ভবঘুরেকথা

নফসের পঞ্চস্তর

-আবুতালেব পলাশ আল্লী

পবিত্রতা অনুসারে নফসের পাঁচটি স্তারে কথা জানা যায়। এর মধ্যে ‘নফসে আম্মারা’, ‘নফসে লাউয়ামা’ ও ‘নফসে মোৎমায়েন্না’ এই তিনটি স্তরের কথা স্পষ্টভাবে কোরানে উল্লেখ পাওয়া যায়। চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরটি যথাক্রমে ‘নফসে মূলহেমার’ ও ‘নফসে রাহমানিয়া’; যা সাধন বলে জেনে নিতে হয়।

নফসে আম্মারা:

যে নফস আত্মশুদ্ধির কোনরূপ ধার ধারে না, যাতে সাময়িক আনন্দ ও সুখ তাতেই মত্ত থাকে এবং দুনিয়াকেই তার একমাত্র কাম্য ও লক্ষ্যরূপে রেখে জীবনযাপন করে সেরূপ নফসকে ‘নফসে আম্মারা’ বলে। নফসে আম্মারা প্রবৃত্তির দাস। আমিত্বের আবর্জনায় সে সম্পূর্ণ কলুষিত।

নফসে লাউয়ামা:

যে নফস আত্মশুদ্ধির জন্য সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে তাকে ‘’নফসে লাউয়ামা’ বলে। প্রবৃত্তির সর্বপ্রকার তাড়নার বিরূদ্ধে সে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এই নফস আমিত্বের অপরাধের মধ্যে বাস করলেও তার জন্য সে অনুতপ্ত থাকে। ভুল-ত্রুটি সে দুর্বল মুহূর্তে করে ফেললেও সে আমিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত।

নফসে মোৎমায়েন্না:

যে নফস প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়যুক্ত হয়েছে বা পরিশুদ্ধ হয়ে গেছে; তাকে ‘নফসে মোৎমায়েন্না’ বলে। এই নফস নিশ্চিন্ত। এই নফসকে বিজয়ী নফসও বলা যেতে পারে। এই প্রকার নফস আল্লাহর ইচ্ছার উপর নিজ ইচ্ছা ছেড়ে দিতে পেরে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হয়ে যায়।

মোৎমায়েন্না নফসকে লক্ষ করে কোরানে বলা হয়েছে, ‘হে মোৎমায়েন্না নফস! তুমি তোমার রবের দিকে ফিরে এস, তুমি (আল্লাহতে) সন্তুষ্ট এবং (আল্লাহ হতে) সন্তোষ প্রাপ্ত। সুতরাং আমার সেবকদলে প্রবেশ কর এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (৮৯: ২৭-৩০)

নফসের এই পর্যায়ে আসলে আল্লাহ তাকে দাস বলে স্বীকৃতি দান করেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান করেন।

নফসে মূলহেমার:

যে পরিশুদ্ধ নফস সর্বদা স্রষ্টা থেকে ‘এলহাম’-এর দ্বারা পরিচালিত হয়; আপন ইচ্ছায় কোন কর্মই করে না তাকে ‘নফসে মূলহেমার’ বলে। আল্লাহর প্রত্যক্ষ বাণী দ্বারা তার প্রতিটি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এই পর্যায়ের নফস পাপপুণ্যের ঊর্ধ্বে চলে যায়, কারণ যা আদেষ্ট হয় তাই করেন এবং মানবীয় গুণ সেখানে থাকে না।

ভাল কাজে কোন পুণ্য নেই, কারণ ভাল কাজে নিজের কোন কৃতিত্ব নেই। যেহেতু তার নিজ ইচ্ছা বা অনিচ্ছার প্রয়োগের বালাই নাই। মন্দের উল্লেখ করাই বাহুল্য। কারণ স্রষ্টা মন্দ কাজের আদেশ করেন না।

এই শ্রেণীর লোকেদের কাজ-কর্ম মানুষের সাধারণ বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। আপাতদৃষ্টিতে অন্যায় কোন কাজ তাদের থেকে প্রকাশ পেতে দেখলেও তাতে নিগূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করতে হবে।

নফসে রহমানিয়া:

একজন সাধক এই পর্যায়ে এসে পূর্ণ মুক্তি লাভ করে এবং পরম আত্মার স্বভাব লাভ করে অর্থাৎ সর্বদা বাকা-বিল্লার স্তরে অবস্থান করে এবং আল্লহর জাতের সাথে মিশে গিয়ে পূর্ণ অলিয়ত্ব অর্জন করে।

