ভবঘুরেকথা
শব্দের মায়াজাল

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: ষষ্ঠ পর্ব

সংক্ষেপে বলতে গেলে, জন্মগতভাবে মানুষ যে সংস্কার প্রাপ্ত হয় তা পৈত্রিক সংস্কার। যা মূলত পিতা-মাতার স্বভাব, অভিজ্ঞতা ও পরিবার থেকে লাভ করে। শব্দের মায়াজালে মানুষ তাতেই অভ্যস্ত থাকে।

পারিপার্শ্বিক সংস্কার হলো মানুষ যা তার চারপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি-মানুষ-ঘটনার প্রভাবে প্রাপ্ত হয়। মানুষ তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে সংস্কার নিজে গড়ে তোলে তাই তার নিজস্ব সংস্কার। আর জন্ম-জন্মান্তর ধরে যে সংস্কার মানুষ সঞ্চিত করে রাখে তা হলো পূর্বজন্মের সংস্কার।

আর আত্মার মূল সংস্কার হলো ব্রহ্মাণ্ডের সংস্কার। অর্থাৎ শূন্যবাদ। শূন্যত্বই হলো ব্রহ্মাণ্ডের সংস্কার। সংস্কার শূন্যই হলো আত্মার মূল সংস্কার। যা হলো সদা আনন্দময়। যাতে দু:খ-কষ্ট, রিপু, কামনা-বাসনা জড়া-ব্যাধি কোনো কিছুর স্থান নেই।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো দেহ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ও সংস্কার এগুলো কিন্তু পাশাপাশি থাকা বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। এগুলো মূলত চক্রাকারে থাকা শ্রেণীবদ্ধ ধারণা মাত্র।

গুছিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়- ইন্দ্রিয় যা গ্রহণ করে তা সে মনকে পাঠায়। মন তা বুদ্ধির কাছে পাঠায়। বুদ্ধি তা তার কাছে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অর্থাৎ সংস্কারের কাছে পাঠায়। সংস্কার যে মন্তব্য প্রদান করে তা বুদ্ধি সিদ্ধান্ত নিয়ে মনকে পাঠায়। মন তা প্রতিকৃয়া প্রকাশ করে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা।

এই স্থূল ও সূক্ষ্ম দুই দেহের এ যাবৎ আলোচনার ভিত্তিতে এটুকু বলা যায় ইন্দ্রিয়ের প্রাপ্ত তথ্যের গন্তব্য হলো সংস্কার। আর সংস্কারের প্রকাশের পথ হলো ইন্দ্রিয়। অর্থাৎ এই প্রকৃয়া চলে চক্রাকারে।

এখানে বেশ কিছু প্রশ্নের উদয় হতেই পারে। যেমন- সংস্কার কেনো সঞ্চিত থাকে? বা আমরা কেনো সংস্কার সঞ্চয় করি? আমরা ইচ্ছা করলেই কি সংস্কার সঞ্চয় থেকে বিরত থাকতে পারি? নাকি সংস্কার সঞ্চয়ই মানব জনমের কার্য?

আসলে এসব যথাযথভাবে বুঝতে গেলে এর সাথে যুক্ত আরো অনেককিছু সম্পর্কেই জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সেসব এ যাত্রায় আলোচনা করা হচ্ছে না বলে গভীর বিষয়গুলো আপাতত এড়িয়ে সহজভাবে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি যাতে করে আলোচনা এগিয়ে নেয়া যায়।

তাই সংস্কারের জটিল মারপ্যাঁচে না গিয়েও সহজে বলতে গেলেও সংস্কারের সাথে যুক্ত আরো দুটি শব্দ সম্পর্কে এখানে খানিকটা ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই শব্দদ্বয় হলো- কামনা ও বাসনা।

সহজ ভাষায় কামনা হলো তাই, যা কিছু মানুষ মনে মনে নিজের করে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে থাকে। যে সকল ইচ্ছের কথা ‘জেনে’ পাওয়া ইচ্ছা পোষণ করে তাকেই সহজে বলা যায় কামনা।

