ভবঘুরেকথা
গুপ্তসংঘ

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

‘গুপ্তসংঘ: এক’

ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যের বিপরীতে ভারতবর্ষে একসময় যেমন বহু মতাদর্শের বিকাশ ঘটেছিল। তেমনি চার্চের কঠিন দমননীতির বিপরীতে ইউরোপেও বেশকিছু মত-চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে। তবে ভিন্নমত প্রকাশের কোনোরূপ সুযোগ না থাকায় গোটা ইউরোপ জুড়ে তখন ছোট বড় বহু গুপ্তসংঘ গড়ে উঠে।

সতেরো শতকের ইউরোপে ক্যাথলিজমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বা তাদের মতবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই চালতো নির্মম নির্যাতন। তাই নতুন সকল চিন্তার চর্চাই চার্চের নজর বাঁচিয়ে অত্যন্ত গোপনীতা রক্ষা করে চলতো। কারণ ধরা পরলে যে শাস্তি ভোগ করতে হতো তা ছিল বর্ণনার অতীত।

ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা সেসব গুপ্তসংঘের সদস্য সংখ্যাও নেহাত ছিল না। তবে যখনই চার্চের নজর তাদের উপর পরেছে তখনই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়েছে। জীবন বাঁচাতে আত্মোগোপনে যেতে হয়েছে; এমনকি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।

তৎকালীন সেসব সংঘের বিশ্বাস ছিল, আত্মার বিকাশ ঘটিয়ে অপার্থিব শক্তি অর্জন করা সম্ভব। আর সে শক্তি কাজে লাগিয়ে তারা ধর্মীয় অপসাশন থেকে সমাজকে মুক্ত করার কথা ভাবতো। এরজন্য বেশিভাগ গুপ্তসংঘ কালাজাদু বা শয়তানের উপাসনা করতো বলেও প্রচারিত আছে। তারা ঈশ্বরের সাথে লড়াই করার জন্য বেছে নিয়েছিল শয়তানকে।

মূলত বাইবেলে উল্লেখিত শয়তানকে তারা বিভিন্ন ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তুষ্ট করে তার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করতো। যা ছিল চার্চের মতের বিপরীত। চার্চ এ বিষয়ে ছিল বেশ সজাগ। তারা কোনো ভাবেই চার্চের বিধানের বিপরীত কোনোমত সহ্য করতো না।

বাইবেল বর্ণিত শয়তান বা ডেভিল হলো ‘লুসিফার’। অনেকে তাকে পতিত দেবদূত বলেও উল্লেখ করেন। বাইবেলে লুসিফারকে অপদেবতা বলে উল্লেখ করা হলেও; গুপ্তসংঘের কাছে তিনিই ঈশ্বর। তারা বিশ্বাস করে, বিশ্বে চলমান সকল কিছুই লুসিফারের নখদর্পনে। সে চাইলেই সব কিছু তার অধীনে কাজ করবে।

কথিত আছে, সংঘের সদস্যরা লুসিফারকে সন্তুষ্ট করতে এবং সংঘের গোপনীয়তাকে রক্ষা করতে সমস্ত কিছু করতে সদা প্রস্তুত। আর লুসিফারের নির্দেশ অমান্যকারী সদস্যদের চরম শাস্তির দিতেও দিধা করে না। হোক তা কালাজাদু বা কোন অনৈতিক পন্থা।

এসব সংঘের কর্মকাণ্ড এতোই গোপনীয়তার সাথে চলতো যে তাদের সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তারপরও চার্চের হাতে যে সকল সদস্য ধরা পরতো। চরম নির্যাতনে তারা যদি কিছু স্বীকার করতো তবেই তাদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত। সে সব তথ্যই পরবর্তীতে ছড়িয়ে পরে।

ওয়েইশপ্ট শুধু মানুষকে আলোকিত করেই নয় বরঞ্চ সম্পূর্ণ সমাজকে পাল্টে ফেলার পরিকল্পনায় সংঘের কাজ শুরু করেন। যাতে করে কট্টরপন্থী ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। ওয়েইশপ্ট বিশাল স্বপ্ন নিয়ে সংঘের যাত্রা শুরু করেছিল।

