ভবঘুরেকথা
শব্দের মায়াজাল

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: প্রথম পর্ব

কথায় যদিও বল হয় ‘বোবার শত্রু নেই’। তাই বলে এ কথার এই মানে নয় যে, যারা বোবা অর্থাৎ যারা একেবারেই কথা বলতে পারেন না; তারা চির শত্রু মুক্ত। এই কথার তাৎপর্য হলো এই যে, যারা বাক্য সংযমী বা কম কথা বলে তাদের শত্রু সৃষ্টির সম্ভাবনা সবচাইতে কম।

অর্থাৎ যেখানে শব্দ নেই… ভাষা নেই… সেখানে দ্বন্দ্বের অবকাশও নেই।

তবে শব্দই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি একমাত্র উৎস, বিষয়টা এমন না হলেও। এ কথা সত্য যে ‘দ্বন্দ্ব-কুতর্ক’ জন্ম দেয়ায় অন্যতম অনুষঙ্গ হলো এই ‘শব্দ’। তাই ভাবনায় যে যত গভীর, তার শব্দের ব্যবহার ও শব্দের চয়ন তত নির্দিষ্ট। তত সুনির্দিষ্ট এবং কম সংখ্যক শব্দ তারা ব্যবহার করে থাকেন। বলা যায়, নিরবতাই হয়ে উঠে তাদের ভাষা।

সাধককুল বলেন, স্রষ্টার বা ব্রহ্মাণ্ডের ভাষাও ‘শব্দ শূন্য’ অর্থাৎ নিরবতা-নিস্তব্ধতা সর্বোপরি শূন্যতা। সাধন-ভজনে সাধক যখন নিজের ভেতর এবং বাহির উভয়ের মাঝে উচ্চারিত শব্দকে শূন্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তখন সে স্বয়ং মহৎ আত্মা হয়ে পরমের ভাষা শুনতে, বুঝতে, জানতে শুরু করে বা জানা-বোঝা-শোনার সম্ভাবনা তার মাঝে উদয় হয়। সহজ ভাবে বলতে গেলে, সে নিরবতা-নিস্তব্ধতার ভাষাকে বুঝবার সক্ষমতা লাভ করে।

বলা হয়, জাগতিক ভাষার নিরবতাতেই পরমের ভাষা জাগ্রত হয়। পরমের ভাষার প্রকাশ শব্দে নয়, হয় উপলব্ধিতে। আর সম্পূর্ণ নিরব হতে পারলে-সম্পূর্ণ শূন্য হতে পারলে তবেই কেবল সেই শব্দহীন ভাষার সন্ধান মেলে। শব্দহীন হলেই শব্দহীনতার মাঝে লীন হওয়া যায়।

নিরবতার নিজস্ব একধরণের শব্দ বা ভাষা যেমন আছে, তেমনি আছে তার ‘সুর’ ‘ধ্বনি’ ‘স্বর’ ‘বর্ণ’ ‘ব্যাকরণ’ প্রভৃতি। এতো বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে আপাতত মহাজাগতিক শব্দের সাথে সুরের সম্পর্ক যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এটুকু জেনে রাখাই যথেষ্ট।

মহাজাগতিক সেই নিরবতার-নিশ্চুপতার শব্দহীন ভাষা বা শব্দমালাকে শোনার জন্যও যেমন চাই দীর্ঘ সাধনা-তপস্যা। তেমনি চারপাশের বহুবিধ সুর-ধ্বনির ভীড়ে পরমের সেই মূল সুরকে শুনতে গেলেও চাই গভীর প্রজ্ঞা, অর্ন্তনিহিত জ্ঞান, প্রেমময়-বিচারশূন্য মন, বাসনা-কামনা মুক্ত চিত্ত, সন্তুষ্ট মনোভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। সহজভাবে বলতে গেলে চাই ‘শুদ্ধ চেতনা’।

মাওলানা জালালউদ্দিনি রুমি বলেছেন, ‘তুমি নিশ্চুপ হও। যিনি পৃথিবীর সকল শব্দকে সৃষ্টি করেছেন তাকেই কথা বলতে দাও। তিনিই দরজা সৃষ্টি করেছেন, তিনি তালা সৃষ্টি করেছেন এবং তার চাবিও তিনিই সৃষ্টি করেছেন।’

আর কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন-

এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।

এখানে জেনে রাখা ভালো, ব্রহ্মাণ্ডের চেতনা সদা ‘শুদ্ধ ও আনন্দময়’। তাই তাকে বুঝতে গেলে, তার ভাষাকে অনুধাবন করতে গেলেও সেই রূপ ধারণ করতে হয়। হতে হয় সদা আনন্দময় প্রশান্ত চিত্তের অধিকারী। তবেই সে ধরা দেয়। কথায় বলে না, ‘তেলে-জলে মেশে না’। এখানেও ঠিক তেমনি।

