গৃহীসন্ন্যাসী তুকারামের সংসারের দিকে কোন লক্ষ্য নেই। সব সময় জবতপ, সাধনভজন, নামকীর্তন আর অধ্যাত্ম চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকেন। সংসারে অন্ন সংস্থানের কোন ব্যবস্থা নেই। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার কোন চেষ্টা নেই।
নিজেদেরই কোনরকমে দিন চলে। তার উপর বাড়িতে ভক্ত ও অতিথি অভ্যাগদের ভিড় লেগেই আছে। সংসারের সব জ্বালা সইতে হয় পত্নী জিজাকে। স্বামীর অধ্যাত্ম সাধনার মর্ম তিনি কিছু বুঝতে পারেন না। তাই স্বামীকে তাঁর এই ঔদাসীন্য ও বৈরাগ্যের জন্য প্রায়ই ভৎসনা করেন জিজা।
স্ত্রীর কথার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একদিন তুকারাম গ্রাম হতে কিছুদূরে এক নির্জন অরণ্যে গিয়ে সেখানে কুটীর বেঁধে সাধন ভজন করতে লাগলেন।
এদিকে স্বামী ঘরে না ফেরায় স্ত্রী জিজার মনে অনুতাপ জাগল। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভাবলেন, স্বভাবতই যিনি সংসারে অনাসক্ত ও বিষয়বাসনাহীন, ইষ্টদেবের চরণে মনপ্রাণ যার নিঃশেষে সমর্পিত, তাঁকে সংসারে আসক্ত করার চেষ্টা বৃথা। তার চেয়ে তিনি বরং ঘরে থেকেই সাধন ভজন করুক। নিজের মতে চলুক।
এই সব কথা চিন্তা করে জিজা বনের মধ্যে তুকার কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইলেন। বললেন, তুমি ঘরে ফিরে চল। ঘরে থেকেই সাধন ভজন করো। আমি শপথ করে বলছি তোমার কোন কাজে বাধা দেব না।
তুকা স্ত্রীর স্বভাব জানেন। আজ তাঁর হৃদয়ে অনুতাপ জেগেছে ঠিক কিন্তু দুদিন চুপ করে থাকার পর আবার তিনি ক্রোধে ফেটে পড়বেন। তাই তিনি শান্ত কণ্ঠে স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললেন, দেখ! তোমার আমার দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। সুতরাং আবার অশান্তি হবেই। তার চেয়ে আমি নির্জনে থেকেই সাধনা করি। তোমাদের যা করে হোক চলে যাবে। তুমি আমায় মুক্তি দাও।
কিন্তু স্ত্রী আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি স্বামীকে না নিয়ে যাবেন না। অগত্যা ঘরে ফিরে গেলেন তুকা। তুকা চান তাঁর স্ত্রীও তাঁর মত সব সংসার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ‘বিঠোবাজী’র চরণে নিজেকে সঁপে দেন। তাঁর মত সাধন ভজনে মত্ত হয়ে থাকুক।
তাই স্ত্রীকে উপদেশ দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, সংসারের মায়া এবার ছাড়। সংসারকে যতই আঁকড়ে ধর সংসার তোমাকে ধরা দেবে না। তা সরে সরেই যাবে। তার চেয়ে সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে সব ছেড়ে পরমবস্তু আমার বিঠোবাজীকে ধরো। তাঁর চরণে সঁপে দাও নিজেকে। দেখবে পরম শান্তি পাবে। সব জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।
তখনকার মত স্বামীর কথাগুলি মেনে নিলেন জিজা। তাঁরও মধ্যে তখন জাগল ভক্তিভাবের আবেশ। প্রাণে উদয় হলো মোহমুক্তির এক নিবিড় আকুতি। স্ত্রীর এই ভাবান্তর লক্ষ্য করে তুকা উৎসাহিত হয়ে বললেন, এসো আমাদের সংসারের জিনিসপত্র দীনদুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে হালকা হই। এই সব পার্থিব ভোগ্যবস্তু সাধনার পথে একান্ত অন্তরায়।