মূলত সেসব গুপ্তসংঘের ধারাবাহিকতাতেই ইলুমিনাতির বিকাশ। প্রথমে তারাও অন্যান্য সংঘের মতোই ধর্মীয় অপশাসন থেকে সমাজকে তথা বিশ্বকে মুক্তির জন্য একত্রিত হয়েছিল; এমনটাই ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে তাদের মাঝেও বিশ্ব নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণে চরম ভূমিকা পালনের বিষয়টি জড়িয়ে নানান কথা প্রচারিত হয়।

অনেকে মনে করে, ইলুমিনাতির বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ নেয়ার অপচেষ্টা এখনো চলছে। আবার অনেকে মনে করেন, তারা অনেক আগেই বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করেছে। তারাই পর্দার আড়ালে থেকে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ভিত্তিতে বিশ্ব পরিচালনা করছে। দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রকরা ইলুমিনাতির হাতের পুতুল মাত্র।

প্রচলিত আছে, প্রতিবছর এপ্রিল মাসে তারা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নতুন সদস্যদের সংঘে যোগ দিতে বাধ্য করে। তবে কেউ নিজ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করলে, এর সদস্য হতে পারে না। তারাই এর সদস্য হতে পারে যারা ইলুমিনাতি কর্তৃক মনোনীত হয়।

ইলুমিনাতির প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম ওয়েইশপ্টের পিতা ইয়হোম অ্যাডাময়ম ইউরোপীয় ‘আলোনায়ন’ বা ‘আলোকিত মানুষের’ সমর্থক ছিলেন। সে সময় ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের বিজ্ঞান ও দার্শনের ভিত্তিতে ধর্মকে চ্যালেঞ্জের যে জোয়ার বইছিল তাতেও সামিল ছিলেন।

যারা ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে ভীত করে তুলেছিল, তাদের বিরুদ্ধে তারা বিজ্ঞান ও তর্কের আহ্বান জানাতো। প্রচার করতো, সকল ঘটনার পেছনে প্রমাণ বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে। পাদ্রীদের চাপিয়ে দেয়া আরোপিত কোনো ব্যাখ্যা মানলে চলবে না।

ইয়হোম অ্যাডাময়ম এনলাইটমেন্ট বা মানুষকে জ্ঞানের ভিত্তিতে আলোকিত করে তোলায় বিশ্বাসী ছিলেন। পরবর্তীতে তার পুত্র অ্যাডাম ওয়েইশপ্টও একই বিশ্বাস নিয়ে জীবনে এগিয়ে চলে। সে সময় ইউরোপে আলোকিত মানুষ হওয়ার একটা হওয়া বইলেও, কি প্রকৃয়ায় তা হওয়া সম্ভব হবে; তার সঠিক কোনো দিক নির্দেশনা ছিল না।

ওয়েইশপ্ট শুধু মানুষকে আলোকিত করেই নয় বরঞ্চ সম্পূর্ণ সমাজকে পাল্টে ফেলার পরিকল্পনায় সংঘের কাজ শুরু করেন। যাতে করে কট্টরপন্থী ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। ওয়েইশপ্ট বিশাল স্বপ্ন নিয়ে সংঘের যাত্রা শুরু করেছিল।

যারা তার সাথে একমত হয়েছিল তাদের অনেকেই এই সংঘে যুক্ত হয়। তৎকালীন খ্যাতনামা বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকও এই গুপ্তসংঘের সক্রিয় সদস্য ছিল বলে জানা যায়।

শোনা যায়, ইলুমিনাতির সদস্যরা নিজেদের মাঝে যোগাযোগের জন্য এমন সব সাংকেতিক ভাষা বা দেহমুদ্রা ব্যবহার করে; যা জনসম্মুখে তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহার করলেও মানুষ তা ধরতে পরে না। এতে তাদের গোপনীয়তা শতভাগ রক্ষা হয়। বিভিন্ন সময় অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষকরা এসব বিষয় ও কিছু সংঘের কার্যক্রম জনমম্মুখে আনলেও তার সাথে ইলুমিনাতির কোনো সম্পর্ক প্রমাণ কর যায় নি।

সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা শিক্ষার সাথে যুক্তদের অগ্রাধিকার দিতো। কারণ শিক্ষকরাই বেশি সংখ্যক জনতার সামনে নিজেদের মতামত পেশ করা এবং তাদের প্রভাবিত করার সুযোগ পেত। তবে যে কাউকেই সংঘের জন্য মনোনীত করা হতো না।

