-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: গন্ধ: গন্ধের রাজ্যে : প্রথম পর্ব
পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্যে ‘গন্ধ’ এমন একটি রহস্যময় ইন্দ্রিয়। যে গন্ধের রাজ্যে অবস্থান করেও আমরা এর কেবল অনুভব করতে বা নিতে পারি সত্য; কিন্তু ভাষায় বা শব্দে তা ব্যক্ত করতে পারি না। কেবল কিছু তুলনা দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করতে পারি মাত্র। আর এই ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি আমরা নিতে পারি আমাদের স্থূল দেহের ‘নাক’ দ্বারা।
মানুষের দুই চোখের মাঝ বরাবর মুখের ঠিক মাঝখানে নাক বহাল তবিয়তে অবস্থান করে। কান নিয়ে যেমন কানাকানি হয় তেমন নাক নিয়ে নাকানাকি না হলেও ‘নাক গলানো’ বলে একটা শব্দ সে অধিকার করে আছে। অর্থাৎ অন্যের কোনো ব্যাপারে ঢুকে পড়াকে বাঙালী বলে নাক গলানো।
আর এই অযাচিত নাক গলানোর বিষয়টি বাঙালী বেশ ভালোই পারে। পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে, কোথায় কি ঘটবে, কোথায় কি ঘটেছিল সব কিছুর মধ্যেই বাঙালী ঢুকে পড়বে। সে বিষয়ে তার জ্ঞান থাক না না থাক। এই যেমন আমি ‘ইন্দ্রিয়’ নিয়ে লিখতে শুরু করেছি।
এটাও এক কথায় অযাচিত নাক গলানোই। ব্যাপারটা তো তাই। তাই না?
নাক নিয়ে বাঙালীর আরেকটা বহুল ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘নাকের ডগা’। বাঙালী নাক গলাতে যেমন ভালোবাসে তেমনি নাকের ডগার উপর দিয়ে কিছু চলে যাবে সেটা হতে দেয় না। অর্থাৎ কিছু একটা ছিটকে বেড়িয়ে গেলো কিন্তু সে সম্পর্কে একটু নাক গলানো হলো না, তাই বা কি করে হয়!
এই ঘ্রাণেন্দ্রিয় নাকের গড়ন নিয়েও আছে নানান কেচ্ছাকাহিনী। এই নাকের গড়ন নিয়ে যেমন রচিত হয়েছে কাব্য; তেমনি হয়েছে নাকের গড়ন দিয়ে মানুষের বৈশিষ্ট্য আন্দাজ করবার চেষ্টা।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘তোমার বিজ্ঞাপন তোমার নাকের ওপর। বিশ্বকর্মার হাতে এ নাক দুবার তৈরি হতে পারে না; ছাঁচ তিনি মনের ক্ষোভে ভেঙে ফেলেছেন।’
নাকের সৌন্দর্য নিয়ে যেমন নানান বাহারি উপমা আছে। তেমনি নাকের বিভিন্ন গঠন-প্রকৃতি-আকার-প্রকার নিয়ে মানুষকে চিহ্নিত করার রীতিও আছে। এজন্য নাক নিয়ে সৌন্দর্য সচেতন মানুষের ভাবনার শেষ নেই। যদি সেটি চেহারার সাথে মানসই হয়। তাহলে তো কেল্লাফতে।
আর যদি না হয় তাহলে আফসোস-অনুযোগ করেই দিন শেষ। আবার অনেকের ছোট হলে বড় চাই। অনেক বড় হলে ছোট চাই। মোটা হলে চিকন চাই। চিনক হলে মোটা চাই। বাঁকা হলে সোজা চাই। আর সোজা হলে বাঁকা চাই বিষয়টা তো রয়েছেই।
আবার নাক উঁচু বলতে বংশে কুলীন বলেও ধরা হয়। আবার নাক উঁচু কুলীন ভদ্রলোকেরা অন্যদের দেখে ‘নাক সিটকায়’। অর্থাৎ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। লজ্জায় কারো নাক হয়ে উঠে লাল। আবার সংস্কারগ্রস্থ মানুষ বলে নাকের ডগা চুলকালে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়।
তবে অর্থবিত্ত আর সাহস থাকলে অনেকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায় নাকের আকার পাল্টে চেহারায় আনে নতুন সুরত। হালের ফ্যাশন জগতে নাক নিয়ে এই নাকানিচোবানির গল্প তো হরহামেশাই পেজ থ্রির পাতা দখল করে নেয়।
আবার এই নাক দেখে মানুষজন অতীত-ভবিষ্যত বলবারও ব্যঙ্গ করার চেষ্টা করেন অনেকে। বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম পুরধা পুরুষ স্বয়ং শেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘কিওপেট্রার নাকটা যদি আরেকটু ছোট হতো, রোমান সাম্রাজ্য তাহলে আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারতো।’
