ভবঘুরেকথা
রূপের রহস্য ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: চতুর্থ পর্ব

তখন তিনি তার প্রাপ্ত জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চান মানবকুলে। কারণ মানবই সেই জ্ঞানকে ধারণ করতে সক্ষম। জন্মান্তরের লীলায় চুরাশি লক্ষ যোনীপথ অতিক্রম করে জীব মানবরূপ পায়। রূপের রহস্যে তাই মানবরূপ শ্রেষ্ঠ রূপ। কারণ এই রূপেই পারে সেই পরম রূপের দর্শনের সাধন করতে। সেই সাধনকে এগিয়ে নিতে।

রূপদর্শী সাধক তার প্রাপ্ত জ্ঞান দিয়ে জান জগতের কল্যাণে। যাতে মানুষ সেই রূপ দর্শনের একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারে। অনেক সময় সাধক সকলের জন্য তা প্রচার করে গেলেও। পরবর্তী নানা গোষ্ঠী-সম্প্রদায় সৃষ্টির ফলে তা তাদের মতো করে হতেও দেখা যায়।

তবে প্রকৃত প্রেমময় মন ঠিক ঠিকই তা থেকেই পায় সর্ব মানুষের সাধনপথ; সহজ পথ। ব্রহ্মাণ্ডের সাথে লীন হওয়ার পথ। ইশকে মাতোয়ারা হয়ে দেওয়ানা হওয়ার দিশা।

স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির এই সাক্ষাৎ নিয়ে বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে আছে নানা যুক্তি প্রমাণ। সাধুগুরুদের জীবনীতেও পাওয়া যায় অগনতি সব কাহিনী। সাধুগুরুরা যেখানে আপন আপন গুরুর মধ্য দিয়ে স্রষ্টার রূপ দর্শন করে। তেমনি আবার পয়গম্বর-অবতার-নবী-রাসুলেরা সরাসরি পান স্রষ্টার সান্নিধ্য।

কোরানে উল্লেখ আছে, ‘…সে তুর পাহাড়ের দিকে আগুন দেখতে পেল। …সে যখন আগুনের কাছে পৌঁছল, তখন ডান উপত্যকার কিনারায় অবস্থিত একটি বৃক্ষ থেকে ডাকা হলো- হে মুসা! আমিই আল্লাহ, জগৎসমূহের প্রতিপালক।’ (সুরা কাসাস: ২৯-৩০)

কোরানে আরো উল্লেখ আছে, ‘আমি মুসার জন্য ত্রিশ রাতের মেয়াদ স্থির করেছিলাম। তারপর আরও দশ রাত বৃদ্ধি করে তা পূর্ণ করি। …মুসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে এসে পৌঁছাল এবং তার প্রতিপালক তার সঙ্গে কথা বললেন, তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দিন আমি আপনাকে দেখব।

তিনি বললেন, তুমি আমাকে কিছুতেই দেখতে পাবে না। তুমি বরং পাহাড়ের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তা যদি আপন স্থানে স্থির থাকে, তবে তুমি আমাকে দেখতে পারবে। অতপর যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে তাজাল্লি (জ্যোতি) ফেললেন তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলল এবং মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেল।

পরে সংজ্ঞা ফিরে আসলে সে বলল, আপনার সত্তা পবিত্র। আমি আপনার দরবারে তওবা করছি এবং (দুনিয়ায় কেউ আপনাকে দেখতে সক্ষম নয়-এ বিষয়ের প্রতি) আমি সবার আগে ঈমান আনছি।’ (সুরা আরাফ: ১৪২-১৪৩)

আবার গীতায় স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজরূপে আবির্ভূত হয়ে শিষ্য অর্জুনকে দেন বিশ্বরূপ দর্শন। শ্রীমদ্ভভগবদগীতার এগারো অধ্যায় ‘বিশ্বরূপদর্শনযোগ’ এভাবে বর্ণিত আছে-

অর্জুন উবাচ
মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া দ্রষ্টুমিতি প্রভো।
যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মনমব্যয়ম্।।৪।।

হে প্রভু! তুমি যদি মনে কর যে, আমি তোমার এই বিশ্বরূপ দর্শন করার যোগ্য, তা হলে হে যোগেশ্বর! আমাকে তোমার সেই নিত্যস্বরূপ দেখাও।

শ্রীভগবানুবাচ
ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নং পশ্যাদ্য সচরাচরম্।
মম দেহে গুড়াকেশ যচ্চান্যদ্ দ্রষ্টুমিচ্ছসি।।৭।।

হে অর্জুন! আমার এই বিরাট শরীরে একত্রে অবস্থিত সমগ্র স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্ব এবং অন্য যা কিছু দেখতে ইচ্ছা কর, তা এক্ষণে দর্শন কর।

ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।।৮।।

কিন্তু তুমি তোমার বর্তমান চক্ষুর দ্বারা আমাকে দর্শন করতে সক্ষম হবে না। তাই, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করছি। তুমি আমার অচিন্ত্য যোগৈশ্বর্য দর্শন কর।

