স্রষ্টা থেকে সৃষ্টির আবির্ভাব
-আবুতালেব পলাশ আল্লী
হাদিসে উল্লেখিত আল্লাহ বলেন, ‘আমি গুপ্ত ধনভাণ্ডার ছিলাম। অতঃপর আমি পরিচিত হতে চাইলাম। তাই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করলাম।’
স্পষ্টত যে স্রষ্টা নিজেকে প্রকাশ করার জন্য করলেন। কাজেই আমাদের কর্তব্য স্রষ্টার পরিচয় গ্রহণে সচেষ্ট হওয়া। পৃথিবী থেকে স্রষ্টাকে চিনে না গেলে পরকালে অন্ধ হয়ে থাকতে হবে। পরকালে স্রষ্টাকে চেনা, জানা বা বোঝার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু দুনিয়াতে কিভাবে স্রষ্টাকে চিনবো? স্রষ্টা তাঁকে চেনার উপায় নিজেই বলেছেন।
সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টা ছিলেন একা। কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। অতঃপর সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্রষ্টা ‘কুন’ বা ‘হও’ বললেন। ফলে সকল মানব রূহ একত্রে সৃষ্টি হয়ে আলমে আরওয়ায় অবস্থান গ্রহণ করল। শুধু মানব রূহ-ই নয়, সৃষ্টি জগতের সকল কিছুই সূক্ষ্ম অবস্থায় আলমে আরওয়ায় বিরাজমান রইলো।
আদেশ শব্দটার প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আর একটি সত্ত্বার আব্যশক। তাহলে স্রষ্টা ‘কুন’ শব্দে কার উপর আদেশ প্রয়োগ করলেন?
বলা হয়, স্রষ্টার জাত-সেফাত চিরস্থায়ী। স্রষ্টার হাকিকি সেফাতের মধ্যে সকল সৃষ্টির হকিকতের উৎপত্তি নিহিত। স্রষ্টা সৃষ্টিলগ্নে যে ‘কুন’ শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন, তা স্রষ্টার সেফাতস্থিত ঐ হকিকতের প্রতি। ফলে ঐ আদেশে সমুদয় সৃষ্টি সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ পায়।
মানব রূহ একত্রে আলমে আরওয়া থেকে মানুষ বহু ধাপ অতিক্রম করে এই আদামতে এসেছে। আলমে আরওয়ায় আমরা স্রষ্টার প্রভুত্ব স্বীকার করলেও আদামতে এসে সে কথা ভুলে গেছি।
আলমে আমর ও আলমে খালকের মধ্যস্থানে বিভেদকারী পর্দার মত আরশ অবস্থিত। সহজ কথায় আরশের উপর হতে ঊর্ধ্ব দিকে আল মে আমর বা লা-মোকাম এবং আরশ হতে নিচের দিকে সাত তলা জমিনের নিচে তাতাস সারা পর্যন্ত আল মে খালক অবস্থিত।
উৎসের কথা ভুলে আমরা নফসে আম্মারার দাসত্ব করছি। শয়তানের কুহকে পরে স্রষ্টার আমানতের খেয়ানত করছি। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পরিণাম ভয়াবহ। নফসে আম্মারা এবং শয়তানের সংগে আমাদেরকে স্রষ্টার ক্রোধের শিকার হয়ে অনন্ত কাল দোযখের আগুনে দগ্ধ হতে হবে। এটি হতে বাঁচিবার উপায়, দুনিয়া হতেই স্রষ্টাকে চিনিয়া যাওয়া।
স্রষ্টা মানবদেহে দশটি কেন্দ্র নির্ধারণ করেছেন, কেন্দ্রগুলোকে বলা হয় লতিফা। সিদ্ধ মানুষের নির্দেশিত পথে সাধন করে দশটি লতিফাকে পরিচ্ছন্ন করে, সেখানে স্রষ্টার নুর ধারণ করে, সেই নুরের পথ দেখে, ঊর্ধ্ব লোকের পানে উরুজ ও ছায়ের করে, স্রষ্টার পরিচয় লাভ করা যায়। লতিফাগুলো হলো- কালব, রূহ, ছের, খফি, আখফা, আব, আতস, খাক, বাদ ও নফস।