আবার রূপকথার গল্পে বলা হয়েছে, মিথ্যা বললে ‘নাক’ বিশাল লম্বা হয়ে যায়। যতবার মিথ্যা বলা হবে ততবার লম্বা হতেই থাকবে। অনেকে অবশ্য এর অর্ন্তনির্হিত অর্থ করে বলেন, নাক এমন এক ইন্দ্রিয় যা মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক রক্ষা করে চলে প্রতিনিয়ত।
অশুদ্ধতার চর্চা করলে প্রকৃতি থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ব্রহ্মাণ্ডের সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটার প্রতীকীরূপই হলো এই নাক বড় হওয়ার উদাহরণ।
অন্যদিকে অহং, অহঙ্কার, গড়িমাকে বোঝাতে বলা হয় ‘নাক উঁচু’। আবার জয়ী ভাব বোঝাতেও অনেক নাক উঁচু করেন। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার অসামান্য সৃষ্টি টেনিদার গল্পের ‘দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা’ গল্পে লিখেছেন-
‘পিরামিডের মতো নাক উঁচু করে বিজয়-গৌরবে ফিরে এল টেনিদা। একগাল হাসি ছড়িয়ে বললে, কেমন পার্ট হল রে হাবুল?’
আবার নাক উঁচু বলতে বংশে কুলীন বলেও ধরা হয়। আবার নাক উঁচু কুলীন ভদ্রলোকেরা অন্যদের দেখে ‘নাক সিটকায়’। অর্থাৎ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। লজ্জায় কারো নাক হয়ে উঠে লাল। আবার সংস্কারগ্রস্থ মানুষ বলে নাকের ডগা চুলকালে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়।
মুখের সৌন্দর্য বর্দ্ধনের অন্যতম অঙ্গ নাক আবার একটানা ডেকে ডেকে অন্যদের করে তোলে বিরক্ত। হ্যা নাক কেবল গন্ধই গ্রহণ করে না। ঘুমের মধ্যে ডেকেও চলে। যাকে ইংরাজিতে বলে, স্নোর। যাদের ঘুমের মধ্যে নাক ডাকে সচরাচর মানুষ তাদের সাথে পাশাপাশি ঘুমানোটা এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে।
কেউ কাব্য করে নাকের উপমা দিতে গিয়ে বলেন- ‘বাঁশির মতো নাক’। কেউবা বলেন- ‘বাঁশ পাতার মতো নাক’। কেউবা বড় নাককে বলে টিয়া পাখির নাক। অনেকে আরেকটু বাড়িয়ে বলে শকুনের নাক বা হারগিলার নাক।
সুকুমার রায় তার ‘নাকের বাহার’ রচনায় লিখেছেন- “মানুষের নাকের প্রশংসা করতে হলে তিল ফুলের সঙ্গে, টিয়া পাখির ঠোঁটের সঙ্গে গরুড়ের নাকের সঙ্গে তার তুলনা করে। কেউ কেউ আবার বলেন শুনেছি ‘বাঁশির মতো নাক’। কিন্তু মোটের উপর এ কথা বলা যায় যে, সকলের নাকেরই মোটামুটি ছাঁদটি সে একঘেয়ে রকমের; দো-নলা সুরঙ্গের মতো।
কারো নলদুটি সরু, কারো বা মোটা, কারো চ্যাপটা, কারো উঁচু-কারো মাঝখানে ঢালু, কারো আগাগোড়াই ঢিপি-এইরকম সামান্য উনিশ-বিশ যা একটু তফাৎ হয়। কারো কারো নাক যদি হাতির শুঁড়ের মতো লম্বা হত কি গণ্ডারের মতো খড়্গধারী হত, অথবা আর কোন উদ্ভট জানোয়ারের মতো হত, তাহলে বেশ একটু রকমারি হতে পারত।”
আবার এই নাককে সাজাতে বাহারি সব অলঙ্কার ব্যবহার করা হয়। নাকের পাতা রীতিমতো ফুঁটো করে বা না করে এসব গহনা পরা হয়। এই অলঙ্কার বা গহনা পরিচিত ‘নাকছবি’ বা ‘নাকফুল’ নামে।
আর মানুষ এটি করতে গিয়ে বেশিভাগ সময় এতোটাই সংবেদনশীল হয়ে উঠে যে, সে দু’চোখ বন্ধ করে গভীর ভাবে সেটা করতে চায়। অন্যসময় নি:শ্বাসের প্রতি মনোযোগী না হলেও এই কাজটি করবার সময় সে দমের প্রতি স্বজাগ হয়ে উঠে।