যারা চরম নির্যাতনের মুখেও সংঘের গোপনীতা রক্ষা করতে পারবে, এমন মানুষিকার লোকদেরই নির্বাচন করা হতো। এমনকি সদস্যদের সকল গোপন তথ্যও সংঘ সংরক্ষণ করতো। যাতে কেউ সংঘের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা না করতে পারে।

প্রাচীন এথেন্সের গণতন্ত্রে প্রভাবিত ওয়েইশপ্ট সে ধারাতেই সংঘের নিয়মাবলী তৈরি করেন। সম্ভবত সেখানে থেকেই সংঘের প্রতীক হিসেবে তিনি বেঁছে নেন পেঁচকে। প্রাচীন গ্রীকে যা জ্ঞানে প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। সেসময় সংঘের উদ্দেশ্যও ছিল জ্ঞানার্জন।

ইলুমিনাতির শুরুটা হয়েছিল জ্ঞানচর্চাকে অগ্রাধিকার দিয়ে। জ্ঞানার্জন এবং জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত করে সমাজে বিদ্যমান অন্ধকারকে নির্মূলই ছিল উদ্দেশ্য। সেই মতে, সংঘের সকল সদস্যের একান্ত ইচ্ছা ছিল, তারা এমন এক প্রকৃয়া বলবদ করবে যা চার্চের সিদ্ধান্ত থেকে অনেক বেশি উন্নত ও পরিশীলিত হবে।

যার চালিকা শক্তি হবে বিজ্ঞান ও দর্শন। তারা বিশ্বাস করতো এসব একদিনে হবে না। তার জন্য চাই দীর্ঘ সময়। আর সেই মতোই তারা পরিকল্পনা করে সংঘের ভিত্তি মজবুত ও গোপন রাখায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। যাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী সংঘ এগিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু শত গোপনীয়তার মাঝেও সদস্যদের তালিকা রাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। আর প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই সংঘ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে যায়। ওয়েইশপ্ট আত্মগোপনে চলে যান। কার্যত এ সময় থেকেই ইলুমিনাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

কিন্তু শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। মূলত এরপর থেকেই তাদের নাম জড়িয়ে বিভিন্ন গল্পগাঁথা ছড়িয়ে পরতে শুরু করে। যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই চলে আসছে। ইলুমিনাতির জব্দ করা কাগজপত্রে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বেনজামিন ফ্রাংকলিনকে লেখা এক পত্রের কথা জানা যায়।

সে পত্রে ইলুমিনাতির পক্ষ থেকে আমেরিকায় তাদের একটি কলোনী স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে এর উত্তরে কোনো পত্র দেয়া হয়েছিল কিনা সেটা জানা যায় না। তবে এর ভিত্তিতে অনেকে মনে করেন, ইলুমিনাতির কিছু সদস্য আমেরিকায় গিয়ে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে নতুন করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।

এই রহস্যময় গুপ্তসংঘকে কেন্দ্র করে এতো সব কল্পকাহিনী প্রচলিত যে, তার কতটা সত্য, কতটা অতিরঞ্জিত বা এসবের আদৌ কোনো সত্যতা আছে কিনা সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।

শোনা যায়, ইলুমিনাতির সদস্যরা নিজেদের মাঝে যোগাযোগের জন্য এমন সব সাংকেতিক ভাষা বা দেহমুদ্রা ব্যবহার করে; যা জনসম্মুখে তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহার করলেও মানুষ তা ধরতে পরে না। এতে তাদের গোপনীয়তা শতভাগ রক্ষা হয়। বিভিন্ন সময় অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষকরা এসব বিষয় ও কিছু সংঘের কার্যক্রম জনমম্মুখে আনলেও তার সাথে ইলুমিনাতির কোনো সম্পর্ক প্রমাণ কর যায় নি।

“ফেলুদা বলছিল এই ডক্টর ম্যাট্রিক্সের মতে মানুষের জীবনে সংখ্যা বা নম্বর জিনিসটা নাকি আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করে। অনেক সাধারণ বা অসাধারণ ঘটনার পিছনেই নাকি খুঁজলে নানারকম নম্বরের খেলা আবিষ্কার করা যায়। ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার হত না যদি না ফেলুদা বইটা থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিত। বলল, ডক্টর ম্যাট্রিক্সের একটা আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা শোন। আমেরিকার দুজন বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট খুন হয়েছিল জানিস তো?

