ভবঘুরেকথা

-নূর মোহাম্মদ মিলু

আবু সুফইয়ান বলতে লাগলেন, কিভাবে মদীনায় এসেছেন এবং কেন এসেছেন, সে কথা। বললেন- মক্কাবাসীরা নবীজীর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য, তাঁর সাথে একটা আপোষরফা করার উদ্দেশ্যে তাঁকে পাঠিয়েছে। তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে মদীনায় ঢুকে পড়েছেন এবং সরাসরি নিজের কন্যা উম্মুল মু‘মিনীন উম্মু হাবীবা রামলার ঘরে উপস্থিত হয়েছেন।

সেখানে নবীজীর বিছানায় বসার জন্য উদ্যত হতেই নিজ কন্যার নিকট বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারণ, তিনি একজন অংশীবাদী, অপবিত্র। আল্লাহর নবীজীর পবিত্র বিছানায় বসার যোগ্যতা তাঁর নেই। কন্যা বিছানাটি গুটিয়ে নেন। মনে কথা বলেন, কিন্তু তাঁর নিকট থেকে কোন জবাব পাননি।

আবু বকরের নিকট থেকেও একই আচরণ লাভ করেন। তারপর যান ওমরের কাছে। তিনি তাঁর বক্তব্য শুনে বলেন- আমি যাব তোমার জন্য সুপারিশ করতে নবীজীর কাছে? আল্লাহর কসম! ভূমিতে উদ্গত সামান্য উদ্ভিদ ছাড়া আর কিছুই যদি না পাই, তা দিয়েই তোমাদের সাথে লড়বো।

এ পর্যন্ত বলার পর আবু সুফইয়ান একটু চুপ থাকলেন, তারপর একটা ঢোক গিলে আলীকে লক্ষ্য করে বললেন- ওহে আলী! তুমি আমার সম্প্রদায়ের প্রতি সবচেয়ে বেশী সদয়। আমি একটা প্রয়োজনে তোমার কাছে এসেছ। অন্যদের কাছ থেকে যেমন হতাশ হয়ে ফিরেছি, তোমার কাছ থেকে সেভাবে ফিরতে চাইনে। তুমি আমার জন্য একটু নবীজীর কাছে সুপারিশ কর।

আলী বললেন- আবু সুফইয়ান! তোমার অনিষ্ট হোক। আল্লাহর কসম! নবীজী একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সে ব্যাপারে আমরা কোন কথা বলতে পারি না।

এবার আবু ‍সুফইয়ান পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ফাতেমার দিকে তাকালেন এবং পাশের বিছানায় সদ্য ঘুম থেকে জাগা ও মায়ের দিকে এগিয়ে আসা হাসানের দিকে ইঙ্গিত করে ফাতেমাকে বললেন- ওহে ‍মোহাম্মদের মেয়ে! তুমি কি তোমার এ ছেলেকে বলবে, সে যেন মানুষের মাঝে দাঁড়িযে তার গোত্রের লোকদের নিরাপত্তার ঘোষণা দিক এবং চিরকালের জন্য সমগ্র আরবের নেতা হয়ে থাক?

ফাতেমা জবাব দিলেন- আমার এই টুকু ছেলের মানুষের মাঝে দাঁড়িযে কাউকে নিরাপত্তা দানের ঘোষণা দেওয়ার বয়স হয়নি আর নবীজী ডিঙ্গিয়ে কেউ কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারে না।

হাতাশ অবস্থায় আবু সুফইয়ান যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে একটু থামলেন। তারপর অত্যন্ত নরম সুরে বললেন- আবুল হাসান (আলী)! মনে হচ্ছে বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে। তুমি আমাকে একটু পরামর্শ দাও।

আলী বললেন- আপনার কাজে আসবে এমন পরামর্শ আমার জানা নেই। তবে আপনি হলেন কিনানা (কুরায়শ গোত্রের একটি শাখা) গোত্রে নেতা। আপনি নিজেই জনমণ্ডলীর মাঝে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তার আবেদন করুন। তারপর নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যান।