যতক্ষণ তুমি তেল হয়ে থাকবে ততক্ষণ জলের সাথে মিশতে পারবে না। বা উল্টো করে বললে, যতক্ষণ তুমি জল হয়ে থাকবে ততক্ষণ তুমি তেলের সাথে মিশতে পারবে না। সাধককুল চিরকালেই এই তেল থেকে জল হয়ে জলের সাথে মেশা বা জল থেকে তেল হয়ে তেলের সাথে মেশার নিজ নিজ সাধন পথে সহজ মত-পথ অনুসন্ধানের কাজ করে চলেছেন।

সাধনা উপলব্ধ সেই সব তরিকা-আচার-বিচার-উপাচার-আরাধনা-উপাসনা তারা দিয়ে গেছেন যোগ্য শিষ্যদের হাতে। যা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চলমান-বহমান। তবে সেই জ্ঞান এমনই জ্ঞান যে তা কেবল শুদ্ধচিত্তেই ধরা দেয়। সেই জ্ঞান ধারার পথ বহন করে চলে বহুজন। কিন্তু তার বিকাশ ঘটে গুটিকয়েক যোগ্য সাধকের মাঝেই।

কি সেই সাধনা? কি সেই পথ? কি সেই মত? তা নিয়েও রয়েছে নানা মুনির নানা মত। শিক্ষিত সমাজ তাকে একভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। বিশ্বাসীরা একভাবে। অবিশ্বাসীরা তাদের মতো করে। এভাবে চলতে থাকে শব্দের যুদ্ধ বা তার্কিক যুদ্ধ।

তবে প্রশ্ন সকল মহলের কাছেই সমান এবং অনেকাংশে একই। শব্দহীনতার কি আদৌও ভাষা আছে? শব্দহীন হলেই কি পরমের সন্ধান মেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়? আদৌও কি সাধনবলে পরমের সান্নিধ্য সম্ভব? পরম বা স্রষ্টা বলে আসলেই কি কিছু আছে?

স্রষ্টার ভাষা কি সৃষ্টি বুঝতে পারে? সৃষ্টি যে ভাষায় কথা বলে তা কি স্রষ্টারই ভাষা নয়? ইত্যাদি ইত্যাদি…

এমনি অগনতি প্রশ্নমালাও কিন্তু শেষমেষ মিলেমিশে উত্তরহীন কিছু শব্দই। তা ভাষা হয়ে উচ্চারিতই হোক বা অনুচ্চারিতই থাকুক। সাধারণভাবে বলতে গেলে, প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা মানেই হলো কিছু শব্দের সরাসরি বা অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যার অনুসন্ধান।

ঘুরে ফিরে বলতে হয়, শব্দ প্রশ্নের জন্ম দেয়। আবার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েও ব্যবহার করতে হয় শব্দ। কারণ এটাই সবচাইতে স্বাভাবিক ও সহজতর জাগতিক পদ্ধতি। ইন্দ্রিয়ের অন্যান্য অনুভূতিও নানাভাবে প্রশ্নের জন্ম দেয় একথাও ততটাই সত্য কিন্তু এর মাঝে শব্দ কেনো বেশি গুরুত্ব বহন করে আশা করে আলোচনা এগিয়ে গেলে সেটাও পরিষ্কার হবে।

প্রকৃত অর্থে শব্দকে যত চর্চা করা হয় ততই নতুন নতুন শব্দের যেমন জন্ম হয়; তেমনি একই শব্দের বারবার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। আর এই শব্দ আমরা বলি বা শুনে থাকি আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা।

জ্ঞানেন্দ্রিয় ‘শব্দ’ অর্থাৎ শ্রবণ শক্তি দ্বারা আমরা শব্দ বা ধ্বনি শুনে থাকি। আর কর্ম ইন্দ্রিয়ের ‘বাক’ অর্থাৎ মুখ দিয়ে আমরা শব্দ উচ্চারণ করে থাকি। আমরা এই শব্দের মায়াজালেই থেকে যাই সর্বক্ষণ। প্রতিনিয়ত বলি বা শুনি। সাধারণ মানুষের জীবনে খুব কম সময়ই আসে এর বাইরে থাকবার।

সাধককুল মানবদেহের পঞ্চ জ্ঞান ও পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয়কে নিজের আয়াত্বে এনে নিরববতার চূড়ান্তে পৌঁছানোর নানাবিধ সাধন-ভজনের কথা বলেছেন। অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন শব্দ বা বাক্যের উপর নিয়ন্ত্রণকে। বলা হয়, শুদ্ধতা চর্চার অন্যতম হলো শুদ্ধ বাক্যের প্রয়োগ।

