ভবঘুরেকথা

-নূর মোহাম্মদ মিলু

তারপর তারা একটা একটা করে গুনে বলতে থাকে- আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দেন, উপাস্যদের দোষের কথা বলেন, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোকদেরকে নির্বোধ ও বোকা মনে করেন।

তিনি বলেন- হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি।

এর পরের ঘটনা দেখে বালিকা ফাতেমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তিনি ভয়ে অসাড় হয়ে পড়েন। দেখেন, তাদের একজন তাঁর পিতার গায়ের চাদরটি তাঁর গলায় পেঁচিয়ে জোরে টানতে শুরু করেছে। আর আবু বকর (রা) তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলছেন- তোমরা একটি লোককে শুধু এ জন্য হত্যা করবে যে, তিনি বলেন- আল্লাহ আমার রব, প্রতিপালক?

লোকগুলো আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালো। তাঁর দাড়ি ধরে টানলো, তারপর মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে ছাড়লো। (ইবন হিশাম, আল-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ্-১/৩১০)

এভাবে আবু বকর সেদিন নিজের জীবন বিপন্ন করে পাষণ্ডদের হাত থেকে নবীজী ছাড়ালেন। ছাড়া পেয়ে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। মেয়ে ফাতেমা পিতার পিছনে পিছনে চললেন। পথে স্বাধীন ও দাস যাদের সাথে দেখা হলো প্রত্যেতেই নানা রকম অশালীন মন্তব্য ছুড়ে মেরে ভীষণ কষ্ট দিল।

নবীজী সোজা বাড়িতে গেলেন এবং মারাত্মক রকমের বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। বালিকা ফাতেমার চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটলো। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৫৯২)

কুরায়শরা নবীজীর উপর নির্যাতন চালানোর নতুন পথ বেছে নিল। এবার তাদের নির্যাতনের হাত বানূ হাশিম ও বানূ আবদিল মুত্তালিবের প্রতিও সম্প্রসারিত হলো। মক্কার মুশরিকরা তাদেরকে বয়কট করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল। নবীজী তাদের কাছে নত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে কেনাবেচা, কথা বলা ও উঠাবসা বন্ধ।

একমাত্র আবু রাহাব ছাড়া বানূ হাশিন ও বানূ আবদিল মুত্তালিব মক্কার উপকণ্ঠে ‘শিবু আবী তালিব’-এ আশ্রয় নেয়। তাদেরকে সেখানে অবরোধ করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ জীবন এক সময ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। শিবুর বাইরে থেকেও সে সময় ক্ষুধা-কাতর নারী ও শিশুদের আহাজারি ও কান্নার রোল শোনা যেত।

এই অবরুদ্ধদের মধ্যে ফাতেমাও ছিলেন। এই অবরোধ তার স্বাস্থ্যের উপর দারুন প্রভাব ফেলে। এখানে নাহারে থেকে যে অপুষ্টির শিকার হন তা আমরণ বহন করে চলেন। এই অবরোধ প্রায় তিন বছর চলে। (নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২০৬)

অবরুদ্ধ জীবনের দুঃখ-বেদনা ভুলতে তিনি আরেকটি বড় রকম দুঃখের মুখোমুখী হন। স্নেহময়ী মা খাদিজা, যিনি তাঁদের সবাইকে আগলে রেখেছিলেন, যিনি অতি নীরবে পুণ্যময় নবীগৃহের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে চলছিলেন, মারা গেলেন।

তিনি আল্লাহর রাসূলের যাবতীয় দায়িত্ব যেন কন্যা ফাতেমার উপর অর্পণ করে যান। ফাতেমা অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয় ও দৃঢ়তার সাথে পিতার পাশে দাঁড়ান। পিতার আদর ও স্নেহ বেশী মাত্রায় পেতে থাকেন। মদীনায় হিজরাতের আগ পর্যন্ত মক্কায় পিতার দাওয়াতী কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে অবদান রাখতে থাকেন। আর এ কারণেই তাঁর ডাকনাম হয়ে যায়- “উম্মু আবীহা” (তাঁর পিতার মা)। (প্রাগুক্ত-২০৭; উসুদুল গাবা-৫/২৫০; আল-ইসাবা-৪/৪৫০)

