ভবঘুরেকথা

শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দের অনুপ্রাণনা থেকে-

এই বিশাল পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখি সদাব্যস্ত মানুষ মহাবেগে ভেসে চলেছে জীবন প্রবাহে। এ সম্বন্ধে একটু ভাবলে মনে বিস্ময়ের উদ্রেক হয়, প্রশ্ন জাগে কোথায় চলেছে সবাই? কি তাদের উদ্দেশ্য? গন্তব্যস্থলে নিশ্চিত পৌঁছবার শ্রেষ্ঠ পথটিই বা কি? 

এদের অনেকের গতিই লক্ষ্যহীন, যেন পলায়মান গাড়ি পথের ঠিকানা জানা নেই। কেন চলেছে, জীবনপথে কোথায় চলেছে এ সম্বন্ধে কোন বিচার নেই, কোন চিন্তা নেই। তারা লক্ষ্যহীন সর্পিল পথে চলেছে, না সোজাসুজি লক্ষ্যপানে চলেছে কিছুই তারা দেখে না। এইভাবে যদি চিন্তা না করে আমরা চলি, তাহলে পথের সন্ধানই বা কি করে মিলবে, আর গন্তব্যস্থলেই বা কি করে পৌঁছাব?

আবার অনেক লোক জীবনের আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অজ্ঞ হলেও, তারা নিজেরা কি চায় তা জানে এবং নিজ উদ্দেশ্য পূরণেও তারা কৃতসঙ্কল্প। ব্যক্তিগত বাসনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তনের স্বার্থে, তারা নিজ ইচ্ছাপূরণের জন্য ভেতরের উদ্যমকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হয়। উদ্যম একটি সৃজনী শক্তি; আমাদের সবার মধ্যে অবস্থিত সেই অসীম স্রস্টারই একটি উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ। 

অনুপ্রাণনা হচ্ছে সৃষ্টি করার ক্ষমতা। সৃষ্টি বলতে বোঝায় নতুনভাবে, নতুন পদ্ধতিতে, নতুন জিনিস তৈরির চেষ্টা যা আগে কেউ জানত না। সৃষ্টিকর্তার কাছে থেকে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়া এই সৃষ্টি ক্ষমতার নামই হলো অনুপ্রাণনা।

আমাদের পরিচিত কিছু লোকের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, তাদের অনেকের মনই যেন এক অশ্বশক্তির ইঞ্জিন। নিজের সৃজনশক্তিকে অনেকেই সম্পূর্ণ কাজে লাগায় না। তারা খায়, কাজ করে, আমোদ-প্রমোদ করে, আর ঘুমায় এই তাদের জীবন। এইভাবে জীবনযাপন করলে, মানুষ আর পশুতে প্রভেদ থাকে কোথায়?

অবশ্য মনঃস্তত্ত্ববিদগণের মতে একটি প্রভেদ আছে। সেটি হলো মানুষই একমাত্র জীব যে হাসতে পারে। হাসতে পারার ক্ষমতা একটি উত্তম গুণ সন্দেহ নেই। তুমি যদি হাসতে না পার তবে উন্নততর জীব মানুষ হিসাবে তোমার বাড়তি গুণটিও আর রইল না। যারা অহরহ জীবনকে সমস্যাসঙ্কুল ভেবে হাসতে ভুলে যায়, তাদের অনুসরণ করো না। তারা জীবনকে মোটেই ভোগ করতে জানে না। 

হাসতে পারার মতো অতুলনীয় ক্ষমতা ছাড়াও মানুষের আর একটি বিশেষ গুণ আছে। এটি মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণগুলির অন্যতম। এর নাম অনুপ্রাণনা বা প্রেরণা শক্তি। এই রহস্যময় গুণটি আসলে কি? উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আমেরিকাবাসীগণ বাণিজ্য ও প্রযুক্ত কারিগরী বিদ্যায় অনুপ্রাণনা শক্তিসম্পন্ন; ভারতবাসী ধর্ম বিষয়ে অনুপ্রাণনা শক্তিবিশিষ্ট।