কথিত আছে, ইলুমিনাতিতে সদস্য হতে হলে সদস্যদের নিজের আত্মা জমা রাখতে হয় সংঘের কাছে। তার বিনিময়ে তারা পায় অর্থ-বৃত্ত-প্রভাব-প্রতিপত্তি। এতে করে চিরদিনই তাদের থাকতে হয় সংঘের অনুগত পুতুল হয়ে। আর এসব প্রচলিত কাহিনী কৌতুহলী মানুষকে তাদের প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট করে।

ইলুমিনাতির মতো গুপ্তসংঘের আদৌ অস্তিত্ব আছে কি নেই তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা থেকে গেছে খবরে। বিশ্বাসীরা বলে, ইলুমিনাতি এমনই এক গুপ্তসংঘ যারা নিজেদের গোপনীয়তা আড়াল করে সত্য কিন্তু তাদের সর্বজনীনতা বজায় রাখে সর্বত্র।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফ্যাসিবাদীরা বিশ্বাস করতো ইলুমিনাতি ইহুদীদের দ্বারা পরিচালিত গুপ্তসংঘ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ধারণা পাল্টে অনকে মনে করতে শুরু করে ইলুমিনাতি আদৌতে কমিউনিস্টদের একটি গুপ্তসংঘ। পরবর্তীতে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে পৃথিবীর প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আসলে এসব গুপ্তসংঘকে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করে।

ষড়যন্ত্র বিষয়ক তাত্ত্বিকরা মনে করে, ইলুমিনাতিরা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর অংশ! তারা একটি মাত্র সরকার দ্বারা বিশ্বব্যাপী শাসন করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তারা বিশ্বে নানা অরাজকতা সৃষ্টি করে ক্ষমতা একমুখি করার দিকে এগুচ্ছে।

বিশ্বে ঘটে যাওয়া বহু ষড়যন্ত্রের সাথে গুপ্তসংঘগুলোকে জড়িয়ে নানা সময় নানা কাহিনী সংবাদের শিরোনামে এসেছে। আমেরিকার বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্টের অপঘাতে মৃত্যুর ঘটনার পেছনেও অনেকে ইলুমিনাতির সূত্র খুঁজে পান। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃত্যু রহস্য। বলা হয়ে থাকে, তিনি ইলুমিনাতির কাছে বাধা দেওয়ায় তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়।

সত্যজিৎ রায় তার ফেলুদা সিরিজের ‘সমাদ্দারের চাবি’ গল্পে ডক্টর ম্যাট্রিক্সের সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে মজার কিছু তথ্য তুলে ধরছেন। যা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃত্যু রহস্যকে আরো রহস্যময়তায় ডুবিয়ে দিয়েছে। আর যেখানে রহস্য সেখানেই নাকি ইলুমিনাতি। গল্পে তোপসে লিখছে-

“ফেলুদা বলছিল এই ডক্টর ম্যাট্রিক্সের মতে মানুষের জীবনে সংখ্যা বা নম্বর জিনিসটা নাকি আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করে। অনেক সাধারণ বা অসাধারণ ঘটনার পিছনেই নাকি খুঁজলে নানারকম নম্বরের খেলা আবিষ্কার করা যায়। ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার হত না যদি না ফেলুদা বইটা থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিত। বলল, ডক্টর ম্যাট্রিক্সের একটা আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা শোন। আমেরিকার দুজন বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট খুন হয়েছিল জানিস তো?

-লিঙ্কন আর কেনেডি?

-হ্যাঁ। আচ্ছা এই দুজনের নামে কটা করে অক্ষর?

-L-I-N-C-O-L-N – সাত। K-E-N-N-E-O-Y – সাত।

-বেশ। এখন শোন, লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট হন ১৮৬০ সালে, আর কেনেডি হন ১৯৬০ সালে -ঠিক একশো বছর পরে। দুজনেই খুন হয় শুক্রবার। খুনের সময় দুজনেরই স্ত্রী পাশে ছিল। লিঙ্কন খুন হন থিয়েটারে; সে থিয়েটারের নাম ছিল ফোর্ড! কেনেডি খুন হন মোটর গাড়িতে। সেটা ফোর্ড কোম্পানির তৈরি গাড়ি।

গাড়িটার নাম ছিল লিঙ্কন। লিঙ্কনের পরে যিনি প্রেসিডেন্ট হন তাঁর নাম ছিল জনসন, অ্যানড্রু জনসন। কেনেডির পরে প্রেসিডেন্ট হন লিন্ডন জনসন। প্রথম জনের জন্ম ১৮০৮, দ্বিতীয় জনের জন্ম ১৯০৮ -ঠিক একশো বছর পর। লিঙ্কনকে যে খুন করে তার নাম জানিস?

