ভবঘুরেকথা
পরমহংস যোগানন্দ গাঁধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি

স্থিরবুদ্ধিজাত সহিষ্ণুতাকে সংস্কৃতে ‘’তিতিক্ষা’ বলে। আমি ঐ মানসিক নিরপেক্ষতার অনুশীলন করেছি। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে সারারাত হিমশীতল জলে বসে ধ্যান করেছি। তেমনি ভারতে, তাপদগ্ধ বালুরাশির ওপর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থেকেছি।

ঐসব অনুশীলন করে আমি প্রবল মানসিক শক্তি অর্জন করেছি। এইরকম আত্মসংযম অনুশীলন করলে পর, মন যাবতীয় অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতেও অটল থাকতে পারে। কোন কিছু করতে পারবো না বলে যদি ভাবেন, তাহলে জানবেন আপনার মন কৃতদাস হয়ে পড়েছে। ঐরূপ ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন।

তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আপনাকে অবিবেচক হতে হবে। ধীরে ধীরে দুরবস্থা কাটিয়ে উঠুন। আর তারজন্যে আপনার চাই সহিষ্ণুতা। সমস্যা যাই হোক না কেন, বিনা দুশ্চিন্তায় তার মোকাবিলা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করুন। যতক্ষণ তা না দূরীভূত হচ্ছে, ততক্ষণ তিতিক্ষা ব্রত পালন করুন।

এটা কি বাস্তবোচিত উপদেশ নয়? আপনি যদি তরুণ ও সবল হন, তাহলে আপনার ইচ্ছা ও মন যত শক্তিশালী হতে থাকবে, ততই আপনি আমার মতো আরও কঠিন আত্মসংযমের পদ্ধতি চর্চা করতে পারবেন।

যদি ভেবে বসেন- শীতকাল এসে পড়লো, এবার আপনার সর্দি হবেই; তাহলে বলবো- আপনার মানসিক শক্তির বিকাশ হচ্ছে না। আপনি ইতিমধ্যেই কিছু কিছু দুর্বলতার বশীভূত হয়ে পড়েছেন। যখন বোধ করবেন আপনার সহজেই ঠাণ্ডা লেগে যাবে, তখন মনে মনে তার প্রতিবাদ করে বলবেন, “দূর হও! সাধারণ বুদ্ধি অনুযায়ী সাবধানতা নিয়েছি; তবে দুশ্চিন্তায় মনকে দুর্বল করে তুলে আমি অসুখকে ডেকে আনবো না।”

এটাই হল সঠিক মানসিক অবস্থান। মনে মনে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান- অবশ্যই বিনা উদ্বেগে। উদ্বেগ কেবল চেষ্টাকেই পঙ্গু করতে পারে। নিজে সর্বাত্মক চেষ্টা করলে পর, ভগবান তাঁর সাহায্যের হাত আপনার দিকে বাড়িয়ে দেবেন।

ঘুম একরকম আশীর্বাদ; কেন না, সমস্যা যাই হোক, ঘুমিয়ে পড়লে পর আপনি তা থেকে রেহাই পান। জাগ্রত অবস্থাতেও সচেতনভাবে তা থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা নিন। চিনি না খেলে কেউ চিনির মিষ্টত্বকে বুঝতে পারে না। তেমনি, মনের পূর্ণ শক্তিকে কাজে না লাগালে তার অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার কথা আপনার কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়।

ওয়াশিংটন ডিসি’র জনৈকা তরুণী আমার কাছে এসে বললো, “আমার জটিল হৃদরোগ। বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েছি বটে, তবু কিছুই উপকার হচ্ছে না। আপনি কি আমাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারেন?” আমি তার মনের দিকে নজর দিয়ে সমস্যাটা বুঝতে পারলুম।

মন যদি যাতনার ইঙ্গিত না মানে, তাহলে কিছুতেই সে যাতনা থেকে কষ্ট পেতে পারে না। কোন অবস্থাকে অপ্রীতিকর বলে না ভাবলে, দরিদ্রতা বা কোনকিছু থেকেই মন কষ্ট পেতে পারে না। যীশুকে তো মারাত্মকরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল, সমস্ত জীবনটাই তাঁর ছিল সমস্যা, বাঁধা, আর অনিশ্চিয়তায় ভরা- তবুও তাঁর মধ্যে কোনরকম উদ্বেগ ছিল না। মনে রাখবেন, আপনি ঈশ্বরের সন্তান।

