ভবঘুরেকথা
রূপের রহস্য ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: পঞ্চম পর্ব

অমী হি ত্বাং সুরসঙ্ঘা বিশন্তি
কেচিদ্ ভীতাঃ প্রাঞ্জলয়ো গৃণন্তি।
স্বস্তীত্যুক্ত্বা মহর্ষিসিদ্ধসঙ্ঘাঃ
স্তুবন্তি ত্বাং স্তুতিভিঃ পুষ্কলাভিঃ।।২১।।

সমস্ত দেবতারা তোমার শরণাগত হয়ে তোমাতেই প্রবেশ করছেন। কেউ কেউ ভীত হয়ে করজোড়ে তোমার গুণগান করছেন। মহর্ষি ও সিদ্ধেরা ‘জগতের কল্যাণ হোক’ বলে প্রচুর স্তুতি বাক্যের দ্বারা তোমার স্তব করছেন।

রুদ্রাদিত্যা বসবো যে চ সাধ্যা
বিশ্বেহশ্বিনৌ মরুতশ্চোষ্মপাশ্চ।
গন্ধর্বযক্ষাসুরসিদ্ধসঙ্ঘা
বীক্ষন্তে ত্বাং বিস্মিতাশ্চৈব সর্বে।।২২।।

-রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, সাধ্য নামক দেবতারা, বসুগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, মরুতগণ, পিতৃগণ, গন্ধর্বগণ, যক্ষগণ, অসুরগণ ও সিদ্ধগণ সকলেই বিস্মৃত হয়ে তোমাকে দর্শন করছে।

রূপং মহত্তে বহুবক্ত্রনেত্রং
মহাবাহো বহুবাহূরুপাদম্।
বহূদরং বহুদংষ্ট্রাকরালং
দৃষ্ট্বা লোকাঃ প্রব্যথিতাস্তথাহম্।।২৩।।

হে মহাবাহু! বহু মুখ, বহু চক্ষু, বহু বাহু, বহু ঊরু, বহু চরণ, বহু উদর ও অসংখ্য করাল দন্তবিশিষ্ট তোমার বিরাটরুপ দর্শন করে সমস্ত প্রাণী অত্যন্ত ব্যথিত হচ্ছে এবং আমিও অত্যন্ত ব্যথিত হচ্ছি।

নভঃস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং
ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্।
দৃষ্ট্বা হি ত্বাং প্রব্যথিতান্তরাত্মা
ধৃতিং ন বিন্দামি শমং চ বিষ্ণো।।২৪।।

হে বিষ্ণু! তোমার আকাশষ্পর্শী, তেজোময়, বিবিধ বর্ণযুক্ত, বিস্তৃত মুখমন্ডল ও উজ্জ্বল আয়ত চক্ষুবিশিষ্ট তোমাকে দেখে আমার হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে এবং আমি ধৈর্য ও শম অবলম্বন করতে পারছি না।

দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি
দৃষ্ট্বৈব কালানলসন্নিভানি।
দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম
প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস।।২৫।।

হে দেবেশ! হে জগন্নিবাস! ভয়ংকর দন্তযুক্ত ও প্রলয়াগ্নি তুল্য তোমার মুখসকল দেখে আমার দিকভ্রম হচ্ছে এবং আমি শান্তি পাচ্ছি না। তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও।

আবার মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স) এর সাথে আল্লাহর সাক্ষাতের পর্বটি পরিচিত ‘মেরাজ’ নামে। এই সাক্ষাতের সময়কাল এবং ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে নানা মতভেদ আছে। কোরানে সরাসরি এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তারপরও কিছু আয়াতে এর উল্লেখ রয়েছে-

আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘অতঃপর তিনি নিকটে এসেছেন এবং অতীব নিকটবর্তী হয়েছেন। এমনকি দুই ধনুকের মত নিকটবর্তী হয়েছেন, এমনকি আরও অধিকতর নিকটবর্তী হয়েছেন।’ (সুরা নজম : ৮-৯)

আল্লাহর সাক্ষাৎ সম্পর্কে কোরানে উল্লেখ, ‘তিনি যা দেখেছেন অন্তর তাকে অস্বীকার করেনি।’ (সুরা নজম : ১১)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর দৃষ্টি বক্র হয়নি এবং লক্ষচ্যুত হয়নি।’ (সুরা নজম : ১৭)

বিভিন্ন হাদিসে মেরাজের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া গেলেও নবীজীর আল্লাহ দর্শন সম্পর্কে সে ভাবে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সেই রূপ দর্শনের বিবরণ সেভাবে নেই। তবে আল্লাহ কর্তৃক বিভিন্ন আদেশ-উপদেশ ও বিধান তিনি পান এই সাক্ষাতে।

রূপের রহস্যে এই রূপ দর্শন যে কেবল স্রষ্টা থেকে জীবে সীমাবদ্ধ তাই নয়। এই রূপ দর্শনের বিস্তার ব্যাপক। প্রকৃতি থেকে জড় সকল কিছুরই রূপ দেখে মানুষ মুগ্ধ হতে পারে। জীব-জড় সকলের রূপই যেমন মানুষকে মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। তেমনি প্রকৃতির প্রেমেও মানুষ নিজেকে।

