ভবঘুরেকথা
মহাতাপস শ্রীশ্রী বালানন্দ ব্রহ্মচারী

মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন

গোমতীস্বামী বললেন, সাধারণত যোগবিভূতিবলে এটা সম্ভব হয়। তবে আবার দ্রব্যগুণ বলেও এটা সম্ভব হয়। তিনি জানেন পারদ মেশানো গুটকা কোন কোন সাধক তৈরি করতে পারেন। তা মুখে রাখলে এভাবে শূন্যে উঠতে পারা যায়। তবে এই সাধুটি কিভাবে খেচরত্ব লাভ করেছেন তা অবশ্য আমি জানি না।

ব্রহ্মানন্দ মহারাজের কাছে দীক্ষাগ্রহণ করার পর গৌরীশংকর মহারাজ, গোমতীস্বামী প্রমুখ অনেক যোগীর সংস্পর্শে এসে অনেক অধ্যাত্মসম্পদ ও শিক্ষা লাভ করেন বালানন্দজী। এই সব মহাপুরুষদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা আধ্যাত্মিক প্রভাব সমৃদ্ধ করে তোলে তাঁর সাধনজীবনকে। নর্মদাতীরের মার্কণ্ডেয় মহারাজের কাছে মহাযোগ শিক্ষা করেন তিনি।

কাশীর ধ্রুবেশ্বর মঠের মঙ্গলেশ্বর রামগিরি মহারাজের কাছে বেদান্তের নানা সূক্ষ্ম তত্ত্ববিচারের জ্ঞানলাভ করেন। উত্তরাখণ্ডে ত্রিগুণীনারায়ণের প্রসিদ্ধ মহাপুরুষ সরমাগিরি মহারাজের কাছে অনেক নিগূঢ় মন্ত্রাদি লাভ করেন। যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের সংস্পর্শেও আসেন তিনি।

এইভাবে যোগসাধনার উচ্চতর ক্রিয়া ও পদ্ধতি শিক্ষা করে অসামান্য যোগশক্তির অধিকারী হয়ে ভারতের যোগী ও সাধু সমাজে এক মর্যাদার আসন লাভ করেন বালানন্দজী।

সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পর গুরুরূপে আবির্ভূত হন বালানন্দ ব্রহ্মচারী। বহু সাধুসন্ন্যাসী ও গৃহস্থ ব্যক্তি তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে বালানন্দজী শিষ্যদের উপদেশ দেন, ‘মক্ষিকা বন যাও’- অর্থাৎ মৌমাছি হয়ে যাও। যেখানে যার কাছে যত অধ্যাত্মসম্পদের মধু পাবে তা সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ করে তোল তোমার সাধকজীবনকে।

মহাসাধক সদ্‌গুরু বালানন্দ ব্রহ্মচারীর প্রথম দীক্ষিত শিষ্য হচ্ছেন রামচরণ বসু। ঘটনাক্রমে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। কামাখ্যা থেকে ফিরে বালানন্দ ব্রহ্মচারী যখন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যটন করে বেড়াচ্ছিলেন তখন একবার তিনি রাণাঘাটে উপস্থিত হন।

রামচরণবাবু তখন একবার রাণাঘাটের মহকুমা শাসক ছিলেন। তিনি সাহসী ও রুচিসম্পন্ন হলেও তিনি অফিসার হিসেবে ছিলেন সৎ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। সে সময় রামচরণবাবু এক মহাবিপদে পড়েন। রাণাঘাটের নিকটে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় বহু লোক হতাহত হয়। রামচরণবাবু মহকুমা শাসক হিসাবে তাঁর কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেননি বলে অভিযোগ ওঠে।

খবরের কাগজে তার বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি হয়। তদন্ত করে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার কাছে কৈফিয়ৎ তলব করেন। রামচরণবাবুর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে। ফলে সংসারের সকলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

এর পরেই গুরুদেবের এক পত্র পান রামচরণবাবু। বালানন্দজী তখন দেওঘরের পাহাড়ে তপস্যা করছিলেন। তিনি চিঠিতে লেখেন একদিন ধ্যানস্থ হয়ে তিনি দেখেন রামচরণবাবুর পিঠে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, অথচ তার কোন বেদনাবোধ হচ্ছে না। তিনি গুরুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

