ভবঘুরেকথা
রূপের রহস্য ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: ষষ্ঠ পর্ব

সাধু মতে, রূপের রহস্যের জগতে দেখাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দৃষ্টি। আর এই তিন মিলে পায় দেখার পূর্ণতা। আর যারা দেখাকে তিন ভাগে ভাগ করে দেখতে সক্ষম হয় তারাই এর ‘রূপ’ ইন্দ্রিয়ের স্বরূপ প্রকৃতভাবে বুঝতে পারে।

দ্রষ্টার স্বভাব কেবল বা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ করা বা দেখা। যাকে আমরা বলি উইটনেস বা অবজারভার। শুধু দেখে যাওয়া… দেখে চলা…।

যা কিছু দৃশ্যমান হয়, তার প্রতি আসক্ত না হয়ে কেবল দেখে যাওয়াই দ্রষ্টার কাজ। দ্রষ্টা ভাব কোনো প্রতিকৃয়া দেয় না। কেবল দেখে যায়। দ্রষ্টা ভাব সূক্ষ্ম দেহে বিরাজ করে। স্থূল দেহের চোখ দিয়ে দেখতে গেলে মোহ মায়ার বন্ধন সৃষ্টি হয়। কিন্তু আসক্তি শূন্য হয়ে দেখতে পারলেই দ্রষ্টা ভাব জাগ্রত হয়।

দ্রষ্টা ভাব জাগ্রত করার জন্য সাধককে রূপ দেখার সময় ভাবতে হয়- দৃশ্য জগৎ আমি নই; এই দৃশ্য জগৎও আমার নয়। অবিদ্যা অর্থাৎ সঞ্চিত সংস্কার দ্রষ্টা ভাব থেকে আমাদের দূরে রাখে। এই অবিদ্যা দূরীভূত হলে সাধকের দ্রষ্টা ভাব উদিত হয়।

দেখার দ্বিতীয় ভাব হলো দৃশ্য। দ্রষ্টার জন্য যা কিছু দৃশ্যমান হয় নাই দৃশ্য। যা কিছু প্রকাশ্য তাই দৃশ্য। তবে এই দৃশ্য কিন্তু কল্পনাকেও হতে পারে। অর্থাৎ জীব যা কিছুর দৃশ্যায়ন দেখে জাগ্রত, ঘুমন্ত বা সুষুপ্ত অবস্থায় সবই দৃশ্য।

আর তৃতীয় হলো দৃষ্টি অর্থাৎ যা দিয়ে দেখা হয়। এই দৃষ্টিকে বোঝে বেশ শক্ত কারণ এটি বুঝতে গেলে গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন। গভীর ভাবের প্রয়োজন। সহজ ভাবে বলতে গেলে, দেখবার যে সক্ষমতা তাকে বলে দৃষ্টি। কোনো কিছু অবলোকন করা দৃষ্টি নয়। অবলোকন করার যে শক্তি সেটা হলো দৃষ্টি।

ফকির লালন সাঁইজি এই কথাগুলো সহজভাবে বলেছেন-

এই বেলা তোর ঘরের খবর
জেনে নে রে মন,
কেবা জাগে কেবা ঘুমায়
কে কারে দেখায় স্বপন।।

শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়
নিঃশব্দে কে আছে সদাই,
যেদিন হবে মহাপ্রলয়
কে কার করে দমন।।

দেহের গুরু আছে কেবা
শিষ্য হয়ে কে দেয় সেবা,
যেদিনে তাই জানতে পাবা
কোলের ঘোর যাবে তখন।।

যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে
কোনখানে সে বসে আছে,
সিরাজ সাঁই কয় তাই না খুঁজে
দিন তো বয়ে যায় লালন।।

অন্যদিকে বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘রূপ জিনিসটার এমন একটা আকর্ষণীয় শক্তি আছে যে, স্ত্রী-পুরুষ, ফল-পুষ্প, জন্তু-জানোয়ার, আকাশ-সমুদ্র যেখানেই তাহার আবির্ভাব ঘটুক না কেন তাহা মানুষকে মুগ্ধ করে।’

সাধনায় ধ্যান একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ধ্যান মানে নিজেকে কেন্দ্রীভূত করে গভীর ভাবে কিছুকে দেখতে চাওয়া বা দর্শনের প্রত্যাশা। সেই দেখা কোনো জাগতিক দেখা নয়। এমনই কিছু দেখবার চেষ্টা যা খোলা চোখে দেখা যায় না। বা যা কল্পনাতেও দেখা যায় না। এমনকি সেই দৃশ্য যা বাস্তবে গড়ে দেখলেও চলে না।

সে এমনই দেখা, যে দেখা দেখবার জন্য, দেখবার যে অঙ্গ অর্থাৎ চোখ; তাকেই বন্ধ করে রাখতে হয়। এটাই বিধান। বলা হয়, জগৎ থেকে বিযুক্তি ঘটাতে, নিজেকে নিজের মাঝে কেন্দ্রীভূত করের জন্য চোখের পাতা বন্ধ করা সবচেয়েই সহজ ও প্রাথমিক পথ।