-জানতাম, ভুলে গেছি।

-জন উইল্‌ক্‌স বুথ। তার জন্ম ১৮৩৯ সালে। আর কেনেডিকে খুন করে লী হারভি অসওয়াল্‌ড। তার জন্ম ঠিক একশো বছর পরে- ১৯৩৯। এইবারে নাম দুটো আরেকবার লক্ষ কর। John Wilkes Booth – Lee Harvey Oswald -ক’টা অক্ষর আছে নামে?

অক্ষর গুণে থ’ হয়ে গেলাম। ঢোক গিলে বললাম, দুটোতেই পনেরো?”

গুপ্তসংঘের অস্তিত্বের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিচার বিশ্লেষণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। নিজ আত্মাকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে তার কাছ থেকে শক্তি অর্জনের যে রীতি বা বিশ্বাস একদা প্রচলিত ছিল বা এখনো আছে সে বিষয়টি উপস্থাপনের জন্যই চুরাশির ফেরে অর্থাৎ জন্মান্তরের ধারাবাহিক লেখায় গুপ্তসংঘ বিষয়টি উপস্থাপন করার ক্ষুদ্র চেষ্টা মাত্র।

শয়তানের উপাসক হিসেবে আখ্যায়িত ইউরোপী-আমেরিকায় গুপ্তসংঘের ইতিহাস বিশাল ও ব্যাপক। সেই বিশালতায় না গিয়ে তাদের গোটা কয়েক সংঘ সম্পর্কে প্রাপ্ত সামান্য কিছু তথ্য আসুন জেনে নেই-

এ্যালামব্রাদোস

পনের-ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনে এ্যালামব্রাদোস নামক একটি গুপ্তসংঘের নাম জানা যায়। যার অর্থ ‘প্রকাশিত হওয়া’। এ্যালামব্রাদোসরা বিশ্বাস করতো, মানুষের আত্মা পরমেশ্বরের এতো কাছাকাছি যেতে পারে যে, তার সংস্পর্শে থেকে জগতের গূঢ় রহস্য ট্রিনিটিকে অনুধাবন করা সম্ভব।

জীবাত্মা আর পরমাত্মার এই মিলনের কাছে জাগতিক সমস্ত প্রার্থনা-পুজাপাঠ তুচ্ছ। যে ব্যক্তি পরমাত্মায় মিলিত হয়ে আলোকিত হতে পারে সে তার মনের সমস্ত কামনা-বাসনা পূরণ করার সক্ষমতা অর্জন করে। তারা এও বিশ্বাস করতো, পরমাত্মার সাথে মিলিত হতে পারলে জীবাত্মা নিজে দুষিত না হয়েও শক্তির বলে সকল প্রকার অন্যায় কাজও করতে পারে।

আঠার শতকের দিকে চার্চ কর্তৃপক্ষ এ্যালামব্রাদোসের কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর সদস্যদের মৃত্যুদণ্ডের বিধানও দেয়া হয়। তাদের কিছু সদস্য ধরা পরে আর বাকিরা স্পেন থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচায়। পরবর্তীতে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় কিনা তার আসে সেভাবে জানা যায় না।

ইলুমিনস

১৬২৩ থেকে ১৬৩৫ সালের দিকে ফ্রান্সে ইলুমিনস নামে একটি গুপ্তসংঘের নাম জানা যায়। তবে ১৬৩৫ সালের পরে তাদের অস্তিত্বের কথা আর জানা যায় না। তারাও শয়তানের উপাসক ছিল বলে প্রচারিত আছে। অনেকে মনে করেন, এই ইলুমিনস থেকেই ইলুমিনাতি নামটি এসেছে।

ফ্রিমেসনরি

ইলুমিনাতি প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বেশ সংগঠিত সংঘ হিসেবে ফ্রিমেসনরি প্রতিষ্ঠিত ছিল। অনেকেই ধারণা করে, ইলুমিনাতি সৃষ্টির পিছনে মূল অণুপ্রেরণা ছিল ফ্রিম্যাসন্সরা। ধাপে ধাপে শীর্ষে পৌঁছানোর যে রীতি ইলুমিনাতিতে প্রচলিত ছিল, সম্ভবত সেটিও ফ্রিমেসনরি থেকেই তা গ্রহণ করা হয়েছিল।

