ভবঘুরেকথা
জন্মন্তরবাদ চুরাশির ফেরে পুনজর্ন্ম

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

‘জন্মজন্মান্তর’

সাধারণ চিন্তার মানুষ বুঝে বা বুঝে-জেনে বা না জেনে পুন:পুন: জন্মের মধ্য দিয়ে এই ধরণীতে বারবার ফিরে ফিরে আসতে চায়। এই জন্মে পূর্ণ না হওয়া প্রত্যাশাগুলো পরজন্মে পূরণ হবে এই আকাঙ্খায় পরজন্মের আশা টিকিয়ে রাখতে চায়।

অন্যদিকে সাধুগুরুরা প্রতিনিয়ত সেই সাধনা করে থাকেন যাতে কোনোক্রমেই আর দেহকে আধার করে পুনরায় জন্মাতে না হয় এই মৃত্যুলোকে। এই ফিরে না আসবার সাধনা সাধুগুরুরা কেন করে থাকেন সেটা ভিন্ন আলোচনা।

আবার এই ফিরে আসা বা না আসা এটা কি আদৌও সাধকদের হাতে থাকে? এই বিধি কি সাধক চাইলে পরিবর্তন করতে পারে? এসব প্রশ্নও ভিন্ন আলোচনা। জন্মান্তরবাদের প্রাথমিক আলোচনায় এই বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব বহন করে না। জন্মান্তরবাদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা সেটাই আসলে প্রাথমিক প্রশ্ন।

এই অনিশ্চিত ও রহস্যময় ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র ধ্রুবসত্য হলো ‘মৃত্যু’। এর থেকে রেহাই পাওয়ার পাকাপাকি কোনো উপায় আজো বিজ্ঞান আবিস্কার করে উঠতে পারেনি। জন্মের স্বাদ গ্রহণ করলে মৃত্যুর পেয়ালাও পান করতেই হয়; এটাই দৃশ্যমান সত্য।

এই সত্য অস্বীকার করবার উপায় নেই; কারণ দৃশ্যতঃ এর ব্যতিক্রম দেখা মেলা ভার। আর মৃত্যু যেহেতু নিশ্চিত তাই মৃত্যু পরবর্তি যাত্রা যাতে সুগম হয় সেকারণে প্রচলিত বিভিন্ন মত-পথ-বিশ্বাস অনুসারে মৃতের সৎকার করার নানারকম বিধি প্রচলিত রয়েছে। তা যেমন আমাজনের গভীর অরণ্যে যেখানে সভ্যতার ছোঁয়া পৌঁছায়নি সেখানেও আছে; আবার সভ্যতার আলোক উজ্জ্বল নগরেও আছে।

কেবল মৃতদেহ মাটিতে সমাহিত করে বা আগুনে পুড়িয়েই এর কার্যকারিতা শেষ হয় না। পালন করা হয় নানা বিধিনিয়ম। জন্মকে কেন্দ্র করে যত রীতিনীতির বিধান প্রচলিত আছে বিভিন্ন মত-পথ-বিশ্বাসে; তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি বিধি-আচার করতে দেখা যায় মৃত্যুর পর সৎকারতে কেন্দ্র করে। কিন্তু কেন এই সৎকার? আবার এই নিশ্চিত মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মনসুর ফকির-

এ মানুষ মরলে পরে
বিচার হবে কার
আমি বুঝলাম না ব্যাপার
কে বলে মানুষ মরে।।

ও যেমন পরম থাকেন নিরাকারে
খেলছেন খেলা নিরেতে
আর জীবআত্মা জীবিত থাকে
পরমআত্মার জোরেতে
এই আদি সত্য পরম যিনি
জীব দেহ চালাচ্ছেন তিনি
আবার জন্ম মৃত্যু নাম ধরিয়া
চালাইছেন কোন কারবার
আমি বুঝলামনা ব্যাপার।।

আর পঞ্চ আত্মা পঞ্চরুহু
হিসাবেতেই পাওয়া যায়
একের হতে দুইয়ের জন্ম
এই পরম আত্মার মরণ নাই
আবার পরম আত্মার কর্ম লইয়া
জীব দেহ যায় বিলিন হইয়া
ওরে এমন সুন্দর দেহখানি
হইয়া যায় বেকার
আমি বুঝলামনা ব্যাপার।।

