এখন প্রত্যেকে নাম জপ কর। একজন জিজ্ঞাসা করল- কোন নাম জপব?বল্টু বলল- ভগবানের যে নাম যার ভাল লাগে।

একে একে উঠে খেলার মাঠ ত্যাগ করে চলে গেল – রইল কেবল গভীর ধ্যানে নিমগ্ন বল্টু। ক্রমে রাত গভীর হল-বল্টু বাড়ি ফিরে নাই-চিন্তিত মা, চিন্তিত পরিবারের আর সকলে।

জপ আরম্ভ হল-সকলেই মুখে উচ্চারণ করে নিজ পছন্দমতো নাম জপ করছে। কেহ বলে ‘কালী কালী’ কেহ ‘দূর্গা দূর্গা’ কেহ ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ কেহ ‘লক্ষ্মী লক্ষ্মী’ কেহ ‘সরস্বতী সরস্বতী’ কেহ ‘রাম রাম’ কেহ ‘শিব শিব’ কেহ ‘বিষ্ণু বিষ্ণু’ এইভাবে কত কত দেবতার নাম বলা হতে লাগল। ছেলেদের উৎসাহ বেড়ে গেল। মৃদু কন্ঠ উচ্চ কন্ঠে পরিনত হল।

নানা জনের মুখে নানা নাম মিলে এক মহাধ্বনিতে পরিনত হল। শুনতে শুনতে বল্টু ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। ইতিমধ্যে ২/১ জন মিটি মিটি করে চেয়ে দেখল-সঙ্গীরা কে কি করছে। ক্রমে ক্রমে সঙ্গী সকলেরই চোখ খুলল। নাম জপ থেমে গেল। কেবল বল্টু ধ্যানমগ্ন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে সঙ্গীরা একে একে উঠে খেলার মাঠ ত্যাগ করে চলে গেল – রইল কেবল গভীর ধ্যানে নিমগ্ন বল্টু।

ক্রমে রাত গভীর হল-বল্টু বাড়ি ফিরে নাই-চিন্তিত মা, চিন্তিত পরিবারের আর সকলে। ভৃত্য ভারত শীল বল্টুর খোঁজে বের হলেন।অনেক খোঁজে নির্জন মাঠে ধ্যানমগ্ন বল্টুকে পেয়ে ভারত শীল তাকে বাড়ি নিয়ে এলেন। গৃহে ফিরেই বল্টু পিতামহকে জিজ্ঞেস করলেন-“আচ্ছা ঠাকুরদা সব নাম একত্র হলে কি ওঁম হয়?” শিশু পৌত্রের মুখে গভীর সাধন তত্ত্বের সিদ্ধান্ত শোনে পিতামহ হরিহর গঙ্গোপাধ্যা’ত বিস্ময়ে অবাক।

বল্টু পাঠশালায় যায়-একরাত্রে সকল সহপাঠী-সহ-পাঠিনী স্বপ্নে এক দিব্যপুরুষকে দেখলেন-সেই দিব্যপুরুষ বললেন তিনি জগদুদ্ধার করতে এসেছেন। “পাঠশালায় গিয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বপ্নের কথা বিবৃত করতে চাইলেন-একে অপরের বিবরণ শুনে শুনে বিস্ময়ে অবাক হলেন- সকলের দেখা স্বপ্নই যে হুবহু এক। এমন সময় বল্টু পাঠশালায় এলেন।

তাঁকে দেখেই সকলেই নিজের অজান্তে একযোগে বললেন-“একি এ যে গতরাতে স্বপ্নে দেখা সেই ঠাকুর”। সেদিন থেকে সহপাঠী-সহ-পাঠিনীরা বল্টুকে মণিঠাকুর বলে সম্বোধন করতে লাগলেন। মণিঠাকুরকে সঙ্গী সাথী সকলেই দেবতার মত শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে লাগলেন। এত শ্রদ্ধা-ভক্তির মধ্যে পড়ে মণিঠাকুর বলতেন-

“তোরা করিস কি? আমার ভিতরে যিনি আছেন -তোদের সকলের ভিতর সেই তিনিই আছেন। তোরা কেন পাগলের মত আমার পূজা করিস?”

