-নূর মোহাম্মদ মিলু
হাসান-হুসায়নের প্রতি নবীজীর স্নেহ
নবীজীর অতি আদরের এ দুই দৌহিত্র যেমন তাঁর অন্তরে প্রশান্তি বয়ে আনে তেমনি তাঁদের মা আয-যাহরার দু‘ কোল ভরে দেয়। খাদিজার ওফাতের পর নবীজী বেশ কয়েকজন নারীকে বেগমের মর্যাদা দান করেন, কিন্তু তাঁদের কেউই তাঁকে সন্তান উপহার দিতে পারেননি।
পুত্র সন্তানের যে অভাববোধ তাঁর মধ্যে ছিল তা এই দুই দৌহিত্রকে পেয়ে দূর হয়ে যায়। এ পৃথিবীতে তাঁদের মাধ্যমে নিজের বংশধারা বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনায় নিশ্চিত হন। এ কারণে তাঁর পিতৃস্নেহও তাঁদের উপর গিয়ে পড়ে। আর তাই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, তিনি তাঁদের দু’জনকে নিজের ছেলে হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী ফাতেমাকে বলতেন, আমার ছেলে দুটোকে ডাক। তাঁরা নিকটে এলে তিনি তাঁদের দেহের গন্ধ শুঁকতেন এবং জড়িয়ে ধরতেন। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬২৬)
হজরত উসামা ইবন যায়দ (রা) বলেছেন, আমি একদিন কোন একটি প্রয়োজনে নবীজীর ঘরের দরজায় টোকা দিলাম। তিনি গায়ের চাদরে কিছু জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন। আমি বুঝতে পারলাম না চাদরে জড়ানো কি জিনিস। আমার কাজ শেষ হলে প্রশ্ন করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি চাদরে ঢেকে রেখেছেন কি জিনিস?
তিনি চাদরটি সরালে দেখলাম, হাসান ও হুসায়ন। তারপর তিনি বললেন- এরা দু‘জন হলো আমার ছেলে এবং আমার মেয়ে। হে আল্লাহ! আমি এদের দু‘জনকে ভালবাসি, আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন। আর তাদেরকে যারা ভালোবাসে তাদেরকেও ভালোবাসুন। (সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-৩/২৫১)
আল্লাহ ফাতেমার প্রতি বড় দয়া অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তাঁর মাধ্যমে নবীজীর বংশধারা সংরক্ষণ করেছেন। তেমনিভাবে আলীর ঔরসে সর্বশেষ নবীর বংশধারা দান করে আল্লাহ তাঁকেও এক চিরকালীন সসম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
রক্ত সম্পর্কের দিক দিয়ে আলী নবীজীর নিকটতম জামাতা। তাঁর দেহে পরিচ্ছন্ন হাশেমী রক্ত বহমান ছিল। নবীজী ও আলীর নসব আবদুল মুত্তালিবে গিয়ে মিলিত হয়েছে। উভয়ে ছিলেন তাঁর পৌত্র। আলীর পরবর্তীতে নবীজীর সেই পিতৃতুল্য চাচার ছেলে আলীকে পিতৃস্নেহে পালন করেন।
তাকে নিজের কলিজার টুকরা কন্যাকে তাঁর নিকট সোপর্দ কনে। সুতরাং নবীজীর নিকট আলীর স্থান ও মর্যাদা ছিল অত্যুচ্চে। আলী থেকে বর্ণিত হয়েছে- একদিন আমি নবীজী প্রশ্ন করলাম- আমি ও ফাতেমা- এ দু‘জনের কে আপনার বেশী প্রিয়?