হিজরত ও ফাতেমা
যে রাতে নবীজী মদীনায় হিজরাত করলেন সে রাতে আলী (রা) যে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন, ফাতেমা অতি নিকট থেকে তা প্রত্যক্ষ করেন। আলী নিজের জীবন বাজি রেখে কুরায়শদের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে নবীজীর বিছানায় শুয়ে থাকেন।

সেই ভয়াবহ রাতে ফাতেমাও বাড়িতে ছিলেন। অত্যন্ত নির্ভীকভাবে কুরায়শদের সব চাপ প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর আলী তিন দিন মক্কায় থেকে নবীজীর নিকট গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ মালিকদের নিকট প্রত্যর্পণ করে মদীনায় পাড়ি জমান।

ফাতেমা ও তাঁর বোন উম্মু কুলছূম মক্কায় থাকলেন। নবীজী মদীনায় একটু স্থির হওয়ার পর পরিবারের লোকদের নেয়ার জন্য একজন সাহাবীকে পাঠালেন। আর সেটা ছিল নবুওয়াতের ১৩তম বছরের ঘটনা। ফাতেমা তখন অষ্টাদশী। মদীনায় পৌছে তিনি দেখেন সেখানে মুহাজিররা শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছেন।

বিদেশ-বিভুঁইয়ের একাকীত্বের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক করে দিয়েছেন। তিনি নিজে আলীকে দ্বীনি ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছেন। (ইবন হিশান-২/১৫০; আল-ইসতীআব-৩/১৯৮)

বিয়ে
হিজরি দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পরে আলীর সাথে ফাতেমার বিয়ে হয়। বিয়ের সঠিক সন তারিখ ও বিয়ের সময় ফাতেমা ও আলীর বয়স নিয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য দেখা যায়। একটি মত এরকম যে, উহুদ যুদ্ধের পর বিয়ে হয়।

একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজী হজরত আয়েশাকে (রা) বিয়ে করে উঠিয়ে নেয়ার চার মাস পরে আলী-ফাতেমার বিয়ে হয় এবং বিয়ের নয় মাস পরে তাঁদের বাসর হয়। বিয়ের সময় ফাতেমার বয়স পনেরো বছর সাড়ে পাঁচ মাস এবং আলীর বয়স একুশ বছর পাঁচ মাস। (আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১০৯)

ইবন আবদিল বার তাঁর ‘আল-ইসতীআব’ গ্রন্থে এবং ইবন সা‘দ তাঁর ‘তাবাকাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আলী ফাতেমাকে বিয়ে করেন নবীজীর মদীনায় আসার পাঁচ মাস পরে রজব মাসে এবং বদর যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তাঁদের বাসর হয়। ফাতেমার বয়স তখন আঠারো বছর।

তাবারীর তারীখে বলা হয়েছে, হিজরি দ্বিতীয় সনে হিজরাতের বাইশ মাসের মাথায় জিলহাজ্জ মাসে আলী-ফাতেমার বাসর হয়। বিয়ের সময় আলী ফাতেমার চেয়ে চার বছরের বড় ছিলেন। (প্রাগুক্ত; তাবাকাত-৮/১১; নিসা’ মাবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২০৮)

আবু বকর (রা) ও ওমরের (রা) মত উঁচু মর্যাদার অধিকারী সাহাবীরাও ফাতেমাকে স্ত্রী হিসেবে পেতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা নবীজীর নিকট প্রস্তাবও দেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন।

হাকিমের মুসতাদরিক ও নাসঈর সুনানে এসেছে যে, আবু বকর ও ওমর উভয়ে ফাতেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নবীজী তাঁদেরকে বলেন- সে এখনো ছোট।

