ভবঘুরেকথা

-নূর মোহাম্মদ মিলু

এই অভিশপ্ত ব্যক্তি তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলেছিল- ‘তুমি বানূ হাশিমের জন্য খাদ্য নিয়ে যাচ্ছো? আল্লাহর কসম! এ খাবার নিয়ে তুমি যেতে পারবে না। মক্কায় চলো, তোমাকে আমি অপমান করবো। সে পথ ছাড়তে অস্বীকার করলো। সেদিন দু‘জনের মধ্যে বেশ মারপিট হয়। এরই প্রেক্ষিতে নাজিল হয়। সুরা আদ-দুখান-৪৩-৪৬; ইবন হিশাম, আস-সীরাহ্-২/২২, ১২৬, ১৩২)

‘নিশ্চয় যাক্কুম বৃক্ষ পাপীর খাদ্য। গলিত তামার মত তাদের পেটে ফুটতে থাকবে। ফুটন্ত পানির মত।’

এই আবু জাহল মক্কায় আগত নাজরানের একটি খ্রীস্টান প্রতিনিধি দলের মুখোমুখি হয়। তারা এসেছিল মক্কায় মোহাম্মদের নুবুওয়াত লাভের খবর পেয়ে, তাঁর সম্পর্কে আরো তথ্য লাভের উদ্দেশ্যে। তারা নবীজীর সাথে সাক্ষাতের পর তাঁর কথা শুনে ঈমান আনে।

তারা নবীজীর মজলিস থেকে বেরিয়ে আসার পরই আবু জাহল তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং তাদেরকে লক্ষ্য করে বলে-

‘আল্লাহ তোমাদের কাফেলাটিকে ব্যর্থ করুন। পিছনে ছেড়ে আসা তোমাদের স্বধর্মাবলম্বীরা তোমাদেরকে পাঠিয়েছে এই লোকটি সম্পর্কে তথ্য নিয়ে যাবার জন্য। তার কাছে তোমরা একটু স্থির হয়ে বসতে না বসতেই তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে বসলে? তোমাদের চেয়ে বেশী নির্বোধ কোন কাফেলার কথা আমার জানা নেই।’ (ইবন হিশাম, প্রাগুক্ত)

এই আবু জাহল নবীজীর মদীনায় হিজরাতের অব্যবহিত পূর্বে কুরাইশদেরকে বলেছিল, কুরাইশ গোত্রের প্রতিটি শাখা থেকে একজন করে সাহসী ও চালাক-চতুর যুবক নির্বচন করে তার হতে একটি করে তীক্ষ্ণ তরবারি তুলে দেবে। তারপর একযোগে নবীজীর উপর হামলা চালিয়ে এক কোপে তাকে হত্যা করবে। তাতে তার রক্তের দায়-দায়িত্ব কুরাইশ গোত্রের সকল শাখার উপর সমানভাবে বর্তাবে। (তাবাকাত-২/১৫,১৭)

রাতে নবীজী মদীনায় হিজরাত করলেন। পর দিন সকালে কুরাইশরা তাঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। তাদের মধ্যে আবু জাহলও ছিল। তারা আবু বকরের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে হ্যাঁকডাক দিতে আরম্ভ করলো- আবু বকরের মেয়ে আসমা বেরিয়ে এলেন।

তারা প্রশ্ন করলো- তোমার আব্বা কোথায়? তিনি বললেন- আল্লাহর কসম! আমার আব্বা কোথায় তা আমার জানা নেই। তখন যাবতীয় অশ্লীল ও দুষ্কর্মের তোহা আবু জাহল তার হাতটি উঠিয়ে সজোরে আসমার গালে চড় বসিয়ে দেয়। আসমার কানের দুলটি ছিটকে পড়ে।

বদরে যখন দু’ পক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার তোড়-জোড় করছে তখন কুরাইশ বাহিনী একজন লোককে পাঠালো শত্রু বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি সম্পর্কে তথ্য নিয়ে আসার জন্য। সে ফিরে এসে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিল।