অনুপ্রাণনা হচ্ছে সৃষ্টি করার ক্ষমতা। সৃষ্টি বলতে বোঝায় নতুনভাবে, নতুন পদ্ধতিতে, নতুন জিনিস তৈরির চেষ্টা যা আগে কেউ জানত না। সৃষ্টিকর্তার কাছে থেকে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়া এই সৃষ্টি ক্ষমতার নামই হলো অনুপ্রাণনা।

পরম পিতার নিকট থেকে প্রাপ্ত এই স্বর্গীয় উপহারের কি সদ্ব্যবহার তুমি জীবনে করেছ? ক’জন লোক সত্যিই এই সৃজন ক্ষমতার ব্যবহার করে? সপ্তাহ, মাস, বছর অতিবাহিত হয়ে যায় কিন্তু তারা যেমন ছিল, তেমনি থাকে। একমাত্র বয়সে বড় হওয়া ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য কোনও পরিবর্তন আসে না।

অনুপ্রাণনা শক্তিসম্পন্ন মানুষ কক্ষচ্যুত তারকার মত; আত্মার মহান উদ্ভাবনী শক্তির বলে সে, কোন কিছু না থেকেই হয়ত কিছু সৃষ্টি করে চলেছে; অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করছে। অনুপ্রাণনা শক্তিসম্পন্ন মানুষকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে- উচ্চ শ্রেণী, মধ্যম শ্রেণী ও সাধারণ শ্রেণী। এছাড়া আর একদল লোক আছে যারা সংখ্যায় বহু হলেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অভাবে ধর্তব্যের বাইরেই পরে থাকে।

আত্মজিজ্ঞাসা জিজ্ঞাসা করে দেখ, “আমি কি কখনও এমন কোন কাজ করতে চেষ্টা করেছি যা পূর্বে আর কেউ করেনি?” অনুপ্রাণনা শক্তির প্রয়োগ এভাবেই আরম্ভ করতে হয়।

যদি এ প্রশ্ন তোমার মনে না জেগে থাকে, তবে তুমিও সেইসব ভ্রান্ত মানুষের দলেরই একজন, যারা সর্বদা ভাবে নিজেদের কর্মপন্থা পরিবর্তনের ক্ষমতা তাদের নেই। ঘুমের ঘোরে যারা পথ চলে বেড়ায় এরা অনেকটা তাদেরই মত। অবচেতন মনের ইঙ্গিত তাদের চেতনাকে ক্ষীণবল করে রেখেছে। 

যদি তুমি এইরূপ নিদ্রিত অবস্থায় থেকেই জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে থাক, তবে শীঘ্র নিদ্রা মুক্ত হও। সতেজে বলো “আমি মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণের অধিকারী আমি অনুপ্রাণনা শক্তির অধিকারী। প্রত্যেক লোকের মধ্যেই যা আগে হয়নি এমন নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষমতা রয়েছে।

অথচ ভ্রান্ত আমি পারিপার্শ্বিক অবস্থার মোহে অতি সহজে নিজের শক্তির কথা ভুলতে বসেছিলাম নিজের সীমাবদ্ধতারূপ নশ্বর চেতনার প্রপঞ্চে কত সহজে আবদ্ধ হয়েছিলাম।” কিন্তু তুমি যদি বল “কর্মক্ষেত্রে সর্বত্রই তো মহা ভীড়! অযথা কষ্ট করে লাভ কি?”

তাহলে বোঝা যাবে যে নৈরাশ্যব্যঞ্জক জাগতিক চেতনার মায়াজালে তুমিও আবদ্ধ হয়েছ। এই জন্যই নিজের অনুপ্রাণনা শক্তির অভাবে, জীবনে পদে পদে এত মানুষ অকৃতকার্য হয়। 

আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও বহুলোক নিষ্ক্রিয়ের মত একই পথে সারাজীবন চলতে থাকে। মনে অসন্তোষ জমে উঠলেও বুদ্ধিহীনের মত পারিবারিক বা পারিপার্শ্বিক চিন্তাধারাতেই সে আবদ্ধ থাকে। যেমন হয়ত ব্যাপ্টিস্ট পরিবারে সে জন্মেছে অথচ বাড়ি পাল্টানোর ফলে এখন কনগ্ৰিগেশ্যনাল চার্চের কাছে তাকে বাস করতে হয়। ফলে তাকেও কনগ্ৰিগেশ্যনলিস্ট হতে হয়। 

নিজ হৃদয়ের অনুজ্ঞা অনুসারে, জীবনের নতুনতর অভিজ্ঞতাকে বরণ করে নেওয়া প্রত্যেক মানুষের অবশ্য কর্তব্য। অন্ধের মত কাজ করা তার উচিত নয়। আমার গুরুদেব শ্রীযুক্তেশ্বরজী বলতেন, “মনে রেখো যদি তোমার মধ্যে সত্যিই সেই বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়ে থাকে যা ঐশ্বরিক এবং তোমার এমন জিনিষ পেতে ইচ্ছা করে যা পৃথিবীতে পাওয়া যায় না; তাহলে তোমার জন্যই তাও সৃষ্টি হবে।”

এঁরা হলেন অপরাজেয় অনুপ্রাণনা শক্তি, আধ্যাত্মিক অনুপ্রাণনা শক্তির অধিকারী। এইসব মহাপুরুষদের এইরূপ গৌরব লাভ কি ঈশ্বরের একদেশদর্শীতার ফল? গৌরব লাভের জন্যই কি ঈশ্বর তাহাদিগকে বিশেষভাবে নির্বাচন করেছেন? 

অন্তরের শক্তির উপর ও ইচ্ছার আধ্যাত্মিক শক্তির উপর, আমার এইরূপ একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল; তাই আমি যখন যা চাইতাম তা পাবার সুবিধার জন্য নতুন অবস্থার সৃষ্টি হতো। 

অনুপ্রাণনা শক্তি তোমাদের মধ্যে অনুন্নত, অব্যবহৃত, অগঠিত ও অনুদঘাটিত অবস্থায় আছে। এই শক্তি আত্মার একান্ত নিজস্ব। ভগবান সকলকেই এই শক্তি দিয়েছেন, কিন্তু তোমরা তাকে ব্যবহার কর না। তাহলে তুমি কিরূপে অনুপ্রাণিত হবে?

যদি তুমি নিজে নতুন কিছু সৃজন করার চিন্তা করতে না পার, বা নিজের পথ রচনা করার উদ্যম না নাও, তবে অন্যে ইতিপূর্বে যা করেছে, তাই আরও উন্নততরভাবে করার চেষ্টা কর। অন্যের কৃত কাজ উন্নততরভাবে করবার চেষ্টাই হলো অনুপ্রাণনা শক্তি বিকাশের প্রথম সোপান। 

মানুষ যখন নতুন কিছু কথা লেখে বা অগৌণ নতুন কিছু আবিষ্কার করে, সেটি হলো অনুপ্রাণনার দ্বিতীয় সোপান বা মধ্যম শ্রেণীর অনুপ্রাণনা। মানুষ যখন উদ্ভিতত্ত্ববিদ্ বারব্যাঙ্কের মত বা পদার্থবিজ্ঞানী এডিসনের মত চিত্তচমৎকারিণী গবেষণালব্ধ ফলের অধিকারী হয়, সমস্ত বিশ্ব যখন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাদের আবিষ্কারের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন বুঝতে হবে : সর্বশ্রেষ্ঠ অনুপ্রাণনা শক্তির বিকাশ হয়েছে।

এঁরা হলেন অপরাজেয় অনুপ্রাণনা শক্তি, আধ্যাত্মিক অনুপ্রাণনা শক্তির অধিকারী। এইসব মহাপুরুষদের এইরূপ গৌরব লাভ কি ঈশ্বরের একদেশদর্শীতার ফল? গৌরব লাভের জন্যই কি ঈশ্বর তাহাদিগকে বিশেষভাবে নির্বাচন করেছেন? 