প্রাশ্চাত্যে যেমন হাতের আংটি দেখে অন্যের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বা অঙ্গীকার বদ্ধ তা বোঝার একটি বিষয় প্রচলিত আছে। তেমনি এশিয়া ও আফ্রিকায় বিবাহিত নারীদের এই নাকছবি পড়তে দেখা যায়। তবে একেক সংস্কৃতিতে এর ব্যবহার ও প্রয়োগের ভিন্ন ভিন্ন কারণও দেখা যায়।
তবে সারাবিশ্বেই নাকে অলঙ্কার ব্যবহারের প্রচলন আছে। তবে এর বেশিভাগই স্রেফ অলঙ্কার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। আবার নাকের কোন পাশের পাতায় বা মাঝের অংশে বা একাধিক নাকছবি পড়ার সংস্কৃতিও আছে বিভিন্ন সম্প্রদায়-ধর্ম-গোত্র-গোষ্ঠীতে। আবার ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড একে নিয়ে করেছে নানা এক্সপ্রিমেন্ট।
দিক বোঝাতেও নাককে অনেক সময় নির্দেশক হিসেবে মানা হয়। যেমন আমরা প্রায়শই বলে থাকি, ‘ঠিক নাক বরাবর চলে যাবেন’। অর্থাৎ সোজা চলে যান।
এতো কথা যে নাককে ঘিরে, সেই নাক জ্ঞানেন্দ্রিয় হিসেবে অন্যতম প্রধান যে কাজটি করে তা হলো গন্ধ বা ঘ্রাণের অনুভূতি নেয়া। আর এই গন্ধ বা ঘ্রাণশক্তি মানুষকে এমন এক অনুভূতির মুখোমুখি করে, যে অভিজ্ঞতাটা একইসাথে বেশ অন্যরকম এবং অদ্ভুত।
এর অনুভবের অভিজ্ঞতাটা এমনি যে, অনুভবের অভিজ্ঞতা নিতে নিতে বা নেয়ার সময় কালেই মানুষ সব কিছু ভুলে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠে। স্মৃতিকাতরতা বিষয়টি অনেক সময়ই আমাদের আবেগী করে তোলে। আর আনন্দের-হৃদয়স্পর্শী স্মৃতি হলে হতো কথাই নেই।
গন্ধকে শব্দে প্রকাশের ভাষাটা মানুষ আজো রপ্ত করতে পারেনি বলেই হয়তো এর রহস্যময়তা আজো অনেকটাই অটুট আছে। তাই গন্ধ নেওয়ার বা পাওয়ার সাথে সাথে মানুষ সেই গন্ধের কাছাকাছি কোনো গন্ধকে স্মৃতির সঞ্চিত সংস্কার হাতড়ে খুঁজতে শুরু করে।
আর মানুষ এটি করতে গিয়ে বেশিভাগ সময় এতোটাই সংবেদনশীল হয়ে উঠে যে, সে দু’চোখ বন্ধ করে গভীর ভাবে সেটা করতে চায়। অন্যসময় নি:শ্বাসের প্রতি মনোযোগী না হলেও এই কাজটি করবার সময় সে দমের প্রতি স্বজাগ হয়ে উঠে।
আর মুর্হূতকালের এই খোঁজার যাত্রায়, মানুষ গন্ধকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্মৃতিতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনায় ঢুকে পরে। স্মৃতিপটের বন্ধ করে দরজা খুলে সে এমন একটা জায়গায় প্রবেশ করে গন্ধ শুঁকে শুঁকে। যে দরজার ওপাশে স্বয়ং সে নিজেও সেই ঘটনার মাঝে বিরাজ করছে।
তখন কোনো গন্ধ কেবল গন্ধ বা সৌরভ বা সুবাস হয়ে থেকে যায় না। তাকে ঘিরে যে স্মৃতি যে ঘটনা তার সবই মনে স্পষ্ট হতে শুরু করে। অনেকটা টাইম ট্রাভেলের মতো ঘটে ব্যাপারটা। যদিও এটা এতো অল্প সময়ের মাঝে ঘটে যে বিষয়টা অনেকেই ধরতে পারে না।
আবার যারা দ্রুত প্রতিকৃয়া দেয়া শুরু করে দেয় তারা ঘ্রাণশক্তির প্রকৃত স্বরূপে প্রবেশ না করে শব্দে বা স্বাদ ইন্দ্রিয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ফেলে নিজের অজ্ঞাতেই।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-১
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-২
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৩
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৪
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৫
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৬
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৭
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৮
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৯