জিজা সম্মতি দিলেন। তুকা তখন ঘরের সব জিনিস গরীব দুঃখীদের দান করতে লাগলেন। সব শেষে যখন স্ত্রীর একটি ছেঁড়া কাপড় দান করতে গেলেন তখন তাঁর স্ত্রী আর থাকতে পারলেন না। তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি তখন ঘরের কোণে যে একগাছি আখ ছিল তা নিয়ে স্বামীর পিঠে সজোরে প্রহার করতে লাগলেন।
তুকা নীরবে বসে পড়লেন। সমানে সব প্রহার সহ্য করে গেলেন। গোটা আখটি পিঠের উপর দু’খণ্ড হয়ে গেল। জিজার চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এল। কিন্তু তারা ব্যাপারটি বুঝবার আগেই তুকারাম স্মিত হাসি হেসে আখের খণ্ড দুটি হাতে নিয়ে বললেন, দু’খণ্ড আখ আমাদের দরকার হওয়ায় হঠাৎ একটা অজুহাত সৃষ্টি করে এটাকে দু’খণ্ড করে নিলো।
প্রতিবেশীরা বুঝতে পারল, বৈরাগ্য ও ভক্তিসিদ্ধ তুকার কামনা ও ক্রোধ বলে কোন জিনিস নেই অন্তরে। তিনি এক মহা সিদ্ধপুরুষ।
লোহাগাঁও এর সিবাবা কাসার নামে একটি লোক তুকার ভাগবত জীবনের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পেরে তাঁর শরণাপন্ন হন। কিন্তু কাসারের স্ত্রী বড় উদ্ধত প্রকৃতির। সে ভাবল, তুকারামের প্রভাবে একবার পড়লে তার স্বামী আর ব্যবসার কাজে মন দেবে না। নামগানে মত্ত হয়ে বিষয় আশয় সব ছেড়ে দেবে। সুতরাং এ বিপদ হতে উদ্ধার হতে হলে তুকারামের প্রাণনাশ করা দরকার। এজন্য সে চেষ্টা করতে থাকে।
একদিন তুকারাম কাসারের বাড়িতে কীর্তন করতে আসেন। কীর্তন শেষে তিনি ভক্ত ও শিষ্যগণসহ বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ান। এমন সময় কাসারের স্ত্রী বাড়ির ছাদ থেকে এক হাঁড়ি ফুটন্ত গরম জল তুকারামের গায়ে ঢেলে দেয়। ফলে তাঁর সারা শরীরে ফোসকা পড়ে যায়। ফোসকা থেকে ঘা হয়ে যায়। সেই ঘায়ে বহুদিন তাঁকে ভুগতে হয়।
এই সময়কার অভিজ্ঞতা তিনি একটি অভঙ্ পদে লিখে যান, ওগো! আজ আমি ভগবানের শ্রীমুখ দর্শন করে অপার অফুরন্ত আনন্দ লাভ করেছি। সেই শ্রীমুখে আমার নয়ন রয়েছে কেন্দ্রীভূত, আমার হাত দুটি স্পর্শ করে আছে তাঁর শ্রীচরণ। একবার তাঁর দর্শন লাভ হলে সব পাপ দূর হয়ে যায়। তাই ত আনন্দের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে ঘটছে আমার উত্তরণ।
তুকা কিন্তু নীরবে সব সহ্য করলেন। মোটেই ক্রুদ্ধ হলেন না। তিনি সকলকে কাসারের স্ত্রীকে কোনোরূপ তিরস্কার করতে বা কটুবাক্য বলতে নিষেধ করলেন। তুকার এই আশ্চর্যজনক সহনশক্তি ও মহানুভবতা দেখে অনুতপ্ত হলো কাসারপত্নী। সে অনুতপ্ত হয়ে তুকার চরণে আত্মসমর্পণ করল।
এইভাবে তুকার এই উদার ও সহজ ভক্তিসাধনায় মুগ্ধ হয়ে বহু মুমুক্ষু ব্যক্তি এসে তাঁর চরণে আশ্রয় নেয়। দিনে দিনে বেড়ে যেতে থাকে ভক্ত শরণাগতের সংখ্যা। তাদের মধ্যে ছিল অনেক ধনী ও প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি।
একদিন কয়েকজন ধনী ভক্ত তুকার সংসারের দুঃখ দৈন্য দেখে মনে ব্যথা পেয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন, আপনার এই কৃচ্ছ্রব্রত কেন? সাধন-পথে এই সব দুঃখ-দারিদ্র্যের কি সত্যিই কোন প্রয়োজন আছে?