হিসেব অনুযায়ী সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডতেই আছে সৃষ্টির অধিকার। তারপরও মানুষ নিজের নিজের বিবেচনায় ধারীত্রির সকল কিছুকেই ভাগাভাগি করে নিয়েছে। যার যতটা ক্ষমতা সে ততটা চায়। আবার যার যত আছে সে আরো চায়। এরই মাঝে পৃথিবীর ভূমি-জল-পাহাড়-সমুদ্র-বন-জঙ্গল-দ্বীপ সকল কিছুরই বিক্রি বাট্টা সারা হয়ে গেছে।

এতো সব ভাগাভাগি-অন্যায়-অত্যাচারের পরও মানুষ সামান্য একটা ফড়িং দেখে, একটা ছোট্ট বনফুল দেখে বা একটা পাখি দেখে মুগ্ধ হয়। রূপে মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টি করে কত শত শিল্প। সেই শিল্পের রূপ দেখে আবার কত জনায় হয় বিমোহিত।

কে যে কখন কোন রূপ দেখে কিসের প্রেমে পরবে তা বলা মুশকিল। দৃশ্যমান জগতের সকল কিছুই তো রূপ। যা আমাদের দৃষ্টি ফ্রেমবন্দী করে প্রতি মুর্হূতে। সচেতন ভাবে সব মনে না থাকলেও সঞ্চিত সংস্কারের ভাণ্ডারে তা গচ্ছিত থেকে যায়।

সে কারণে বহু দিন পর দেখা হলে। সেই পুরানো দৃশ্য স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। আবার অনেককে ঠিক চিনে উঠতে পারি না সময়ের প্রবাহে। আবার অনেককে গুলিয়ে ফেলি পরিচিত অন্য কারো সাথে।

শুধু কি ব্যক্তি? সকল দৃশ্যমান অস্তিত্বের সাথেই আমাদের এমন সম্পর্ক। আমরা প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হই। দেশের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়। আর দেশের রূপের কথা আসলে যে গানটা সবার আগে মনে আসে সেটা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়-

হায়রে আমার মন মাতানো দেশ
হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি
রূপ দেখে তোর কেন আমার
নয়ন ভরে না
তোরে এত ভালোবাসি তবু
পরান ভরে না।।

যখন তোর ঐ গাঁয়ের ধারে
ঘুঘু ডাকা নিঝুম কোন দুপুরে
হংস মিথুন ভেসে বেড়ায়
শাপলা ফোটা টলটলে ঐ পুকুরে
নয়ন পাখি দিশা হারায়
প্রজাপ্রতির পাখায় পাখায়
তাদের কথা মনে ধরে না।।

যখন তোর ঐ আকাশ নীলে
পাল তুলে যায় সাত সাগরের পসরা
নদীর বুকে হাতছানি দেয়
লক্ষ জেলে মানিক জ্বালা ইশারায়
হায়রে আমার বুকের মাঝে
হাজার তারের বীণা বাঁজে
অবাক চোখে পলকপড়ে না।।

প্রকৃত প্রেমিকের কাছে যেমন প্রেমিকাকে এক ঝলক দেখবার আকুতি পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েই মেটে না। তেমনি গুরুবাদীদের মাঝে গুরু রূপ দেখবার আকুতি। বিশ্বাসীদের স্রষ্টাকে বা তার পয়গম্বর বা অবতার দেব-দেবীকে মোটকথা আরাধ্য বা ইষ্ট দেবকে দেখবার বাসনা সমান।

আবার যে চোখ দিয়ে মানুষ দেখে, দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কে ধারণা নেয়। সেই চোখ দেখে আবার সেই ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়। অনেকে বলেন, মানুষের স্বভাব-চরিত্র সবকিছুই তার চোখে ফুটে উঠে। ধুর্ত বা চতুর না হলে মানুষ তার স্বভাব-চরিত্র চোখে দৃশ্যমান হওয়া থেকে আটকাতে পারে না।

যে জন শুদ্ধ তার চোখ দেখলেই চেনা যায়। ফকির লালন সাঁইজি এ প্রসঙ্গে বলেছেন-

শুদ্ধ প্রেমের প্রেমিক মানুষ যে জন হয়।
মুখে কথা কউক বা না কউক
নয়ন দেখলে চেনা যায়।।

রূপে নয়ন করে খাঁটি
ভুলে যায় সে নাম মন্তটি,
চিএগুপ্ত পাপ পুণ্য তার
কি লিখবেন খাতায়।।

মণীহারা ফণী যেমন
প্রেম রসিকের দুটি নয়ন,
কি করতে কি করে সে জন
অন্ত নাহি বোঝা যায়।।

সিরাজ সাঁই কয় বারে বারে
শোনরে লালন বলি তোরে,
মদন রসে বেড়াও ঘুরে
সে ভাব তোমার কৈ দাঁড়ায়।।

আবার লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে হয় অন্যদিকে তাকিয়ে!’

(চলবে…)

পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : ষষ্ঠ পর্ব >>

…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!