ভবঘুরেকথা

-নূর মোহাম্মদ মিলু

ফাতেমাকে দেখে আলী প্রশ্ন করলেন- খবর কি?

ফাতেমা বললেন- আমি দুনিয়া পাওয়ার জন্য প্রত্যাশা নিয়ে তোমর নিকট থেকে গিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরে এসেছি আখিরাত নিয়ে।

আলী বললেন- আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন। (কানয আল-‘উম্মাল-১/৩০২; হায়াত আস-সাহাবা-১/৪৩)

দাম্পত্য কলহ
জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ফাতেমা আনন্দ-ফুর্তি যে কি জিনিস তা জানতো না। পিতাকে নিয়ে তিনি সবসময়ই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতেন। তিনি যখন যুদ্ধে যেতেন তখন তা আরো শত গুণ বেড়ে যেত। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই পিতাকে আগলে রাখতে রাখতে তাঁর নিজের মধ্যেও একটা সংগ্রামী চেতনা গড়ে উঠেছিল।

তাই সুযোগ পেলে তিনিও ছুটে যেতেন যুদ্ধের ময়দানে। উহুদ যুদ্ধে তাঁকে আহত যোদ্ধাদের পট্টি বাঁধতে, ক্ষতে ঔষুধ লাগাতে এবং মৃত্যুপথযাত্রী শহীদদেরকে পানি পান করাতে দেখা যায়।

যখন ঘরে থাকতেন তখন চাইতেন স্বামীর সোহাগভরা কোমল আচরণ। কিন্তু আলীর জীবনের যে ইতিহাস তাতে তাঁর মধ্যে এই কোমলতার সুযোগ কোথায়? তাঁর জীবনের গোটাটাই তো হলো কঠোর সংগ্রাম, তাই তাঁর মধ্যে কিছুটা রূঢ়তা থাকা বিচিত্র নয়।

ফলে তাঁদের সম্পর্ক মাঝে মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠত। পিতার কানেও সে কথা পৌঁছে যেত। তিনি ছুটে যেতেন এবং ধৈর্যের সাথে দু‘জনের মধ্যে আপস রফা করে দিতেন।

বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন নবীজীকে সন্ধ্যার সময় একটু ব্যস্ততার সাথে মেয়ের বাড়ির দিকে যেতে দেখা গেল, চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ভাব। কিছুক্ষণ পর যখন সেখান থেকে বের হলেন তখন তাঁকে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেল। সাহাবায়ে কিরাম বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে এক অবস্থায় ঢুকতে দেখলাম, আর এখন বের হচ্ছেন হাসি-খুশি অবস্থায়!

তিনি জবাব দিলেন- আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয় দু‘জনের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দিলাম তাতে আমি খুশি হবো না। (তাবাকাত-৮/৪৯৯; আল-ইসাবা-৪/৩৬৮; আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১১)

আরেকবার ফাতেমা আলীর রূঢ়তায় কষ্ট পান। তিনি বলেন- আমি নবীজীর নিকট নালিশ জানাবো- একথা বলে ঘর থেকে বের হন। আলীও তাঁর পেছনে চলেন।

ফাতেমা তাঁর স্বামীর প্রতি যে কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন তা পিতাকে বলেন, মহান পিতা বেশ নরমভাবে বুঝিয়ে তাঁকে খুশি করেন। আলী স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বলেন- আল্লাহর কসম! তুমি অখুশি হও এমন কিছুই আমি আর কখনো করবো না। (তাবাকাত-৮/২৬; আল-ইসাবা-৪/৩৬৮)

আলীর দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা
ফাতেমা না চাইলেও এমন কিছু ঘটনা ঘটতো যা তাঁকে ভীষণ বিচলিত করে তুলতো। তাঁর স্বামী আরেকটি বিয়ে করে ঘরে সতীন এনে উঠাবে ফাতেমা তা মোটেই মেনে নিতে পারেন না। আলী আরেকটি বিয়ের ইচ্ছা করলেন। তিনি সহজভাবে হিসাব কষলেন, শরিয়তের বিধান মতে আরেকটি বিয়ে করা তো বৈধ।