না, তা কখনই নয়। তারা নিজ নিজ অনুপ্রাণনা শক্তির বলেই এই গৌরবের অধিকারী হয়েছেন। এইরূপ গৌরব লাভে ঈশ্বরের অমর সন্তান হিসাবে প্রত্যেক লোকেরই সমান অধিকার। যে লোক ব্যক্তিগত গৌরব লাভে উৎসুক, তাকে কখনই মহৎ বলা চলে না। আত্মগর্বে স্মীত হয়ে তারা ঈশ্বরের প্রকৃত সাহায্য লাভে বঞ্চিত হয়। শক্তি, সাহস, সঙ্গীত বা শিল্পকলা দানের বিষয় যাইহোক না কেন, যিনি অপরকে দিয়েই সুখী, তাকেই শুধু মহৎ বলা চলে। 

এ জগতে যারা গৌরবের অধিকারী হয়েছেন, তারা সবাই নিজ নিজ অবচেতন মনের সাহায্যেই পরিচালিত হয়েছেন; এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে প্রাথমিক অবস্থায় কিছুটা সাহায্য পেয়েছেন মাত্র।

বংশ কৌলিন্যকে কাজে লাগিয়ে তারা অসাধারণ, অনন্য হয়েছেন। তোমার মধ্যেও যদি মহৎ হবার মত গুণ থাকে, মহৎ হবার বীজ সুপ্ত থাকে, তাহলে তুমিও তোমার মনঃশক্তির সাহায্যে পরিবেশ পরিবর্তন করে, নতুন পরিবেশে তোমার অনুপ্রাণনার বীজকে অঙ্কুরিত করে, তাকে সুন্দর কুসুমিত করতে পার। সুতরাং এই অর্থে মহৎ লোক সৃষ্ট হয় এ কথাই ঠিক।

তবে আমি এও জানি যে মহৎ লোক সৃষ্টিও করা যায় বা অতি সাধারণ মানুষ হতেও মহামানবকে গড়ে তোলা যায়। বড় হওয়ার, অসাধারণ অনুপ্রাণনা শক্তির অধিকারী হবার রাস্তা আছে। জ্ঞান, উপযুক্ত শিক্ষা ও যোগদা সৎসঙ্গ সাধন প্রণালীর চর্চায় এই শক্তির বিকাশ সাধন হয় এবং তাকে পূর্ণভাবে কার্যকারী করাও যায়।

যারা দীর্ঘকাল আগে প্রচেষ্টা শুরু করেছে, তারাই এখন তাদের কর্মের সুফল দেখতে পাচ্ছে। তোমরাও নিজস্ব শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হও। আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করবার জন্যে তোমাকেই চেষ্টা করতে হবে। 

বেশিরভাগ লোকের স্বভাব হচ্ছে নিজ ব্যক্তিত্বের বিকাশের কথা ভুলে প্রাণহীন পুরানো শ্লোক আওড়ানো, আর অন্য লোকের ভাবধারা সংগ্রহ করা। তোমার নিজের মধ্যে কি কোনো বিশেষত্ব নেই? কোথায় তোমার মধ্যে ঈশ্বরের অনন্য বিশিষ্টতা? তার ব্যবহার করছ না কেন?

যে কোনও জীবিকায় সিদ্ধিলাভ করতে হলে অন্য লোকের নিন্দায় বা সমালোচনায় বিচলিত হলে চলবে না। চিরাচরিত ভাবকে ত্যাগ করে নতুন ভাবনা ভাবতে শেখো, নতুন ভাবে কথা বলতে শেখো এবং নিজের বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য শক্তিহীন ও শ্লথ প্রকৃতি মানুষের কাছ থেকে দূরে থাক। তোমার উদ্যম যেন অক্লান্ত থাকে।

অসাধারণ অনুপ্রাণনাসম্পন্ন লোক জানে যে, সে ঠিক পথেই চলছে; তাই সবসময় বাধাবিঘ্ন তার কাছে একান্ত তুচ্ছ বলে মনে হয়। মনে রেখো, অসীম সৃজনী শক্তি তোমাকে সর্বদা সাহায্য করছে ; অতএব দৃঢ় পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে চল। ঐ অসীম শক্তির সঙ্গেই প্রথমে তোমাকে সচেতন যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। এ হলো যাবতীয় অনুপ্রেরণার উৎস।