রামচরণবাবুর মাতা বড় ভক্তিমতী ও ধর্মপরায়ণ মহিলা ছিলেন। তিনি পুত্রের মঙ্গল কামনায় তার ইষ্ট দেবতার কাছে বারবার আকুল প্রার্থনা জানাতে থাকেন। তখন একদিন তার অন্তর থেকে কে যেন বলে দেয়, কোন ভয় নেই, তোমাদের সংসারে এক শক্তিমান সাধকের আবির্ভাব হবে। তাঁরই কৃপায় সব বিপদ কেটে যাবে।

এর পরেই রামচরণবাবুর মা জানালা দিয়ে দেখেন, জটাধারী দিব্যকান্তি এক সাধু তাদের বাংলোর উঠোনে প্রবেশ করছেন। সাধু রামচরণবাবুর কাছে এসে বললেন, বাবা, আমার একটা বাঘছালের বড় প্রয়োজন। শুনলাম, নাকি আপনি বড় শিকারী। তাই ভাবলাম আপনার কাছে হয়ত এটা পাওয়া যাবে। তাই এলাম।

সাধুর দিব্যকান্তি দর্শনে ভক্তিভাব জাগল রামচরণবাবুর অন্তরে। তিনি বিশেষ উৎসাহভরে কতকগুলি বাঘছাল দেখালেন। কিন্তু সাধুর তা পছন্দ হলো না। সেদিন রাত্রিতে ঘুমের ঘোরে রামচরণবাবু সেই সাধুর স্বপ্ন দেখলেন। তাকে যেন কে বলে দিল, ওরে এই সাধুর দ্বারাই তোর অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। ওঁর চরণে আশ্রয় গ্রহণ কর।

এই সাধুই হচ্ছেন মহাসাধক বালানন্দ ব্রহ্মচারী।

রামচরণবাবু পরদিনই সপরিবারে বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আস্তানায় গিয়ে তাঁর শরণ নিয়ে তাঁর বিপদের কথা সব বললেন। বালানন্দজী তাদের অভয় দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। দু-এক দিনের মধ্যেই রেল দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সব গোলমাল মিটে গেল। রামচরণবাবু আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

বালানন্দজীর প্রতি তার ভক্তিশ্রদ্ধা বেড়ে গেল। দু-একদিনের মধ্যে রামচরণবাবু ও তাঁর স্ত্রী বালানন্দজীকে তাদের দীক্ষাদানের জন্য অনুরোধ করলেন। তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে তাদের দীক্ষা দিলেন বালানন্দজী। ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে রামচরণবাবু গুরুর দেওয়া বীজমন্ত্র জপ করতে থাকেন। অবিচল হয়ে ওঠে তার গুরুভক্তি।

একবার রামচরণবাবুর পিঠে কারবঙ্কল হয়। তখন তার পিঠে অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু রামচরণবাবু বলেন ক্লোরোফর্ম দিয়ে তাকে অজ্ঞান করার প্রয়োজন হবে না। তার কোন যন্ত্রণা হবে না। তার পীড়াপীড়িতে সার্জেন বিনা ক্লোরোফর্মেই অস্ত্রোপচার করেন।

অস্ত্রোপচারের সময় রামচরণবাবু একমনে গুরুর ধ্যান করতে থাকেন। ফলে কোন জ্বালা যন্ত্রণাই অনুভব করেননি তিনি। তা দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে যায়।

এর পরেই গুরুদেবের এক পত্র পান রামচরণবাবু। বালানন্দজী তখন দেওঘরের পাহাড়ে তপস্যা করছিলেন। তিনি চিঠিতে লেখেন একদিন ধ্যানস্থ হয়ে তিনি দেখেন রামচরণবাবুর পিঠে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, অথচ তার কোন বেদনাবোধ হচ্ছে না। তিনি গুরুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

লোকটিকে তিনি চিনতে পারলেন না। তবু কোন কথা জিজ্ঞাসা না করেই তিনি লোকটির পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন। আহ্বানকারী তাঁর উপরের গুহাঘরে নিয়ে গেল বালানন্দজীকে। এটা তাঁর সাধনার ঘর। ঘরটিতে তিনি সন্ধ্যার আগে নিজে তালাবন্ধ করে যান। কিন্তু তখন দেখলেন ঘরটি একেবারে খোলা। ঘরটি তখন অন্ধকার। তাই আলো জ্বালার জন্য বাতি আর দিয়াশলাইএর খোঁজ করতে লাগলেন বালানন্দজী।

মহারাজের চিঠি আশ্চর্য হয়ে গেলাম রামচরণবাবু। তিনি বুঝতে পারলেন তার গুরুদেব এক শক্তিমান যোগী মহাপুরুষ। তিনি দূর থেকে শিষ্যের সুখ দুঃখের প্রতি সদাজাগ্রত দৃষ্টি রাখেন।