তুকারাম বললেন, এই সব দুঃখ দারিদ্র্য অভিশাপ নয়, তা হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সমস্ত ভোগ ঐশ্বর্যের আবরণ ঘুঁচিয়ে প্রভু তাঁর ভক্তকে এই দৈন্যদুঃখের পথেই টেনে নেন তাঁর কাছে। তাই সুখস্বাচ্ছন্দ্যের পথে তাঁর প্রিয়তম ভক্তকে চলতে দেন না প্রভু।
সাংসারিক স্নেহপ্রেমের সব বন্ধনকেও তিনি ছিন্ন করে দেন। তিনি জানেন, অর্থ ধন ঐশ্বর্য বাড়লে মনে অহংকার অভিমান জাগবে। তাই বরাবর চৈতন্যময় দারিদ্র্যের আঘাত হানেন তার উপর। দৈন্যময় জীবনের মধ্য দিয়ে ভক্তসাধক তাঁর ইষ্টদেব স্বরূপ প্রাপ্ত হন। তিনি তখন ইষ্টদেবের মতন পরম জ্ঞানী ও শক্তিধর হয়ে ওঠেন।
তুকারাম এই অভঙ্ পদে লেখেন, ভাই! নিরন্তর গোবিন্দের নাম জপ করে যাও। ফলে তুমিও হয়ে উঠবে গোবিন্দস্বরূপ। তোমার আর তোমার প্রভুর মধ্যে সব পার্থক্যই ঘুঁচে যাবে। পরমানন্দের আলোয় ঝলমল হয়ে উঠবে তোমার চিত্ত। প্রেমের অশ্রুধারায় নয়ন প্লাবিত হবে।
আর একটি পদে বলেন, নিজেকে ক্ষুদ্র বলে ভাবছ কেন? তুমি যে এই বিশ্বসৃষ্টির মতই মহান। এই মুহূর্তেই পার্থিব জীবনের গণ্ডিকে অপসারিত করে দাও। নিজেকে বদ্ধ ও ক্ষুদ্র ভাবছ বলেই আঁধারে ডুবে আছ। তাইত তোমার জীবন হয়ে উঠেছে দুঃখময়।
তুকার এই সব বাণী শুনে মুমুক্ষু ধর্মপিপাসু অসংখ্য নরনারী এক নূতন আশ্বাসে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। এইভাবে সাধনার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা যতই শেষ হয়ে আসে, ততই ভক্তিভাবের মাধুর্যে ও আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর চিত্ত।
এই সময়কার অভিজ্ঞতা তিনি একটি অভঙ্ পদে লিখে যান, ওগো! আজ আমি ভগবানের শ্রীমুখ দর্শন করে অপার অফুরন্ত আনন্দ লাভ করেছি। সেই শ্রীমুখে আমার নয়ন রয়েছে কেন্দ্রীভূত, আমার হাত দুটি স্পর্শ করে আছে তাঁর শ্রীচরণ। একবার তাঁর দর্শন লাভ হলে সব পাপ দূর হয়ে যায়। তাই ত আনন্দের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে ঘটছে আমার উত্তরণ।
ইষ্টদর্শন লাভ করে মৃত্যুভয় হতে মুক্ত হন তুকারাম। বার্ধক্য আর জরাব্যধিতে জর্জরিত হয় না তাঁর দেহ। পরমপুরুষে বহুপ্রার্থিত পরমপদ লাভ করে তিনি হন শাশ্বত ও সীমাহীন ঐশ্বর্যের অধিকারী। তিনি হন ধন্য, আর তাঁর সকল প্রয়াস হয় সার্থক।