সেই অতিমানস চেতনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হলে চেতন ও অবচেতন মন স্বতঃই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বহুদিন পূর্বে আমার মনে একটা সন্দেহ জেগেছিল যে, যে সামান্য অনুপ্রাণনা শক্তি আমি অর্জন করেছি তা হয়ত শেষপর্যন্ত নানা কঠিন পরীক্ষার ফলে নষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু এখন আমি সেই পরমশক্তির উৎসকে নিজ হৃদয় মধ্যে অনুভব করেছি যে শক্তি সমস্ত শিল্পকলা, সঙ্গীত এবং জ্ঞানেরও উৎস। সেই শক্তি যখন আমার সহায়ক, তখন আমার পরাজয় অসম্ভব। 

কোনও সুন্দর কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা তোমার মনে জাগলে কাজটি আরম্ভ করার আগে স্থির হয়ে বসে ধ্যানস্থ হও। ধ্যানে তোমার মধ্যে যে অসীম ও আবিষ্কারপ্রবণ সৃজন শক্তি রয়েছে, তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন কর। নতুন রকম কাজে নিজেকে নিযুক্ত কর। কর্মের পথে এ বিশ্বাস কখনও হারিয়ো না যে, সেই মহান তত্ত্ব তোমার সব কাজের অন্তরালে আছেন এবং তিনিই তোমাকে সাফল্যলাভে সহায়তা করবেন।

আত্মার অসীম সৃজনশক্তির কাজই হচ্ছে সর্বদা সকলকে সাহায্য করা। সন্দেহ ও কুঁড়েমির জঞ্জালে সেই উৎসমুখ বন্ধ করে রেখেছ। ঐ জঞ্জাল অপসারণ কর! অটল সংকল্প সহকারে কর্মপথে অগ্রসর হও। 

বেশিরভাগ লোকের স্বভাব হচ্ছে নিজ ব্যক্তিত্বের বিকাশের কথা ভুলে প্রাণহীন পুরানো শ্লোক আওড়ানো, আর অন্য লোকের ভাবধারা সংগ্রহ করা। তোমার নিজের মধ্যে কি কোনো বিশেষত্ব নেই? কোথায় তোমার মধ্যে ঈশ্বরের অনন্য বিশিষ্টতা? তার ব্যবহার করছ না কেন? ধর্মশিক্ষণের কার্যে ব্রতী হতে প্রথম দিকে আমার অনিচ্ছাই ছিল। এ কাজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করে আমি ভয় পেতাম।

শিক্ষককে সবরকম আঘাত নীরবে পরিপাক করতে হয়, কারণ আঘাত যদি চঞ্চলতার সৃষ্টি করে তবে শিক্ষক সাহায্য প্রার্থীকে সাহায্য করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সত্যিকারের ধর্মোপদেস্টা হতে হলে প্রত্যেক মানুষকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে বুঝতে হবে, আর পরমেশ্বরকে জানতে হবে।

কিন্তু আমার গুরুদেব শ্রীযুক্তশ্বরজী যখন আমাকে জানালেন যে আমার বর্তমান জীবনের ভূমিকা হবে ধর্মোপদেস্টার ভূমিকা, তখন আমি পরমেশ্বরের কাছে তাঁর অসীম শক্তিলাভের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করলাম। 

প্রথম বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করবার সময় মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে আমি পুঁথিগত বিদ্যার কথা কাউকে বলব না, আমার অন্তরের অনুপ্রেরণা অনুযায়ীই কথা বলব। মনে মনে আরও ভেবে নিলাম যে আমার বক্তৃতার প্রতিটি কথার পেছনে থাকবে অফুরন্ত ‘সৃজন শক্তি’। অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমি এই শক্তিকে নানাভাবে লোকহিতকর কাজের জন্য ব্যবহার করেছি ব্যবসায়ীকে সাহায্য করেছি।