বয়সে বড় দুজন বললেন -“আমরাতো পাথরে গড়া দেবতার পূজা করি-তুমি কি তাহা অপেক্ষা খারাপ?” হেসে মণিঠাকুর বললেন – ” পাথরের চেয়ে খারাপ নই, তবে তোমাদের চেয়ে ভাল নই। তোমরা পাথরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাই আমিও পাথর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” সেদিন হতে সহপাঠী -সহপাঠিনীরা নিয়মিত মণিঠাকুরের পূজা করতে লাগলেন।

ছোট বালক মণিঠাকুর শত বলেও সঙ্গী সাথীদের নিবৃত্ত করতে পারতেন না বলে তাদের আবদার মেনে নিতে বাধ্য হতেন বটে, কিন্তু সবসময়ই বলতেন – ভগবান সকলের ভিতরেই আছেন, নিজেকে জানাই আসল পূজা। শৈশবের সেই উপলব্ধি সারা জনম স্বামী স্বরূপানন্দজী ব্যক্ত করেছন। পরবর্তী কালে লক্ষ লক্ষ শিষ্যের গুরু হয়েও তিনি নিজেকে পূজার আসনে বসাননি-তিনি বলতেন-

“তোমাদের পূজা পাওয়া আমার প্রয়োজন নহে, আমি চাহি তোমরা জগতের কল্যাণে লাগো।”

একজন বলল – এ যে লছমিয়া। বল্টু ঠাকুর বললেন ‘ও ছুঁবে না কেন- সে ও তো আমাদের মতই মানুষ।’ সমস্বরে আর সকলে উত্তর দিল ‘ওতো মানুষ নয় মুচি।’ জান না বুঝি লছমিয়া মুচির মেয়ে।”

বাড়ীর সাথে একটি কুল গাছ। এটি পাড়ার সব ছেলে মেয়েদের প্রচণ্ডতম আকর্ষনের কেন্দ্র। পড়তে বসে বল্টু ঠাকুরের মনে পড়ল কুল খেতে হবে। দেখতে না দেখতে বল্টু ঠাকুর গাছের ডগায় গিয়ে উঠলেন। পাড়ার ছেলেমেয়েরা এসে জুটল। বল্টু ঠাকুর এক একেকটা ডাল ঝাঁকা দেন আর তলায় অজস্র কুল ঝরে পড়ে-কুল কুড়াইবার জন্য বালক বালিকাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল-হঠাৎ গাছের নীচে সমস্বরে একটা ধ্বনি -ছুসনে ছুসনে।

বল্টু ঠাকুর নীচে তাকিয়ে দেখেন একটি ছোট্ট মেয়ে রাস্তা হতে ছুটে এসে কুল কুড়াতে লেগে গেছে- আর তার উদ্দেশ্যেই সবাকার এ বক্তব্য। বল্টু ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন -এ মেয়েটিকে তোরা কুল ছুঁতে বারণ করছিস কেন? একজন বলল – এ যে লছমিয়া। বল্টু ঠাকুর বললেন ‘ও ছুঁবে না কেন- সে ও তো আমাদের মতই মানুষ।’

সমস্বরে আর সকলে উত্তর দিল ‘ওতো মানুষ নয় মুচি।’ জান না বুঝি লছমিয়া মুচির মেয়ে।” এবার বল্টু ঠাকুর তীব্র কণ্ঠে আদেশ করলেন -“সবাই গাছতলা থেকে সরে যাও- একটা কুলও কেউ ছুঁতে পারবে না।” কেহ কেহ বলল- আমরা ব্রাহ্মণ, আমরা কি ছুঁতে পারব না? কেহ বলল আমরা কায়স্থ -আমরাও কি পারব না? গাছের উপর হতে জবাব এল- ‘যতক্ষণ আমি গাছ থেকে না নেমে আসি ততক্ষণ একটি কুলও কেউ ছুঁবে না।

সকলে দাঁড়িয়ে রইল। বল্টু ঠাকুর একের পর এক ডালে ঝাঁকি দিতে লাগলেন -অজস্র কুল গাছতলায় ঝরে পড়ল। অবশেষে বল্টু ঠাকুর গাছ থেকে নেমে এলেন। একজনকে বললেন ‘একঘটি জল নিয়ে আয়।’ আর একজনকে বললেন নুন-লঙ্কা আনতে। তৃতীয় জনের উপর আদেশ হল বড় রকমের একটা বাঁশের ডালা আনতে।

আদেশ পালিত হল-এবার সকলে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল যে বল্টু ঠাকুর মুচির মেয়েটাকে হাত ধরে টেনে এনে কুল গাছের নীচে বাসলেন।