অন্য মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রে যেমন এক সাথে চারজনকে রাখা বৈধ তেমনিভাবে নবীজীর মেয়ের সাথেও অন্য আরেকজন স্ত্রীকে ঘরে আনাতে কোন দোষ নেই। তিনি ধারণা করলেন, এতে ফাতেমা তাঁর প্রতি তেমন ক্ষ্যাপবেন না। কারণ, তাঁর পিতৃগৃহেই তো এর নজীর আছে।

আয়েশা, হাফসা ও উম্মু সালামা তো এক সাথেই আছেন। তাছাড়া একবার বানূ মাখযূমের এক মহিলা চুরি করলে তার শাস্তি মওকুফের জন্য মহিলার আত্মীয়রা উসামা ইবন যায়িদের মাধ্যমে নবীজীর নিকট আবেদন করে। তখন নবীজী বলেছিলেন- তুমি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি রহিত করার জন্য সুপারিশ করছো?

তারপর তিনি উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। তাতে বলেন- তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে এই জন্য যে, তাদের কোন সম্মানীয় ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তার উপর ‘হদ’ বা নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করতো।

আল্লাহর কসম! মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে আমি তার হাত কেটে দেব। (সাহীহ আল-বুখারী- আল-আম্বিয়া; মুলিম- আল-হুদূদ; তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬১৮)

এ বক্তব্যের দ্বারা আলী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ফাতেমাও তো অন্য দশজন মুসলিম মেয়ের মত।

এমন একটি সরল হিসেবে আলী আরেকটি বিয়ের চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া যে এত মারাত্মক হবে আলীর কল্পনায়ও তা আসেনি। আমর ইবন হিশাম ইবন আল-মুগীরা আল-মাখযুমীর মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন, একথা প্রকাশ করতেই ফাতেমা ক্ষোভে-উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন। নবীজী রাগান্বিত হলেন।

আমর ইবন হিশাম তথা আবু জাহলের মেয়ের সাথে আলীর বিয়ের প্রস্তাবের কথা ফাতেমার কানে যেতেই তিনি পিতার কাছে ছুটে যেয়ে অনুযোগের সুরে বলেন- আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা ধারণা করে, আপনার মেয়ের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলেও আপনি রাগ করেন না। এই আলী তো এখন আবু জাহলের মেয়েকে বিয়ে করছে। (নিস মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২১৫)

আসলে কথাটি শুনে নবীজী দারুণ ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু বিষয়টি ছিল বেশ জটিল। কারণ, এখানে আলীর অধিকারের প্রশ্নও জড়িত ছিল। ফাতেমাকে রেখেও আলী আরো একাধিক বিয়ে করতে পারেন। সে অধিকার আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন। এ অধিকারে নবীজী কিভাবে বাধা দিবেন?

অন্যদিকে কলিজার টুকরো মেয়েকে সতীনের ঘর করতে হবে এটাও বড় দুঃখের ব্যাপার। তাই এখানে সমস্যাটির আরেকটি দিক আছে। তা হলো আলীর প্রস্তাবিত কনে আবু জাহ্ল আমর ইবন হিশামের মেয়ে। আলীর গৃহে তাঁর স্ত্রী হিসেবে আল্লাহর রাসূলের মেয়ে এবং আল্লাহর দুশমনের মেয়ে এক সাথে অবস্থান করতে পারে?

