ভবঘুরেকথা

সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: আট

কালী নাম-

মহাসংহার-সময়ে কাল সকলকে গ্রাস করে, আমি সেই কালকে গ্রাস করি বলে আমার নাম কালী।

‘কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়তে।’

অর্থাৎ কাল এবং আদিভূতা বলে আমি কালীনামে গীত হই।

আমি বাক্যের অতীতা- মনের অগম্যা, সাকারা হয়েও নিরাকারা, মায়া অবলম্বনে বহু রূপ ধারণ করি। আমি সকলের আদি, অনাদি, আমি কর্ত্রী, আমি হর্ত্রী।

মা তোর কালীমূর্তি অমন ভয়ঙ্করী কেন?

যারা পাপী তারা আমায় ভীষণা দেখে, ভয় পায়, ভক্তরা ভীষণা দেখে না- ভয় পায় না, ব্যাঘ্রীকে দেখলে অন্য সকলে ভীত হয়, বাঘিনীর ছেলে মা’র প্রসন্ন মুখ দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

ওরে, অসুর সংহার করবার জন্য ঐরূপ মূর্তি ধারণ করতে হয়।

তোদের কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মাৎসর্য্য রূপ শত্রুগুলোকে, অজ্ঞানরূপ মহাশত্রুকে ভীষণ মূর্তি ধারণ করে সংহার করি- আর স্নেহময়ী, প্রেমময়ী মা হয়ে কোলে করে স্তন্য পান করাই।

তুই কেবল মা মা করে ডাক, তাহলে আমাকে ভয়ঙ্করী দেখবি না- অতিসুন্দর নয়ন-মন-বিমোহন আমার রূপ দেখে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বি।

বল- কালী কালী কালী।
জয় মা জয় মা জয় মা।।

হ্যাঁ মা তুই অপবিত্র শ্মশান কেন ভালোবাসিস?

শ্মশান বড় পবিত্র স্থান, তাই শ্মশানে থাকতে ভালবাসি।

শ্মশানে মড়া পোড়ান হয়, শ্মশান পবিত্র হল কি করে?

জগতের কতকগুলো জিনিষ আছে বাইরে পবিত্র অন্তরে অপবিত্র, আর কতকগুলি আছে অন্তরে পবিত্র বাইরে অপবিত্র।

গন্ধদ্রব্য, উত্তম শয্যা, বসন-ভূষণ, উত্তম খাদ্যদ্রব্য- এসব বাইরে পবিত্র হলেও তার দ্বারা রজঃ তমোগুণ বৃদ্ধি পায়, এ জন্য অন্তরে অপবিত্র।

সেরূপ উত্তম অট্টালিকা প্রভৃতি ইহলোকের সুখের উপকরণ যা কিছু সব অন্তরে অপবিত্র, কেননা তাতে কামনা বাড়ে।

আর শ্মশান বাইরে অপবিত্র হলেও শ্মশান দেখলে মনের অপবিত্র ভাব দূর হয়ে যায়,কামনা বাসনা পলায়ন করে। শত শত তীর্থ ভ্রমণে যা না হয়, শ্মশানে কিছুদিন যদি মানুষ থাকে তা’হলে তার সহস্রগুণ পুণ্য লাভ হয়। কামনা শূন্য হৃদয়ে মহাশক্তি উপস্থিত হয়। তাই আমার শঙ্কর ও আমি শ্মশানেই বাস করি।

শ্মশান তাহলে খুব পবিত্র স্থান!

হ্যাঁ।

আচ্ছা, তুই মানুষের দেহেও থাকিস- মানুষের দেহে শ্মশান কোথায়?

ইড়া, পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে শুষুম্না নাড়ীই শ্মশান। সেই শ্মশানে অবস্থান করে আপন মনে নাচি গাই, নাচতে নাচতে উপরে উঠি- নীচে নামি,আর আয় আয় বলে তোদের ডাকি।

তোর ডাক কি সব সময়ে সকলে শুনতে পায়?