ঘটি হতে জল ঢালতে ঢালতে বললেন -‘হাত ধো।’ হাত ধোয়া হলে মেয়েটির হাতে ডালাটা দিয়ে বললেন ‘কুল কুড়া।’ মুচির মেয়েটি সঙ্কুচিত চিত্তে কুল কুড়াতে লাগলো। সমস্ত কুল কুড়ানো হলে, বল্টু ঠাকুর সকলকে ডেকে বললেন -“আয় কুল খাবি।” সকলে সভয়ে চিৎকার করে বলল- ‘জাত যাবে যে।’ বল্টু ঠাকুর নিজে এবার ডালার পাশে বসে লঙ্কা-নুন সহযোগে কুল খেতে লাগলেন।

বিস্ময়ে বিমূঢ় বালক – বালিকার দল গভীর মনোযোগ দিয়ে চারদিকে লক্ষ্য করে দেখতে লাগলো – জাতটা কোনদিকে যায়। অনেকেরই ধারণা ছিল মানুষ -গরু-ছাগলের মত জাতটাও একটা প্রাণী বিশেষ। মুচিকে ছুলে জাতটা শরীর থেকে ছুটে বেড়িয়ে যায়।

একে একে সকলে কুল খাওয়া আরম্ভ করল-মহাসমারোহে কুল ভক্ষণ চলল। পরবর্তী জীবনে শ্রী শ্রী স্বরূপানন্দ এই জাতি ভেদ প্রথার অর্গল মুক্ত সর্বজনীন ধর্মমত প্রচার করেছিলেন।

যখন দেখা গেল বল্টু ঠাকুর মুচির মেয়ের ছোঁয়া কুর খেয়ে চলছে অথচ কোন কিছু বল্টু ঠাকুরের শরীর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে না-তখন সঙ্গী সাথীরা ভরসা পেল-একে একে সকলে কুল খাওয়া আরম্ভ করল-মহাসমারোহে কুল ভক্ষণ চলল। পরবর্তী জীবনে শ্রী শ্রী স্বরূপানন্দ এই জাতি ভেদ প্রথার অর্গল মুক্ত সর্বজনীন ধর্মমত প্রচার করেছিলেন।

তাঁর মতে জাতিভেদ নয়, সমাজের কল্যাণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভাল মানুষের। তিনি বললেন,“ভগবানের জাতের ‍বিচার নাই।” ধর্মীয় সাধনায় সর্ব বর্ণের সমান অধিকার।

এই বল্টু ঠাকুর একবার কুড়ি বাইশ দিন জ্বরে ভোগছেন-আজ জ্বর নাই-অন্ন পথ্য হবে। মা মমতা দেবী ঝোল ভাত রান্না করে পরিবেশ করছেন। আহার আরম্ভ হবে এমন সময় এক ভিখারী এসে দুয়ারে দাঁড়াল। জীর্ণ মলিন বেশে ভিখারীর শীর্ণ কঙ্কালসার দেহ বল্টু ঠাকুরের মনে মমতা জাগাল। তিনি মাকে বললেন,

“মা আজ আমি বার্লিই খাব, আমার জন্য রান্না করা ভাত ভিখারীকে দাও মা।” মা মমতাদেবী বল্টু ঠাকুরের দরদে ভরা মনের কথা জানতেন -তিনি বললেন, “আচ্ছা বাবা আবার আমি তোমার জন্য বার্লিই তৈরী করে দিচ্ছি। তুমি অন্ন পথ্য গ্রহণের দিন-নিজের অন্ন আনন্দ করে অন্নহীনকে খাওয়াও আর তার খাওয়া দেখ।” শ্রী শ্রী স্বরূপানন্দ বলতেন, “পতিত অধম অনাথের লাগি পরাণ যাহার কাঁদে, অমল প্রীতির প্রসূন মালায় সেইতো আমারে বাধেঁ।”

তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ দিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিজীবনকে এমনভাবে আড়াল করে রেখেছিলেন যে, স্বামীজির ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে খুব কথাই জানা যায়।

স্বামী স্বারূপানন্দ পরমহংসদেব ছিলেন এক বিশাল কর্মযোগী। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু শাখায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি একাধারে তপস্বী, সাহিত্যিক, কবি, গায়ক, সুরস্রষ্টা, বাগ্মী ও বেদবিদ, তিনি ছিরেন চিকিৎসক, কৃষিবিদ, স্থপতি এবং সমাজ সংস্কারক। তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ দিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিজীবনকে এমনভাবে আড়াল করে রেখেছিলেন যে, স্বামীজির ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে খুব কথাই জানা যায়।

