ভবঘুরেকথা
মা মনসা সাপ

মনসা হলেন আরেক সরস্বতী। আমরা হয়ত খেয়াল করি না যে পদ্ম ও হংসের সাথে সরস্বতীর মত মনসারও সম্পর্ক আছে। তাছাড়া গবেষকদের দাবী অনুযায়ী সরস্বতী ও মনসার সম্পর্ক বহু আগে থেকেই ছিল। বৃহৎ বঙ্গের ভাবচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে একথা আরও বেশি করে সত্য।

শুধু আমরা আমাদের দার্শনিক বয়ান ভুলে গেছি। সরস্বতী যেমন আমাদের কাছে নিছক শাস্ত্রের দেবী নন, তেমনই মনসাও আমাদের কাছে শাস্ত্রের দেবী নন। মনসার সাথে পদ্ম ও হাঁসের সম্পর্ক বিচার কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে গেলে পদ্ম ও হাঁসের অর্থ জানতে হবে।

পদ্ম হল অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত হবার প্রতীক। শক্তির লীলা পদ্মের মত করেই বিকশিত হয়। পদ্ম উপর থেকে দেখতে চক্রাকার। চক্র বা বৃত্তের শেষ বা শুরু দেখানো যায় না। শক্তিকেও শেষ বা শুরু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আবার শক্তির ক্রিয়াকেও আদি বা অন্ত দিয়ে বিচার করা যায় না।

একইসাথে আদি ও একইসাথে অন্ত হল চক্র বা বৃত্ত। তাই মানবদেহেও চক্রকে বলা হয় পদ্ম। আর এই পদ্মের সাথেও শক্তিরই সম্পর্ক। পদ্ম পাঁকে জন্মালেও এর প্রকাশ কিন্তু দ্যুতিময়। তাই পদ্মকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। পদ্ম জীবন, বিকাশ, উর্বরতা, পবিত্রতা ও নির্লিপ্ততার প্রতীক।

তাছাড়া পদ্মের দ্যুতিময়তা সুর্যকেও নির্দেশ করে। পদ্ম এমন এক উদ্ভিদ যাতে ফুল ও ফল একত্রে হাজির থাকে। ফুল-ফলকে কার্য-কারণ মানলেই বিশাল দার্শনিক তত্ত্ব খুব সহজেই বুঝে যেতে পারি। অর্থাৎ কার্য ও কারণ একইসাথে বিরাজ করে সেই তত্ত্ব খুব সহজেই পদ্ম দিয়ে প্রকাশ করা যায়।

পদ্মের পাপড়ি ফলকে বেষ্টিত করে থাকে এবং পদ্ম ফলকে বহন করে। পরমজ্ঞান লাভ করতে হলেও এই জগতে পদ্মের মত হতে হবে।

অর্থাৎ কোথাও না কোথাও মনসার সাথে সরস্বতী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক থেকেই যাচ্ছে। আমরা এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত টেনে বলতে পারি, মনসা বঙ্গের আরেক সরস্বতী। পদ্ম ও হংসে তাঁদের আসন তা যে পর্যন্ত জীব ও ব্রহ্মের মিলন ঘটিয়ে দেয়।

শত-সহস্র আবর্জনার মধ্যে বাস করেও নিজেকে তার থেকে আলাদা রাখতে হবে, দৃঢ়তার সাথে নিজের সত্তাকে বিকশিত করতে হবে এবং নিজের সারবস্তুকে পদ্মের পাপড়ির মত কোমলতার সাথে আগলে রাখতে হবে। অর্থাৎ পদ্মকে বুঝলে আমরা সরলভাবে অনেক গূঢ় রহস্য বুঝে যেতে পারি।

হংসের প্রজনন শক্তি অসাধারণ। হংস শব্দের সাথে হং ও সঃ এর সম্পর্ক ব্যাপক। আবার সোহং ও ওং এর সাথেও হংসের সম্পর্ক আছে। আবার অহং সঃ এর তত্ত্ব হল হংস। আমিই যে তুমি অর্থাৎ পরমই যে বহু হয়ে জীবরূপে হাজির হয়েছেন সেই তত্ত্বও হংস। তাছাড়া হংসে হরূপী পুরুষ ও সরূপী প্রকৃতি দুজনই আছে।