আবু সুফইয়ান বললেন- এটা কি আমার কোন কাজে আসবে? আলী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- আল্লাহর কসম! আমি তা মনে করি না। কিন্তু আমি তো আপনার জন্য এছাড়া আর কোন পথ দেখছিনে।

আবু সুফইয়ান আলীর পরামর্শ মত কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেলেন। আর এ দম্পতি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার কথা ভাবতে লাগলেন। তাঁরা ভাবতে লাগলেন উম্মুল কুরা মক্কা, কাবা, কুরয়শদের বাড়িঘর ইত্যাদির কথা। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬৩৩)

মক্কা অভিযানে ফাতেমা
দশ হাজার মুলমান সঙ্গীসহ নবীজী মদীনা থেকে মক্কার দিকে যাত্রা করলেন। আট বছর পূর্বে কেবল আবু বকর সিদ্দীককে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় চলে আসেন। নবী পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ফাতেমাও এই মহা বিজয় ও গৌরবজনক প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করার জন্য এই কাফেলায় শরীক হলেন।

আট বছর পূর্বে তিনি একদিন বড় বোন উম্মু কুলছূমের সাথে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে এসেছিলেন। তাঁর অন্য দুই বোন রুকাইয়্যা ও যয়নাবও হিজরাত করেছিলেন। কিন্তু আজ এই বিজয়ী কাফেলায় তাঁরা নেই। তাঁরা মদীনার মাটিতে চিরদিনের জন্য শুয়ে আছেন। আর কোনদিন মক্কায় ফিরবেন না।

অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফাতেমা কাফেলার সাথে চলছেন। এক সময় কাফেলা ‘মাররুজ জাহরান’ এসে পৌঁছলো এবং শিবির স্থাপন করলো। দিন শেষ হতেই রারে প্রথম বাগে মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর নেতা আবু ‍সুফইয়ান ইবন হারব এসে উপস্থিত হলেন।

মক্কাবাসীদের ব্যাপারে নবীজীর সিদ্ধান্ত জানার জন্য সারা রাত তিনি তাঁর দরজায় অপেক্ষা করলেন। ভোর হতেই তিনি নবীজীর সামনে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে সোজা মক্কার পথ ধরেন।

মক্কায় পৌঁছে একটা উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দেন- ‘ওহে কুরায়শ বংশের লোকেরা! মোহাম্মদ এমন এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছেন যার সাথে তোমরা কখনো পরিচিত নও। যে ব্যক্তি আবু সুফইয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে নিজ গৃহে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে সে নিরাপদ, আর যে মসজিদে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’

ঘোষণা শুনে মক্কার অধিবাসীরা নিজ নিজ গৃহে এবং মসজিদুল হারামে ঢুকে পড়লো। নবীজী ‘যী তুওয়া’-তে বাহনের পিঠে অবস্থান করে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন বাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক ভাগের একজন নেতা ও পতাকাবাহী হন সা‘দ ইবন উবাদা আল-নানসারী (রা)। তিনি আবার আলীকে বলেন- ‘পতাকাটি খায়বারে, বানী কুরায়জার যুদ্ধে নবীজীর এবং উহুদ যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকাবাহী ছিলেন।’ (তাবাকাত -/২৭, ৭৭)

মক্কা বিজয়ের দিন নবীজী ‘আযাখির’-এর পথে মক্কায় প্রবেশ করে মক্কার উঁচু ভূমিতে অবতরণ করেন। খাদিজার কবরের অনতিদূরে তাঁর জন্য তাঁবু স্থাপন করা হয়। সঙ্গে কন্যা ফাতেমাও ছিলেন। মক্কা থেকে যেদিন ফাতেমা মদীনায় যাচ্ছিলেন সেদিন আল-হুওয়ায়রিছ ইবন মুনকিয তাঁকে তাঁর বাহনের পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে জীবন বিপন্ন করে ফেলেছিল।