তুকারামের ভক্তিসাধনায় সিদ্ধির খ্যাতি আর নানা বিভূতির কাহিনী এবার দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে লোকমুখে। ফলে অজস্র দর্শনার্থী ও মুমুক্ষু নর-নারীর ভিড় বাড়তে থাকে তাঁর চারদিকে। বহু ভক্ত সব সময় ঘিরে থাকে তাঁকে।
ভক্তি আর সেবা দিয়ে ভক্ত প্রভুর ভৃত্য হয়েও রাজার মত শক্তিমান ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। তখন সে যা চায় তাই পায়। তখন সে রাজার মত সিংহাসনে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে সবাইকে দেখে। ওগো! বিশ্বাস আর শরণাগতির জোরেই তুকা পেয়েছে তার সিংহাসন। তাই ত মানুষ শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করছে তাকে।
একদিন লোহাগাঁও নামে এক জায়গায় নামকীর্তনে মত্ত হয়ে আছেন তুকা। এমন সময় এক নারী তার মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে এসে তুকার সামনে মৃতদেহটি রেখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এই সকরুণ দৃশ্য দেখে তুকা কীর্তন থামিয়ে সেই দিকে নীরবে চেয়ে রইলেন।
পুত্র শোকাতুরা মাতা তখন কাতরকণ্ঠে বলতে লাগল, বাবা, আমার ছেলের প্রাণ ফিরিয়ে দাও, এ দুঃখিনীকে বাঁচতে দাও। বিঠোবাজীর সত্যিকারের ভক্ত যদি হও, তাহলে আমার ছেলের প্রাণ অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে পারবে। আর যদি না পার, তাহলে বুঝব প্রভুর উদ্দেশ্যে যত কিছু নামকীর্তন করছ তা সব অর্থহীন। এ সবই তোমার ভণ্ডামি।
শোকাকুলা নারীর আর্ত ক্রন্দন শুনে করুণায় বিগলিত হয়ে উঠল তুকার অন্তর। অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল গণ্ড বেয়ে। তিনি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন মৃত বালকের দিকে। তারপর তার দেহ স্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল প্রাণসঞ্চার হচ্ছে মৃতদেহে। দুচোখ মেলে তাকাল মৃত বালক।
এই অভাবনীয় অলৌকিক দৃশ্য দেখে বিস্ময়বিমিশ্রিত আনন্দে অভিভূত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল সমবেত জনতা। ভক্ত সাধক তুকারাম ও প্রভু বিঠোবাজীর জয়ধ্বনিতে কম্পিত হয়ে উঠল লোহাগাঁও এর আকাশ বাতাস। সকালে বুঝতে পারল, তুকারাম কত বড় সাধক আর কি বিপুল আধ্যাত্ম শক্তির অধিকারী হয়েছেন তিনি।
একদিন এক বিশিষ্ট ভক্ত প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনার এই অলৌকিক শক্তির উৎস কোথায়? কি করে পেলেন এই শক্তি?