জগতের সকল শুদ্ধ মত-পথ-ধর্ম-দর্শন শুদ্ধ বাক্য-সত্য বাক্য এবং বাক্য সংযমের কথা বলেছেন। সাধুগুরু-মুনি-ঋষি-অলি-আউলিয়াদের অধিকাংশই এর সাথে একত্বতা প্রকাশ করেছেন। তবে আধ্যাত্মিক পাগল, খোদার পাগল-ইসকে দিওয়ানা-মস্তান এবং কিছু তান্ত্রিকদের মাঝে এর ব্যত্যয় দেখা গেলেও তার ব্যাখ্যা ভিন্ন। সে প্রসঙ্গেও কয়েক কথা বলবো অন্য কোনো সময়।

সাধককুল সাধনে প্রবেশের জন্য মানবদেহের পঞ্চতত্ত্ব, পঞ্চ জ্ঞান ইন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয়কে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহারের রীতিনীতি ব্যক্ত করেছেন; বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ভাবে। তবে সে সবই সাধন-ভজনের প্রারম্ভের কথা। কিন্তু সাধনের চূড়ান্ত পর্বে জ্ঞান ও কর্ম ইন্দ্রিয়ের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না।

ইন্দ্রিয়ের ঊর্দ্ধে উঠে তবেই সে সাধন দেশ হতে মোক্ষ বা নির্বাণের পথে যাত্রা করতে হয়। তবেই হয় লীলা। আরো এগুলে হয় লীলাখেলা।

সাধনার শুরুতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ সকল কিছুকেই বিভিন্ন আচার-উপাচারে ব্যবহারের বিধি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। ইন্দ্রিয় দ্বারাই আমরা সাধারণভাবে বাইরের সকল কিছুর স্বাদ আস্বাদন করি অর্থাৎ অনুভব করি।

বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমই হলো আমাদের এই সকল ইন্দ্রিয়সমূহ। ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার ছাড়া আমরা অচল; এই প্রকাশ্য বিশ্ব সংসারে। তাই দেহধারী জীব ইন্দ্রিয়কে অস্বীকার করতে পারে না। তবে এর প্রকৃত ব্যবহার সম্পর্কে জানতে ও সেই মতে ব্যবহার করার সাধন সে করতে পারে।

ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে স্রষ্টা বা পরম বা ব্রহ্মাণ্ডের চরম সত্যকে পাওয়ার জন্য মানুষ নিজ নিজ বিশ্বাসে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে চলেছে, সেই আদ্দিকাল থেকেই। প্রচলিত ধর্ম-মতাদর্শগুলোতে এর গঠনমূলক নিয়মনীতি সহজেই চোখে পরে।

সেখানে যেমন আছে শব্দের ব্যবহার, তেমনি আছে অন্যান্য ইন্দ্রিয় অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধের ব্যবহার। তবে পরিশেষে সবই নিরবতায় যেয়েই মিশে। কারণ নিরবতাতেই পরমে বাস; নিরবতাই পরমের ভাষা। সেটাই তার সাথে যোগাযোগের পথ। তার সান্নিধ্য পাওয়ার অবলম্বন।

আর এই নিরবতা ভঙ্গে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অন্যতম ইন্দ্রিয় ‘শব্দ’। তবে শব্দকে যতই দোষ দেয়া হোক না কেনো, একথা কি আর অস্বীকার করা যায় যে শব্দের ভেতরে দিয়েই আমরা সবচেয়ে সুন্দর-নান্দনিক ভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি? নিজের ভাবনাকে ব্যক্ত করতে পারি?

(চলবে…)

পরবর্তী পর্ব >>

……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Limon , রবিবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ @ ১:২০ পূর্বাহ্ণ

    আলেক সাঁই
    শব্দ নিয়ে কখনো এভাবে চিন্তা করা হয় নি।
    সাধু মূল কথা তো এই, স্রষ্টার শব্দ শুনতে হলে নিজের শব্দকে বন্ধ রাখতে হবে?

    • ভবঘুরে , সোমবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ @ ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ

      জয় গুরু সাধু
      এক কথায় এর উত্তর দেয়া কঠিন।
      শব্দ সবগুলো পর্ব পড়লে হয়তো কিছুটা ধারণা পাবেন।
      আর অতি শীঘ্রই স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ ইন্দ্রিয় বিষয়ক লেখাগুলোও প্রকাশ করা হবে
      আশা করি সবগুলো পড়লে উত্তরটা খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।
      জয়গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!