(এই স্বজ্ঞাশক্তি আপনিও গড়ে তুলতে পারেন যদি আপনি ধীরস্থির হন ও গভীর ধ্যানচর্চা করেন। আপনার ভিতরে ঈশ্বর যে সহজাত শক্তি দিয়েছেন, তাই দিয়ে করা যায় না এমন কোন কাজই নেই।) আমি তরুণীকে বললাম, “আপনার হৃদপিণ্ডের কোন রোগই নেই। এত বড় সত্যকথা আমি আগে কখনো বলিনি। কাল যদি আপনার হৃদপিণ্ডের সমস্যা থাকে, তাহলে আপনি আমাকে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী বলতে পারেন এবং আমার কথা ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু আমি জানি, আপনার ব্যাধি দূর হয়ে যাবেই।”

– “কি করে?”

– “সম্প্রতি প্রেমের ব্যাপারে আপনার কি কোনরকম দুঃখদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছে?” ভদ্রমহিলা ভীষণ অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ। কিন্তু আপনি জানলেন কেমন করে?”

আমি তখন বললাম, “আপনি কি দিনরাত ঐ দুঃখদায়ক ঘটনার কথাই ভাবছেন না?”

মহিলা মাথা নীচু করে আমার বক্তব্যকে সমর্থন করলেন। আমি তাকে বললাম, “মনের অবসন্নতাকে ঝেড়ে ফেলুন। দুধ কেটে গেছে-এখন আর কেঁদে কি লাভ? এমন কারোর সন্ধান করুন যে আপনার প্রেমের মর্যাদা দেবে। যে আপনাকে ভালই বাসে না, তাকে মনপ্রাণ সঁপে কি লাভ! আপনার পূর্বপ্রেমিক এখন অন্য কারোর সাথে ফুর্তি করছে; আর এখানে আপনি তার জন্য হাহাকার করে মরছেন।”

ভদ্রমহিলা বললেন, তিনি লোকটিকে ভুলে যাবার চেষ্টা করবেন।

আমি বললাম, “শুধু চেষ্টা করলেই হবে না, এই মুহূর্ত থেকেই তাকে ভুলে যেতে হবে। মন থেকে ঐ ব্যক্তিটিকে বিদায় করে দিন।”

মহিলা আমার কথা শুনেছিলেন। কিছুদিন বাদে তিনি আমায় এসে বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছিলেন। যে মুহূর্তে আমি সেই লোকটির কথা ও আমার অশান্তির চিন্তা ত্যাগ করলাম, সেই মুহূর্তে আমার হৃদস্পন্দনও স্বাভাবিক হয়ে গেল।”

আজ আপনাদের যেমনটি বললাম সেইভাবে যদি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, যদি আপনি বিপদে পড়েও দুর্বলতা প্রকাশ না করেন, নিজের সমস্যা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা না করেন, তাহলে দেখবেন- আপনি কত বেশি সফল, শান্ত ও সুখী হয়েছেন।

নিজস্ব চেষ্টায় ব্যক্তিগত জীবনে আমি তা উপলব্ধি করেছি। আপনাদেরও ঐরকমটি করা উচিত। রোজ এই সংকল্প করবেন, “আমি অলস হবো না, আবার কাজ পাগলও হবো না। জীবনে প্রতিটা চ্যালেঞ্জের সামনে, ভবিষ্যতের জন্যে দুর্ভাবনা না করে, আমি যথাসাধ্য কাজ করে যাব।”

মন যদি যাতনার ইঙ্গিত না মানে, তাহলে কিছুতেই সে যাতনা থেকে কষ্ট পেতে পারে না। কোন অবস্থাকে অপ্রীতিকর বলে না ভাবলে, দরিদ্রতা বা কোনকিছু থেকেই মন কষ্ট পেতে পারে না। যীশুকে তো মারাত্মকরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল, সমস্ত জীবনটাই তাঁর ছিল সমস্যা, বাঁধা, আর অনিশ্চিয়তায় ভরা- তবুও তাঁর মধ্যে কোনরকম উদ্বেগ ছিল না। মনে রাখবেন, আপনি ঈশ্বরের সন্তান।

