ভবঘুরেকথা

-নূর মোহাম্মদ মিলু

তাঁর মুখমণ্ডল থেকে রক্ত মুছতে লাগলেন। আর নবীজীর মুখ থেকে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল-

আল্লাহর শক্ত ক্রোধ পতিত হয়েছে সেই জাতির উপর যারা আল্লাহর নবীজীর মুখমণ্ডলকে রক্তরঞ্জিত করেছে।’ (আল-বায়হাকী- দালায়িল আন-নুবুওয়াহ-৩/২৮৩)

উহুদে ফাতেমার ভূমিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাহাবী সাহল ইবন সা‘দ বলেছেন- নবীজী আহত হলেন, সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেল। মাথায় তরবারি ভাঙ্গা হলো।, ফাতেমা নবীজী রক্ত ধুতে লাগলেন। আর আলী ঢালে করে পানি ঢালতে লাগলেন।

ফাতেমা যখন দেখলেন, যতই পানি ঢালা হচ্ছে ততই রক্ত বেশী বের হচ্ছে। তখন তিনি একটি চাটাই উঠিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করলেন। এবং সেই ছাই ক্ষতস্থানে লাগালেন। আর তখন রক্তপড়া বন্ধ হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৪/৩৯; তাবাকাত-২/৪৮; বুখারী- আল-মাগাযী; মুসলিম- আল-হুদূদ ওয়াস সিয়ার)

উহুদ যুদ্ধে নবীজীর চাচা ও ফাতেমার দাদা হজরত হামযা শহীদ হন। তিনিই ফাতেমার বিয়ের সময় ওলীমা অনুষ্ঠান করে মানুষকে আহার করান। ফাতেমা তাঁর প্রতি দারুণ মুগ্ধ ছিলেন। তিনি আজীবন হামযার কবর জিয়ারত করতেন এবং তাঁর জন্য কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। (আল-বায়হাকী- দালায়িল আল-নুবুওয়াহ; আল-ওয়াকিদী- আল-মাগাযী-২/৩১৩)

অন্যান্য যুদ্ধেও ফাতেমার যোগদানের কথা জানা যায়। যেমন খন্দক ও খায়বার অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এই খায়বার বিজয়ের পর তথাকার উৎপাদিত গম থেকে তাঁর জন্য নবীজী ৮৫ ওয়াসক নির্ধারণ করে দেন। মক্কা বিজয়েও তিনি নবীজীর সফরসঙ্গী হন।

মূতা অভিযানে নবীজী তিন সেনাপতি-যায়দ ইবন আল-হারিছা, জা‘ফর ইবন আবী তালিব ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে পাঠান। একের পর এক তাঁরা তিনজনই শহীদ হলেন। এ খবর মদীনায় পৌঁছলে ফাতেমা তাঁর প্রিয় চাচা জাফরের শোকে ‘ওয়া আম্মাহ্’ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

এ সময় নবীজী সেখানে উপস্থিত হন এবং মন্তব্য করেন, ‘যে কাঁদতে চায় তারা জাফরের মত মানুষের জন্য কাঁদা উচিত।’ (নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ-২১৪)

ফাতেমার মর্যাদা
তাঁর মহত্ব, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য অনেক। নবী পরিবারের মধ্যে আরো মর্যাদাবান ব্যক্তি আছেন। কিন্তু তাঁদের মাঝে ফাতেমার অবস্থান এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আনে। সুরা আল-আহযাবের আয়াতে তাতহীর (পবিত্রকরণের আয়াত) এর নুযূল ফাতেমার বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করেন। (সুরা আল-আহযাব-৩৩)

‘হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’

হজরত আয়েশা বলেন-

আমি নবীজীকে দেখলাম, তিনি আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসায়নকে ডাকলেন এবং তাদের মাথার উপর একখানা কাপড় ফেলে দিলেন। তারপর বললেন- হে আল্লাহ! এরা আমার পরিবারের সদস্য। তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দিন এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করুন!’ (মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর -৩/৯৪)

হজরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, নবীজী এ আয়াত নাজিলের পর ছয়মাস পর্যন্ত ফজরের নামাজে যাওয়ার সময় ফাতেমার ঘরের দরজা অতিক্রম করাকালে বলতেন- ‘আস্-সালাত, ওহে নবী-পরিবার! আস-সালাত।’

তারপর তিনি পাঠ করতেন- উসুদুল গাবা, জীবনী! (৭১৭৫; আদ-দুররুল মানছূর -৬/৬০৫; নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২১৯)

ইমাম আহমাদ (রা) হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। নবীজী আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসায়নের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন-

‘তোমাদের সঙ্গে যে যুদ্ধ করে আমি তাদের জন্য যুদ্ধ, তোমরদের সাষে যে শান্তি ও সন্ধি স্থাপন কর আমি তাদের জন্য শান্তি।’ (সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/১২৩)

এই নবী পরিবার সম্পর্কে নবীজীর অন্য একটি বাণীতে এসেছে-

‘যে কেউ আহলে বায়ত বা নবী-পরিবারের সাথে বিরোধিতা করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’ (প্রাগুক্ত)