না, যাদের চিত্ত শুদ্ধ হয়েছে, আমার শরণাগত, খুব নাম করেছে, তারা সব সময় শুনতে পায়। যারা অনন্য শরণ নয়, তারা শুনতে পায় যখন জপ করে।

যারা ডাকে না তাদের কাছে আমি ঘুমিয়ে থাকি। যারা অনুক্ষণ কেবল স্মরণ করে তাদের নিকট আমি সদা জাগ্রত হয়ে গান গেয়ে তাদের কর্মক্ষয় ও বাসনা-নাশ করে দিয়ে বুকে তুলে নিই, তারা গান শুনতে শুনতে আমার বুকে ঘুমিয়ে পড়ে।

নাম কর-কেবল নাম কর।

বল- কালী কালী কালী।

-মাতৃগাথা

 

গুণকীর্তন-

হে রঘুনন্দন! শুনেছি তোমার গুণকীর্তন করলে মানুষ অনায়াসে সংসার সাগর উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তাই তোমার গুণকীর্তন করতে আমার ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু তোমার যে অসীম গুণ, তা কীর্তন করবার সামর্থ তো আমার নেই, তথাপি কীর্তন করতে চাই!

ব্রম্ভা, মহেশ্বর, ইন্দ্রাদি দেবগণ, নারদাদি মহামুনিগণ, সনক সনন্দদাদি ঋষিগণ তোমার যে গুণগাঁথার পার প্রাপ্ত হন নি- আমি কীটাণুকীট, তা কি রূপে কীর্তন করব জানিনা কিন্তু বড় ইচ্ছা করছে।

হে গুনাতীত! সত্ব রজ তম এই তিন গুণের পরপারে তুমি অবস্থিত।

তোমার ইক্ষণেই গুণত্রয়ের সাম্যবস্থা রূপিণী প্রকিতি এ বিরাট ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। তোমার শক্তিতেই এই গুণত্রয় শক্তিমান হয়ে জগৎকার্য চালাচ্ছে।

মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত গুণাতীত হতে না পারে, ততক্ষণ তোমায় জানতে পারে না।

গুণাতীত হলে তবে গুণাতীত তোমায় স্পর্শ করতে পারে। সে অবস্থা লাভ করতে হলেও তোমার ভক্ত হওয়ার প্রয়োজন, তোমাকে একান্ত আশ্রয় করা ভিন্ন গুণাতীত কেউ হতে পারে না- তোমার ভক্ত কে তুমি সব ই দাও।

তুমি আমায় ভক্ত করে ফেল। আমি তোমার ভক্ত হয়ে নিশ্চিন্ত হই।

ভক্তের প্রতি তোমার অভয়বাণী শুনলে প্রাণ এ আশার সঞ্চার হয়- ‘কৌন্তেয়! প্রতিজানিহি ন মে ভক্ত প্রণশ্যত’- ‘অর্জুন! তুমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারো আমার ভক্ত বিনাশপ্রাপ্ত হয় না।’

-প্রপন্ন পথিক

 

ওঙ্কার

দেখরে আমি আমার ভক্তকে আত্মদান করবো বলে আমার বশীকরণ ও আকর্যণের পরমমন্ত্র নাম করবার কথা, নামের মহিমা বহু শাস্ত্রে বলেছি। আহা! জীব আমাতে থেকে আমাকে ভুলে গিয়ে আমাকে না দেখে কত যন্ত্রণা পায়; তাই ডাকি আর বলি, ওরে নাম কর, নাম কর।

যে নাম করবার জন্য রসনা পেয়ে নাম না করে অন্য বৃথা বাক্য মিথ্যা কথা বলে, যে জিহ্বা ‘শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ শ্রীকৃষ্ণ’ এ নাম কীর্ত্তন না করে, রোগ শোক দুঃখ দারিদ্র্যবিবর্দ্ধিনী অধোগতিদায়িনী সে জিহ্বা শত খণ্ড হয়ে পতিতা হোক।

সত্যই যে জিহ্বা তোমার নাম না করে তার পতিত হওয়াই প্রয়োজন! মাত্র ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ উচ্চারণ করলে ধর্ম্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ-দাতা কল্পতরু প্রেমময় শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা যায়,তথাপি তা যে করে না তার থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।

তুই আমার নামমাহাত্ম্য শুনতে ভালোবাসিস? নামমাহাত্ম্য শুনলে কি হয় জানিস?

