ভবঘুরেকথা
শব্দের মায়াজাল

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: চোদ্দতম পর্ব

তারপরও অনেকে শব্দের ব্যবহারে সাধারণ কথাকেও হাস্যরসে পরিণত করে। এ এক শিল্প। অনেক সময় কেবল বলবার ভক্তিতেই সাধারণ শব্দ শুনেও মানুষ হাসিতে ফেটে পারে। আবার অন্যের বিশেষ করে জনপ্রিয় কারো শব্দের উচ্চারণ ও চয়ন ভঙ্গির প্রতিরূপ করেও অনেকে মানুষকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করে। এটি জনপ্রিয় ‘মিমিক্রি’ নামে।

আবার ‘হরবোলা’ বলে আরেকটা কৌশল আছে। হরবোলা শিল্পীরা মুখ দিয়ে অবিকলভাবে নানা পশুপাখির বিচিত্র সব শব্দ করে থাকে। বর্তমানে হরবোলা শিল্পীরা কেবল প্রাকৃতিক শব্দেই নয় নানাবিধ কৃত্রিম শব্দের উপস্থাপন করেও দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে। এটাও বেশ আশ্চর্য এক প্রতিভা।

আরেক ধরনের শিল্পী আছেন যারা শব্দকে এমনভাবে ব্যবহার করেন যে তা কোথা থেকে হচ্ছে তা ধরা মুশকিল হয়ে যায়। এই শিল্পটি পরিচিত ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম’ বা ‘ভেন্ট্রোলোকি’ নামে। আর এর শিল্পীরা ‘ভেন্ট্রোলোকিস্ট’ নামে।

অনেক সময় তারা বিভিন্ন পুতুল নিয়ে এসব শব্দ উৎক্ষেপনের খেলা দেখান। তারা মুখ প্রায় বন্ধ রেখে এমন কায়দায় নানান শব্দ উচ্চারণ করে যাতে করে মনে হয় তাদের পুতুলগুলোই সেসব বলছে।

শব্দের এমন অভিনব ব্যবহার মানুষকে অনেক সময় মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। মানুষ ভুলেই যায় পুতুলগুলো জীবিত কেউ নয়। কেবলই খেলনা মাত্র। কিছু শব্দ তাদেরকে মানুষের স্মৃতিতে জীবন্ত করে তোলে এভাবেই।

কৌতুক বা হাস্যরসে বহুল ব্যবহৃত আরেকটি শব্দ হলো ‘ডুয়েল মিনিং’ বা ‘দ্বৈত অর্থ’। এতে কৌতুক শিল্পীরা এমন কিছু ইংগিতপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে। যাতে বলবার ভঙ্গি বা শব্দের ব্যবহারে তাকে একটা ভিন্ন অর্থে নিয়ে যায়। তার অর্থ সকলের কাছে পরিষ্কার হলেও, সকল সময় তা সকলের সামনে মুখে বলা যায় না।

প্রচলিত সমাজের অনেক আপত্তিকর শব্দ বা ভাবনাকেও অনেক কৌতুক শিল্পী তার এই দ্বৈত অর্থের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে থাকে।

আবার কিছু কিছু শব্দ সময়ের আবহে দ্বৈত অর্থ বহন করে চলে। শুদ্ধ মতে, তার একটা নির্ধারিত অর্থ থাকলেও প্রচলিত সমাজে সেই শব্দই আবার ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়।

একে অনেকে শব্দ বিভ্রাটও বলেন। আসলেই বিশাল বিভ্রাট ঘটে যায় ভুল জায়গায় এরূপ শব্দ ব্যবহারে। কথায় বলে না- ‘এক দেশের বুলি, অন্য দেশের গালি’। এটিও অনেকটা সে রকমই।

শব্দের আরেকটা চমকপ্রদ ব্যবহার করতে দেয়া যায় ক্যানভাসারদের। হাটে-মাঠে-মেলা বা রাস্তার মোড়ে তারা নানা চিত্তাকর্ষক শব্দ ব্যবহার করে এমন চমকপ্রদ ভাবে ব্যবহার করে যে মানুষ ভীড় করে তা শুনতে বাধ্য হয়। তাদের চমকপ্রদ শব্দের ব্যবহারে প্রয়োজন না থাকলেও উপস্থিত মানুষজন তা কিনতে বাধ্য হয়।

আধুনিকভাবে সেই কন্যাভাস আশ্রয় নিয়েছে বিজ্ঞাপনের ভাষায়। নানা গণমাধ্যমে নানা ভাবে শব্দকে ব্যবহার করে আকষর্ণীয় করে তোলা হয় এই সব বিজ্ঞাপন। যাতে মানুষ একই প্রকৃয়ায় প্রয়োজন না থাকলেও সে সব পণ্য কিনতে মড়িয়া হয়ে যায়।