বালানন্দজী যখন দেওঘরে করণীবাদ আশ্রমে থাকতেন তখন দয়ানিধি ঝা নামে তাঁর এক প্রবীণ শিষ্য তাঁর কাছে আশ্রমে তার ছেলেকে নিয়ে বাস করতেন। একদিন গভীর রাতে দয়ানিধির ছেলেকে এক বিষধর সাপে কামড়ায়। ছেলেটির প্রাণসংশয় দেখা দেয়।

কিন্তু দয়ানিধি অবিচলিতভাবে গুরুর চরণে প্রণাম করে ধ্যান করতে থাকেন। ধ্যানস্থ অবস্থায় তিনি এক অলৌকিক দৃশ্য দেখেন। তিনি দেখেন যমদূতের মত দর্শন কতকগুলি মূর্তি আশ্রমের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে আর তাঁর গুরুদেব বালানন্দজী ত্রিশূল হাতে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন।

এরপরই দেখা গেল ছেলেটির মধ্যে বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে গেল। অলৌকিকভাবে তার প্রাণ রক্ষা পেল। কিছুদিন পর দেওঘরের করণীবাদ আশ্রম থেকে তপোবন পাহাড়ে গিয়ে তপস্যা করতে থাকেন বালানন্দজী।

একদিন তপোবন পাহাড়ে তাঁর গুহার মধ্যে একা যোগাসনে বসে ধ্যানে নিবিষ্ট ছিলেন বালানন্দজী। এক সময় চোখ খুলতেই দেখলেন বিচিত্র রঙের এক সাপ তার বড় ফণাটি বিস্তার করে আছে সামনে। তিনি আরও দেখলেন মানুষের গোঁফের মত লোম রয়েছে সাপটির মুখে।

তখন বালানন্দজী কোন ভয় না পেয়ে ভাবলেন, নিশ্চয় কোন মহাত্মা সাপের বেশে তাঁকে পরীক্ষা করতে এসেছেন। তিনি তখন ত্রাটক মন্ত্র জপ করতে করতে সাপটির চোখে চোখ রাখতেই সাপটি চলে গেল সেখান থেকে। আর একবার একটি ঘটনা ঘটে তপোবন পাহাড়ের আশ্রমে।

তখন শীতকাল। মহারাজ নীচে ধুনির কাছে একটি কম্বল গায়ে দিয়ে একা শুয়ে ছিলেন। রাত্রি প্রায় দুটোর সময় হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলেন কে যেন তাঁর গা থেকে কম্বলটা টেনে নিয়ে ফেলে দিল পাশে। তিনি উঠে পড়লেন। দেখলেন কে একজন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে পাহাড়ে যাবার জন্য ইশারা করছে।

লোকটিকে তিনি চিনতে পারলেন না। তবু কোন কথা জিজ্ঞাসা না করেই তিনি লোকটির পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন। আহ্বানকারী তাঁর উপরের গুহাঘরে নিয়ে গেল বালানন্দজীকে। এটা তাঁর সাধনার ঘর। ঘরটিতে তিনি সন্ধ্যার আগে নিজে তালাবন্ধ করে যান। কিন্তু তখন দেখলেন ঘরটি একেবারে খোলা। ঘরটি তখন অন্ধকার। তাই আলো জ্বালার জন্য বাতি আর দিয়াশলাইএর খোঁজ করতে লাগলেন বালানন্দজী।

বালানন্দজী একবার কলকাতায় বরানগরে এক জায়গায় কিছুদিন বাস করেন। এই সময় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর একদিন তার এক প্রতিনিধিকে বালানন্দজীর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে তাঁর বাড়িতে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি জানান বালানন্দজী যদি কৃপা করে একবার তার বাড়িতে যান তাহলে কৃতার্থ বোধ করবেন তিনি।

এমন সময় দেখলেন বৈদ্যুতিক আলোর মত উজ্জ্বল আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল ঘরখানি। কিন্তু তাঁর আহ্বানকারীকে দেখতে পেলেন না। তিনি জেগে আছেন না ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছেন এ কথা ভাবতে ভাবতে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন বালানন্দজী।

পরদিন সকালে গুরুদেবকে আশ্রমে ধুনির কাছে দেখতে না পেয়ে তাঁর খোঁজ করতে লাগল শিষ্যরা। পরে সবাই দেখল উপরে গুহাঘরে সমাধিস্থ হয়ে বসে আছেন। শিষ্যদের ডাকাডাকিতে ধ্যান ভঙ্গ হলো তাঁর। তখন গতরাত্রির ঘটনার কথা বললেন। তা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল সকলে।