যেমন সাগর হতে আসে পানি
এই নদীতে ভেসে বেড়ায়
যেথা হতে আসে পানি
তথায় আবার ফিরা যায়
এই জোয়ার ভাটায় ঘোরে ফিরে
তবু সাগর কিন্তু শুকায় নারে
তেমনি মানুষ ঘোরে ফিরে
মনসুর কয় বারে বার।।

কে বলে মানুষ মরে
আমি বুঝলাম না ব্যাপার
ওরে মানুষ মরলে পরে
বিচার হবে কার
আমি বুঝলামনা ব্যাপার।।

জন্মান্তরে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী সকলেই মনে করেন মৃত্যুর পর মানুষ নতুন এক যাত্রা শুরু করে। জন্মান্তরে বিশ্বাসীরা মনে করে আত্মা অবিনশ্বর; তার মৃত্যু বা ধ্বংস নেই। সেকারণে মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহ লাভ করে পুনরায় জন্মায়; যতক্ষণ পর্যন্ত না নির্বাণ লাভ করে ততবার জন্মাতেই থাকে; যার যার কর্মফলের বিচারে।

জন্মান্তরে অবিশ্বাসীরা মনে করে, মৃত্যুর পর রূহ অপেক্ষা করে শেষ বিচারের জন্য। আত্মা বা রূহরুহু অবিনশ্বর ; তবে তার আর পুনরায় জন্ম হয় না। তা, ব্রহ্মাণ্ডের নির্দিষ্ট স্তরে শেষ বিচারের প্রতীক্ষায় অবস্থান করতে থাকে। আর এই দুই মতের কোনটাই যারা বিশ্বাস করেন না, তারা অবশ্য এটা নিশ্চিত করে বলতে পরেন না যে, মৃত্যুর পর আত্মার পরিণতি কি হয়।

আবার যারা আত্মা বা জীবনীশক্তিকেও বিশ্বাস করেন না, তারা এটাও স্পষ্ট করে বলতে পারেন না যে, কিসের কারণে মানুষ বেঁচে থাকে আর কিসের অভাবে দেহে সমস্ত কিছু উপস্থিত থাকতেও তাতে আর প্রাণ থাকে না।

তবে সম্রাট ও ধনাঢ্যদের জন্য নেয়া হতো সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। শুধু দেহকে মমি করেই ক্ষান্ত দিতো না তারা। আত্মা দেহে ফিরে আসলে দেহের যা যা প্রয়োজন হতে পারে। সবকিছুরই ব্যবস্থা রাখা হতো মমির সাথে। নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাবার-দাবার, এমন কি মহামূল্যবান দ্রব্যাদির পাশাপাশি পশুপাখি, দাস-দাসী পর্যন্ত মমির সাথে দেয়া হতো।

প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করত, মৃত্যুর পর দেহ থেকে আত্মা আগামী দুনিয়ায় যাত্রা শুরু করে। যার যার কর্মফল অনুযায়ী সূর্যের প্রহরীরূপে থাকার পর আত্মা পুনরায় দেহে ফিরে আসে। কিন্তু মৃতদেহে পচন ধরলে বা আঘাত লাগলে আত্মা আর দেহে প্রবেশ করতে পারে না। আত্মা ফিরে এসে যদি অক্ষত দেহ না পায় তাহলে সূর্য ধ্বংস হয়ে পৃথিবীতে মহাপ্রলয় নেমে আসবে।

এই বিশ্বাস থেকেই প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে সঠিক পদ্ধতিতে দেহ সংরক্ষণ ছিল অতিব জরুরী। মৃত্যুর পর পচন থেকে বাঁচাতে মিশরীয়রা নানা কৌশল-পদ্ধতি-আচার-রীতি-নীতি মেনে দেহকে মমিতে রূপান্তরিত করত। অত্যন্ত কারিগরি দক্ষতা-সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় এই পদ্ধতি সকলের ভাগ্যে জুটতো না। তারপরও প্রত্যেকের মৃতদেহেই প্রাথমিক কিছু ক্রিয়া করা হতো।