ঠাকুরবাড়ি কৃত্তি (ব্যঘ্রচর্ম) আছে, অজিন (মৃগচর্ম) আছে। বাল্যে কৈশোরে মাঝে মাঝে শিব সেজে চাঁদপুরের মহল্লায় বের হতেন। কোন দিন কৃষ্ণ সেজে বরে হতেন, কিন্তু এ শিব হচ্ছেন গৌরী বর্জিত। এ কৃষ্ণ হচ্ছেন রাধাঁবিহীন।

যৌবনে বিভূতি দর্শন করানো তার অদ্ভূত খেলা ছিল। কারও মস্তকে হাত স্পর্শ করলে তিনি দূর্গা, কালী, শিব প্রভৃতি বিভূতি দর্শন করাতে পারতেন। একবার মেঘনা নদীতে নৌকা ডুবি হওয়ায় খুব কষ্ট পেলেন। সেই থেকে বিভূতি দর্শন করানো খেলা বন্ধ হল।

বাবাকে, জেঠাকে, ঠাকুদাদাকে সাধক দেখেছেন। প্রতি রাতে বাবাকে, জেঠাকে ধ্যান করতে দেখতেন। কলির বশিষ্ঠ ভোলানন্দগিরি মহারাজ তাঁর ঠাকুরদা শ্রী শ্রী হরিহর গঙ্গোপাধ্যায় উকিল মহোদয় ৯৩ বছর বয়সে যোগাসনে প্রাণ ত্যাগ করেন। পরমারাধ্য পিতৃদেব শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় কবিবর ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত গ্রন্থের নাম “শান্তি”।

সাধক মনোমোহন দত্তের পুত্র মহাত্মা সুধীর দত্ত। শ্রী শ্রী বাবামনি আগে আগে পথ চলছেন। সুধীর বাবু কিঞ্চিত পেছনে তাঁকে অনুসরণ করছেন। হঠাৎ করে প্রবল বেগে তুফান শুরু হল। সুধীর বাবু মরিয়া হয়ে গুরুদেবের কাছে আসলেন। এখানে খারাপ আবহাওয়ার কনামাত্র নেই। শ্রী শ্র্রী বাবামনি বললেন, “কি হে, সুধীর! তুই না বিরাট সাধক হয়ে গেছিস! একটুখানি অলৌকিকত্ব দেখালুম আর কী!”

একবার এক বাড়িতে দীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। শ্রীশ্রী বাবামনি কার জন্যে যেন প্রতীক্ষা করছেন। জানা গেল পাশের বাড়ির নব বিবাহিতা বধু দীক্ষা নিতে একান্ত আগ্রহী। এব্যাপারে পরিবারের অনুমতি নেই। দু:খে মহিলা গলায় ফাসি দিয়ে ঝুলছে। গুরুদেব সেই বাড়িতে নিজে গিয়ে সেই মৃত বধুকে বাঁচালেন এবং দীক্ষা মন্ডপে এনে তাকে দীক্ষা দিলেন। এরুপ অগণিত অলৌকিকত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি।

তিনি বলতেন, “অবতারের ক্ষমতা নিয়ে এসেছি, কিন্তু অবতারত্বকে বর্জন করে ‘মহামন্ত্র ওঁকারকে সেই আসন দিয়েছি।” বাবাকে, জেঠাকে, ঠাকুদাদাকে সাধক দেখেছেন। প্রতি রাতে বাবাকে, জেঠাকে ধ্যান করতে দেখতেন। কলির বশিষ্ঠ ভোলানন্দগিরি মহারাজ তাঁর ঠাকুরদা শ্রী শ্রী হরিহর গঙ্গোপাধ্যায় উকিল মহোদয় ৯৩ বছর বয়সে যোগাসনে প্রাণ ত্যাগ করেন।

পরমারাধ্য পিতৃদেব শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় কবিবর ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত গ্রন্থের নাম “শান্তি”। (দেউন্দি চা বাগানে শ্রী প্রমোদ নাথের কাছে গ্রন্থখানি আছ।)

