ভবঘুরেকথা

-নূর মোহাম্মদ মিলু

কিন্তু সেই বাড়িটি তাঁদের হিজরাতের পর আকীল ইবন আবী তালিবের অধিকারে চলে যায়। মক্কা বিজয়ের সময়কালে একদিন উসামা ইবন যায়িদ (রা) নবীজীকে জিজ্ঞেস করেন- মক্কায় আপনারা কোন বাড়িতে উঠবেন? জবাবে তিনি বলেন- আকীল কি আমাদের জন্য কোন আবাসস্থল বা ঘর অবশিষ্ট রেখেছে?

এই সফরে তাঁর দু‘মাসের বেশী মক্কায় অবস্থান করা হয়নি। অষ্টম হিজরির রামাদান মাসে মক্কায আসেন এবং একই বছর যুল কা‘দা মাসের শেষ দিকে উমরা আদায়ের পর পিতার সাথে মদীনায় ফিরে যান। এ সময়ে তিনি জান্নাতবাসিনী মা খাদিজার কবরও যিয়ারাত করেন।

হিজরি নবম সনে নবীজীর তৃতীয় কন্য, হজরত উছমানের স্ত্রী উম্মু কুলছূম মারা গেলেন। দশম হিজরিতে নবীজীর স্ত্রী মারিয়া আল-কিবতিয়্যার গর্ভজাত সন্তান হজরত ইবরাহীমও ইহলোক ত্যাগ করেন। এখন নবীজীর সন্তানদের মধ্যে একমাত্র ফাতেমা ছাড়া আর কেউ জীবিত থকলেন না।

পিতা অন্তিম রোগশয্যায়
এরপর এলো সেই মহা দুদর্শার সময়টি। হিজরি ১১ সনের সফর মাসে ফাতেমার মহান পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নবী পরিবারের এবং অন্য মুসলমানরা ধারণা করলেন যে, এ হয়তো সামান্য অসুস্থতা, খুব শীঘ্রই সেরে উঠবেন। কেউ ধারণা করলেন না যে এ তাঁর অন্তিম রোগ।

পিতা মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। সঙ্গে সঙ্গে পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর গৃহের দিকে বেরিয়ে পড়লেন। নবীজীর শয্যাপাশে তখন হজরত আয়েশা সহ অন্য বেগমরা বসা। এ সময় ধীর স্থির ও গম্ভীরভাবে কন্যা ফাতেমাকে এগিয়ে আসতে দেখে পিতা তাঁকে স্বাগত জানালেন এভাবে-

আমার মেয়ে! স্বাগত তারপর তাঁকে চুমু দিয়ে ডান পাশে বসান এবং কানে কানে বলেন, তাঁর মরণ সময় ঘনিয়ে এসেছে। ফাতেমা কেঁদে ফেলেন। তাঁর সেই কান্না থেমে যায় যখন পিতা তাঁর কানে কানে আবার বলেন- (তাবাকাত-৮/১৬ বুখারী- বাবু আলামাত আন-নুবুওয়াহ; মুসলিম- ফাদায়িল আস-সাহাবা; কানয আল-‘উম্মাল- ১৩/৬৭৫)

আমার পরিবারবর্গের মধ্যে তুমি সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। ফাতেমা! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, ঈমানদার নারীদের নেত্রী হও?’ অথবা নবীজী একথা বলেন, ‘তুমি এই উম্মাতের নারীদের নেত্রী হও তাতে কি সন্তুষ্ট নও?’

এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফাতেমার মুখমণ্ডলে আনন্দের আভা ফুটে উঠলো। তিনি কান্না থামিয়ে হেসে দিলেন। তাঁর এমন আচরণ দেখে পাশেই বসা হজরত আয়েশা বিস্মিত হলেন। তিনি মন্তব্য করেন।- ‘দুঃখের অধিক নিকটবর্তী আনন্দের এমন দৃশ্য আজকের মত আর কখনো দেখিনি।’

পরে তিনি ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করেন- তোমার পিতা কানে কানে তোমাকে কি বলেছেন?