এ কারণে সাধারণভাবে ধ্যান বা মেডিটেশনে প্রবেশের জন্য সকলেই চোখ বন্ধ করে রাখে। চোখ বন্ধ করলে ধীরে ধীরে বাইরের জগতের সাথে একটা আড়াল তৈরি হয়। সাধক ধীরে ধীরে তার চিন্তা-চেতনাকে তার নিজের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে।

তবে এই চোখ বন্ধ করা মানে কিন্তু দৃষ্টি বন্ধ করা নয়। এই চোখ বন্ধ করা মানে বাইরের জগতের সাথে নিজের একটা আড়াল তৈরি করা। এই আড়াল তৈরি করতে চোখ যে পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হয় তাও নয়। অনেক ধ্যানেই চোখ সম্পূর্ণ বন্ধ না করে খানিকটা খোলা রাখা হয়।

সাধককুল বলেন, চোখ বন্ধ করেই সাধক পায় প্রকৃত দৃষ্টি। যা দিয়ে সে অনন্তের দর্শন পায়। ব্রহ্মাণ্ডের দর্শন পায়। তথা নিজের দর্শন পায়। সেই প্রকৃত রূপ ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করতে চাই এই স্থূল দেহের রূপ দর্শনের ইন্দ্রিয় চোখকে বন্ধ করা।

তাতেই দৃষ্ট হয় ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ। নিজের স্বরূপ। গুরুর স্বরূপ। গুরুবাদীরা বলে, সেই ছবি যখন দৃষ্ট হয় তখন সাধক ইশকে মাতোয়ারা হয়ে যায়। তখন আর সাধক স্থির থাকতে পারে না। এ প্রসঙ্গে সাধক জালালুদ্দিন খাঁ লিখেছেন-

দেখলে ছবি পাগল হবি ঘরে রইতে পারবি না
এই চৌদ্দ ভুবনে আমার মর্শিদ মৌলানা।।

মোহন মুরতি বাবার, দেখলে পরে ঘোচে আধার
আরশ কুরসি সাগর পাহাড় দেখবার বাকি থাকেনা।।

যিশু ভাবে খৃষ্টানেরা ভাবে জিন-দেব জৈনেরা
হিন্দু ভাবে মদনমোহন, শ্রীনন্দের কেলে সোনা।।

এশ্ক ভাবে রাখিলে প্রাণ,পানি হয়ে যায় পাষাণ
নুরেরই তছল্লি-শান করিয়া দেয় দিল ফানা।।

বাহিরে পীরের ছবি, ভিতরে সেই নুরের নবী
ধ্যানের দেশে আল্লা হবি জালাল কহে ডুবে দেখনা।।

আসলে রূপ বড়ই বিভ্রান্তিকর এক ইন্দ্রিয়। এই যেমন কার যে কখন কাকে বা কোন কিছুকে ভালো লাগবে তার নিরূপণ করে বলা কঠিন। মানুষ যখন রূপের প্রেমে পরে তখন সে সেই মায়াজাল থেকে বের হতে পারে না। তখন তার মাঝে এমন এক ঘোরের সৃষ্টি হয় যে সে তার ভালো-মন্দ বিচারের ঊর্দ্ধে চলে যায়।

পৃথিবীর সকল মানুষও যদি সে সম্পর্কে নানান কথা বলে। প্রেমিককে নানাবিধ সতর্ক করার চেষ্টা করে বা কান ভারি করার চেষ্টা করে। তাতে প্রেমিকের কিচ্ছুটি আসে যায় না।

রূপ দর্শন এমনই একটি বিষয়। আপনার চোখে যে বিশ্বসুন্দর বা বিশ্বসুন্দরী অন্যে হয়তো তাকে ফিরেও দেখবে না। খেলাটা এখানেই। যার চোখে যাকে লাগে ভালো। আর রূপের কথা বলতে গেলে আরেক জন নারীর কথা না বললেই নয়।

যে নারী ইতিহাসে জায়গা করে বসে আছেন আপন মহিমায়। এতো শত বছর পরেও যিনি সকল রূপের আলোচনায় ঢুকে পরেন তিনি হলেন ‘মোনা লিসা’।

এই নারী আধুনিক সৌন্দর্যের বিচারে কতটা আকর্ষণীয় সে বিবেচনার চেয়েও তিনি ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময়ী নারী চরিত্র হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী তার জায়গা অটুট রেখেছেন। মোনা লিসার হাসি নিয়ে, মোনালিসাকে নিয়ে, মোনালিসা চিত্রকর্মকে, মোনালিসার স্রষ্টাকে নিয়ে যুগে যুগে বহুমুখী গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।

সেই সব জটিলতায় না গিয়ে রূপের সাথে সম্পর্কিত মোনা লিসা সম্পর্কে দুই এক কথা বলা যাক বরঞ্চ। ইতালীর শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির এক অনন্য সৃষ্টি মোনা লিসা। শিল্পী ১৬ শতকে এই ছবিটি আঁকেন।

(চলবে…)

পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : সপ্তম পর্ব >>

…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!