স্কুলের শিক্ষা সমাপন করে তিনি কলেজে পড়ছেন। শোনা যায় উচ্চর শিক্ষা গ্রহণের জন্য ইংল্যান্ডে যাবার ব্যবস্থা তার জন্য হয়েছিল। সে সময়ে দেশের অবস্থা খুবেই খারাপ। ভিনদেশীয় শাসকসদের অত্যাচারী শাসনের নিস্পেষনণ দেশবাসীর অবস্থা করুণ। এই অত্যাচারের শৃঙ্খলমুক্তির জন্য দেশমাতা তখন চাইছিলেন শিক্ষিত দরদী যুবকদের আত্মোৎসর্গ। উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়া হল না তাঁর।

ভারতের বিহার রাজ্যের পুপুনকীতে এবং বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাস্থিত রহিমপুরে অযাচক আশ্রম প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর যে কৃচ্ছসাধনা তা অভূতপূর্ব। কখনও অর্ধাহারে, কখনও অনাহারে, কখনও কাঁচা ঝিঙ্গা, কচি ঢেরশ পাতা খেয়ে, কখনও পলাশ পাতা ও মহুয়া ফুল সিদ্ধ করে খেয়ে, তিনি স্বাবলম্বনের ইতিহাস রচনা করেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় অযাচক আশ্রম।

দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নি:শেষে উজার করে ‍দিলেন। তিনি ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী অগ্নিপুরুষদের প্রেরণার স্থল। তাঁর দেশাত্মবোধক ক্ষুরধার লেখনী অগণিত বিপ্লবীকে আত্মোৎসর্গে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘কর্মের পথে’ বাঙ্গালী বিপ্লবীদের নিত্য পাঠ্য ছিল।

তিনি অস্ত্র হাতে ধরেননি, রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করেননি- তাঁর লেখনী রাজনীতি নিরপেক্ষ ভাবে প্রেরণা যুগিয়েছে দেশের জন্য নিজেকে উজার করে দিবার। স্বামীজি যে আদর্শ প্রচার করে গেছেন তার অনুকুলে তিনি এক বিশাল সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। বিভিন্ন খন্ডসহ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা শতাধিক।

তিনি ছিলেন স্বাবলম্বনের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বাস করতেন পরনির্ভর হয়ে প্রকৃত দেশ সবো করা যায় না। তিনি প্রবর্তন করলেন অভিক্ষা সাধনার। ভিক্ষা না করে দেশ জাতি ও র্ধমের সেবার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অযাচক আশ্রম। ভারতের বিহার রাজ্যের পুপুনকীতে এবং বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাস্থিত রহিমপুরে অযাচক আশ্রম প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর যে কৃচ্ছসাধনা তা অভূতপূর্ব।

কখনও অর্ধাহারে, কখনও অনাহারে, কখনও কাঁচা ঝিঙ্গা, কচি ঢেরশ পাতা খেয়ে, কখনও পলাশ পাতা ও মহুয়া ফুল সিদ্ধ করে খেয়ে, তিনি স্বাবলম্বনের ইতিহাস রচনা করেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় অযাচক আশ্রম।

ভেদ বিসম্বাদে পূর্ণ সাম্প্রদায়িকতা পরিক্লিষ্ট সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে ঈশ্বর সাধনার জন্য তিনি প্রর্বতন করেন এক অভিনব সাধনার ‘সমবেত উপাসনা’। সমবেত উপাসনায় জাতি-বর্ণ-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলে সমকালে, সমাসনে, সমকন্ঠে স্রষ্টার আরাধনার সুযোগ লাভ করে। স্বামীজী ভবিষ্যদ্বানী করেন যে, “সমবেত উপাসনার মাধ্যমে খন্ড-বিখন্ড মানবজাতি এক হইবে।”

কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাস্থিত রহিমপুর গ্রামে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অযাচক আশ্রমে স্বামীজী ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে সৃষ্টি করেন স্ট্যান্ডর্ড সুরে হরিওঁ কীর্ত্তন। হরিওঁ মানে ঈশ্বর এক, হরিওঁ মানে ঈশ্বরই সব, হরিওঁ মানে ঈশ্বর আছেন। স্বামীজি বলতেন , হরিওঁ কীর্ত্তন মানবে ঐক্য সংস্থাপনের ঘোষণাবাণী।