আর মানুষ যা কিছু নিজের করে নিতে চায়, কিন্তু তা সে নিজেও জানে না তাই হলো বাসনা।

কামনা-বাসনা এ দুটিই হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। যা মানুষ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে নিজের করে নিতে চায়। তাই আমরা সাধারণেরা বেশিভাগ ক্ষেত্রে নিজের অজ্ঞাতেও সকল কিছুকেই নিজের করে রাখতে চাই।

এই নিজের করে রাখতে চাওয়ার প্রবণতা মানুষকে যোগ্যতা প্রমাণের পথে হাঁটায়। মানুষ যখন নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে চায় বা নিজেকে অন্যের কাছে প্রমাণ করতে চায়, তখনই সে সকল তথ্য-উপাত্য-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাখতে শুরু করে।

শিশুকাল থেকেই মানুষ তার নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বা নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা শুরু করে দেয়। আর বড় হতে হতে মানুষ নিজেকে যতই সভ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে ততই নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টাও পাল্লা দিয়ে বাড়িয়েই চলে।

এই নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে মানুষ প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানাবিধ তথ্য-উপাত্য প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করে চলে। বাড়িয়ে চলে সংস্কারের ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডার প্রতিনিয়ত বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও জন্মান্তরে বিশ্বাসীরা বলেন, এই সংস্কার এতোই ভয়ঙ্কর যে মৃত্যুর মধ্য দিয়েও সংস্কার মুঝে ফেলা যায় না।

দেহ থেকে ‘আত্মা’ বেড়িয়ে যাবার সময় তার সাথে আর কোনো কিছু যেতে না পারলেও সংস্কার আত্মার সাথে লেপ্টে থাকে জন্মজন্মান্তর ধরে। আত্মার অভিজ্ঞতা স্বরূপ।

বিশ্বাসীরা আরো বলেন, মৃত্যুর পর আত্মা তার সাথে যে সংস্কারের ভাণ্ডারকে বহন করে নিয়ে যায়। তার ভিত্তিতেই জীবের নব জন্মের ঠিকানা নির্দিষ্ট হয়।

আর যতক্ষণ পর্যন্ত সে সংস্কার শূন্য না হতে পারে ততক্ষণ সে পরম ব্রহ্মাণ্ডের সাথে লীন হওয়ার অনুমতি প্রাপ্ত হয় না। কারণ ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ হলো সংস্কার শূন্য।

তাই কেউ যখন সংস্কার শূন্য হতে পারে তখনই সে ব্রহ্মাণ্ডকে বুঝতে-জানতে-চিনতে পারার যোগ্যতা অর্জন করে। নয়তো নব নব জন্ম নিয়ে বিশ্ব সংসারে ঘুরতে থাকে।

আর যার সংস্কারের সঞ্চয় যত কম, সে ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো বিষয় সম্পর্কে ততবেশি সত্যের কাছাকাছি ধারণা করতে পারে। নয়তো সত্যে পৌঁছানোর আগেই সংস্কারের ভাণ্ডার আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে ফেলে।

যখনি আমরা কোনো শব্দ শুনি বা বলি সাধারণভাবে আমরা তার গভীরতায় প্রবেশ করার আগেই পূর্বের সঞ্চিত সংস্কারের মুখাপেক্ষী হই। তার বিবেচনায় প্রতিকৃয়া প্রকাশ করে ফেলি। পূর্ব পরিচিত শব্দ সম্পর্কিত সঞ্চিত জমা-পুঞ্জির কারণে আমরা শব্দের সঠিক অর্থে পৌঁছাতে বেশিভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হই।

যার সংস্কার কম থাকে বা শুদ্ধ থাকে, সে অভিজ্ঞতার ধারণা থেকে অনুমান করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না। সে শব্দের সঠিক তত্ত্বের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা চালায়। উপলব্ধির প্রকাশ ঘটায়।

সাধককুল বলে, সংস্কারশূন্য মন সকল ঘটনা সকল পরিস্থিতি সর্বোপরি সকল কিছুকে চূড়ান্ত বিচারে মূল্যায়ন করতে পারে। এই সংস্কার শূন্য হওয়াই সাধনায় অভীষ্ট লক্ষ্য। অর্থাৎ নিজে শূন্য হয় মহাশূন্যে লীন হওয়া।