হাকীম ইবন হিযাম ইবন খুওয়াইলিদ গেলেন উতবা ইবন রাবীআর নিকট এবং তাকে লোক-লস্করসহ ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন। উতবা নিমরাজি ভাব প্রকাশ করে সে হাকীমকে আবু জাহলের নিকট পাঠালো। কিন্তু আবু জাহল যুদ্ধ ছাড়া হাকীমের কথা কানেই কুললো না।

এ সেই আবু জাহল, বদরের দিন নবীজী যে সাতজন কট্টর কাফেরের প্রতি বদ-দোয়া করেন, সে তাদের অন্যতম। এ যুদ্ধে সে অভিশপ্ত কাফের হিসেবে নিহত হয়। তার মাথাটি কেটে নবীজীর সামনে আনা হলে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন। (প্রাগুক্ত; তারাজিমু সায়্যিদিতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬১২)

নবীজী আবু জাহলেন উটটি নিজের কাছে রেখে দেন। এর চার বছর পর উমরার উদ্দেশ্যে যখন মক্কার দিকে যাত্র করেন তখন উটটি কুরবানীর পশু হিসেবে সঙ্গে নিয়ে চলেন। পথে হুদায়বিয়াতে কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই উটটি কুরবানী করেন। (তাবাকাত-২/৬৯)

ইসলামের এহেন দুশমন ব্যক্তির মেয়ে কি নবীজীর মেয়ে ফাতেমার সতীন হতে পারে? তাই আল্লাহ ও তাঁর নবী প্রত্যাখ্যান করেন। নবীজী রাগান্বিত অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে যান এবং সোজা মিম্বরে গিয়ে ওঠেন। তারপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্য নিম্নের ভাষণটি দেন-

‘বানী হিশাম ইবন আল-মুগীরা আলীর সাথে তাদের মেয়ে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমার অনুমতি চায়। আমি তাদেরকে সে অনুমতি দিব না। অনুমতি দিব না। অনুমতি দিব না। তবে আলী ইচ্ছা করলে আমার মেয়েকে তালাক দিয়ে তাদের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে।

কারণ, আমার মেয়ে আমার দেহেরি একটি অংশের মত। তাকে যা কিছু অস্থির করে তা আমাকেও অস্থির করে, আর যা তাকে কষ্ট দেয় তা আমাকেও কষ্ট দেয়। আমি তার দীনের ব্যাপারে সঙ্কটে পড়ার ভয় করছি।

তারপর তিনি তাঁর জামাই আবুল আসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তার সাথে বৈবাহিক আত্মীয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন-

‘সে আমাকে কথা দিয়েছে এবং সে কথা সত্য প্রমাণিত করেছে। সে আমার সাথে অঙ্গীকার করেছে এবং তা পূরণ করেছে। আমি হালালকে হারাম করতে পারবো না। তেমনিভাবে হারামকেও হালাল করতে পারবো না। তবে আল্লাহর রাসূলের মেয়ে ও আল্লাহর দুশমনের মেয়ের কখনো সহ অবস্থান হতে পারে না।’ (হাদিসটি সাহীহ আল-বুখারী, আল-মুসলিম, সুনানে আবী দাউদ, সুনানে ইবন মাজাহ, সুনানে তিরমিযী ও সুনানে আহমাদ(৬/৩২৬, ৩২৮) সহ হাদিসের প্রায় সকল গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।)

আলী মসজিদে ছিলেন। চুপচাপ বসে শ্বশুরের বক্তব্য শুনলেন। তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে বাড়ির পথ ধরলেন। এক সময় বাড়িতে পৌঁছলেন, সেখানে দুঃখ ও বেদনায় ভারাক্রান্ত ফাতেমা বসা আছেন। আলী আস্তে আস্তে তাঁর পাশে গিয়ে বসলেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। কি বলবেন তা যেন স্থির করতে পারছেন না। যখন দেখলেন ফাতেমা কাঁদছেন, তখন ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে আস্তে করে বলেন, ‘ফাতেমা! তোমার অধিকারের ব্যাপারে আমার ভুল হয়েছে। তোমার মত ব্যক্তিরা ক্ষমা করতে পারে।’

অনেক্ষণ কেটে গেল ফাতেমা কোন জবাব দিলেন না। তারপর এক সময় বললেন- আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন।’