জবাবে তিনি বললেন- আমি নবীজীর গোপন কথা প্রকাশ করতে পারি না। (তাবাকাত-৮/১৬)

পিতার রোগের এ অবস্থা দেখে ফাতেমা সেদিন নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। এদিকে নবীজী এ রোগের মধ্যেও নিয়ম অনুযায়ী পালাক্রমে বেগমদের ঘরে অবস্থান করতে লাগলেন। যেদিন তিনি মায়মূনা বিনত আল-হারিছ আল-হিলালিয়্যার ঘরে, সেদিন তাঁর রোগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

তিনি অন্য বেগমদের ডেকে পাঠান। তাঁরা উপস্থিত হলে তিনি এ অসুস্থ অবস্থায় আয়েশার গৃহে অবস্থানের অনুমতি চান এবং তাঁদের অনুমতি লাভ করেন।

নবী কন্যা ফাতেমা সব সময়, এমনটি রাত জেগে অসুস্থ পিতার সেবা-শুশ্রূষা করতে থাকেন। ধৈর্য্যের সাথে সেবার পাশাপাশি অত্যন্ত বিনয় ও বিনম্রভাবে আল্লাহর দরবারে পিতার সুস্থতার জন্য দোয়া করতে থাকেন।

এত কিছুর পরেও যখন উত্তরোত্তর রোগের প্রকোপ বেড়ে যেতে লাগলো এবং কষ্টের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে চললো, ফাতেমা তখন হাতে পানি নিয়ে অত্যন্ত দরদের সাথে পিতার মাথায় দিতে থাকেন। পিতার এ কষ্ট দেখে কান্নায় কণ্ঠরোধ হওয়ার উপক্রম হয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে অনুচ্চ স্বরে উচ্চারণ করেন- আব্বা! আপনার কষ্ট তো আমি সহ্য করতে পারছিনে না। পিতা তাঁর দিকে স্নেহমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অত্যন্ত দরদের সাথে উত্তর দেন- আজকের দিনের পর তোমার আব্বার আর কোন কষ্ট নেই। (বুখারী- বাবু মারদিহি ওয়া ওফাতিহি (সা)- ফাতহুল বারী-৮/১০৫; মুসনাদে আহমাদ-৩/১৪১; তাবাকাত-২/২)

কন্যাকে দুঃখের সাগরে বাসিযে পিতা মহাপ্রভুর সান্নিধ্যে যাত্রা করলেন। আজ ফাতেমা সত্যিকার ভাবে পিতৃ-মাতৃহারা এক দুঃখী এতিমে পরিণত হলেন। এ দুঃখ-বেদনায় সান্ত্বনা লাভের কোন পথই তাঁর সামনে ছিল না।

পিতাকে হারিয়ে ফাতেমা দারুণভাবে শোকাতুর হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় দু‘দিনের মধ্যেই সাকীফা বানূ সা‘ইদা চত্বরে খলিফা হিসেবে হজরত আবু বকরের হাতে বায়াত সম্পন্ন হয়। ফাতেমা তাঁর বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থাকে একটু সামলে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে পিতার কবরের নিকট যান।

কবর থেকে এক মুঠো মাটি উঠিয়ে নিয়ে অশ্রু বিগলিত দু‘চোখের উপর বুলিয়ে দেন। তারপর তার ঘ্রাণ নিতে নিতে এই চারণ দু‘টি আওড়াতে থাকেন-

‘যে ব্যক্তি আহমাদের কবরের মাটির ঘ্রাণ নেয় সারা জীবন সে যেন আর কোন সুগন্ধির ঘ্রাণ না নেয়। আমার উপর যে সকল বিপদ আপতিত হয়েছে যদি তা হতো দিনের উপর তাহলে তা রাতে পরিণত হতো।’ (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/১৩৪; আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১১৪)

হজরত সাহাবায়ে কিরাম নবীজীর দাফন-কাফন শেষ করে ফাতেমার নিকট আসেন তাকে সান্ত্বনা দানের জন্য। তিনি হজরত আনাসকে জিজ্ঞেস করেন- আপনারা কি নবীজী মাটিতে ঢেকে দিতে আপনাদের অন্তর সায় দিল কেমন করে? তারপর তিনি নবীজীর স্মরণে নিম্নের চরণগুলো আবৃত্তি করেন-