অমরত্বকে প্রকাশ করতে আমি মরণশীল মানব-মন ব্যবহার করেছি। আমি পরমেশ্বরের নিকট কখনও প্রার্থনা করিনি যে, “প্রভু, আমার এ কাজটি করে দাও।”

আমি বলেছি “প্রভু! আমি এই কাজটি করতে চাই। তুমি আমার পথনির্দেশ কর, আমাকে প্রেরণা দাও, আমার চালক হও।” কাজ সামান্য হলেও সর্বদা সেটি অনন্যভাবে শেষ কর; যে কাজই কর না কেন, তার সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী হও।

গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেও না। এমন কিছু কর যা ইতিপূর্বে অন্য কেউ করেনি, এমন কিছু যা দেখে সমস্ত পৃথিবী বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যাবে। এমন কিছু কর যাতে বোঝা যায় যে পরমেশ্বরের সৃষ্টিক্ষমতার তুমিও একজন অধিকারী।

অতীতকে ভুলে যাও। তোমার ভুলের পরিমাণ যদি সাগরের মত অতলস্পর্শীও হয় তথাপি তোমার আত্মা তাতে নিমজ্জিত হবে না। পুরানো ভুলের স্মৃতি যেন তোমার বর্তমান অগ্রগতির পথে বাঁধার সৃষ্টি না করে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সহকারে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হও। 

জীবনের পথে অন্ধকার আছে, জটিলতা আছে। সুযোগ সুবিধা দেখা দিয়েই অদৃশ্য হতে পারে, কিন্তু কখনও এমন কথা মনে ভেবো না, “আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। ভগবান আমাকে পরিত্যাগ করেছেন।”

এমন হতাশাভরা লোকের জন্য কে কি করতে পারে? তোমার আত্মীয় পরিজন তোমাকে পরিত্যাগ করতে পারে, সৌভাগ্য হয়ত তোমাকে ত্যাগ করতে পারে, সমগ্র মানবকুল ও প্রাকৃতিক অবস্থাও তোমার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে, কিন্তু তোমার মধ্যে যে দিব্য অনুপ্রাণনা শক্তিটি রয়েছে তার সাহায্যে তুমি তোমার পূর্বকৃত পাপের ফলস্বরূপ প্রাপ্ত দুর্ভাগ্যকে পরাজিত করে বিজয়ীর বেশে স্বর্গে প্রবেশলাভ করতে পার। 

শতবার পরাজিত হলেও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস কর যে, শেষ জয় তোমারই। পরাজয় চিরদিন ঘটবে না। পরাজয় ক্ষণকালের পরীক্ষামাত্র। এই পরীক্ষার ছলে ভগবান তোমাকে অজেয় রূপে গড়ে তুলেছেন। তোমার মধ্যে যে অজেয় শক্তি নিহিত আছে তাকে প্রয়োগ করা শেখাচ্ছেন যাতে যে উন্নত ভূমিকায় অভিনয় করবার জন্য তুমি সংসারে এসেছ, তাতে সফল হও।

কোন ভূমিকাটি তোমার পক্ষে উপযোগী হবে তা তুমি নিজে কি করে বুঝবে? সবাই যদি রাজার ভূমিকা পাওয়ার জন্য ব্যগ্র হয় তাহলে ভৃত্যের ভূমিকাটি কে নেবে? রঙ্গমঞ্চে রাজার ভূমিকা আর ভৃত্যের ভূমিকার মধ্যে আসলে কোন তফাৎ নেই, যদি ভূমিকাটি ঠিকমত সুষ্ঠুভাবে অভিনীত হয়। মনে রেখো এই জন্যই আমরা নানা রূপে ও বিভিন্ন কর্মেচ্ছা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি।