মৌজগিরি ও পূর্ণানন্দ স্বামী নামে দুজন সর্বত্যাগী শিষ্য মহারাজের কাছে থাকতেন তাঁর আশ্রমে। কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাণগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি ভক্ত সাধকগণও এসে দীক্ষা গ্রহণ করেন বালানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছে। এইভাবে শিক্ষিত সমাজে বালানন্দজীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে।

বালানন্দজী তাঁর ভক্ত ও শিষ্যদের প্রায়ই বলতেন, চারটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবে সাধকগণ সিদ্ধি লাভ করতে পারেন। এই চারটি পরীক্ষা হল- ঘর্ষণ, তাপন, ছেদন ও তাড়ন। একজন সুদক্ষ স্বর্ণকার যে যে পদ্ধতিতে অলঙ্কার তৈরি করে তেমনি গুরুদেব সেই একই পদ্ধতিতে সাধক শিষ্যদের সাধনজীবনকে গড়ে তুলে তাদের সিদ্ধিলাভে সমর্থ করে তোলেন।

স্বর্ণকার যেমন প্রথমে কষ্টিপাথরে ঘর্ষণ করে বুঝে নেয় ধাতুটি খাঁটি সোনা কি না তেমনি কৃচ্ছ্রসাধনের কষ্টিপাথরে ঘষে গুরু বুঝে নেন তাঁর শিষ্য খাঁটি বা সত্যিকারের সাধক কিনা। তারপর সোনাকে তাপ দিয়ে গলাতে হয়। তেমনি ত্যাগ তিতিক্ষার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় সাধক শিষ্যকে।

তারপর সোনাকে ছেদন বা কেটে গালা বা খাদকে বাদ দিতে হয়। তেমনি শিষ্যদের চরিত্র থেকে ত্রুটিগুলি বাদ দিতে হয়। অবশেষে হাতুড়ীর ঘা দিয়ে সোনাকে পেটাতে হয়। শিষ্যদেরও তাড়ন বা নানা আঘাতের মধ্য দিয়ে তাদের সাধকজীবনকে গড়ে তুলতে হয়।

সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী সাধকদের জন্য বালানন্দজী বিশেষ কঠোরতা ও কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বললেও গৃহস্থ ভক্ত ও শিষ্যদের জন্য সহজসাধ্য সাধনার ব্যবস্থা করতেন। আবার স্নেহ ও সহানুভূতির সঙ্গে তাদের সাধনায় সহায়তা করতেন।

বালানন্দজী একবার কলকাতায় বরানগরে এক জায়গায় কিছুদিন বাস করেন। এই সময় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর একদিন তার এক প্রতিনিধিকে বালানন্দজীর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে তাঁর বাড়িতে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি জানান বালানন্দজী যদি কৃপা করে একবার তার বাড়িতে যান তাহলে কৃতার্থ বোধ করবেন তিনি।

কিন্তু যোগীবর বালানন্দজী তার প্রতিনিধিকে পরিহাস করে বলেন, যতীন্দ্রমোহন যে একজন মহারাজ তা শুনেছি। এদিকে আমাকেও লোকে মহারাজ বলে। একজন মহারাজের কাছে আর একজন মহারাজ এলে তাতে লজ্জার কি আছে? মহারাজ যতীন্দ্রমোহন নিজে একবার আমার কাছে এলেই ত ভালো হয়।

মাত্র নয় বছর বয়সে উজ্জয়িনীর মহাকালের মন্দিরে তাঁর সাধনজীবনের যে ধারাটি উৎসারিত হয় সে ধারা দীর্ঘপথ পরিক্রমা করে অসংখ্য মুমূর্ষ নরনারীর জীবনকে এক মহাজীবনের আস্বাদ দিয়ে অবশেষে বৈদ্যনাথধাম আশ্রমে বিলীন হয়ে যায় নিঃশেষে।

মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের প্রতিনিধি ফিরে গিয়ে সব কথা জানান। এ কথা শুনে লজ্জিত হয়ে যতীন্দ্রমোহন নিজেই গিয়ে দর্শন করেন বালানন্দজীকে। যতীন্দ্রমোহন বালানন্দজীকে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের মত সংসারী লোক কি ভাবে মুক্তি পাবে? চারিদিকে বন্ধনের জাল। এই বন্ধন হতে মুক্তির উপায় বলে দিন।