তবে সম্রাট ও ধনাঢ্যদের জন্য নেয়া হতো সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। শুধু দেহকে মমি করেই ক্ষান্ত দিতো না তারা। আত্মা দেহে ফিরে আসলে দেহের যা যা প্রয়োজন হতে পারে। সবকিছুরই ব্যবস্থা রাখা হতো মমির সাথে। নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাবার-দাবার, এমন কি মহামূল্যবান দ্রব্যাদির পাশাপাশি পশুপাখি, দাস-দাসী পর্যন্ত মমির সাথে দেয়া হতো।

আর এ সবকিছুকে সুরক্ষা দিতে এবং মমির জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা নির্ধারণ করতে বানানো হতো বিশালাকৃতির পিরামিড। আবার পিরামিড পাহারার জন্য নির্মাণ করা হতো স্ফিংস। জানা যায়, ধনাঢ্যদের মতো না হলেও সাধারণ মানুষের সমাধীতেও তারা সাধ্যমত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দিতো।

অবশ্য এই মমি প্রথা কেবল মিশরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে পিরামিডের সন্ধান পাওয়া যায়। পেরুতে মৃতদেহ মমি করা ও পিরামিডের অস্থিত্ব পাওয়া যায়।

অন্যদিকে ‘মৃত্যু মানেই চিরবিদায় এটা বিশ্বাস করে না ইন্দোনেশিয়ার সালাউয়াসি অঞ্চলের টোরাজন সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা মৃতদেহকে মমি করে ঘরেই রেখে দেয়। প্রতিদিন তাদের সাথে কুশলবিনিময় করে, প্রার্থনা করে, প্রতিবেলায় খাবারদাবার দেয়, সেবা যত্নআত্তি করে; প্রয়োজন অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ করে।

তারা বিশ্বাস করে, মৃতরা সকল কিছুই শুনতে ও বুঝতে পারে। তবে ব্যক্ত করতে পারে না। একজন অসুস্থ মানুষকে যেভাবে সেবাযত্ন করা হয় সেভাবেই মৃতদেহকে সেবাযত্ন করা হয়। এমনি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও গোসল পর্যন্ত করানো হয় সময় সময়।

বাড়ির অন্যান্য সদস্যের মতোই তারা ঘরে সকলের সাথেই বিশেষ যত্নে অবস্থান করে। তবে টোরাজনরাও মৃতের সৎকার করে। তবে তা মৃত্যুর পরপরই নয়। তারা বিশ্বাস করে, দ্রুত সমাহিত করা হলে মৃতকে ছেড়ে থাকতে তাদের যেমন কষ্ট অনুভূত হবে তেমনি মৃতেরও কষ্ট হবে তাদের ছেড়ে যেতে।

মৃত্যুর বহুবছর পর যখন টোরাজনটা মনকে স্থির করতে পারে তখন সেই মৃতদেহকে বিশাল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাহিত করে। তবে এতে তাদের মৃতের সাথে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে যায় না। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সেই মৃতদেহ সমাধি থেকে উত্তোলন করা হয়।

মৃতদেহকে পুনরায় রক্ষণাবেক্ষণ করে পরিপাটি করে নতুন পোষাকে সাজানো হয়। সপ্তাহখানেক সকলের মাঝে রাখার পর নতুন করে প্রকৃয়াকৃত উপাদান দিয়ে আবার সমাহিত করা হয়। এই বিধি এখনো প্রচলিত আছে তাদের মাঝে।

আবার তাইওয়ানের কিছু অধিবাসীদের মধ্যে পূর্বপুরুষের মৃতদেহ সমাধি থেকে তুলে বিশেষ পাত্রে দ্বিতীয়বার সমাহিত করার বিশেষ রীতি প্রচলিত আছে। তাদের বিশ্বাস, পূর্বপুরুষরা সুখে থাকলেই তারা সুখে থাকবে। পূর্বপুরুষের আত্মা ভালো না থাকলে স্বাচ্ছন্দে না থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম ভালো থাকতে পারে না।

তাই যখন তারা মনে করে তাদের মৃত নির্দিষ্ট কোনো পূর্বপুরুষদের ভালো নেই; তখন তারা তার দেহ সমাধি থেকে তুলে নতুন করে দ্বিতীয়বারের মতো সামহিত করে। তারা বিশ্বাস করে, মৃতরা যখন ভালো না থাকে তখন তাদের কাছে এসে বলে তারা ভালো নেই। তখন তারা এই ক্রিয়া করে থাকে।