পরমাত্মা নিত্য নতুন সার্থকতার সৃষ্টি করেন। তিনি তোমাদের যন্ত্রমানব করতে চান না। দিব্যশক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন কর। যে কোন কার্যেই তুমি নিযুক্ত থাকো না কেন, তা সে কারখানার শ্রমিক হও আর ব্যবসায়ীই হও, দৃঢ় কন্ঠে বল, “আমার মধ্যে রয়েছে অনন্ত সৃষ্টি শক্তি! কোন কিছু গৌরবজনক কার্য সম্পন্ন না করে আমি এ সংসার থেকে বিদায় নেব না।

পরমেশ্বর আমাদের তুষ্টি বিধানের জন্যই এই পৃথিবীকে একটি বিশাল দর্শনীয় নাট্যরূপে সৃষ্টি করেছেন। আমরা কিন্তু মঞ্চাধ্যক্ষের নির্দেশে কথা ভুলে নিজেদের মনোমত ভূমিকায় অভিনয় করতে ব্যগ্ৰ হয়ে পড়ি তাঁর ইচ্ছার কথা মনে রাখি না। যে ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য আমাদের এই সংসার রঙ্গমঞ্চে আগমন সে ভূমিকা ত্যাগ করে আমরা সর্বদা অন্য ভূমিকায় অভিনয়ের চেষ্টা করি বলেই জীবনে বিফলতা আসে।

কখনও কখনও দর্শকের মনোযোগ রাজাকে ছেড়ে বিদূষকের দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয়; সুতরাং তোমার নিজ ভূমিকাটি যতই নগণ্য হোক না কেন সুন্দরভাবে সেইটিই অভিনয় কর। আত্মার নির্দেশানুযায়ী চলো; এই সংসার মঞ্চে তোমার নির্দিষ্ট ভূমিকা সুন্দররূপে অভিনয় করতে পারবে। 

তোমাদের কষ্ট দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। যারা বিয়োগান্ত ভূমিকায় অভিনয় করছে তারা যেন ভুলে না যায় যে, তারা অভিনয়ই করছে মাত্র। কোন ভূমিকাটি তুমি পেয়েছ তার জন্য দুশ্চিন্তা না করে, সুষ্ঠুভাবে অভিনয় কর। মঞ্চাধ্যক্ষের নির্দেশানুযায়ী সুন্দরভাবে করতে পারলে তোমার ক্ষুদ্র ভূমিকাও অন্যকে জ্ঞানালোকিত করতে পারবে। মনে রেখো, সেই পরম শক্তিমান পরমাত্মারই একাংশ তোমার মাধ্যমে সংসার রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করছেন। 

পরমাত্মা নিত্য নতুন সার্থকতার সৃষ্টি করেন। তিনি তোমাদের যন্ত্রমানব করতে চান না। দিব্যশক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন কর। যে কোন কার্যেই তুমি নিযুক্ত থাকো না কেন, তা সে কারখানার শ্রমিক হও আর ব্যবসায়ীই হও, দৃঢ় কন্ঠে বল, “আমার মধ্যে রয়েছে অনন্ত সৃষ্টি শক্তি! কোন কিছু গৌরবজনক কার্য সম্পন্ন না করে আমি এ সংসার থেকে বিদায় নেব না।

আমি জ্ঞানী, আমি যুক্তিবাদী। আমিই পরমাত্মার শক্তি আত্মশক্তির মূর্ত প্রতীক। বাণিজ্যজগতে, চিন্তাজগতে, জ্ঞানজগতে সর্বত্রই আমি নতুন বাণী বহন করে আনব। আমি এবং পরমেশ্বর অভিন্ন। আমি সৃষ্টিকর্তা পিতা ব্রহ্মার মতই সৃষ্টি করতে সমর্থ।”

…………………………………
পুণঃপ্রচারে বিনীত – প্রণয় সেন

…………………………………
আরও পড়ুন-
আধ্যাত্মিক উপলব্ধি
পরমসত্তানুসন্ধানে আত্মোপলব্ধির গুরুত্ব
অলৌকিক ঘটনার নিয়ম
অনুপ্রাণনা কি?
মানবিক জীবন ও আত্মদর্শন
হৃদয়জুড়ে মানবসেবা
উদ্বেগমুক্ত চেতনা
মায়া
আপন স্বরূপ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!