এই সেই আবু জাহল, ইসলামের প্রতি যার নিকৃষ্ট শত্রুতা এবং নবীজী ও মুসলমানদের উপর নির্দয় যুলুম-নির্যাতনের কথা নবীজী ও মুসলমানদের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি।

আল্লাহর এই দুশমন একদিন কুরাইশদেরকে বলেছিল- ‘ওহে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! তোমরা এই মোহাম্মদকে আমাদের উপাস্যদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে বেড়াতে, আমাদের পূর্বপুরুষকে গালিগালাজ করতে এবং আমাদের বুদ্ধিমান লোকদেরকে বোকা ও নির্বোধ বলে বেড়াতে দেখছো তা থেকে সে বিরত হবে না।

আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আগামীকাল আমি বহন করতে সক্ষম এমন একটি বড় পাথর নিয়ে বসে থাকবো। যখনই সে সেজদায় যাবে অমনি সেই পাথরটি দিয়ে আমি তার মাথাটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবো। তখন তোমরা আমাকে বানূ আবদি মান্নাফের হাতে সোপর্দ অথবা তাদের হাত থেকে রক্ষা, যা খুশি তাই করবে।” (ইবন হিশাম, আস-সীরাহ্-১/৩১৯; তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬১৯)

সে কুরাইশদের সমাবেশে নবীজী বিদ্রূপ করে বলে বেড়াতো- ‘ওহে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! মোহাম্মদ মনে করে দোজখে আল্লাহর যে সৈনিকরা তোমাদেরকে শাস্তি দিবে এবং বন্দী করে রাখবে তাদের সংখ্যা মাত্র উনিশজন। তোমরা তো তাদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশী। তোমাদের প্রতি একশ জনে কি তাদের একজনকে রুখে দিতে পারবে না?’ তখন নাজিল হয় কোরানের এ আয়াত-

আমি ফেরেশতাগণকে করেছি জাহান্নামের প্রহরী; কাফেরদের পরীক্ষা স্বরূপই আমি তাদের এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি। (ইবন হিশাম, আস-সীরাহ্-১/৩৩৩, ৩৩৫)

এই সেই আবু জাহল যে আখনাস ইবন মুরায়ককে যখন সে তার কাছে তার শোনা কোরান সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, বলেছিল- তুমি কী শুনেছ? আমরা ও বানূ আবদি মান্নাফ মর্যাদা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করলাম। তারা মানুষকে আহার করালো, আমরাও করালাম। তারা মানুষের দায়িত্ব ক৭াধে নিল আমরাও নিলাম।

তারা মানুষকে দগান করলো; আমরাও করলাম। এভাবে আমরা যখন বাজির দুই ঘোড়ার মত সমান সমান হয়ে গেলাম তখন তারা বললো- আমাদের মধ্যে নবী আছে, আকাশ থেকে তাঁর কাছে ওহি আসে। এখন এ নবী আমরা কিভাবে পাব? আল্লাহর কসম! আমি কক্ষনো তার প্রতি ঈমানও আনবো না, তাকে বিশ্বাসও করবো না। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬২০)

এ সেই আবু জাহল যে কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে শুনতে পেলে তাকে ভয়-ভীতি দেখাতো, হেয় ও অপমান করতো। বলতো- ‘তুমি তোমার পিতাকে যে তোমার চেয়ে ভালো ছিল, ত্যাগ করেছো? তোমার বুদ্ধিমত্তাকে আমরা নির্বুদ্ধিতা বলে প্রচার করবো, তোমার মতামত ও সিদ্ধান্তকে আমরা ভুল-ভ্রান্তিতে পূর্ণ বলে প্রতিষ্ঠা করবো এবং তোমার মান-মর্যাদা ধুয়ে মিশিয়ে দিব।’

আর যদি কোন ব্যবসায়ী ইসলাম গ্রহণ করত, তাকে বলত- আল্লাহর কসম! আমরা তোমার ব্যবসা লাটে উঠাব, তোমার অর্থ-সম্পদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বো।’ আর ইসলাম গ্রহণকারী দুর্বল হলে দৈহিক শাস্তি দিয়ে তাকে ইসলাম ত্যাগের জন্য চাপ দিত।

এ সেই আবু জাহল যে মক্কার শিআবে আবী তালিবের অবরোধকালে হাকীম ইবন হিযাম ইবন খুওয়াইলিদকে তাঁর ফুফু খাদীজর জন্য সামান্য কিছু খাবার নিয়ে যেতে বাধা দিয়েছিল।

(চলবে…)

…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!