সৃষ্টি জগতকে আলমে আমর ও আলমে খালক নামে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। কালব, রূহ, ছের, খফি, আখফা -এই পাঁচটি আলমে আমর বা সূক্ষ্ম জগতের লতিফা। আর আব, আতস, খাক ও বাদ অর্থাৎ আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস আলমে খালক বা স্থূল জগতের লতিফা।
আলমে আমর ও আলমে খালকের মধ্যস্থানে বিভেদকারী পর্দার মত আরশ অবস্থিত। সহজ কথায় আরশের উপর হতে ঊর্ধ্ব দিকে আল মে আমর বা লা-মোকাম এবং আরশ হতে নিচের দিকে সাত তলা জমিনের নিচে তাতাস সারা পর্যন্ত আল মে খালক অবস্থিত।
-লতিফা-
লতিফায়ে কালব
এই লতিফা মানুষের বাম স্তনের এক আঙ্গুল নীচে অবস্থিত। পদ্মকোরক উল্টে ধরলে যেই রূপ দেখা যায়, লতিফা কালবের আকার অনেকটা সেইরূপ। বাংলায় যাকে হৃৎপিণ্ড বলে। এই লতিফায়ে কালব স্রষ্টার ভেদের এক মহাজ্ঞান সমুদ্র। এই কালবের মধ্যেই স্রষ্টার নিদর্শন লাভ করা যায়।
স্রষ্টা কোরান মজিদে বলেন, আমার নিদর্শন তোমার ভেতরেই আছে, তোমরা দেখ না কেন?(জারিয়াত, ২১ )
স্রষ্টার নিদর্শন দেখার কেন্দ্র এই কালব। একটি বটের বীজের মধ্যে যেমন, বিরাট একটি বটগাছ লুকিয়ে আছে, তেমনি মানব বক্ষস্থিত কালব নামক ক্ষুদ্র এই মাংসপিণ্ড, যার মধ্যে স্রষ্টার ভেদের এক বিরাট দফতর লুকিয়ে আছে। লতিফায়ে কালব মহাকালবের ক্ষুদ্রতম অংশ।
সুফি সাধকরা বলেন, কালবের ক্ষেত্র ব্যাপক ও বিস্তৃত। দুই চার’শ আসমান যদি এই কালবের ভেতর রাখা হয়, তবে তা কালবের এক পাশে পরে থাকবে। কালব আরশের উপরের জগতের লতিফা হওয়ায় তা স্বচ্ছ এবং পবিত্র। কিন্তু আলমে খালকে এসে নফসে আম্মারার সংস্পর্শে কালব তার পবিত্রতা এবং স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে।
মানুষ যতই পাপ কাজে লিপ্ত হয়, তার কালব ততই অস্বচ্ছ-মলিন হয়। সিদ্ধ মানুষের সংস্পর্শে সাধকের কালব স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা ফিরে পায়। এমতাবস্থায় মহাকালবের সাথে কালব পুনরায় যোগসূত্র স্থাপন করতে সমর্থ হয়। মহাকালব থেকে স্রষ্টার জাতের জেল্লি, তার গুণাগুণ বা সেফাতের প্রতিচ্ছবি এবং তার ক্রিয়ার প্রতিচ্ছবি তখন মুরিদের কালবে প্রতিফলিত হয়।
ফলে ছালেক এই কালবের মাধ্যমে সৃষ্টিতত্ত্ব জ্ঞান ও স্রষ্টাতত্ত্ব জ্ঞান অর্থাৎ এলমে হুসুলী ও এলমে হুজুরীর জ্ঞান লাভ করতে পারে। পরিচ্ছন্ন এই কালবে আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, সবই দৃষ্ট হয়।
মাওলানা রুমি বলেছেন-
আরশ, কুরছি, দর দেলে উস্ত লওহ কলম
হরকে দেলরা ইয়াফত্যা আরা নিস্ত গোম।।
অর্থাৎ আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, বেহেশত, দোযখ, সাত তলা আসমান থেকে সাত তলা জমিনের নীচে তাতাস সারা পর্যন্ত সবই তোমার কালবে পরিলক্ষিত হবে, যদি তোমার কালব মহাকালবের সাথে যোগ সূত্র স্থাপন করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। মহাকালব হতে তখন ছালেকের কালব অসীম জ্ঞান রাজ্যের জ্ঞান অহরণ করে মহাজ্ঞানী হয়।