কিন্তু শব্দশূন্য হওয়া তো কোনো সহজ কাজ নয়। শব্দ নামক ইন্দ্রিয় তা হতে বা দিবেই বা কেনো? তার উপর জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কারের ভাণ্ডার তো রয়েছেই।

শব্দ বড়ই আশ্চর্যপ্রদ ইন্দ্রিয়। পারস্যের সুফি মতের একটা ধারা বিশ্বাস করে, এ জগৎ সৃষ্টি হয়েছে শব্দের ভেতর দিয়ে। এমনকি জগতের সকল কিছুর সৃষ্টির পেছনেও আছে শব্দের খেলা। সকল শব্দেরই আছে নিজস্ব এক দৃশ্যমান সৃষ্টি।

তারা আরো বলেন, প্রথম শব্দে একজন বার্তাবাহক সৃষ্টি হয়। আর এই বার্তাবাহকের পাখার শব্দে জগতের এক এক করে সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। পারস্যের সুফি সাধক ও কবি শেইখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দির ইশরাকি দর্শন এর অন্যতম সমর্থক।

অন্যদিক ভারতীয় পৌরাণিক গাঁথায় পাওয়া যায়, মহাদেব শিব ওঁম ধ্বনি করার পর সমস্ত সৃষ্টি একে একে সৃষ্ট জগতে দৃশ্যমান হতে থাকে। এই ওঁম ধ্বনিই সৃষ্টির মূলরহস্য বা সৃষ্টির প্রাথমিক বা মৌলিক শব্দ।

শব্দ এবং শব্দ সম্পর্কিত আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আবারো ‘বিড়াল’ শব্দটাকেই নেয়া যাক। যেমন ধরুন আপনার কানে আসলো ‘বিড়াল’ শব্দটি। সাথে সাথে আপনি কল্পনায় এক ধরনের বিড়ালের ছবি বা তার স্বভাব কল্পনা করতে শুরু করে দিবেন।

আপনার অভিজ্ঞতায় যদি কালো বিড়াল থাকে তাহলে আপনি কালো বিড়ালের কথা ভাবতে শুরু করবেন। যদি আপনি কোনো বিড়ালের সাথে পরিচিতি থাকেন। তাহলে সেই বিড়ালের সাথে মেলাতে চেষ্টা করতে থাকবেন।

ধরা যাক, আপনার পোষা বা আপনার পরিচিত কারো পোষা বিড়ালের নাম ছিল ‘মিনু’। আমি সেই মিনুর সাথে এই বিড়াল শব্দটিকে মেলাতে শুরু করে দিবেন নিজের অজান্তেই। সুকুমার রায় তার অনবদ্য সৃষ্টি ‘হ য ব র ল’-তে এই শব্দের খেলায় এক জায়গায় বলেছেন, ‘কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।’

এই যে শব্দের মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতা পাল্টে যাওয়া। এটা একটা দারুণ ব্যাপার। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ এই শব্দের পেছনের অভিজ্ঞতা পাল্টাতে পারি না সহজে। আমরা থেকে যাই নিজস্ব অভিজ্ঞতার সঞ্চিত সংস্কারের কল্পিত গণ্ডিতে। এর জন্যই আমরা পৃথক হয়ে যাই পরস্পর থেকে।

যেমন প্রত্যেক তত্ত্ব বা ঘরানার কিছু নিজস্ব শব্দ থাকে। আপনি যদি সেই শব্দগুলো জানেন তাহলে তারা আপনাকে প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে নিবেন। বা অন্যরা আপনাকে এড়িয়ে চলবে।

যেমন ধরুন আপনি কথায় কথায় ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’ বলেন। তাহলে আপনাকে এক গোষ্ঠি বুকে টেনে নিবে। আরেক গোষ্ঠি আপনার কাছ থেকে হাজার গজ দূরে থাকবে।

আপনি যদি কথায় কথায় প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন তাহলে আপনার সাথে এক রকম আচরণ করা হবে। আবার যদি প্রচুর ভুল ইংরেজি ব্যবহার করেন তাহলে আরেক ধরনের ব্যবহার করা হবে।

তেমনি আপনার ভাষায় যদি মাতৃভাষার বদলে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দের বেশি প্রয়োগ হয় তাহলে আপনাকে একটা শ্রেণীভুক্ত করা হবে।

(চলবে…)

পরবর্তী পর্ব >>

……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!