একটি বর্ণনায় এসেছে, আবু বকর প্রস্তাব দিলেন। নবীজী বললেন- আবু বকর! তাঁর ব্যাপারে আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা কর। আবু বকর একথা ওমরকে বললেন, ওমর বললেন- তিনি তো আপনার প্রস্তাব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপর আবু বকর ওমরকে বললেন- এবার আপনি নবীজীর নিকট ফাতেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিন।

ওমর প্রস্তাব দিলেন। নবীজী আবু বকরকে যে কথা বলে ফিরিয়ে দেন, ওমরকেও ঠিক একই কথা বলেন। ওমর আবু বকরকে সে কথা বললে তিনি মন্তব্য করেন- ওমর, তিনি আপনার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপর ওমর আলীকে বলেন, আপনিই ফাতেমার উপযুক্ত পাত্র।

আলী বলেন, আমার সম্পদের মধ্যে এই একটি বর্ম ছাড়া তো আর কিছুই নেই।

আলী-ফাতেমার বিয়েটি কিভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বর্ণনা দেখা যায়। সেগুলো প্রায় কাছাকাছি। তাবাকাতে ইবন সা‘দ ও উসুদুর গাবা‘র গ্রন্থের বর্ণনা মতে, আলী ওমরের কথামত নবীজীর নিকট ফাতেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নবীজী সাথে সাথে নিজ উদ্যোগে আলীর সাথে ফাতেমাকে বিয়ে দেন।

এ খবর ফাতেমার কানে পৌঁছলে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। অতঃপর নবীজী ফাতেমার কাছে যান এবং তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন- ফাতেমা! আমি তোমাকে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে বেশী বিচক্ষণ এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়েছি।

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আলী প্রস্তাব দানের পর নবীজী বলেন- ফাতেমা! আলী তোমাকে স্মরণ করে। ফাতেমা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। অতঃপর নবীজী বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন।

অন্য একটি বর্ণনা এ রকম- মদীনার আনসারদের কিছু লোক আলীকে বলেন- আপনার জন্য তো ফাতেমা আছে। একথার পর আলী নবীজীর নিকট যান।

নবীজী বলেন- আবু তালিবের ছেলের কি প্রয়োজন? আলী ফাতেমার প্রসঙ্গে কথা বলেন।

নবীজী বলেন- মারহাবান ওয়া আহলান। (পরিবারে সুস্বাগতম)। এর বেশী আর কিছু বললেন না।

আলী নবীজীর নিকট থেকে উঠে অপেক্ষামান আনসারদের সেই দলটির কাছে গেলেন। তারা জিজ্ঞেস করলো- পিছনের খবর কি? আলী বললেন- আমি জানিনে। তিনি আমাকে ‘মারহাবান ওয়া আহলান’ ছাড়া আর কিছুই বলেননি।

তাঁরা বললেন- নবীজীর পক্ষ থেকে আপনাকে এতটুকু বলাই কি যথেষ্ট নয়? তিনি আপনাকে পরিবারের সদস্য বলে স্বাগত জানিয়েছেন। ফাতেমার সাথে কিভাবে বিয়ে হয়েছিল সে সম্পর্কে আলীর বর্ণনা এ রকম- নবীজীর নিকট ফাতেমার বিয়ের পয়গাম এলো। তখন আমার এক দাসী আমাকে বললেন- আপনি কি একথা জানেন যে, নবীজীর নিকট ফাতেমার বিয়ের পয়গাম এসেছে?

বললাম- না।

সে বললো- হ্যাঁ, পয়গাম এসেছে। আপনি নবীজীর নিকট কেন যাচ্ছেন না? আপনি গেলে নবীজী ফাতেমাকে আপনার সাথেই বিয়ে দিবেন।

বললাম- বিয়ে করার মত আমার কিছু আছে কি?

(চলবে…)

…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!