আবার শব্দের ব্যবহারে ভিন্নতা দেখা যায় আবৃত্তিতে। শব্দের উচ্চরণকে গুরুত্ব দিয়ে সে নিয়ে একটা শিল্প হয়ে উঠেছে। একই ভাবে যাত্রাপালায় শব্দের ব্যবহারকে দেখলে দেখা যাবে সহজ একটা শব্দকে অতি উচ্চস্বরে বলে মানুষকে তার মধ্যে বেঁধে রাখে।

সিনেমায় এক ধরনের শব্দের ব্যবহার করা হয়, টিভি নাটকে এক ধরনের, আবার মঞ্চ নাটকে বা পথ নাটকে আরেক ভাবে শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।

ভিজুয়াল মিডিয়ার সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায় শব্দকে নানা ভাবে ব্যবহার করতে। কোনো কোন সংবাদ পাঠক এমন করে শব্দ পাঠ করে যেন মনে হয় এই মাত্র বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। সাধারণ বিষয়কেও কোনো কোন সংবাদপাঠ এমন সংবাদের পরিণত করে যে তা উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে উঠে।

আসলে এরূপ নানাভাবে শব্দকে ব্যবহার করে মানুষ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা যুগে যুগে চালিয়েই যাচ্ছে। শব্দ শেষ বিচারে যদি মাত্র সেই তিনটিতেই অর্থাৎ ‘আ য়া ম’ বা ‘উ য় ম’ হয় তাহলে আশ্চর্য হতেই হয়। এই তিনটি শব্দ দিয়ে আমরা কত রকম শব্দ আবিষ্কার করে চলেছি। আবার সেই শব্দকে কতভাবে উপস্থাপন করে চলেছি।

আবার শব্দকে যেমন অক্ষরের মধ্য দিয়ে রূপ দিয়েছে বিভিন্ন ভাষা। তেমনি আবার শব্দের সাংকেতিক ভাষায় ব্যবহারও বহুল প্রচলিত। মিশর, চীন সহ বহু দেশের আদি লিপিতে কেবল অক্ষর নয় শব্দকে চিত্রিত করতেও সংকেতের ব্যবহার সর্ব মহলেরই জানা।

আবার অনেকে বলেন, সমস্ত চিত্রকর্মই আদৌতে শব্দের প্রকাশের একটা ভাষা মাত্র। সেই আদি কালে গুহায় আঁকা যে চিত্রমালা… সেই বাইসন, সেই হরিণ, শিকারী সবই তো আদৌতে অনেক অব্যক্ত শব্দ ছবি হয়েই ফুটে আছে।

হাজার হাজার বছর পরে তো আমরা সেসবের শব্দকেই অনুসন্ধান করতে চাই; তার ভাষাকে বোঝার জন্য, তার ভাবকে বুঝবার জন্য। চিত্র শিল্পীরা তাদের ভাষা… তাদের শব্দকে… চিত্রের ভেতর দিয়ে এক ধরনের বার্তা দিয়ে যায়। তাদের সেই বার্তার শব্দ লুকায়িত থাকে চিত্রপটে।

এছাড়ারও বহু ভাষায় সংকেতের ব্যবহার দেখা যায়। অনেকে আবার নিজেদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য শব্দকে নিজেদের মতো সাজিয়ে সাংকেতিক ভাষার রূপ দেয়। এই সাংকেতিক শব্দ কেবল গোয়েন্দা মহল ব্যবহার করে তা তো নয়। এর ব্যবহার অপরাধী, গুপ্তসংঘ থেকে শুরু করে সাধুগুরুরাও ব্যবহার করে থাকেন।

আবার স্রেফ মজা করার জন্য অনেকে শব্দকে উল্টে বলার অভ্যাস করে। যেমন- আমি তোমাকে ভালোবাসিকে বলে ‘মিআ কেমাতো কেসিবালোভা’। আবার অনেকে শব্দের সাথে কিছু যুক্ত করে বা একটু পাল্টে নিয়ে বলে- ‘ইটামি তিটোমারে ভিটালোবিটাসি’।

আবার পেশাজীবীদের অনেকে ‘শব্দ সংকোচ’ বা ‘শর্ট হ্যান্ড’-এর ব্যবহার করে থাকে। দ্রুত বলে যাওয়া শব্দগুলোকে ধরে রাখবার জন্য শর্ট হ্যান্ড গত শতকে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।