স্বামী স্বরুপানন্দ পরমহংসদেব বলতেন,“চরিত্র হচ্ছে মানব জীবনের বুনিয়াদ। ধর্মীয় সাধনা, দেশসেবা সব কিছুরেই মূল চরিত্র। তিনি বলতেন, দেশের কিশোর এবং যুবকদের অপবিত্রতার পথ হইতে টানিয়া তুলিয়া নির্মলচেতা ও শুদ্ধ বুদ্ধি করাই আমার জীবনের সাধনা। সুগঠিত চরিত্র মানবসমাজ গঠনের লক্ষ্যে তিনি এক আন্দোলনের সৃষ্টি করেন যার নাম দিয়েছেন, ‘চরিত্র গঠন আন্দোলন’।

চাঁদপুর শহরের নিকটবর্তী ঘোড়ামারার মাঠে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই আন্দোলনের সৃষ্টি করেন।

স্বামীজীর শিক্ষা ও আর্দশ অনুশীলন ও প্রচারের জন্য গঠিত হয়েছে ধর্মীয় সংগঠন অখন্ড মন্ডলী। এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার অখন্ড মন্ডলী গঠিত হয়ে স্বামীজীর শিক্ষা ও আর্দশ অনুসরণ করে চলছে।

স্বামীজী তাঁর শিক্ষাকে হাতে কলমে গ্রহণের সুযোগ দানের জন্য আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি সনাতনী ঋষিদের শিক্ষাকে সমন্বিত করে এক অভিনব শিক্ষা কার্যক্রমের পরিকল্পনা করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন এক ব্যতিক্রমর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “মাল্টিভার্সিটি বা বহুমুখী শিক্ষাকেন্দ্র।’ এর প্রথম শাখাটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পুপুনকী অযাচক আশ্রম।

স্বামীজীর পরিকল্পনা পূর্ণরূপ পরিগ্রহ করলে এখানকার বিদ্যার্থীগন প্রচলিত শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্ম সাধনা, কৃষি, গোপালন, মৎস্য চাষ ও বিভিন্ন কারিগরী শিক্ষা লাভ করতে এবং শিক্ষাকালীন সময়ে স্বোপার্জিত অর্থ দ্বারা যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে এবং শিক্ষা সমাপান্তে স্বাধীনভাবে জীবীকা নির্বাহের মত মূলধন সঞ্চয় করার সুযোগ লাভ করবে।

স্বামীজী সনাতন র্ধমের আধ্যাত্মিক রাজধানী বারানসীতে অযাচক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে বিশুদ্ধ আয়ুর্বেদীয় ঔষধ প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান এবং তাঁর বিশাল সাহিত্য প্রকাশনা সংস্থা ও আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বামীজীর শিক্ষা ও আর্দশ অনুশীলন ও প্রচারের জন্য গঠিত হয়েছে ধর্মীয় সংগঠন অখন্ড মন্ডলী। এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার অখন্ড মন্ডলী গঠিত হয়ে স্বামীজীর শিক্ষা ও আর্দশ অনুসরণ করে চলছে।

স্বামী স্বরুপানন্দ পরমহংসদেব অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম পালনে আগ্রহী না হয়ে ধর্মকে জীবনব্যাপী করার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ধর্মকে জীবনময় কর, জীবনকে ধর্মময় কর।” এই মহামানব ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল, কলকাতা কাঁকুরগাছিতে অবস্থিত সংঘ কার্যালয় ‘গুরুধামে’ তাঁহার ইহজাগতিক লীলা সম্বরণ করেন। এ মহামানবের মহাজীবনবেদ থেকে অল্প কয়টি কথাই ব্যক্ত করা হলো।

………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন

Related Articles

3 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Kapil Mukherjee , শুক্রবার ২৯ মে ২০২০ @ ১১:৩৬ অপরাহ্ণ

    এক সময় babamoni র বক্তব্য অবধারিত, মাসিক, বা সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোতে, সেগুলোর কোনো samstigato sankalon আছে, যদি থাকে তো কি ভাবে পাওয়া যাবে

    ? কপিল

    • ভবঘুরে , সোমবার ১ জুন ২০২০ @ ৮:৪২ অপরাহ্ণ

      জেনে আপনাকে জানাবো…
      সাথে থাকবেন
      জয়গুরু

  • Durgaprosad Hoom Chowdhury , বৃহস্পতিবার ১৫ এপ্রিল ২০২১ @ ১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

    ওঁ তৎসত
    স্বামীজির চরনে প্রনাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!