বললেন- ফাতেমা তোমর চেয়ে আমার বেশী প্রিয়। আর তুমি আমার নিকট তার চেয়ে বেশী সম্মানের পাত্র।
এ জবাবের মধ্যে নবীজীর নিকট ফাতেমা ও আলীর স্থান ও মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ কারণে শত ব্যস্ততার মাঝে সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় এই দম্পতির গৃহে এবং অতি আদরের দৌহিত্রদ্বয়কে কোলে তুলে নিয়ে স্নেহের পরশ বুলাতেন।
একদিন তাঁদের গৃহে যেয়ে দেখেন, আলী-ফাতেমা ঘুমিয়ে আছেন আর শিশু হাসান খাবারের জন্য কান্না জুড়ে দিয়েছে। তিনি তাঁদের দু‘জনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলেন না। হাসানকে উঠিয়ে নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় বাধা একটি ছাগীর কাছে চলে যান এবং নিজ হতে ছাগীর দুধ দুইয়ে হাসানকে পান করিয়ে তাকে শান্ত করেন।
আর একদিনের ঘটনা। নবীজী ফাতেমা-আলীর বাড়ির পাশ দিয়ে ব্যস্ততার সাথে কোথাও যাচ্ছেন। এমন সময় হুসায়নের কান্নার আওয়াজ তাঁর কানে গেল। তিনি বাড়িতে ঢুকে মেয়েকে তিরস্কারের সুরে বললেন- তুমি কি জন না, তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়? (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬২৭)
কন্যা যায়নাব ও উম্মু কুলছূমের জন্ম
এরপর এ দম্পতির সন্তান সংখ্যা বাড়তে থাকে। হিজরি ৫ম সনে ফাতিমর (রা) প্রথম কন্যার মা হন। নানা নবীজী তার নাম রাখেন ‘যায়নাব’। উল্লেখ্য যে, ফাতেমার এক সহোদরার নাম ছিল ‘যায়নাব’, মদীনায় হিজরাতের পর সে মারা যান।
সেই যয়নাবের স্মৃতি তাঁর পিতা ও বোনের হৃদয়ে বিদ্যমান ছিল। সেই খালার নামে ফাতেমার এই কন্যার নাম রাখা হয়। এর দু‘বছর পর ফাতেমা দ্বিতীয় কন্যার মা হন। তারও নাম রাখেন নবীজী। নিজের আরেক মৃত কন্যা উম্মু কুলছূমের নামে।
এভাবে ফাতেমা তাঁর কন্যার মাধ্যমে নিজের মৃত দু‘বোনের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখেন। ফাতেমার এ চার সন্তানকে জীবিত রেখেই নবীজী আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।
ফাতেমার সব সন্তানই ছিল নবীজীর কলিজার টুকরা বিশেষতঃ হাসান ও হুসায়নের মধ্যে তিনি যেন নিজের পরলোকগত পুত্র সন্তানদেরকে খুঁজে পান। তাই তাদের প্রতি ছিল বিশেষ মুহাব্বাত। একদিন তিনি তাদের একজনকে কাঁধে করে মদীনার বাজারে ঘুরছেন।
নামাজের সময় হলে তিনি মসজিদে ঢুকলেন এবং তাকে খুব আদরের সাথে এক পাশে বসিয়ে ইমাম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় সেজদায় কাটালেন যে পিছনের মুক্তাদিররা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
নামাজ শেষে কেউ একজন জিজ্ঞেস কসলো- ইয় রাসূলাল্লাহ! আপনি এত লম্বা সেজদা করেছেন যে, আমরা ধারণা করেছিলাম কিছু একটা ঘটেছে অথবা ওহি নাজিল হয়েছে।
জবাবে তিনি বললেন- না, তেমন কিছু ঘটেনি। আসল ঘটনা হলো, আমার ছেলে আমার পিঠে চড়ে বসেছিল। আমি চেয়েছি তার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাই তাড়াতাড়ি করি নি।
একদিন নবীজী মিম্বরের উপর বসে ভাষণ দিচ্ছেন। এমন সময় দেখলেন হাসান হুসায়ন দুই ভাই লাল জামা পরে উঠা-পড়া অবস্থায় হেঁটে আসছে। তিনি ভাষণ বন্ধ করে মিম্বর থেকে নেমে গিয়ে তাদের দু‘জনকে উঠিয়ে সামনে এনে বসান। তারপর তিনি উপস্থিত জনমণ্ডলীকে লক্ষ্য করে বলেন- ‘আল্লাহ সত্যই বলেছেন। তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পরীক্ষা বিশেষ।’ (সুরা আত-তাগাবুন-১৫)