এবার আলী একটু সহজ হলেন। তারপর মসজিদের সব ঘটনা তাঁকে বর্ণনা করেন। তাঁকে একথাও বলেন যে, নবীজী বলেছেন, আল্লাহর রাসূলের মেয়ে ও আল্লাহর দুশমনের মেয়ের সহাবস্থান কখনো সম্ভব নয়। ফাতেমার দু‘চোখ পানিতে ভরে গেল। তারপর তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুযওয়াহ-৬২৪)

আবু জাহলের সেই কন্যার নাম নিয়ে মতপার্থক্য আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে ‘জুওয়ায়বিয়া’। তাছাড়া আল-আওরা’, আল-হানকা’, জাহদাম ও জামীলাও বলা হয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি নবীজীর নিকট বায়াত হন এবং নবীজীর কিছু হাদিসও স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেন। (আ‘লাম-আন-নিসা’ -৪/১১২; টীকা নং-১)

আলী তাঁর পয়গাম প্রত্যাহার করে নেন এবং আবু জাহলের কন্যাকে উত্তাব ইবন উসায়দ বিয়ে করেন। এ ঘটনার পর ফাতেমা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলীর একক স্ত্রী হিসেবে অতিবাহিত করেন। ফাতেমার মৃত্যূর আগ পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন নি।

দ্বিতীয় বিয়ের অভিপ্রায় ঘটেছিল কখন
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলো- আলী কখন এই দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা করেছিলেন? ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে নবীজীর উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি বর্ণিত হলেও কেউ তার সময়কাল সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করেননি।

অথচ এটা নবীজীর জীবন ও তাঁর পরিবারের জন্য ছিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাই কোন কোন বিশেষজ্ঞ বিভিন্নভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এটা ছিল আলী-ফাতেমার বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা।

আর সুনির্দিষ্টভাবে তা হয়তো হবে হিজরি দ্বিতীয় সন, তৃতীয় সনে তাঁদের প্রথম সন্তান হাসান হওয়ার পূর্বে। অবশ্য এটা সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক মতামত; এর সপক্ষে কোন বর্ণনামূলক দলিল-প্রমাণ নেই। (প্রাগুক্ত)

হাসান-হুসায়নের জন্ম
আলী-ফাতেমার জীবনে মেঘ ভর করেছিল তা কেটে গেল, জীবনের এক কঠিন পরীক্ষায় তারা উৎড়ে গেলেন। অভাব ও টানাটানির সংসারটি আবার প্রেম-প্রীতি ও সহমর্মিতায় ভরে গেল। এরই মধ্যে হিজরি তৃতীয় সনে তাঁদের প্রথম সন্তান হাসানের জন্ম হয়। ফাতেমার পিতাকে এ সুসংবাদ দেয়া হলো।

নবীজী দ্রুত ছুটে গেলেন এবং আদরের মেয়ে ফাতেমার সদ্যপ্রসূত সন্তানকে দু‘হাতে তুলে তার কানে আযান দেন এবং গভীরভা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। গোটা মদীনা যেনো আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে। নবীজী দৌহিত্র হাসানের মাথা মুড়িয়ে তার চুলের সমপরিমাণ ওজনের রূপা গরীব-মিসকীনদের মধ্যে দান করে দেন।

শিশু হাসানের বয়স এক বছরের কিছু বেশী হতে না হতেই চতুর্থ হিজরির শা‘বান মাসে ফাতেমা আরেকটি সন্তান উপহার দেন। আর এই শিশু হলেন হুসায়। (সাহীহ আল-বুখারী, কিতাবুল মানাকিব; মুলিম-আল-ফাদায়িল)

ফাতেমা হাসান, হুসাইন, উম্মু কুলছূম ও যায়নাক- এ চার সন্তানের মা হন। তিনি শিশু হাসানকে দু‘হাতের উপর রেখে দোলাতে দোলাতে নিম্নের চরণটি আবৃত্তি করতেন- ‘আমার সন্তান নবীর মত দেখতে, আলীর মত নয়।’ (প্রাগুক্ত-৪/১১৩)

(চলবে…)

…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!