ভবঘুরেকথা
রূপের রহস্য ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: সপ্তম পর্ব

রূপের রহস্যে এই ছবির রূপ দর্শন করে কেউ খুঁজে পান খুবই সাধারণ এক নারীকে। কেউ পান রহস্যময় হাসির এক অনন্য নারীকে। কেউ পান এর মাঝে লুকিয়ে থাকা নানা গুপ্ত ভাষা।

কেউ পান ভিন গ্রহের প্রাণীর চিত্র। অনেকে একে মাদার মেরি ভাবেন। অনেকে আবার ভাবেন এটি শিল্পীর নারী রূপের চিত্র।

অনেকে বলেন, ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে দেখলে ছবিটির হাসিটি পরিবর্তন হতে থাকে। আবার কেউ বলেন নারীটি মোটেও হাসছে না সে চিন্তিত। অনেকে আবার ছবিটির বিভিন্ন গুপ্ত বা লুকায়িত শব্দ বের করে তার সাথে তরঙ্গ যুক্ত করে সাউন্ড স্কেপ তৈরি করার চেষ্টা করেছে।

২০০৫ সালে এক বৈজ্ঞানিক পাস্কেল কটেল ছবিটি নিয়ে বেশকিছু তথ্য প্রকাশ করেন। এতে বলা হয়- যে রং দিয়ে মোনা লিসার ছবিটি আঁকা হয়েছিল তার স্তর চল্লিশ মাইক্রোমিটার ছিল। যার মানে হল একটি সরু চুলের থেকেও পাতলা এবং এই চিত্রটির মধ্যে আরও তিনটি চিত্র লুকিয়ে রয়েছে।

মোনা লিসার ডান হাতের কাছে গোপন একটি বার্তা দেওয়া আছে। অক্ষরগুলোর পরপর সাজালে হয় ‘La Risposta Si Trova Qui’ ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘The Answer Is Here’। মোনালিসার ছবিটি বর্তমানে রাখা আছে ফ্রান্সের ল্যুভ মিউজিয়ামে।

একটা শিশু কাঁদছে সেই রূপ ছবি কেনো মানুষ ঘরে ঘরে টানিয়ে বেড়াচ্ছে সেই ভেদ করা সহজ নয়। এই লেখার উদ্দেশ্যও তা নয়। মজার বিষয় হলো এই ছবিটিকে অনেকেই অভিশপ্ত ছবি হিসেবে চিহ্নিত করলেও তাকে অস্বীকার করতে পারেনি।

যুগে যুগে কেবল যৌবনাবতী নারীরাই রূপের মায়ায় জগৎ ভুলিয়েছে তা নয়। রূপ অর্থাৎ দর্শনে পিছিয়ে নেই কেহই। আবালবৃদ্ধবনিতা সকল বয়সের, সকল লিঙ্গের মানুষই এই রূপের ছটা ভুবন মাতিয়েছেন। মোনা লিসা যেমন পৃথিবীর বহু প্রান্তের, বহু সংস্কৃতির, বহু ভাষার মানুষ ভালোবেসে বাঁধাই করে পছন্দের দেয়ালে ঝুঁলিয়েছে।

তেমনি জগতের বহু সুন্দর, কুদসিদ, যুদ্ধবিগ্রহ, হাসি, তামাসা, আনন্দ, উল্লাস, দু:খ-কষ্ট প্রভৃতি নানা রূপের চিত্রকে ভালবেসেছে। কখন কোন পরিবেশে, কোন মনস্থিতি কোন রূপকে যে মানুষ ভালোবাসবে দেখে হতবাক হবে তা নিশ্চিত করে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

চিত্রের কথা যখন উঠলোই তখন বিখ্যাত ‘ক্রাইং বয় পেইন্টিং’ নিয়েও কয়েক কথা বলতেই হয়। মানুষ সাধারণত গৃহে এমন কিছু প্রদর্শন করতে চায়। যা দেখে মন আনন্দে ভরে উঠে। কিন্তু গত শতকে এক ক্রন্দনরত শিশুর ছবিটি অনেকের ঘরের দেয়ালেই শোভা পেতে দেখা যায়।

একটা শিশু কাঁদছে সেই রূপ ছবি কেনো মানুষ ঘরে ঘরে টানিয়ে বেড়াচ্ছে সেই ভেদ করা সহজ নয়। এই লেখার উদ্দেশ্যও তা নয়। মজার বিষয় হলো এই ছবিটিকে অনেকেই অভিশপ্ত ছবি হিসেবে চিহ্নিত করলেও তাকে অস্বীকার করতে পারেনি।

আসলে রূপের মায়াই তাই। রূপ সে যেমন রূপই হোক একবার মনে গেঁথে গেলে তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার ‘পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।।

আমি যেবার প্রথম সমুদ্র দেখেছিলাম, তা দেখে মনে যে ভাবের উদয় হয়েছিল তা প্রকাশের ভাষা নেই। এতো বিশাল কিছু হতে পারে তার আগে ধরণাই ছিল না।