সেই স্মৃতি তাঁর দীর্ঘদিন পর জন্মভূমিতে ফিরে আসার আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছিল। নবীজী সে কথা ভোলেননি। তিনি বাহিনীকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে একজন পরিচালক নির্ধারণ করে বলেন, এরা যদি কা‘বার গিলাফের নীচেও আশ্রয় নেয় তাহলেও তাদের হত্যা করবে।

তাদের মধ্যে আল-‘জুয়ায়রিছ ইবন মুনকিযও ছিল। তাকে হত্যার দায়িত্ব অর্পিত হয় ফাতেমার স্বামী আলীর উপর। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬৩৫)

নবীজীর চাচাতো বোন উম্মু হানী বিনত আবী তালিব, মক্কার হুবায়রা ইবন আবী ওয়াহাবের স্ত্রী তিনি বলেছেন, নবীজী মক্কার উঁচু ভূমিতে অবতরণ করার পর বানূ মাখযূনের দুই ব্যক্তি আল-হারিছ ইবন হিশাম ও যুহায়র ইবন আবী উমাইয়্যা ইবন আল-মুগীরা পালিয়ে আমার গৃহে আশ্রয় নেয়।

আমার ভাই আলী ইবন আবী তালিব (রা) আমার সাথে দেখা করতে এসে তাদেরকে দেখে ভীষণ ক্ষেপে যান। আল্লাহর নামে কসম করে তিনি বলেন- আমি অবশ্যই তাদেরকে হত্যা করবো। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে নবীজীর নিকট ছুটে গেলাম।

সেখানে পৌঁছে দেখি, তিনি একটি বড় পাত্রে পানি নিয়ে গোসল করছেন এবং ফাতেমা তাঁকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন। নবীজী গোসল সেরে আট রাকাত চাশতের নামাজ আদায় করলেন, তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন- উম্মু হানী, কি জন্য এসেছো?

আমি তাঁকে আমার বাড়ির ঘটনাটি বললাম। তিনি বললেন- তুমি যাদের আশ্রয় দিয়েছো আমিও তাদের আশ্রয় দিলাম। যাদের তুমি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ আমিও তাদের আশ্রয় দিলাম। যাদের তুমি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ আমিও তাদের নিরাপত্তা দান করলাম। আলী তাদের হত্যা করবে না। (প্রাগুক্ত; সাহীহ মুসলিম- সালাতুল মুসাফিরীন)

মক্কায় ফাতেমার প্রথম রাতটি কেমন কেটেছিল সে কথাও জানা যায়। তিনি বেশ আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। প্রিয়তমা মায়ের কথা, দুই সহোদরা যায়নাব ও রুকাইয়্যার স্মৃতি তাঁর মানসপটে ভেসে উঠছিল। মক্কার অধিবাসীরা তাঁর পিতার সঙ্গে যে নির্মম আচরণ করেছিল সে কথা, মক্কায় নিজের শৈশব-কৈশোরের নানা কথা তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল।

সারা রাত তিন দু‘চোখের পাতা এক করতে পারেননি। প্রভাতে মসজিদুল হারাম থেকে বিলালের কণ্ঠে ফজরের আযান ধ্বনিত হলো। আলী শয্যা ছেড়ে নামাজে যাবার প্রস্তুতির মধ্যে একবার প্রশ্ন করলেন- হাসানের মা, তুমি কি ঘুমাওনি?

তিনি একটা গভীর আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন- আমি সম্পূর্ণ সজাগ থেকে বিজয়ীবেশে এ প্রত্যাবর্তনকে উপভোগ করতে চাই। ঘুমিয়ে পড়লে গোটা ব্যাপারটিই না জানি স্বপ্ন বলে ভ্রম হয়।

এরপর তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যান। নামাজ শেষে একটু ঘুমিয়ে নেন। ঘুম থেকে উঠে সেই বাড়িটিতে যাওয়ার ইচ্ছা করেন যেখান তাঁর জন্ম হয়েছিল। যে বাড়িটি ছিল তাঁর নিজের ও স্বামী আলীর শৈশব-কৈশোরের চারণভূমি।

(চলবে…)

…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!