না, তুমি বল।

যে মানব প্রাতঃকালে উঠে আমার নাম মাহাত্ম্য পাঠ করে, আমি তার পরম মঙ্গলদাতা হই-এ সম্বন্ধে কোন সংশয় নাই।

তা না হলে লোকে তোমায় কৃপাময় বলবে কেন? কেহ যদি নামও না করতে পারে কেবল তোমার নামমাহাত্ম্য পাঠ করে, তাহলেও সে সুখ মঙ্গল লাভ করতে সমর্থ হয়। অপূর্ব্ব করুণা।

আচ্ছা, আরও শোন-

শ্রীকৃষ্ণনামমাহাত্ম্য ত্রিসন্ধ্যায় যে পাঠ করে, সে ইহলোকে সমস্ত বাঞ্ছিত কাম্যবস্তু লাভ করে ও মরণের পর পরমগতি প্রাপ্ত হয়!

হে লীলাময়! জীবগণ যে তোমায় ভুলে থাকে তার কারণ তো তুমি, তুমি যদি দয়া কর তাহলে আর কি জীব তোমায় ভুলে থাকতে পারে? তুমি দয়া কর, দয়া কর; জগতের প্রতি কৃপাদৃষ্টিপাত কর।

কৃপা করা ভিন্ন আমার দ্বিতীয় কর্ম নাই।

যা কিছু দেখছ, সবই ওঙ্কার, কিন্তু শাস্ত্র সকলকে ওঙ্কারের অধিকার দেন নাই। যতক্ষণ বহু দর্শনের ইচ্ছা মন থেকে একেবারে মুছে না যায়, ততক্ষণ কেহ ওঙ্কারের অধিকারী হতে পারেন না। ওঙ্কার ব্রহ্ম, যার যে ভাব, সেই ভাব বাড়িয়ে দেন। কামী ওঙ্কার জপ করলে কাম বাড়বে, ক্রোধী ওঙ্কার জপ বাড়লে ক্রোধ বাড়বে।

একবার ব্রহ্মার কাছে দেবগণ, মহর্ষিগণ, অসুরসমূহ ও সর্পসকলে গিয়ে উপদেশ প্রার্থনা করেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা বলেন- ‘ওঁ’। সেই ওঙ্কারের উপাসনায় দেবগণের দানপ্রবৃত্তি, মহর্ষিগণের দমগুণ বৃদ্ধি হয়েছিল, আর অসুরগণের দম্ভভাব, সর্পগণের দংশনপ্রবৃত্তি বেড়েছিল।

প্রথমে সগুণ মন্ত্রের উপাসনার দ্বারা সগুণ সাক্ষাৎকার হয়। শ্রীভগবানের দর্শনের পর সগুণ মন্ত্র তাঁর অঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। তখন স্বতঃই ওঙ্কার আবির্ভূত হন। সে সময় আর স্ত্রী, শূদ্র, চাঁড়াল, চোয়ার, হাড়ি, ডোম কোন ভেদ থাকে না।

কিন্তু সগুণ সাক্ষাৎকার না করে যিনি ওঙ্কার আশ্রয় করতে যান,তাঁর দুর্গতির সীমা থাকে না। রিপুর পীড়ন, মান, সম্ভ্রম, প্রতিষ্ঠা,কামিনী, কাঞ্চন তাকে পেয়ে বসে। জনমটাই ব্যর্থ হয়ে যায়।

বেশী কথা কি, কুটীচক, বহূদক, হংসের পর্য্যন্ত গায়ত্রীর অধিকার, পরমহংসই ওঙ্কারের অধিকারী। অধিকার জোর করে হয় না। ভগবদ্দর্শনেই আপনা আপনি সমস্ত কর্ম্ম গলিত হয়ে যায়। মন্ত্র থাকে না, নাদাত্মক জ্যোতির্ময় ওঙ্কার হৃদয়কমলে আনন্দ দিতে দিতে পরমব্রহ্মে একীভূত করে দেন।

-শ্রীশ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেব

সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: নয়>>

……………….
আরও পড়ুন-
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: এক
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: দুই
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: তিন
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: চার
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: পাঁচ
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: সাত
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: আট
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: নয়

……………….
আরও পড়ুন-
মহানবীর বাণী: এক
মহানবীর বাণী: দুই
মহানবীর বাণী: তিন
মহানবীর বাণী: চার
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: এক
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: এক
গৌতম বুদ্ধের বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: তিন
গৌতম বুদ্ধের বাণী: চার

গুরু নানকের বাণী: এক
গুরু নানকের বাণী: দুই
চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী
কনফুসিয়াসের বাণী: এক
কনফুসিয়াসের বাণী: দুই

…………………….

আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!