হিজরি ৯ম সনে নাজরানের একটি খ্রীষ্টান প্রতিনিধি দল নবীজীর কাছে আসে এবং হজরত ঈসার (আ) ব্যাপারে তারা অহেতুক বিতর্কে লিপ্ত হয়। তখন নাজিল হয় আয়াতে ‘মাবাহালা’।

মাবাহালার অর্থ হলো, যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তাহলে তারা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এই মুবাহালা বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে করতে পারে এবং গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য পরিবার-পরিজনকেও একত্রিত করতে পারে। মাহাবালার আয়াতটি হলো। সুরা আলে ইমরান-৬১)

‘তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বল এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদেরকে, তোমাদের পুত্রদেরকে, আমাদের নারীদেরকে, তেহামাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজদিগকে ও তোমাদের নিজদিগকে, অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা‘নত।’

এ আয়াত নাজিলের পর নবীজী প্রতিনিধি দলকে মুহাবালার আহ্বান জানান এবং নিজেও ফাতেমা, আলী, হসান ও হুসায়নকে সঙ্গে নিয়ে মুবাহালার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসেন এবং বলেন- ‘হে আল্লাহ! এই আমার পরিবার-পরিজন। আপনি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করুন।’

এ কথাগুলো তিনবার বলার পর উচ্চারণ করেন। (সহীহ মুসরিম- ফাদায়িল আস-সাহাবা; মুনসাদ-৪/১০৭; মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর- ১/২৮৭-২৮৯)

‘হে আল্লাহ! আপনি আপনার দয়া ও অনুগ্রহ নবীজীর পরিবার-পরিজনকে দান করুন যেমন আপনি করেছেন ইব্রাহিমের পরিবার-পরিজনকে। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত।’

নবীজী একদিন ফাতেমাকে বলেন, ‘আল্লাহ তোমার খুশিতে খুশি হন এবং তোমার অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট হন।’ (তাহযীব আত-তাহযীব -১২/৪৪২; আল-ইসাবা-৪/৩৬৬)

নবীজী যখন কোন যুদ্ধ বা সফর থেকে ফিরতেন তখন প্রথমে মসজিদে যেয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। তারপর ফাতেমার ঘরে গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে বেগমদের নিকট যেতেন। (উসুদুল গাবা-৫/৫৩৫)

একবার ফাতেমা অসুস্থ হলে নবীজী দেখতে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন- মেয়ে! কেমন আছ?

ফাতেমা বললেন- মেয়ে! তুমি বিশ্বের সকল নারীর নেত্রী হও এতে কি সন্তুষ্ট নও?

ফাতেমা বললেন- আব্বা! তাহলে মারয়াম বিনত ইমরানের অবস্থান কোথায়?

জবাবে নবীজী বললেন- তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের নারীদের নেত্রী, আর তুমি হবে তোমার সময়ের নারীদের নেত্রী।

আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের একজন নেতার সাথে বিয়ে দিয়েছি নবীজী তাঁকে-

‘জান্নাতের অধিবাসী নারীদের নেত্রী হলেন ক্রমানুসারে মারয়ম, ফাতেমা, খাদিজা ও পিরআওনের স্ত্রী আসিয়া।’

একবার নবীজী মাটতে চারটি রেখা টানলেন, তারপর বললেন, তোমরা কি জান এটা কি? সবাই বললো- আল্লাহর ও তাঁর নবীজী ভালো জানেন। তিনি বললেন- ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ, খাদিজা বিনতে খুওয়ইদিলদ, মারয়াম বিনত ‘ইমরান ও আসিয়া বিনত মুযাহিম (ফিরাউনের স্ত্রী)। জান্নাতের নারীদের উপর তাদের রয়েছে এক বিশেষ মর্যাদা।

ফাতেমা ব্যক্তিত্বের প্রতি যে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়েছে তা নবীজীর এই হাদিসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে-

‘পৃথিবীর নারীদের মধ্যে তোমার অনুসরণের জন্য মারয়াম, খাদিজা, ফাতেমা ও ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া যথেষ্ট।’ (তিরমিযী; আল-মানকিব)

নবীজীর সবচেয়ে বেশী স্নেহের ও প্রিয় পাত্রী ছিলেন ফাতেমা। একবার নবীজীকে জিজ্ঞেস করা হলো- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সবচেয়ে বেশী প্রিয় মানুষটি কে?

তিনি বললেন- ফাতেমা।

ইমাম আয-যাহাবী বলেন- ‘নারীদের মধ্যে নবীজীর সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিলেন ফাতেমা এবং পুরুষদের মধ্যে আলী।’

একবার হজরত আলী নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন- ফাতেমা ও আমি এ দুইজনের মধ্যে কে আপনার সবচেয়ে বেশী প্রিয়। বললেন- তোমারর চেয়ে ফাতেমা আমার বেশী প্রিয়। (নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২১৬)

(চলবে…)

…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!