-দ্বীনো দাস
বাউল শব্দের অর্থ কি? এই শব্দের অর্থ খুঁজতে গিয়ে অনেকে অনেক অর্থ করেছেন। ক্ষিতিমোহন সেনের মতো বাউলবিশেষজ্ঞ মনে করেছেন, বাউল এসেছে ব্যাকুল শব্দ থেকে, কেননা বাউলরা আত্মানুসন্ধানে ব্যাকুল। তাহারা মুক্তপুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন তারা মানেন নাই।
এই কথার ধারনা মেনে একজন লিখেছেন বায়ু+ল= বাউল। আরেকজন বলেছেন, হিন্দি বাউর শব্দ বাংলায় হয়েছে বাউল। চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে ‘ঈশ্বরপ্রেমে মাতাল, বস্তুজ্ঞানবর্জিত, উদাসীন ভক্ত’-এই অর্থে নাকি বাউল শব্দ একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে বলছেন অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরবি-পারশি ভাষার পণ্ডিত হরেন্দ্রচন্দ্র পাল মনে করছেন ‘আউল’ ‘ওয়ালী’ শব্দ থেকে আউল বাউল শব্দের জন্ম।
ফকির দুদ্দু শাহ্ তার বাণীতে বলছেন- ‘যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।’ কেউ বলছে, বাউ+উল= বাউল; হচ্ছে বাতাস অনুসন্ধানকারী, সু বাতাসে যে চলে সেই বাউল।
বসিরহাটের কাজি মৌলবী কেরামতউল্লা ও গোলাম কিবরিয়া ‘উচিত কথা’ বইতে আরেক নতুন তথ্য যোগ করে বলেছেন, বাউলদের মতে আসল ফকিরি তত্ত্ব চারটি। যেমন-
আউলে ফকির আল্লাহ্ বাউলে মোহাম্মদ
দরবেশে আদম ছফি এই তক হদ,
তিনমত এক সাত করিয়া যে আলী
প্রকাশ করিয়া দিল সাঁই মত বলি।।
এই শোলোক থেকে আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই -চারটি ধারার খবর মেলে।
ঐ সময় যারা অখণ্ড বাংলায় বাউল ফকির বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন। সেই শরীয়তবাদী আলেম মুসলমানরা-অসংখ্য ফকির, আউল বাউল, দরবেশ, সাঁই সকলকে কচুকাটা করেছিলেন। কারণ বিশ শতকের সুচনায় উত্তরবঙ্গে বিশেষ মুসলমানদের মধ্যে বহুলোক এসব মরমি, ফকিরি ও কায়াবাদী সাধনার পথে চলে যাচ্ছিলেন।
তখন রংপুর জেলার বাঙালীপুরের মৌলবী রেয়াজ উদ্দিন আহমদ ফকির বাউল মত ধ্বংসের ফৎওয়া দেন এবং তাতে অগনতি বাউল ফকিরদের হত্যা করা হয়।
ফকির লালন সাঁইজির জীবদ্দশায় তাঁর উপরেও অনেক অত্যাচার করা হয়েছে। তাঁর বসতভিটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক সাধু ফকিরের চুল কাটা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। তারপরও তাঁরা ছাড়েনি তাদের মত, পথ, ধর্ম বিশ্বাস।
বংলার ফকিরদের সাঁই বলা হয়। হিন্দু ব্রাহ্মণকে বলা হয় গোঁসাই। এই উপাসকদের মধ্যে নানান মত ও প্রকার চালু আছে। তবে তাদের বক্তব্য হল, নানা বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও লক্ষ্যে পৌঁছানোর বিষয়টা অভিন্ন। মতবাদ একটাই, শুধু যাজন ভিন্ন ভিন্ন। সবাই একই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
ওরা বলে-
“এই ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে তা মানবভাণ্ডেও আছে। তাই নিজের, মানবদেহের সঙ্গে প্রেম জরুরী। দেহের মধ্যে পাওয়া যাবে গুরু, মুর্শিদ বা আধ্যাত্মিক নিয়ন্তাকে। মানুষের নব হল শাস্ত্র। গুরু ধরে এই শাস্ত্রের চর্চা করতে হবে এবং এভাবেই পরম মুর্শিদের বা পরম গুরুর সন্ধান পাওয়া যাবে।