আমি দেখলাম, এই শিশু হ্যাঁটছে আর পড়ছে। দৃশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে কথা বন্ধ করে তাদেরকে উঠিয়ে এনেছি।
আরেকদিন তো দেখা গেল, শিশু হুসায়নের দু‘কাঁধের উপর নবীজীর হাত। আর তার দু‘পা রাসূলের দু’পায়ের উপর। তিনি তাকে শক্ত করে ধরে বলছেন, উপরে বেযে ওঠো। হুসায়ন উপরের দিকে উঠতে উঠতে এক সময় নানার বুকে পা রাখলো।
এবার তিনি হসায়নকে বললেন- মুখ খোল। সে হা করলো। তিনি তার মুখে চুমু দিলে বললেন- হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি এবং সেও আমাকে ভালবাসে। তাকে যারা ভালোবাসে আপনি তাদের ভালোবাসুন। (মুসলিম, আল-ফাদায়িল)
একদিন নবীজী কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে করে কোথাও দাওয়াত খেতে যাচ্ছেন। পথে হুসায়নকে তার সমবয়সী শিশুদের সাথে খেলতে দেখলেন। নবীজী দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার জন্য এগিয়ে গেলেন। সে নানার হাতে ধরা না দেওয়ার জন্য একবার এদিক, একবার ওদিক পালাতে থাকে।
নবীজী হাসতে হাসতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। এক সময় তাকে ধরে নিজের একটি হাতের উপর বসান এবং অন্য হাতটি তার চিবুকের নীচে রেখে তাকে চুমু দেন। তারপর বলেন- হুসায়ন আমার অংশ এবং আমি হুসায়নের অংশ। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬৩০)
ফাতেমার বাড়ির দরজায় আবু সুফইয়ান
সময় গড়িয়ে চললো। ইসলামের আলোতে গোটা আরবের অন্ধকার বিদূরিত হতে চললো। এক সময় নবীজী মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। মদীনায় ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। নারী-পুরুষ সবাই এ অভিযানে অংশ নিবে। মক্কায় এ খবর সময় মত পৌঁছে গেল।
কুরায়শদের হৃদকম্পন শুরু হলো। তারা ভাবলো এবার আর রক্ষা নেই। অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনার পর তারা মদীনাবাসীদেরকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখার জন্য আবু সুফইয়ান ইবন হারবকে মদীনায় পাঠালো। কারণ, ইতোমধ্যে তাঁর কন্যা উম্মু হাবীবা রামলা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং নবীজী তাঁকে বেগমের মর্যাদা দান করেছেন। সুতরাং তাঁকে দিয়েই এ কাজ সম্ভব হবে।
আলী ও ফাতেমা এ অভিযানে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। যাত্রার পূর্বে একদিন রাতে তাঁরা সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। নানা স্মৃতি তাঁদের মানসপটে ভেসে উঠছে। মাঝে মাঝে তাঁরা স্মৃতিচরণও করছেন। আট বছর পূর্বে যে মক্কা তাঁরা পিছনে ফেলে চলে এসেছিলেন তা কি তেমনই আছে?
তাঁদের স্মৃতিতে তখন ভেসে উঠছে মা খাদিজা, পিতা আবু তালিবের ছবি। এমনই এক ভাব-বিহ্বল অবস্থার মধ্যে যখন তাঁরা, তখন অকস্মাৎ দরজায় টোকা পড়লো। এত রাতের আগন্তুক কে তা দেখার জন্য আলী দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ফাতেমাও সে দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
দরজা খুলতেই তাঁরা দেখতে পেলেন আবু সুফইয়ান ইবন হারব দাঁড়িয়ে। এই সেই আবু সুফইয়ান, যিনি মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর পতাকাবাহী এবং উহুদের শহীদ হজরত হামযার বুক ফেঁড়ে কলিজা বের করে চিবিয়েছিল যে হিন্দ, তার স্বামী।
(চলবে…)
…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২