তাছাড়া হংসকে ধরা হয় বিবেকের প্রতীক। দুধ ও জল মিশিয়ে দিলে হংস দুধ বেছে খায় আর জলে থাকলেও গায়ে জল লাগে না। অর্থাৎ হংসও পদ্মের মত অনেক গূঢ় রহস্য প্রকাশ করে।

আরেকটা ব্যাপার আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, হাঁস ও পদ্মের সাথে জলের সম্পর্ক বিদ্যমান। জলকে প্রাণ সঞ্চারের প্রতীক ধরা হয়। আবার সরস্বতী নিজেই জল। সরস্বতী ভৌতিক দৃষ্টিতে জল, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে প্রাণ আর দৈবিক দৃষ্টিতে হয় চিন্ময় প্রকাশ।

অর্থাৎ কোথাও না কোথাও মনসার সাথে সরস্বতী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক থেকেই যাচ্ছে। আমরা এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত টেনে বলতে পারি, মনসা বঙ্গের আরেক সরস্বতী। পদ্ম ও হংসে তাঁদের আসন তা যে পর্যন্ত জীব ও ব্রহ্মের মিলন ঘটিয়ে দেয়।

আর যে জলে তাঁদের লীলা সেই জল অমর্ত্যলোক থেকে মর্ত্যে আসে। যার ভবের খেলা থেকে মন উঠে যায় সে এই জলের ধারা ধরে উজান পথে চলতে শুরু করে।

৭.
বৃহৎ বঙ্গের ভাবচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে মনসা হলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রেরণাদাত্রী। মানুষের অগ্রযাত্রার পথে সবচেয়ে সহায়ক পদক্ষেপ হল সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সকল প্রকার স্থবিরতা, জড়তা, অন্ধত্ব এবং শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর লড়াই এটি।

মানুষকে বিকশিত ও সাম্যবাদী সমাজের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার অভূতপূর্ব মহাযাত্রা। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ব্যাপ্তি তথাকথিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী সার্বিক বিপ্লব ছাড়া কিছু নয়।

মনসার মহিমা যদি প্রচার করতে হয় তাহলে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। আজ যদি আমরা এই শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে পারি তাহলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে অনেক পরীক্ষা করতে সক্ষম হব এবং পরিশেষে ঘটাতেও সক্ষম হব।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সারকথা হল জীবনের সর্বস্তরে বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সংস্কৃতি আসলে কালচার বা চর্চা নয় ; এটা হল সম্যকরূপে কৃতি। রেনেসাঁ ও রিফরমেশন বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে তার সার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অন্তর্ভুক্ত এবং তার থেকে আরও অগ্রসর।

মনসা বেহুলা-লখিন্দরের ভেলা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চান জাগতিক ক্ষেত্রে মৃতবৎ ব্যবস্থাতে সর্পদংশন অমঙ্গল নয় বরং মঙ্গল। তাতে প্রাণসঞ্চার করার প্রথম ধাপ হল সর্পদংশন। দংশনের শিকার হওয়ার পর এবার একে বেহুলার মত করে ভেলায় ভাসতে ভাসতে উজানে নিতে হবে।

সেখানেই মনসা নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করবেন এবং মনসার মহিমা সর্বত্র চর্চিত হবে। একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে ব্যাপারটাকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পাঠ হিসেবে আমরা গ্রহণ করতেই পারি।

এটাতো প্রতীকী অর্থবিচার মাত্র। আমরা যদি মনসার দার্শনিক অবস্থান বিচারকে আমলে আনি, ইইতোপূর্বে আমরা যা করেছি, তাহলে জাগতিকতা ও পারমার্থিকতার ভেদরেখা আমরা মুছে ফেলতে সক্ষম।

এর ফলে আমরা পারমার্থিকতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে গণশক্তির উদ্বোধনের মাধ্যমে উচ্ছেদ করতে পারব সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার এবং ঘটিয়ে দিতে পারব সার্বিক বিপ্লব।

মনসার মহিমা যদি প্রচার করতে হয় তাহলে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। আজ যদি আমরা এই শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে পারি তাহলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে অনেক পরীক্ষা করতে সক্ষম হব এবং পরিশেষে ঘটাতেও সক্ষম হব।

(সমাপ্ত)

<<মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -এক।। মনসাদেবীর পাঁচালী>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
আরো পড়ুন:
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -এক
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -দুই
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -তিন
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -চার
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -পাঁচ
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -ছয়
মনসাদেবীর পাঁচালী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!