সঞ্জয় উবাচ
এবমুক্ত্বা ততো রাজন্ মহাযোগেশ্বরো হরিঃ।
দর্শয়ামাস পার্থায় পরমং রয়পমৈশ্বরম্।।৯।।

সঞ্জয় বললেন- হে রাজন্! এভাবেই বলে, মহান যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন।

অনেকবক্ত্রনয়নমনেকাদ্ভুতর্শনম্।
অনেকদিব্যাভরণং দিব্যানেকোদ্যতায়ুধম্।।১০।।
দিব্যমাল্যাম্বরধরং দিব্যগন্ধানুলেপনম্।
সর্বাশ্চর্যময়ং দেবমনস্তং বিশ্বতোমুখম্।।১১।।

অর্জুন সেই বিশ্বরূপে অনেক মুখ, অনেক নেত্র ও অনেক অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু দেখলেন। সেই রূপ অসংখ্য দিব্য অলঙ্কারে সজ্জিত ছিল এবং অনেক উদ্যত দিব্য অস্ত্র ধারণ করেছিল। সেই বিশ্বরূপ দিব্য মালা ও দিব্য বস্ত্রে ভূষিত ছিল এবং তাঁর শরীর দিব্য গন্ধ দ্বারা অনুলিপ্ত ছিল। সবই ছিল অত্যন্ত আশ্চর্যজনক, জ্যোতির্ময়, অনন্ত ও সর্বব্যাপী।

ততঃ স বিস্ময়াবিষ্টো হৃষ্টরোমা ধনঞ্জয়ঃ।
প্রণম্য শিরসা দেবং কৃতাঞ্জলিরভাষত।।১৪।।

তারপর অর্জুন বিস্মিত ও রোমাঞ্চিত হয়ে এবং অবনত মস্তকে ভগবানকে প্রণাম করে করজোড়ে বলতে লাগলেন।

অর্জুন উবাচ
পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে
সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্।
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থম্
ঋষীংশ্চ সর্বানুরাগাংশ্চ দিব্যান্।১৫।।

অর্জুন বললেন- হে দেব! তোমার দেহে দেবতাদের, বিবিধ প্রাণীদের, কমলাসনে স্থিত ব্রহ্মা, শিব, ঋষিদের ও দিব্য সর্পদেরকে দেখছি।

অনেকবাহুদরবক্ত্রনেত্রং
পশ্যামি ত্বাং সর্বতোহনন্তরূপম্।
নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং
পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ।।১৬।।

হে বিশ্বেশ্বর! হে বিশ্বরূপ! তোমার দেহে অনেক বাহু, উদর, মুখ এবং সর্বত্র অনন্ত রূপ দেখছি। আমি তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

কিরীটিনং গদিনং চক্রিণং চ
তেজোরাশিং সর্বতো দীপ্তিমন্তম্।
পশ্যামি ত্বাং দুনিরীক্ষ্যং সমস্তাদ্
দীপ্তানলার্কদ্যুতিমপ্রমেয়ম্।।১৭।।

কিরীট শোভিত, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিমান, তেজঃপুঞ্জ- স্বরূপ, দুর্নিরীক্ষ্য, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের মতো প্রভাবিশিষ্ট এবং অপ্রমেয় স্বরূপ তোমাকে আমি সর্বত্রই দেখছি।

ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং
ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্।
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা
সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে।।১৮।।

তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি অব্যয়, সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং সনাতন পরম পুরুষ। এই আমার অভিমত।

অনাদিমধ্যান্তমনন্তবীর্যম্।
অনন্তবাহুং শশিসূর্যনেত্রম্।
পশ্যামি ত্বাং দীপ্তহুতাশবক্ত্রং
স্বতেজসা বিশ্বমিদং তপন্তম্।।১৯।।

আমি দেখছি তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত নেই। তুমি অনন্ত বীর্যশালী ও অসংখ্য বাহুবিশিষ্ট এবং চন্দ্র ও সূর্য তোমার চক্ষুদ্বয়। তোমার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত অগ্নির জ্যোতি এবং তুমি স্বীয় তেজে সমস্ত জগৎ সন্তপ্ত করছ।

দ্যাবাপৃথিব্যোরিদমন্তরং হি
ব্যাপ্তং ত্বয়ৈকেন দিশশ্চ সর্বাঃ।
দৃষ্ট্বাদ্ভুতং রূপমুগ্রং তবেদং
লোকত্রয়ং প্রব্যথিতং মহাত্মন্।।২০।।

তুমি একাই স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তী অন্তরীক্ষ ও দশদিক পরিব্যাপ্ত করে আছ। হে মহাত্মন! তোমার এই অদ্ভুত ও ভয়ংকর রূপ দর্শন করে ত্রিলোক অত্যন্ত ভীত হচ্ছে।

(চলবে…)

পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : পঞ্চম পর্ব >>

…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!