হজরত আবুবকর কাতানী(র) কাবা শরীফের পার্শ্ববর্তী এলাকায় তরিকা প্রচার করতেন। তিনি মক্কাবাসীদের কাছে ‘চেরাগে হেরেম’ অর্থাৎ হেরেম শরীফের প্রদীপ বলে আখ্যায়িত ছিলেন। একদিন তিনি কাবা শরীফের ভেতর এক পাশে একাকী বসে ওজিফারতে ছিলেন। দূরে ইব্রাহিমের কাছে কয়েকজন তাবেঈ নবীজীর বাণী নিয়ে আলোচনা করছিল।
এমন সময় একজন বৃদ্ধলোক সোজাসুজি হজরত কাতানীর কাছে এসে বললেন, ইব্রাহিমের কাছে হাদিস বিশারদরা হাদিস নিয়ে গবেষণা করছে, আর আপনি এখানে একাকী বসে আছেন? সেখানে হাদিস গবেষণায় অংশ গ্রহণ করতে তো পারতেন।’
পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের নিজ নিজ কক্ষ পথে ভ্রমণ এক এক ঋতুতে পৃথিবীর এক এক রূপধারণ। সমস্ত স্রষ্টার ক্রিয়াগুণের প্রতিবিম্ব। লতিফায়ে কালব প্রথমে আদমের উপর বিকাশ পেয়েছিল। তাই এই লতিফাকে আদমের জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফায়ে কালবের বেলায়েত অর্জনকারীকে ‘আদমী মাশরাব অলী’ অর্থাৎ আদম-এর ঘাটের ঘাঁটি বলা হয়।
কাতানী মাথা তুলে পূর্বক বললেন, ‘যারা হাদিস নিয়ে গবেষণা করছেন, তারা কোথা থেকে তা পেয়েছে।’ উত্তরে বৃদ্ধ বললেন, ‘তারা প্রধান প্রধান সাহাবীদের কাছে থেকে হাদিস শিখেছেন এবং সাহাবা সকল নবীজীর কাছে থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন।’
শুনে কাতানী বললেন, ‘আপনি তো দীর্ঘ সূত্রের কথা বললেন, কিন্তু আমি এখানে বসে বিনা সূত্রে সরাসরি তা শ্রবণ করছি।’
বৃদ্ধ প্রশ্ন করলেন, ‘কি ভাবে আপনি শ্রবণ করছেন?’
তিনি বললেন, ‘আমার কালব স্রষ্টার কাছে থেকে সমস্তই আমার কাছে বর্ণনা করে থাকে।’
বৃদ্ধ পুনরায় প্রশ্ন করলেন, আপনার এই কথার সমর্থনে কোন প্রমাণ আছে কি?
কাতানী মুচকি হেসে বললেন, ‘এর পক্ষে এতটুকু প্রমাণই যথেষ্ট যে, যে আগন্তুক বৃদ্ধ আমাকে উপদেশ প্রধান করছেন, তিনি হজরত খিজির(আ)। হজরত খিজির এটা শুনে নিজের পরিচয় দিয়ে কাতানীর সকল কথার সাথে একমত পোষণ করলেন।
কালবে যে নুর দৃষ্ট হয়, তা সরিষা ফুলের মতো হলুদ বর্ণের। কালবের নুর আরশের উপর এবং এর মূলের মূল তাজাল্লিয়াতে আফায়েলে সন্নিবেশিত আছে। ছালেক বা মুরিদ যখন এই মোকামে উন্নীত হয়, তখন সে বুঝতে পারে, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তা এক স্রষ্টার ইচ্ছা এবং ক্রিয়াগুণের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে।
পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের নিজ নিজ কক্ষ পথে ভ্রমণ এক এক ঋতুতে পৃথিবীর এক এক রূপধারণ। সমস্ত স্রষ্টার ক্রিয়াগুণের প্রতিবিম্ব। লতিফায়ে কালব প্রথমে আদমের উপর বিকাশ পেয়েছিল। তাই এই লতিফাকে আদমের জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফায়ে কালবের বেলায়েত অর্জনকারীকে ‘আদমী মাশরাব অলী’ অর্থাৎ আদম-এর ঘাটের ঘাঁটি বলা হয়।
লতিফায়ে রূহ
এই লতিফা মানুষের দক্ষিণ বা ডান স্তনের এক আঙ্গুল নীচে অবস্থিত। এটি আলমে আমর বা সূক্ষ্ম জগতের লতিফা। এই লতিফার মূল আরশের উপরে এবং মূলের মূল স্রষ্টার ‘সেফাতে এলাহিয়া ’তে সন্নিবেশিত আছে।