আকাশের দিগন্ত ধুলিমলিন হয়ে গেছে, মধ্যাহ্ন-সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে এবং যুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। নবীজীর পরে ভূমি কেবল বিষণ্ণ হয়নি, বরং দুঃখের তীব্রতায় বিদীর্ণ হয়েছে। তার জন্য কাঁদছে পূর্ব-পশ্চিম, মাতম করছে সমগ্র মুদার ও ইয়ামান গোত্র। তাঁর জন্য কাঁদছে বড় বড় পাহাড়-পর্বত ও বিশালকায় অট্টালিকাসমূহ।

হে খাতামুন নাবিয়্যীন, আল্লাহর জ্যোতি আপনার প্রতি বর্ষিত হোক্ আল-কোরানের নাজিলকারী আপনার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন।’ (উসুদুল গাবা-৫/৫৩২; আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১১৩)

অনেকে উপরোক্ত চরণগুলো ফাতেমার, আর পূর্বোক্ত চরণগুলো আলীর রচিত বলে উল্লেখ করেছেন। (সাহাবিয়াত-১৫০)

ফাতেমা পিতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এ চরণ দুটিও আবৃত্তি করেন। (আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১১৪)

‘ভূমি ও উট হারানোর মত আমরা হারিয়েছি আপনাকে আপনার অদৃশ্য হওয়ার পর ওহি ও কিতাব আমাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

হায়! আপনার পূর্বে যদি আমাদের মৃত্যু হতো! আপনার মৃত্যু সংবাদ শুনতে হতো না এবং মাটির ঢিবিও আপনার মাঝে অন্তরায় হতো না।

বিয়ের পরেও ফাতেমা পিতার সংসারের সকল বিষয়ের খোঁজ-খবর রাখতেন। অনেক সময় তাঁর সৎ মা‘দের ছোটখাট রাগ-বিরাগ ও মান-অভিমানের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতেন। যেমন নবীজী আয়েশাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। একথা গোটা সাহাবী সমাজের জানা ছিল।

এ কারণে নবীজী যেদিন আয়েশার ঘরে কাটাতেন সেদিন তারা বেশী বেশী হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন। এতে অন্য বেগমরা ক্ষুব্ধ হতেন। তাঁরা চাইতেন নবীজী যেন লোকদের নির্দেশ দেন, তিনি যেদিন যেখানে থাকেন লোকেরা যেন সেখানেই যা কিছু পাঠাবার পাঠায়।

কিন্তু সে কথা নবীজীকে বলার হিম্মত কারো হতো না। এই জন্য তাঁরা সবাই মিলে তাঁদের মনের কথা নবীজীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নবীজীর কলিজার টুকরা ফাতেমাকে বেছে নেন।

নবীজী ফাতেমার বক্তব্য শুনে বললেন, ‘মা, আমি যা চাই, তুমি কি তা চাও না?’ ফাতেমা পিতার ইচ্ছ বুঝতে পারলেন এবং ফিরে এলেন। তাঁর সৎ মায়েরা আবার তাঁকে পাঠাতে চাইলেন- কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। (বুখারী- ফাদায়িলু আয়েশা; মুসলিম- ফাদায়িলুস সাহাবা (২৪৪১); আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৫/৭৩)

জিহাদের ময়দানে
জিহাদের ময়দানে ফাতেমার রয়েছে উজ্জ্বল ভূমিকা। উহুদ যু্দ্ধে নবীজী দেহে ও মুখে আঘাত পেয়ে আহত হলেন। পবিত্র দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কোন কিছুতে যখন রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছিল না তখন ফাতেমা খেজুরের চাটাই আগুনে পুড়িয়ে তার ছাই ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন। (আনসাব আল-আশরাফ -১/৩২৪)

এ প্রসঙ্গে ইমার আল-বায়হাকী বলেন- মুহাজির ও আনসার নারীরা উহুদের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন। তাঁরা তাঁদের পিঠে করে পানি ও খাদ্য বহন করে নিয়ে গেলেন। তাঁদের সঙ্গে ফাতেমা বিনত নবীজী ও বের হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি যখন পিতাকে রক্তরঞ্জিত অবস্থায় দেখলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন।

(চলবে…)

…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!