আকাশ দেখেছি কিন্তু তা চাইলেই ছুঁয়ে দেখা যায় না। কিন্তু সমুদ্র প্রতিনিয়ত পায়ের তলা থেকে যখন বালি নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি লালমোহন বাবু তথা জটায়ুর ভাষায় ‘স্তব্ধবাক-রুদ্ধশ্বাস-বিমূঢ়-বিস্ময়’।

প্রথম দেখবার বিষয়টা বিস্ময়ের সাথে তুলনা চলে। আবার অনেকে কোনো কিছু দেখেই বিস্মিত হয় না। তাজমহল বা পিরামিড দেখেও বলে, ‘ওহ্ এটা’। অনেকে আবার একটা কুকুর ছানা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে।

আবার অনেকে জগৎ ঘুরে ঘুরে বিশাল বিশাল সব ব্যাপার-স্যাপার দেখে বেড়ায়। এই দেখে বেড়ানোটাইকে জীবন করে নেন। আবার অনেকে কেবল নিজে দেখে বেড়ান না। যা দেখেন তা তার শিল্পে তুলে ধরে অন্য সকলকেও দেখাবার প্রয়াস করেন।

এই নিজে দেখা এবং তা আবার অন্য দেখানোর মাঝে একটা বিশাল ফারাক থাকে। কারণ এতে যে দৃশ্য ঘটছে তার একটা নিজস্ব বহমানতা থাকে। আবার যিনি দেখছেন তার একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। আর দেখাবার সময় তার আরেকটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।

আবার তার দেখাবার জন্য তিনি আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নেন অনেক সময়। আর যে সে শিল্পটাকে দেখে তার মাঝে আবার সেই লুপটা তৈরি হয়। আর এই লুপ অর্থাৎ শেষ না হওয়া অনন্ত চক্র চলতেই থাকে। আর মানুষ বিভ্রান্ত হতেই থাকে।

তাই আমরা প্রতিনিয়ত দেখে গেলেও যা দেখবার কথা তা দেখতে পাই কই। আমরা মূল্যবান-দামী-মর্যাদাসম্পন্ন ভেবে ভেবে জগতের কতকিই না দেখে বেড়াই সামর্থ অনুযায়ী।

কিন্তু মিস করে যাই চোখের সামনে থাকা অসামান্য সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলো। এ দেখার প্রসঙ্গটি বিস্তারিত বলবার কিছু নেই। এর জন্য ঠাকুর মশাইয়ের কয়েকটি লাইনই যথেষ্ট-

বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।।

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।।

আবার দৃষ্টিকে আরো বেশি ‘নন্দন’ করতে যুগে যুগে মানুষ বহু কাণ্ড ঘটিয়েছে। এতে প্রাকৃতিক ছোঁয়াকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তেমনি করা হয়েছে কৃত্রিম ব্যবহার। জীব ও জড় সকল কিছুকেই আরো বেশি আকর্ষণীয় করতে আরো বেশি দৃষ্টিনন্দন করতে মানুষ কত কিছুই না করেছে, করছে এবং করবে।

মানুষ যেমন বানিয়েছে কৃত্রিম নগর, রাজ্য, বন, জঙ্গল, পাহাড়, দ্বীপ তেমনি রূপ সজ্জার জন্য বানিয়েছে নানান প্রসাধনী পণ্য। পোশাকে এনেছে বৈচিত্র্য। ফ্যাশন, স্টাইল, ট্যান্ডের নামে প্রতিনিয়ত কত কিছুই না উদ্ভাবন হচ্ছে। আবার পুরানো কত কিছুই না ফিরে আসছে।

আসলে এ সবই কি চোখের শান্তির জন্য করা নাকি মনের শান্তির জন্য? চিত্তের আনন্দের জন্য করা? নাকি কেবলই বাণিজ্যিক স্বার্থে এসবের সৃষ্টি সে ভিন্ন আলোচনা।

বিশ্ব অর্থনীতি-রাজনীতি-ষড়যন্ত্র সকল কিছুকে পেছনে ফেলে মানুষ নিজেকে, নিজের চারপাশে, প্রিয়জনকে, প্রিয় স্থানকে, পছন্দের স্থাপনাকে দৃষ্টিনন্দন করার কতই না পরিশ্রম করে। কতই দৌড়ঝাঁপ করে। কত কসরত করে।

নিজেকে সকলের সামনে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপনের জন্য মানুষ প্রতিনিয়ত কতই না নিয়মনীতি মেনে চলে। কতই না উদ্বিগ্ন হয়। কতই না আপসোস করে। অনেকে তো এ নিয়ে স্ট্রেস নিতে নিতে ডিপ্রসনে পর্যন্ত চলে যায়।

অন্যদিকে রূপকে ব্যবহার করে নানাবিধ সুবিধাদি আদায়ের প্রকৃয়াটি বেশ প্রাচীন। এই প্রকৃয়া যে কেবল ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, আর্ন্তজাতিকভাবে সীমিত থেকেছে তাও নয়। এই রূপের বিকিকিনিকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িরা পণ্যের বাজারজাত করা থেকে শুরু করে, চাহিদা তৈরি করার মতো সকল কাজেই ব্যবহৃত করছে একে।

(চলবে…)

পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : অষ্টম পর্ব >>

…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!