এই সেফাতে ছুবুতী ঐ সমস্ত গুণ, যা স্রষ্টার জাতে ছাবেত থাকে। সিদ্ধ মানুষ বলে, ছালেক এই স্তরে পৌঁছালে সে বুঝতে পারে যে তার নিজের কোন গুণ নাই। দর্শন, শ্রবণ, চিন্তন, বর্ণন, কল্পন, কথন, সৃজন সমস্তই স্রষ্টার গুণাবলী। বস্তুত মানুষের নিজের বলে কিছু নাই। নিজের সমস্ত গুণাগুণই প্রকৃত অর্থে স্রষ্টা থেকে ধার করা।
এই লতিফার নুরের রং সোনালী। এই লতিফা হজরত নূহ(আ) ও হজরত ইব্রাহিম(আ) এর উপরে প্রথম প্রকাশ পায়। এই লতিফা নূহ ইব্রাহিমের জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা রূহের বেলায়েত লাভকারীকে ‘ইব্রাহিম মাশরাব ওলী’ অর্থাৎ হজরত ইব্রাহিমের ঘাটের ঘাঁটি বলা হয়।
লতিফায়ে ছের
এই লতিফা কালবের দুই অঙ্গুল পরিমাণ দূরে বুকের ডান দিকে অবস্থিত। এই লতিফা আলমে আমরের লতিফা। এর আসল আরশের উপরে আসলের আসল স্রষ্টার শানে সন্নিবেশিত আছে। এই লতিফার নুর সাদা-অতি তেজস্কর।
এটি হজরত মুসা(আ) এর উপর প্রথম প্রকাশ পায়। তাই এই লতিফাকে মুসার জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা ছেরের বেলায়েত লাভকারীকে ‘মুছবী মাশরাব অলী’ অর্থাৎ হজরত মুসার ঘাটের ঘাঁটি বলা হয়।
লতিফায়ে খফি
এই লতিফা রূহের দুই অঙ্গুল পরিমাণ দূরে বুকের বাম দিকে অবস্থিত। এই লতিফা আলমে আমরের লতিফা। এই লতিফার মূল আরশের উপরে এবং মূলের মূল স্রষ্টার ‘সেফাতে ছলবীয়া’তে সন্নিবেশিত আছে। এই মোকামে উন্নীত হলে ছালেক বুঝতে পারে যে, স্রষ্টা অব্যয়, অক্ষয়, চিরস্থায়ী, অপরিবর্তনশীল ইত্যাদি।
এই লতিফার নুর কালো বর্ণের, তবে দৃষ্টিরোধক নয়। এই লতিফা হজরত ঈসা(আ) এর উপর প্রথম প্রকাশ পায়। তাই এই লতিফাকে ঈসার জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা খফির বেলায়েত লাভকারীকে ‘ঈসুবী মাশরাব’ অর্থাৎ হজরত ঈসার ঘাটের ঘাঁটি বলা হয়।
লতিফায়ে আখফা
এটি বুকের মাঝখানে অবস্থিত। এই লতিফার মূল আরশের উপরে এবং মূলের মূল স্রষ্টার ‘শানে জামেয়ায়’ সন্নিবেশিত আছে। এটিকে তাইনে আওয়াল বা তাইনে ওজুদী বা হকিকতে আহ ম্মদী বলে, যা হকিকতে মোহাম্মদীর উৎপত্তি স্থল।
ছালেক এই মোকামে উন্নীত হলে স্রষ্টার এমনি নিবিড় ও ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভ করে, যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এখানে গুণ ও শানের কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে নাই। এই সম্পর্ককে ইংগিতেও বুঝানো যায় না। যা কেহ স্বীয় জ্ঞানে আনিতে পারে না, অনুভবও করতে পারে না।
হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানী বলেন, আহাদ ও আহম্মদ নামের মধ্যে যে মিমের ব্যবধান তা কেবল এই দুই নামের মধ্যেকার পার্থক্যই নির্ণয় করে। এই মোকামে উন্নীত হলে ছালেকের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক অবর্ণনীয়। এটি কেবলমাত্র স্রষ্টাই জানেন।
এই লতিফার নুর সবুজ বর্ণের। এই লতিফা নবীজীর উপর প্রথম প্রকাশ পায়। তাই এই লতিফাকে হজরত মোহাম্মদ(স)-এর জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা আখফার বেলায়েত অর্জনকারীকে ‘মোহাম্মদী মাশরাব অলী’ অর্থাৎ হজরত মোহাম্মদের ঘাটের ঘাঁটি বলা হয়।