এছাড়াও প্রতিবছর মৃতদেহ সৎকার দিবসে তারা মৃতের যা যা প্রয়োজন হতে পারে এমন সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় ও বিনোদন সামগ্রী, খাবার পানীয়, টাকাপয়সা ইত্যাদি সমাধির সামনে আগুনে পুড়িয়ে থাকে। মনে করা হয়, এভাবে পুড়িয়ে দিলে মৃতরা তা লাভ করে।

দ্বিতীয়বার সমাহিত করার সময় সমাধি থেকে উত্তোলিত সমস্ত হাড়কে উত্তমরূপে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে; দেহের শ্রেণীতে সাজিয়ে বিশেষ রং দিয়ে রক্তের ধারা তৈরি করে; তারপর প্রতিটি হাড় আলাদা আলাদা করে বিশেষ কাগজ বা কাপড় দিয়ে মুড়ে পুনরায় শ্রেণীবদ্ধ করে। তারপর নির্দিষ্ট আকৃতির পাত্রে সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, এভাবে ক্রিয়া করলে আত্মা পুনরায় দেহে সুখে বসবাস করতে পারে।

এইরকম ব্যতিক্রমী সৎকারের চিত্র পৃথিবী জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন মত-পথ-বিশ্বাসে। এমন অদ্ভুত অদ্ভুত রীতি দৃষ্ট হয় যা অনেকক্ষেত্রে বিশ্বাস করাও কঠিন। তবে মৃতদেহ সংরক্ষণের কোন বিশেষ রীতি ভারতবর্ষে অধিক প্রচলিত মত-পথ-বিশ্বাসে দেখতে পাওয়া যায় না সেভাবে।

তবে ভারতবর্ষে স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের বিভিন্ন রীতি দেখতে পাওয়া যায়। এরমধ্যে মৃতের ছবির মধ্য দিয়ে মৃতকে স্মরণ সনাতন বিশ্বাসীদের মাঝে অধিক লক্ষণীয়। সকল মতের মানুষই মৃতের ছবি সংরক্ষণ করলেও সনাতন ধর্মালম্বীরা মৃতের ছবি বাঁধাই করে গৃহে রাখে এবং প্রত্যেকদিন তাতে তাজা ফুলের মালা দিয়ে পূজা করে।

এতে করে মৃত আত্মীয়-স্বজনকে প্রতিদিন স্বরণের পাশাপাশি তাদের ছবির মধ্যে দিয়ে তাদের উপস্থিতিই অনুভব করে। এই রীতি অনেক সম্প্রদায়ের মাঝে প্রচলন থাকলেও সনাতন ধর্মালম্বীদের মাঝে এই রীতি অবশ্য পালনীয়।

অন্যদিকে ভারতবর্ষ আদিকাল থেকেই আত্মাকে দেখা হয়েছে পৃথক সত্ত্বা হিসেবে। আত্মা দেহে থাকলেও সে দেহের সাথে না মিশে পৃথক থাকতে পারে এই ধারণা ভারতীয় সনাতনী মুণি-ঋষিরাই প্রথম করেছিল বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়।

ধারিত্রীর সকল মত-পথ বিশ্বাসেই মৃতদেহ সৎকারে নিজস্ব রীতি-নিতি-বিধি যেমন প্রচলিত রয়েছে; তেমনি আত্মা সম্পর্কে রয়েছে নিজস্ব ভাবনা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রাচীন বেশিভাগ বিশ্বাসে আত্মাকে দেহের অংশ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই মৃত্যুর পরও দেহকে সংরক্ষণে নানা বিধিমালা আবিস্কৃত হয়েছে।

অন্যদিকে ভারতবর্ষ আদিকাল থেকেই আত্মাকে দেখা হয়েছে পৃথক সত্ত্বা হিসেবে। আত্মা দেহে থাকলেও সে দেহের সাথে না মিশে পৃথক থাকতে পারে এই ধারণা ভারতীয় সনাতনী মুণি-ঋষিরাই প্রথম করেছিল বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়। আত্মা অমর ও অবিনশ্বর প্রাচীন মিশরীয়সহ অন্যান্য আদি বিশ্বাসীদের মাঝে আত্মা নিয়ে চর্চা করতে দেখলেও তাদের মাঝে আত্মাকে দেহের অংশ হিসেবেই ভাবতে দেখা যায়।