গত শতকে বিজ্ঞানী মার্কনি শব্দকে বহুদূরে প্রেরণ করেও একই ভাবে তা প্রচার করে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বকে। ১৯০৪ সালে মার্কনিকে রেডিও আবিষ্কারের পেটেন্ট দিয়ে দেওয়া হয়। মার্কনি ১৯০৯ সালে নোবেল পুরস্কার জিতে নেন।

যদিও তার আগেই বাঙালীর ছেলে জগদীশচন্দ্র বসু রেডিও আবিষ্কার করে ফেলেছিল। বিজ্ঞানী টেসলাও রেডিওর পেটেন্ট্রে জন্য আবেদন করেছিল ১৮৯৭ সালে।

এর বহুদিন পর আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল আবিষ্কার করে ফেলেন ‘টেলিফোন’ বা ‘দূরালাপনী’ যন্ত্র। যাতে দুই প্রান্তে থাকা মানুষ নিজেদের মধ্যে সরাসরি কথা চালিয়ে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়।

১৮৭৬ সালে মার্কিন উদ্ভাবক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে মুখের কথা পাঠানোর যন্ত্রের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ট লাভ করেন। পরবর্তী বহু জনের ছোঁয়ায় তার ক্রমে আধুনিক হতে হতে আজ স্মার্ট ফোনের রূপ নিয়ে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে।

১৮৬০-এর দশকে যে কৃত্রিমভাবে দ্বিমাত্রিক চলমান ছবি তৈরির কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় তার দুই দশক পরে চলচ্চিত্র ক্যামেরা উদ্ভাবিত হয়। এই ধারা এগিয়ে গিয়ে নির্বাক চলচ্চিত্র সৃষ্টি হয়। সে চলচ্চিত্রে ছবি দেখা গেলেও শব্দ শোনার ব্যবস্থা ছিল না।

চলচ্চিত্রে সরাসরি শব্দ প্রয়োগের ব্যবস্থা না করা গেলেও পরিবেশকরা নতুন এক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন এ সময়। তারা চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় পর্দার পাশে যন্ত্রীদের বসিয়ে দিতো। তারা সেখানে বসে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের সাথে তাল মিলিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নির্বাক চলচ্চিত্রে প্রাণ দেয়ার চেষ্টা করতো।

কোনো কোনো চলচ্চিত্রে শব্দকে লেখার ভাষায় ব্যবহার করা হতো। তবে ১৯২০ দশকের দিকে প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে চলচ্চিত্রে ধীরে ধীরে শব্দ, সুর ও সংলাপের শব্দ যুক্ত করা হতে শুরু করে। উদ্ভব হয় সবাক চলচ্চিত্রের। তখন তা পরিচিতি পায় ‘’টকিং পিকচার’ বা ‘টকি’ নামে। এভাবেই চলচ্চিত্রে শব্দ যুক্ত হয়ে যায়।

প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রায় মানুষ এখন চাইলেই শব্দকে বহুদূরে নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট কারো আছে যেমন পাঠাতে পারে। তেমন শব্দকে ধরে রাখতে পারে। শব্দকে মাপতে পারে, বাঁধতে পারে নানা প্যারামিটারে।

তবে এতো সব আধুনিকতার আগেও শব্দ বার্তা হয়ে টরেটক্কা বা টেলিগ্রাম যন্ত্র দিয়ে দূর দূরান্তের ডাকঘরে পৌঁছে যেত। এক সময় এটি ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় বার্তা মাধ্যম। এটি এমন একটি পদ্ধতি যা মূল লিখিত পত্রটিকে প্রেরণ না করে তারের মাধ্যমে বার্তাটি পাঠিয়ে দেয়া হতো।

প্রতিটা অক্ষরের প্রেক্ষিতে একটা নির্দিষ্ট বা নির্দিষ্টসংখ্যক শব্দ ব্যবহার করে। পৃথিবীর বহু গোয়েন্দা সংস্থা আজো তাদের বার্তা গোপন রাখতে এরূপ পদ্ধতি ব্যবহার করে। আসলে শব্দকে নিয়ে যে কত রকম প্রয়োগ মানুষ করেছে এবং করে চলেছে তার শেষ নেই।

শব্দের লিখিত রূপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচলন হলো- চিঠিপত্র বা বার্তা। এই তো কিছুদিন আগেও লিখিত চিঠির শব্দে মানুষের প্রাণের আবেদন ফুটে উঠতো। যান্ত্রিক আধুনিকায়নে সেই কাগজে লেখা চিঠি আজ আবেদন হারিয়েছে। তার নতুন কিছু রূপ আবিষ্কৃত অবশ্য হয়েছে।

(চলবে…)

পরবর্তী পর্ব >>

……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!