মানুষের ভেতরে কর্তাভাব প্রবল। এই কর্তাসত্তার ফলেই মানুষ উচ্চতর চিন্তাভাবনা করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করে। চিন্তা আর কাজ দুই জায়গায় মানুষের ভূমিকা অন্যান্য জীব থেকে ভিন্ন। তাই মানুষ শেষ বিচারে কর্তা। মানুষ উচ্চতর চিন্তা করে মানে মানুষ উপরে উঠতে চায়।
এটা তো কর্তাসত্তার জাগৃতি ছাড়া অসম্ভব। কিন্তু কর্তাসত্তাকে বুঝতে চাইলে শ্রমের জায়গাগুলো সচেতনতার সাথে বুঝতে হবে। কেননা, কর্তা হয়ে মানুষ শ্রম দেয়। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-পুনঃসৃষ্টি এই সমীকরণ দ্বারা অতি সরলভাবে আমরা শ্রমকে বুঝতে পারি।
কোনো প্রকার কঠিন দার্শনিক বিশ্লেষণ ছাড়া শুধু শ্রমের সামগ্রিকতা অনুভব করলেই আমরা দেখব শ্রমের দ্বারা আমাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় ঘটছে আবার লয়ের পরে সৃষ্টি হচ্ছে। চিন্তাও শেষ পর্যন্ত শ্রমের বাইরে নয়। যে খাবার খেয়ে দেহগঠিত হচ্ছে ও আমরা চিন্তা করতে পারছি তাতো শ্রমেরই ফসল।
আবার মানসিক শ্রম ছাড়া চিন্তাও অসম্ভব। অর্থাৎ সমগ্র জগতে শ্রম ছাড়া কিছুই করা সম্ভব নয়। জাগতিকতা বলি আর আধ্যাত্মিকতা বলি শ্রম না বুঝলে কিছুই সম্ভব নয়। ভাষাতত্ত্ব বা ব্যাকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করলেও কথাটা সত্য। কারণ শ্রম অর্থ কায়িক ও মানসিক কর্ম এবং তপস্যা।
তাই তপস্বীদের, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও জৈন তপস্বীদের, বলা হয় শ্রমণ। কিন্তু সমাজে মানুষ দেহ ও মনে বিভক্ত হয়ে যায়। বরাবরই কায়িক ও মানসিক শ্রমের আলাদা সত্তা আবির্ভূত হয়। এক পর্যায়ে মানসিক শ্রম কায়িক শ্রমের উপর আধিপত্য শুরু করে।
মানুষকে যদি এই জ্ঞান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় তাহলে মানুষের কর্তাসত্তার জাগৃতি বা তার সাথে মানুষের পরিচয় ঘটতে অসুবিধা হয়। মনসা একে হরণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন তৈরি করে এমন যা কিছু আছে তা উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত মানুষের শান্তি নেই।
কিন্তু কায়িক ও মানসিক দুই শ্রমই যে, সামগ্রিক বিচারে একই শ্রমের দ্বৈত রূপ তা স্বীকার করা হয় না। এর ফলে শোষণ-বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। যার ফলে মানুষ তার কর্তাসত্তাকে চিনতে পারে না। মনসা চাঁদ সওদাগরের মহাজ্ঞান হরণ করে আমাদের এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখালেন।
মনসা কাহিনীতে দেখা যায় যে, তিনি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসেছেন। অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ চাঁদ সওদাগরের কাছে পূজা চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু চাঁদ বণিক তা করতে অস্বীকার করলে এক পর্যায়ে তার মহাজ্ঞান হরণ করেন মনসা। ব্যাপারটা প্রতীকী।
যে জ্ঞানের বাড়তি আবরণে দাম্ভিক হয়ে উঠেছিল চাঁদ তা মনসা হরণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষ যদি এই আবরণগুলো সরিয়ে না দেয় তাহলে সমাজে সমতা আনা যাবে না। জ্ঞান শেষ বিচারে সামাজিক। হঠাৎ করে ব্যক্তি মানুষে তা হাজির হয় না।
মানুষকে যদি এই জ্ঞান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় তাহলে মানুষের কর্তাসত্তার জাগৃতি বা তার সাথে মানুষের পরিচয় ঘটতে অসুবিধা হয়। মনসা একে হরণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন তৈরি করে এমন যা কিছু আছে তা উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত মানুষের শান্তি নেই।
তাছাড়া যা কিছু সামাজিক তা সামাজিক করাই উত্তম। মনসা যখন সওদাগরের বিরুদ্ধে লড়ছেন তখন প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন তার আধিপত্যের ক্ষেত্রগুলো। তাতে চাঁদ দূর্বল হয়ে গেছে এবং এক পর্যায়ে মনসার কথা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
(চলবে…)
<<মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -চার ।। মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -ছয়>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………
আরো পড়ুন:
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -এক
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -দুই
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -তিন
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -চার
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -পাঁচ
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -ছয়
মনসাদেবীর পাঁচালী