অনার্যদের মাঝে এমন ভাবনার উদয় হয়েছিল এরূপ যথার্থ প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। তাই এ অঞ্চলে মৃত্যুর পর দেহকে সংরক্ষণের পরিবর্তে পঞ্চভুতের দেহ যতদ্রুত পঞ্চভুতে মিশে যেতে পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে দেখা যায়। অনেকে অবশ্য বিষয়টাকে এভাবে দেখবার চেষ্টা করেছেন যে, এই অঞ্চলের আবহাওয়া দেহ সংরক্ষণের উপযোগী নয় তাই দেহ সংরক্ষণ করার কোনো বিধি প্রচলিত হয়নি।

কিন্তু ভারতীয় আধ্যাত্মবাদে দেহকে কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়নি সেভাবে। সকল সময়ই আত্মাকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ভারতীয় মুণি-ঋষিদের সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে গভীর অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রমাণ পাওয়া গেলেও মৃতদেহ সংরক্ষণের তেমন কোনো দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া যায় না। তবে যোগী বা সিদ্ধ পুরুষদের না পুড়িয়ে মাটিতে সমাহিত করার বিধান দেখা যায়।

কিন্তু সৎকারের বিশেষ রীতি ভারতবর্ষে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতোই প্রচলিত। অনেকক্ষেত্রে শেষকৃর্ত অনেক বেশি গুরুত্ব সহকারে ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করতে দেখা যায়। এমন কি সনাতন ধর্মালম্বীদের এর অনেক রীতি পালন করতে বেশ বেগও পেতে হয় আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে।

কিন্তু প্রায় সকলেই ভেবে থাকেন আর্থিক অসঙ্গতি থাকলেও মৃতের সদগতির জন্য এসব অবশ্য পালনীয়। এইরূপে মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-জৈন সহ ভারতবর্ষের বড় সম্প্রদায়গুলো নিজ নিজ ক্রিয়ার মাধ্যমে মৃতদেহ সৎকার ও তার পরবর্তী ক্রিয়া করে থাকে।

বছর বছর একই দিনে স্মরণসহ নানা বিধি পালন করে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও তাই। আসলে এসবই মৃত্যু পরবর্তী সময়কালে যাতে মৃতের কোনোরূপ জটিলতা তৈরি না হয় তাই করা হয়। আর যুগ যুগ ধরে এই প্রথাই চলে আসছে। আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক লোকজন অবশ্য এসব ধার ধারেন না। তবে সামাজিক চাপে অনেকে করতে বাধ্য হন। আবার অনেকে সবকিছুই এড়িয়ে যান।

আসলে এই যে আসা যাওয়া। এই যে জন্ম মৃত্যু। এই যে এর মধ্যবর্তী সময়ে কাটিয়ে যাওয়া জীবন। সবকিছুই রহস্যময়। এই জীবন কেনো? জীবনের অর্থ কি? আমি কে? এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তরও মানুষ আজো সেভাবে নির্দিষ্ট করতে পরেনি। তেমনি জন্মান্তর বা জন্মান্তরবাদকে নিয়েও এক এক জনের রয়েছে এক এক ধারণা। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার বিচারে এর কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সত্য কিন্তু নিশ্চিত করে বলা কি আর সম্ভব?

তাই ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-

দেখ নারে মন পুনর্জনম কোথা হতে হয়।
মরে যদি ফিরে আসে
স্বর্গনরক কেবা পায়।।

পিতার বীজে পুত্রের সৃজন
তাইতে পিতার পুনর্জনম,
পঞ্চভূতে দেহের গঠন
আলকরূপে ফেরে সাঁই।।

ঝিয়ের গর্ভে মায়ের জন্ম
এ বড় নিগূঢ় মর্ম,
শোণিতে শুক্র হলে গম্ভু
তবে সে ভেদ জানা যায়।।

শোণিতে শুক্র হলে বিচার
জানতে পারবি কে জীব কে ঈশ্বর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন এবার
ঘুরে ম’লি কোলের ধোঁকায়।।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২

চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১

চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • uzzal , সোমবার ৪ নভেম্বর ২০১৯ @ ১২:৪৫ অপরাহ্ণ

    মৃত্যু মানে চিরবিদায় নয়,জয় গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!