নফসের নিয়ন্ত্রণ

সৃষ্টিকর্তা রমজান মাসের প্রতিটি দিন, রাত, মুহূর্ত অশেষ রহমত, বরকতে পরিপূর্ণ করেছেন। রমজান হলো সেই পবিত্র মাস যা রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস বল বিবেচিত।

রমজানের সিয়াম সাধনা প্রকৃত অর্থে একটি প্রশিক্ষণ মাত্র। যার মাধ্যমে মুত্তাকি হওয়া যায়। শরিয়তের ভাষায় সব পাপাচার, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার থেকে বিরত হয়ে জীবন পরিচালনার নাম ‘তাকওয়া’। যিনি তাকওয়া অর্জন করে তাকে বলে ‘মুত্তাকি’।

আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর নৈকট্যার্জনে সিয়ামের অবদান সবচেয়ে বেশি। আত্মিক, বাহ্যিক, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বহুবিধ কল্যাণে সিয়াম পরিপূর্ণ। সিয়াম আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধিতা, ধৈর্য, তাকওয়া, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে।

সিয়ামের মাধ্যমে মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয় এবং অন্তরে আল্লাহর আজমত ও মহাত্বের প্রভাব পড়ে। এজন্য প্রয়োজন সর্বোৎকৃষ্ট মানের সিয়াম সাধনা তথা সিয়ামের শতভাগ হক আদায় করা।

ইমাম গাজ্জালী সিয়াম সাধনাকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন-

১. নিম্ন শ্রেণীর সিয়াম।
২. মধ্যম শ্রেণীর সিয়াম।
৩. উঁচু শ্রেণীর সিয়াম।

নিম্ন শ্রেণীর সিয়াম:

শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা। গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার চিন্তা থাকে না।

মধ্যম শ্রেণীর সিয়াম:

পানাহার প্রভৃতি থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব পাপ থেকে আত্মরক্ষা করা। যেমন- মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখা, অনর্থক কথা বলা, মিথ্যা, গিবত প্রভৃতি থেকে বিরত থাকা। চোখকে হারাম দর্শন থেকে সংযত রাখা। সিয়াম শত গুণে প্রশংসনীয়।

উচ্চ শ্রেণীর সিয়াম:

এ শ্রেণীর সিয়ামে পানাহার প্রভৃতি থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ-প্রতঙ্গকে পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। অপরদিকে মনকেও কুপ্রভাব, কুচিন্তা থেকে পবিত্র রেখে স্রষ্টার ধ্যান ও ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে সিয়ামকে সমৃদ্ধ করা হয়। এটিই সিয়ামের প্রকৃত হকিকত।

স্রষ্টার প্রেমিকরাই সিয়ামের হকিকত উপলব্ধি করতে পারেন তদনুযায়ী আমল করে থাকেন। সিয়ামের মাধ্যমে তারা নফসে আম্মারাকে ধ্বংস করেন। দৈহিক ভোগ-বিলাসের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা মানব হৃদয়ে জাগ্রত হয় তাই নফসে আম্মারা বা ভোগাত্মা।

মানুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে সে ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রেখে তা ইলম, আকল ও রুহের মাধ্যমে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। নাকি নফসের কামনা-বাসনার ওপর ছেড়ে দেবে। মানুষের ইন্দ্রিয়কে বশে রাখার জন্য সিয়াম সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার। যার নিদর্শন পাওয়া যায় সুফি সাধক ও অলি-আউলিয়াদের জীবনে।

এর কাজ মানবাত্মাকে বিভ্রান্ত করা এবং আত্মিক বা আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। জাগতিক লোভ-লালসা কামনা-বাসনা থেকে মোহমুক্ত না হতে পারলে মহাপ্রভুর সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব হয় না।

কোরানে বলা হয়েছে, নিশ্চয় নফসে আম্মারা মানুষকে বিপথগামী করে। এ অর্থেই নবীজী বলেছেন, প্রতিটি মানব সন্তানের সঙ্গে একটি করে শয়তান রয়েছে।

সিয়ামের মূল হকিকত নফসের কামনাকে সংযত করা এবং নিজের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। মানুষের দশ ইন্দ্রিয় যেমন সৎ কাজে তেমনি পাপ কাজের জন্য সমান উপযোগী। এসব ইন্দ্রিয় পথেই মানুষ আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়, আবার নাফরমানিও করে।

মানুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে সে ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রেখে তা ইলম, আকল ও রুহের মাধ্যমে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। নাকি নফসের কামনা-বাসনার ওপর ছেড়ে দেবে। মানুষের ইন্দ্রিয়কে বশে রাখার জন্য সিয়াম সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার। যার নিদর্শন পাওয়া যায় সুফি সাধক ও অলি-আউলিয়াদের জীবনে।

বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী বলেছেন, পানাহার এবং যা কিছু করলে সিয়াম ভঙ্গ হয়; তা করা থেকে বিরত থাকা শরিয়তের সিয়াম। অপর পক্ষে হারাম, কুপ্রবৃত্তি, লোভ-লালসা ও নিষেধ হওয়া সব কার্যাবলী থেকে বিরত থাকা তরিকতের সিয়াম।

এ সব বজর্নীয় কাজের কোনো একটি করলে, তরিকতের সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়। শরিয়তের সিয়াম নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, কিন্তু তরিকতের সিয়াম আজীবন। হজরত ঈসা তার সঙ্গীদের বলেছিলেন, পেটকে ক্ষুধার্ত রাখ, কলিজাকে রাখ পিপাসার্ত। এতে হৃদয়ের চোখ দিয়ে তোমাদের প্রভুকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবে।

সিয়াম সাধনা হলো আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহ প্রাপ্তির হাতিয়ার। তাই বছর ঘুরে রমজান বা সিয়াম আসে। মূলত রমাজান একটি প্রশিক্ষণের মাস, দীর্ঘ একমাস প্রশিক্ষণ নিতে হয় বাকি ১১ মাস কিভাবে চলতে হবে। তাই সুফি সাধকরা এ মাসে কঠোর সিয়াম সাধনায় ব্রত হন।

সিয়ামের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবীজী বলেছেন, সিয়াম পালনকারী দ্বিবিধ আনন্দ উপভোগ করে। একটি ইফতার করার সময় অন্যটি আল্লাহর দিদার লাভ করার সময়।

নবীজী বলেছেন, ‘সিয়ামরত অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশালীন ও অর্থহীন কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়। কেউ যদি তাকে অশালীন কথা বলে কিংবা তার সাথে অকারণে বাদানুবাদে লিপ্ত থেকে চায়, তবে সে যেন এ কথা বলে দেয় যে, আমি রোজাদার।’

তিনি আরোও বলেছেন, ‘যে রোজা রেখেছে অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি তার এই কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই।’ (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সওম-১৯৩৭/১৯৩৮)

বস্তুত যে সিয়াম তাকওয়া তথা স্রষ্টাভীতি ও হৃদয়ের পবিত্রতা শূন্য এবং চারিত্রিক মাহাত্ম্য ও চিন্তার বিশুদ্ধতা বঞ্চিত, সে সিয়াম হচ্ছে প্রাণহীন এক দেহ; যা শুধু স্বাস্থহীনতা ও দূর্গন্ধই ছড়ায়।

নবীজী বলেছেন, ‘অনেক সিয়াম পালনকারী এমন যাদের ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা সার হয়েছে। তদ্রূপ অনেক ইবাদতকারী এমন যাদের বিনিদ্র রাত কাটানো ছাড়া আর কিছুই অর্জন হয় না। (সহীহ ইবনে হিব্বান-৩৫৬৩, সহীহ ইবনে খুযাইমা-১৮৮০, মুসতাদরাক-১৫০২, মুসনাদে আহমদ-৯৪৭২)

সিয়াম সাধনা হলো আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহ প্রাপ্তির হাতিয়ার। তাই বছর ঘুরে রমজান বা সিয়াম আসে। মূলত রমাজান একটি প্রশিক্ষণের মাস, দীর্ঘ একমাস প্রশিক্ষণ নিতে হয় বাকি ১১ মাস কিভাবে চলতে হবে। তাই সুফি সাধকরা এ মাসে কঠোর সিয়াম সাধনায় ব্রত হন।

তরিকায় নামাজ রোজা>>

……………………………
পুনপ্রচারে বিনীত: আবুতালেব পলাশ আল্লী
মা শাহে সেতারার রওজা বা দরবার শরিফ
খুলনা, বাংলাদেশ।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………
আরও পড়ুন-
দোজখ
নফসের সংযম
স্রষ্টা থেকে সৃষ্টির আবির্ভাব
মোরাকাবা-মোশাহেদা
নফসের পঞ্চস্তর
তরিকায় নামাজ রোজা
তরিকায় জাকাত
দেহতত্ত্বে লতিফা ও চক্র ভেদ
সাধনার ধারা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!