এঁদের মত সন্ন্যাসীরা যে কোন রাজার থেকেই অনেক মহৎ। নিরাহারী, নিরাপত্তার সামান্যতম আভাসটুকু যাদের নেই, তাঁরা যদি নিরুদ্বিগ্ন, শান্ত, রাজার মতো হতে পারেন, তাহলে আপনারই বা পারবেন না কেন? ভুলে যাবেন না, পরমপিতা অনন্তকালধরে আপনাদের হৃদয়েই বিরাজ করছেন। তাঁকে বলুন, “হে প্রভু, জীবনে, মরণে, সুস্থ বা অসুস্থ অবস্থা নিয়ে আমি আদৌ চিন্তিত নই, কেননা আমি যে চিরদিন তোমারই সন্তান।”

সবাই আপনাকে ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু ভগবান কখনো আপনাকে ত্যাগ করবেন না, কেননা তিনি আপনাকে ভালোবাসেন। কখনো দুশ্চিন্তাও করবেন না, কেননা তিনি আপনাকে নিজের হার-না-মানা ভাবরূপেই সৃষ্টি করেছেন। যা নেই, তারজন্যে শোক করা উচিত নয়।

বৈষয়িক দিক থেকে যিনি সবচেয়ে সফল, তার মধ্যেও হয়তো মহাদুঃখ ও মহাঅশান্তি রয়েছে। অথচ ভারতের নগণ্য কুটীরবাসী ও গুহাবাসী এমন অনেক মানুষকেই দেখেছি, যারা বাস্তবিকই রাজামহারাজা। এমনই এক সাধুর পার্থিব ‘সিংহাসন’টি ছিল শুকনো ঘাসের চাটাই।

তাঁকে যদি আজ এখানে, আপনাদের সামনে উপস্থিত করতে পারতাম, তাহলে আপনারা একজন খাঁটি রাজাকেই দেখতে পেতেন। তাঁর পরিধান বলতে হাঁটু অবধি ছোট একখানা কাপড়। ভিক্ষাপাত্র পর্যন্ত তাঁর ছিল না। এঁরাই হলেন পৃথিবীর সত্যিকারের রাজা।

তাঁদের কয়েকজনকে আমি হিমালয় পাহাড়ে দেখেছি। তাঁদের জন্যে না আছে কোন খাবার, না অন্য কিছু। অথচ তাঁরা ভিখারীও নন। পৃথিবীর কোটিপতিদের থেকেও তাঁরা বেশি ধনী। তাঁরা সবার বন্ধু; তাই মানুষ তাঁদের ভালবাসে, তাঁদের আহার করাতে পছন্দ করে।

হিমালয়ের হাড়কাঁপানো শীতে আমি এমন সন্ন্যাসীকেও দেখেছি যার পরিধানে বস্ত্র বলে কিছু ছিল না। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার ঠাণ্ডা লাগবে না? মিষ্টি হেসে তিনি শুধু বলেছিলেন, “ভগবৎপ্রেমে যে ঊষ্ণ থাকে, তার কি করে ঠাণ্ডা লাগতে পারে?”

এঁদের মত সন্ন্যাসীরা যে কোন রাজার থেকেই অনেক মহৎ। নিরাহারী, নিরাপত্তার সামান্যতম আভাসটুকু যাদের নেই, তাঁরা যদি নিরুদ্বিগ্ন, শান্ত, রাজার মতো হতে পারেন, তাহলে আপনারই বা পারবেন না কেন? ভুলে যাবেন না, পরমপিতা অনন্তকালধরে আপনাদের হৃদয়েই বিরাজ করছেন। তাঁকে বলুন, “হে প্রভু, জীবনে, মরণে, সুস্থ বা অসুস্থ অবস্থা নিয়ে আমি আদৌ চিন্তিত নই, কেননা আমি যে চিরদিন তোমারই সন্তান।”

…………………………………
পুণঃপ্রচারে বিনীত – প্রণয় সেন

…………………………………
আরও পড়ুন-
আধ্যাত্মিক উপলব্ধি
পরমসত্তানুসন্ধানে আত্মোপলব্ধির গুরুত্ব
অলৌকিক ঘটনার নিয়ম
অনুপ্রাণনা কি?
মানবিক জীবন ও আত্মদর্শন
হৃদয়জুড়ে মানবসেবা
উদ্বেগমুক্ত চেতনা
মায়া
আপন স্বরূপ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!