বালানন্দজী বললেন, মহারাজ আপ অর উলট যাইয়ে। অর্থাৎ এখন উল্টে যান।

কথাটির অর্থ বুঝতে পারলেন না যতীন্দ্রমোহন। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বালানন্দজীর মুখপানে তাকাতে তখন ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললেন, মহারাজ! আপনার যা কিছু সবই থাকবে। শুধু আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টাতে হবে। ‘সব আমার’ এই মনোভাবের পরিবর্তে সব তাঁর অর্থাৎ ভগবানের এই মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।

অহং বোধটি একেবারে দূর করে ভগবানে আত্মসমর্পণ করতে হবে। নিজেকে সব কিছুর মালিক না ভেবে নিজেকে ভগবানের কর্মচারী ভাবতে হবে।

১৯০৬ সালে আবার গঙ্গোনাথ আশ্রমে যান বালানন্দজী। তাঁর গুরু ব্রহ্মানন্দ মহারাজ এই সময় মহারুদ্র যজ্ঞ ও মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন।

এই অনুষ্ঠানের পর ব্রহ্মানন্দ মহারাজ একদিন বালানন্দজীকে বললেন, বাবা! এবার আমি মরদেহ ত্যাগ করব।
বালানন্দজী গুরুদেবকে বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে আরও বহু কাল এ দেহ ধারণ করতে পারেন।

গুরুজী বললেন, আর না, বহু পুরনো হয়ে গেছে এ দেহটা।

সেবার মাঘ মাসের এক পূণ্যতিথিতে তাঁর কুটিরের মধ্যে সকাল হতেই ধ্যান সমাধিস্থ হয়ে পড়েন ব্রহ্মানন্দজী। বালানন্দজী তখন নর্মদার তীরে আশ্রমের এক প্রান্তে মন্ত্র জপ করছিলেন। হঠাৎ এক সময় দেখলেন, ব্রহ্মানন্দ মহারাজ যে কুটিরে ধ্যান করছেন সেই কুটিরটিতে আগুন ধরে গেছে এবং সেটি জ্বলছে।

তারপর সেই জ্বলন্ত কুটির থেকে একটি অগ্নিশিখা ঊর্ধ্বে উঠে দূর আকাশে মিলিয়ে গেল। বুঝলেন, যোগীবর গুরুদেবের জ্যোতির্ময় সত্তাটি মরদেহ ত্যাগ করে স্বর্গধামে চলে গেল।

গঙ্গোনাথের আশ্রমটি গুরুজী বালানন্দ মহারাজকেই দান করে যান। কিন্তু গুরুদেবের দেহত্যাগের পর সেখানে আর থাকতে মন চাইল না বালানন্দজীর। তিনি ছিলেন গুরুজীর প্রথম এবং প্রিয় শিষ্য। গুরুজীর পূণ্যস্মৃতির পীড়ন থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলেন না কিছুতেই।

তাই তিনি তাঁর গুরুভাই কেশবানন্দজীর উপর আশ্রমের ভার দিয়ে আবার দেওঘরে ফিরে এলেন বালানন্দজী। রামচরণবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বেশ কিছু টাকা নিয়ে করণীবাদে এক আশ্রমভবন প্রতিষ্ঠা করে দেন। তারপর থেকে বালানন্দ মহারাজের শিষ্য ও ভক্তের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে দিনে দিনে।

শেষ জীবনটি দেওঘরের আশ্রমেই যাপন করেন বালানন্দজী। আশ্রমে থেকেই অসংখ্য ভক্ত ও শিষ্যের কল্যাণ বিধান করে চলেন। অবশেষে ১৩৪৪ সালের ২৬শে জ্যৈষ্ঠ রাত্রি মধ্যযামে মহাযোগী বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আত্মা ধ্যান সমাধিস্থ অবস্থায় পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়।

মাত্র নয় বছর বয়সে উজ্জয়িনীর মহাকালের মন্দিরে তাঁর সাধনজীবনের যে ধারাটি উৎসারিত হয় সে ধারা দীর্ঘপথ পরিক্রমা করে অসংখ্য মুমূর্ষ নরনারীর জীবনকে এক মহাজীবনের আস্বাদ দিয়ে অবশেষে বৈদ্যনাথধাম আশ্রমে বিলীন হয়ে যায় নিঃশেষে।

(সমাপ্ত)

…………………….
আরো পড়ুন:
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক

মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন

…………………….
ভারতের সাধক ও সাধিকা : সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ

………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!