সাধারণ কোরানের অধ্যায় তিরিশটি, আরও দশটি অধ্যায় আছে ফকিরের কাছে। এটা লিখিত নয়- এর বিষয়বস্তু হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চরিত হয়। হৃদয়ে জেগে উঠে মহাতরঙ্গমালা। তাই নিজেকে জানার উপায় হল ফকিরি। লিখিত কোরানে নয়, মনের অলিখিত কোরানই আমাদের আস্থা।
গানের ভেতর দিয়ে যারা আশিক, মাশুকের (লায়লা-মজনু বা রাধাকৃষ্ণর সম্পর্ক যেমন) ভেদাভেদ ভুলে নাসুতকে লাহুতে তুলে আনার কথা বলেন। ফানাফিল্লাহ হতে চান, গান যাদের পারমার্থিক মিলনের অন্যতম মাধ্যম, সামা বা কওয়ালির মধ্যে (হমদ্- আল্লাহ্ কীর্তন বা সানে) (নাৎ- পয়গম্বর মুহাম্মদ (স)-এর কীর্তন বা সানে) এবং (মনকামৎ- সুফি এবং আওলিয়াদের কীর্তন বা সানে)।
জীবনের গূঢ় রহস্য না জেনে প্রার্থনা বা উপবাস করে লাভ নেই। সেই জন্যই আমরা দেহতত্ত্ব গায়। দুধকে ঘি’য়ে পরিণত করবো বলেই আমরা সাধনা করি। আমাদের ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য অন্যান্য ধর্মের তুলনায় আমরা একটু ভিন্ন পথে অগ্রসর হই।
অন্যান্য ধর্মে প্রার্থনা ও উপবাসের কথা বলা হয়, কিন্তু সেগুলো লক্ষ্যে পৌঁছাবার উপায় নয়। আসলে কারও মন যদি স্থির হয় তাহলে প্রার্থনা উপবাস এ সবের আর দরকার পড়ে না।
জল, আগুন (সূর্য), পৃথিবী ও বাতাস মানুষের স্রষ্টার দানকৃত সম্পদ। জাত-বর্ণ-ধর্মবিশ্বাস বিচার না করে এগুলো সকলেরই উপকার করে। তেমনি বাউল ফকির বা ভক্তরা মানুষে মানুষে কিংবা বিভিন্ন মত ও পথের মানুষে কোন প্রভেদ করে না বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি সত্যিকারের ভক্ত হয়।
তাহলে সে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান যাই হোক না কেন, সে অন্তরের বিশ্বাস দিয়েই নিজের পথ কেটে নেবে, বহিরঙ্গ পোশাক দিয়ে নয়।”
যা হোক এবার সৎ সঙ্গীতের দিকে যাই-
গানের ভেতর দিয়ে যারা আশিক, মাশুকের (লায়লা-মজনু বা রাধাকৃষ্ণর সম্পর্ক যেমন) ভেদাভেদ ভুলে নাসুতকে লাহুতে তুলে আনার কথা বলেন। ফানাফিল্লাহ হতে চান, গান যাদের পারমার্থিক মিলনের অন্যতম মাধ্যম, সামা বা কওয়ালির মধ্যে (হমদ্- আল্লাহ্ কীর্তন বা সানে) (নাৎ- পয়গম্বর মুহাম্মদ (স)-এর কীর্তন বা সানে) এবং (মনকামৎ- সুফি এবং আওলিয়াদের কীর্তন বা সানে)।
কোনো ভূমিকা যে বাউল গানের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীকরণের মধ্য তাদের প্রভাবেও এসে থাকবে, এ নিয়ে কুতর্ক না তোলাই ভাল।
(চলবে…)
………………..
আরো পড়ুন:
বাউল/ফকির : পর্ব-১
বাউল/ফকির : পর্ব-২
বাউল/ফকির : পর্ব-৩
বাউল/ফকির : পর্ব-৪
বাউল/ফকির : পর্ব-৫
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………..
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু ইতিহাস থেকে নেওয়া কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।। আলেক সাঁই। জয়গুরু।।