একটি অভঙ্-এর মাধ্যমে এর উত্তর দেন তুকারাম, ভক্তির রসসাগরে নিহিত আছে কত অমূল্য মণিমুক্তা, ভাগবত করুণার কত ঐশ্বর্য্য।
ভক্তি আর সেবা দিয়ে ভক্ত প্রভুর ভৃত্য হয়েও রাজার মত শক্তিমান ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। তখন সে যা চায় তাই পায়। তখন সে রাজার মত সিংহাসনে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে সবাইকে দেখে। ওগো! বিশ্বাস আর শরণাগতির জোরেই তুকা পেয়েছে তার সিংহাসন। তাই ত মানুষ শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করছে তাকে।
মারাঠা বীর শিবাজীর অন্যতম আবাসস্থল পুণা এই দেহু ও লোহাগাঁও-এর মধ্যেই অবস্থিত। বয়সে তখন তরুণ তিনি ধর্মরাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন ক্রমে সংকল্পে পরিণত হয়। এই সময় মহারাষ্ট্রে সিদ্ধপুরুষ তুকারামের খ্যাতির কথা শুনে তাঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ করতে আসতেন এবং ধর্ম ও রাজনীতির বিষয়ে আলোচনা করতেন।
ঈশ্বরকে জীবনের সবকিছু সমর্পন করেও নির্জনে নিভৃতে দিনরাত ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকেন না। তাঁর ঘরে সব সময় অজস্র নরনারীর ভিড় লেগে থাকে। আর তুকা তাদের সকলকে উপদেশ দিয়ে মুক্তিপথের নির্দেশ দেন। তিনি তাদের সকলের কল্যাণের জন্য তার সাধনলব্ধ সমস্ত ঐশ্বর্য অকাতরে বিলিয়ে দেন।
একদিন এক দর্শনার্থী তুকাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি একটি অভঙ্এর মাধ্যমে এর উত্তর দেন। সংসারকে এড়িয়ে কোথায় আমি পালাব বলত? যে দিকেই চাই, দেখি প্রভু আমার বিরাজ করছেন সেখানেই। এ কি তাঁর অদ্ভুত লীলা। নির্জনতা থেকে আমি বঞ্চিত হলেও তিনি ছাড়া কোন স্থানই আমি দেখতে পাই না।
সিদ্ধপুরুষ তুকার খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। তাঁর শত শত ভক্তিমূলক অভঙ্ গান সমাজের উচ্চ নীচ সকল স্তরে প্রচারিত হয়। বিশেষ করে তাঁর ভক্তিমূলক সহজ ধর্মসাধনা এক প্রবল আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তি জাগিয়ে তোলে নিম্নশ্রেণীর ও সাধারণ মারাঠীদের মধ্যে।
সমাজের নিম্নশ্রেণীর ও সাধারণ মানুষের এই জাগরণ বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে মারাঠী জাতির সংগঠন ও পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে। মহারাষ্ট্র সাহিত্যের বিরাট সম্ভাবনার বীজ তুকার অভঙ্ পদগুলির মধ্যেই যে নিহিত ছিল, সেকথা রাণাডে প্রমূখ গুণীজন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন।
তুকারামের অসংখ্য ভক্ত ও শিষ্যের মধ্যে যারা চারিত্রিক মহত্ত্ব ও গুরুভক্তির জোরে সাধনায় সাফল্য লাভ করে স্বনামধন্য হয়ে ওঠেন তাঁরা হলেন- নিলোবা, সন্তজী তেলী, গঙ্গারাম মাভল, রামেশ্বর ভট্ট, সিবাবা কাসার, বাহিনাবাঈ প্রভৃতি।
তুকারাম ছিলেন ঈশ্বরকোটির সাধক। তাই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেও এই সিদ্ধপুরুষ সব সময় মানুষের কল্যাণ সাধনের কথা ভাবতেন, তাদের ত্রিতাপজ্বালা হতে চিরতরে মুক্ত করতে চাইতেন। অসংখ্য ভক্ত ও শিষ্যদের দিয়ে দেহু ও লোহাগাঁওয়ে নামকীর্তন করে বেড়াতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে ভক্তিভাব জাগাবার জন্য।