ধারণা করা হয়, ফ্রিমেসনরির উদ্ভব হয়েছিল মধ্যযুগে। এটি মূলত মুক্ত কারিগরদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সংঘ। এই কারিগরদের নির্মিত স্থাপত্য বিশেষ বৈশিষ্টপূর্ণ। যা আজও অদ্ভুত সুন্দর বলে বিবেচিত। তাদের প্রতিটা নির্মাণ আশ্চর্য সুন্দরের পাশাপাশি এক রহস্যময়তায় ঘেরা। এতো বছর পরও সেগুলো যে কাউকে বিস্মিত করে।

তাদের নির্মিত স্থাপত্যে এমন কিছু বিষয় যুক্ত হতো; তা নানন্দিকতায় বহুগুণ বাড়িয়ে তুললেও তার আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন চিরকালীন। অনেকে বলেন, স্থাপত্যে এ সকল বাড়তি অলঙ্করণ শুধু তাদের গুপ্তজ্ঞানকেই প্রকাশ করে না; প্রকৃত অর্থে এর দ্বারা তারা লুকানো গুপ্তধনের নকশা প্রকাশ করেছেন।

কঠিন গোপনীয়তা রক্ষা করবে এই শর্তে নতুন সদস্যরা জানতে পারতো তাদের স্থাপত্য-ভাস্কর্য নির্মাণের গোপন সব কলাকৌশল। পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় তাদের ছোট ছোট বহু দল গড়ে উঠে। সেগুলো পরিচিত ছিল গিল্ড নামে। দেশের সকল ছোট ছোট গিল্ড মিলে যে বড় সংঘ তৈরি হয় তাকে বলা হতো লজ। আর এভাবেই দেশের প্রধান লজদের নিয়ে গঠিত হয় গ্রাউন্ড লজ।

অনেকে সন্দেহ করেন তারা ইতিহাসের বিখ্যাত কিং সোলেমানের গুপ্তধনের রক্ষক। কি সোলেমান তার গুপ্তধন রক্ষা করার জন্য যাদের কাছে নকশা দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দিয়েছেল তাদেরই একটি দল হলো এই ফ্রিম্যাসন্সরা। তারা আজো কিং সোলেমানকে সম্মানপূর্বক সেই গুপ্তধনের নকশা সংরক্ষণ করে আসছে।

আরো বলা হয়, তারা কিং সোলেমানের সেই জাদুবিদ্যার ধারাতেই তাদের সাধন-ভজন করে আসছে। তারা কি সোলেমানের আদর্শেই নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখে। সেই মতেই তারা বিশ্বব্যাপী তাদের সদস্য ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে চলেছে।

তাদের ফ্রিম্যাসন্স বলার কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, তারা তৎকালীন অন্য কারিগরদের মতো ক্রীতদাস বা কোনো মালিকের অধীন কাজ করতে বাধ্য ছিল না।

তারা ছিল মুক্ত-স্বাধীন। যেখানে চাইতো সেখানে তারা বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মাণ করে মানুষকে মুগ্ধ করতো। কিন্তু তারা এই স্থাপত্য নির্মাণের অদ্ভুত সুন্দর বিদ্যা নিজেদের মাঝেই গুপ্ত রাখতো। অবশ্য ১৬৫০ সালের দিকে তারা সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তাদের সাথে যোগ দিতে অন্যদেরও আমন্ত্রণ জানায়।

কঠিন গোপনীয়তা রক্ষা করবে এই শর্তে নতুন সদস্যরা জানতে পারতো তাদের স্থাপত্য-ভাস্কর্য নির্মাণের গোপন সব কলাকৌশল। পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় তাদের ছোট ছোট বহু দল গড়ে উঠে। সেগুলো পরিচিত ছিল গিল্ড নামে। দেশের সকল ছোট ছোট গিল্ড মিলে যে বড় সংঘ তৈরি হয় তাকে বলা হতো লজ। আর এভাবেই দেশের প্রধান লজদের নিয়ে গঠিত হয় গ্রাউন্ড লজ।

(চলবে…)

…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া

…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২

চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১

চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!