আল্লাহ আদমের দেহ তৈরি করে তার ভেতরে রূহ ফুকে দিলেন। রূহ আদমের দেহে প্রবেশ করে অন্ধকার দেখে দেহ থেকে বাহির হয়ে আসল। এই অন্ধকারে থাকতে রূহ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। তখন স্রষ্টার ইশারায় আদমের দেহে নুরে মোহাম্মদী প্রবেশ করলো।
আলমে আমরের এই পঞ্চ লতিফা যথা- কালব, রূহ, ছের, খফি ও আখফাকে মোজাদ্দেদ আলফেছানী(রা) সারপঞ্চক বলে উল্লেখ করেছেন।
মানবদেহে- আব, আতস, খাক ও বাদ অর্থাৎ আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের সমন্বয়ে তৈরি। স্রষ্টা বিশেষ কৌশলে পরস্পর বিপরীতধর্মী এই চার উপাদান দ্বারা আমাদের দেহকে তৈরি করেছেন। এই চারটি উপাদান পৃথক পৃথক ভাবে এক একটি লতিফা। এই চারটি লতিফার অবস্থান সর্ব দেহ ব্যাপী।
তারপর আলমে খলকের অবশিষ্ট লতিফা যার নাম নফস। আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের সমন্বয়ে পৃথক এক সত্ত্বা যার ধর্ম উক্ত চার উপাদান হতে পৃথক। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের যৌগিকে যেমন ভিন্ন এক উপাদান পানির তৈরি হয়। এই পানির ধর্ম হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের ধর্ম হতে পৃথক।
তেমনি এই নফস, যার স্বভাব দৈহিক অন্যান্য উপাদানের ধর্ম হতে পৃথক। যাবতীয় কু-চিন্তা এবং কু-কর্মের উৎস এই নফস। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, হিংসা, কিনা, রিয়া, কামনা, বাসনা ইত্যাদি সকল রিপুই এই নফস থেকে উৎপত্তি।
নফসের স্বভাব স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ করা। স্রষ্টার নাফরমানীতেই তার শান্তি। স্রষ্টার দাসত্বের অস্বীকৃতি প্রদানই তার ধর্ম। দুনিয়ার ধন, জন, যশ, খ্যাতি, কর্তৃত্বে সবই তার আকাংখা। নফস চায় সকলের উপর কর্তৃত্ব করতে। সকল সৃষ্টিই তার অধীন হয়ে থাকবে আর সে সকলের উপর সর্দারি করিবে -এটিই তার কাম্য।
মোজাদ্দেদ আলফেসানী বলেন, ‘নফসের এই স্বভাব স্রষ্টাই দাবী বই কিছুই নয়। প্রত্যেকের নফসই তাই এক একটি ফেরাউন।’ কাজেই এই নফসের হাত থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কারো নিস্তার নাই।
আল্লাহ আদমের দেহ তৈরি করে তার ভেতরে রূহ ফুকে দিলেন। রূহ আদমের দেহে প্রবেশ করে অন্ধকার দেখে দেহ থেকে বাহির হয়ে আসল। এই অন্ধকারে থাকতে রূহ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। তখন স্রষ্টার ইশারায় আদমের দেহে নুরে মোহাম্মদী প্রবেশ করলো।
কাজেই নফসে আম্মারার কবল থেকে রূহকে মুক্ত করার জন্য একজন সাহায্যকারীর প্রয়োজন। সেই সাহায্যকারী হিসেবে যুগে যুগে দুনিয়াতে নবী রাসূলের আবির্ভাব ঘটেছে। নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাদেরই চরিত্রে চরিত্রবান করে স্রষ্টা অলী-আউলিয়া তথা সিদ্ধ মানুষ প্রেরণ করছেন।
নুরে মোহাম্মদীর আকর্ষণে তখন রূহ মানবদেহে রহিয়া গেল। এই ভাবে স্রষ্টা তার নিজস্ব কৌশলে নফসের সাথে রূহের মিলন ঘটালেন। অন্ধকারের সাথে আলোর সংমিশ্রণ করলেন। তারপর নফসের সাথে রূহের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে দিলেন।
রূহ ঊর্ধ্ব জগতের উপাদান। রূহের উৎস স্রষ্টারর সেফাতে এরাদত। রূহ স্রষ্টার চরিত্রে চরিত্রবান। রূহের ভেতর ভাল গুণ ব্যতীত খারাপ কোন গুণের স্থান নাই। রূহের আবাস্থল আমরে রাব্বী।
অন্যদিকে নফস হলো আলমে খালকের উপাদান। যাবতীয় কু-কর্মের কর্তা এই নফস। খারাপ ভিন্ন ভালোর কোন স্থান এই নফসের ভেতর নাই। আল্লাহ বলেন, ‘নফস আমার শত্রু, তোমরা নফসের সাথে শত্রুতা কর।’ কাজেই রূহের একান্ত ইচ্ছা, এই নফসকে তার কু-স্বভাব হতে মুক্ত করে, ঊর্ধ্ব জগতের নুরে আলোকিত করে ঊর্ধ্ব লোকের পানে নিয়ে যাবে।
স্রষ্টার প্রেমিক বানাবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। রূহ নফসে আম্মারাকে হেদায়েত করতে এসে নিজেই নফসের প্রেমে পরে গেল। নফসের দাসত্ব করা শুরু করলো। নফসের যা ভাল লাগে, রূহেরও তাই ভাল লাগে। নফসের প্রেমে পরে নফসের ভাল লাগাই রূহের ভাল লাগায় পরিণত হয়।
নফসের কর্মসূচীই রূহের কর্মসূচী হয়। কিন্তু কথাতো এরকম ছিল না। দুইয়ের স্বভাবও এক ছিল না। রূহের যা প্রিয়, নফসের তা অ-প্রিয়। রূহের জন্য যা মধুর, নফসের তা তিক্তকর। নফস সর্বদাই স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ করতে ভালবাসে। নফস স্রষ্টার শত্রু।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নফসের সাথে বন্ধুত্ব করো না, তোমরা নফসের দাসত্ব করো না।’ এই দুনিয়ার যশ, খ্যাতি, ধন-সম্পদ কর্তৃত্ব সকলই নফসের কাম্য। নফস এই দুনিয়াকে সুন্দর রূপে সাজিয়ে রূহের সম্মুখে উপস্থিত করলো। ফলে রূহও দুনিয়ার প্রেমে পরলো। নফসকে ইমানদার বানাতে এসে নিজেই ইমান হারিয়ে ফেলল।
স্রষ্টার কথা, নুরময় জগতের কথা, নিজস্ব আবাস স্থলের কথা- সবই ভুলে গেল। দুনিয়ার প্রেমে মত্ত হয়ে নফসের দাসত্ব করা শুরু করলো। এই অবস্থা চলতে থাকলে রূহের ধ্বংস অনিবার্য। নফসের সাথে, নফসের সাহায্যকারী দুনিয়ার সঙ্গে, স্রষ্টার ক্রোধানলে পরে অনন্তকাল দোজখের আগুনে দগ্ধ হতে হবে।
কাজেই নফসে আম্মারার কবল থেকে রূহকে মুক্ত করার জন্য একজন সাহায্যকারীর প্রয়োজন। সেই সাহায্যকারী হিসেবে যুগে যুগে দুনিয়াতে নবী রাসূলের আবির্ভাব ঘটেছে। নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাদেরই চরিত্রে চরিত্রবান করে স্রষ্টা অলী-আউলিয়া তথা সিদ্ধ মানুষ প্রেরণ করছেন।
পথভ্রষ্ট মানব সকলকে তথা মানব রূহকে নফসে আম্মারার দাসত্ব হতে মুক্ত করে, দুনিয়ার অধীনতা কে অস্বীকার করে স্রষ্টা মুখী করার জন্য।
……………………………
পুনপ্রচারে বিনীত: আবুতালেব পলাশ আল্লী
মা শাহে সেতারার রওজা বা দরবার শরিফ
খুলনা, বাংলাদেশ।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………
আরও পড়ুন-
দোজখ
নফসের সংযম
স্রষ্টা থেকে সৃষ্টির আবির্ভাব
মোরাকাবা-মোশাহেদা
নফসের পঞ্চস্তর
তরিকায় নামাজ রোজা
তরিকায় জাকাত
দেহতত্ত্বে লতিফা ও চক্র ভেদ
সাধনার ধারা