মারাঠা বীর শিবাজীর অন্যতম আবাসস্থল পুণা এই দেহু ও লোহাগাঁও-এর মধ্যেই অবস্থিত। বয়সে তখন তরুণ তিনি ধর্মরাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন ক্রমে সংকল্পে পরিণত হয়। এই সময় মহারাষ্ট্রে সিদ্ধপুরুষ তুকারামের খ্যাতির কথা শুনে তাঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ করতে আসতেন এবং ধর্ম ও রাজনীতির বিষয়ে আলোচনা করতেন।
তুকা কিন্তু শিবাজীকে নিজে দীক্ষা না দিয়ে তাঁকে রামদাস স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, তাঁদের দুজনের সাধনপথ ও আধ্যাত্ম-দর্শন এক নয়। পরে শিবাজী তুকার নির্দেশ অনুসারে কর্মযোগী রামদাসের কাছেই দীক্ষা গ্রহণ করে সাফল্যলাভ করেন।
সেই সময় গুরু রামদাস কৃষ্ণা নদীর তীরে কুটীর বেঁধে সেখানেই সাধনা করতেন আর তুকারাম বেশীর ভাগ সময় থাকতেন পানচনপুরে বিঠোবাজীর মন্দিরে। একবার রামদাস নিজে পানচনপুরের মন্দিরে এসে তুকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এদিকে অগণিত ভক্ত ও শিষ্যের মুখের উপর নেমে এসেছে ঘন বিষাদের ছায়া। সকলের চোখে ঝরছে অশ্রুর ধারা। অবশেষে শোকাকুল ভক্তের দল গুরুর মরদেহটি দাহ না করে তাঁরই শেষ ইচ্ছানুসারে ভাসিয়ে দিল ইন্দ্রায়নী নদীর পবিত্র জলস্রোতে।
দর্শনের সঙ্গে সঙ্গেই দুজনের অধ্যাত্মশক্তি ও সম্পদের কথা বুঝতে পারেন। দুজনেই ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন। দুজনেই মৌন অবস্থায় আপন আপন অধ্যাত্মভাব ও তত্ত্বোপলব্ধির কথা কয়েকটি মুদ্রার মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
সেদিন ছিল ১৬৫০ খ্রীষ্টাব্দের ফাল্গুন মাসের একটি দিন। দেহু গ্রামের সাধন কুটীরে বসে তুকা সহসা শুনতে পেলেন স্বর্গলোকের আহ্বান। তাঁর চির-আরাধ্য পরম প্রাণপ্রভু বিঠোবাজী আজ যেন তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন।
একটি অভঙ্ পদে তুকা তাঁর তখনকার মনের ভাব ও অনুভূতিটি ব্যক্ত করেন, ওগো! দিন-রাতের মধ্যে আজ আমি কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাই না। নিখিল বিশ্বে ওতপ্রোত হয়ে আছে শুধু আলোকের এক মহা-উদ্ভাসন। সেই আলোকোদ্ভাসের প্লাবনে সব ভেদ দূরীভূত হয়ে যায় নিঃশেষে। প্রভু ও ভৃত্য, ইষ্ট ও ভক্ত, স্বর্গ ও মর্ত্য, আত্মা ও পরমাত্মা সব একাকার হয়ে যায়।
দিব্যদৃষ্টি দিয়ে তিনি তখন আরও দেখলেন সারা বিশ্বজগতে জন্ম মৃত্যু আবির্ভাব তিরোভাব বলে কিছু নেই। বিশ্বের সর্ব ভূতে সকল বস্তুতে এক আত্মা প্রলয়কালীন মহাপ্লাবনের মত ব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই আত্মাই হলো ঈশ্বর, ঈশ্বরের পরম সত্তা, পরমাত্মা।
তুকা বললেন, দেখছি, ঈশ্বরই সব কিছুর দাতা, আবার তিনিই ভোক্তা। আমাদের অনুভূতিও তাঁরই দান। ভাষা ও কণ্ঠও তাঁরই দান। সুতরাং কি ভোগ করব, কি প্রকাশ করব?
সব শেষে তুকা দেখলেন একমাত্র ভেদের প্রাচীর হচ্ছে এই মরদেহ। এবার সেই দেহের প্রাচীরটিকে ভেঙ্গে তাঁর জীবাত্মা সব লীলা ত্যাগ করে স্বর্গমর্ত্যব্যাপী সেই পরমাত্মায় লীন হয়ে গেল। ঈশ্বরের স্বারূপ্য আগেই লাভ করেছিলেন। আজ তিনি লাভ করলেন তার পরমপ্রভু পরমেশ্বর বিঠোবাজীর সাযুজ্য।
এদিকে অগণিত ভক্ত ও শিষ্যের মুখের উপর নেমে এসেছে ঘন বিষাদের ছায়া। সকলের চোখে ঝরছে অশ্রুর ধারা। অবশেষে শোকাকুল ভক্তের দল গুরুর মরদেহটি দাহ না করে তাঁরই শেষ ইচ্ছানুসারে ভাসিয়ে দিল ইন্দ্রায়নী নদীর পবিত্র জলস্রোতে।
………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন