ভবঘুরেকথা
স্পর্শের কাতরতা ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: স্পর্শ : স্পর্শের কাতরতা: দ্বিতীয় পর্ব

জীবের সারাদেহ জুড়ে ত্বক তথা স্পর্শ ইন্দ্রিয় থাকলেও তার সংবেনশীলতা ও ধরণ একই রকম নয়। স্পর্শের কাতরতা সমান নয়। যেমন হাত ও পায়ের তালুর ত্বক দেহের অন্য যে কোনো ত্বকের থেকে আলাদা। এর ত্বক অধিক সহনশীল। আবার মুখের ত্বক এক রকম আবার হাত পায়ের ত্বক আরেক রকম।

সংবেনশীলতা যে দেহের সর্বত্র সমান হয় না তার খুব সাধারণ উদাহরণ বলতে গেলে বলতে হয়। খেয়াল করলে দেখবেন দেহের কোনো কোনো অংশে ব্যথা পেলে বা চুলকে উঠলে প্রথমেই সঠিক জায়গাটি খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার যে অংশের সংবেদশীলতা বেশি সেখানে প্রথমেই সঠিক জায়গাটি খুঁজে পাওয়া যায়।

বিষয়টা অন্যভাবে বলতে গেলে এভাবে বলা যায়, হয়তও খুব উত্তপ্ত বা খুব শীতল কোনো বস্তুর স্পর্শ লাগলো দেহে। সেই বস্তুটি দেহের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করলে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি দেবে। তার শীতলতা বা উত্তপ্ততা সমান থাকলেও আপনার অনুভূতি সর্বত্র সমান হবে না।

প্রকৃতির অন্যান্য জীব ঋতু পরিবর্তনের সাথে তার ত্বককে পরিবর্তন করে নিতে পারে। তাই তাদের জলবায়ুর পরিবর্তনে খাপ খাইয়ে নিতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু মানুষ যতবেশি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠছে ততবেশি প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

তাই ঋতুর পরিবর্তনে ত্বকের সক্ষমতা পরিবর্তন করা তো দূরের কথা। দিবা-রাত্রির পরিবর্তনেও ত্বক অনেকক্ষেত্রে সংবেদনশীল হয়ে উঠে নাগরিক সমাজে। তাই এই ত্বকের নিতে হয় বিশেষ যত্ন। রাখতে হয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

এই ত্বক যেহেতু দেহের বহিরাবরণ তাই একে এমন ভাবে রাখতে হয় যাতে করে এতে বাইরের ধুলাবালি জমতে না পারে। আবার যথেষ্ট পরিমাণ আলো-বাতাস-জল না পেলে ত্বাক তার সক্ষমতা চরিত্র পরিবর্তন করতে থাকে।

আর সৌন্দর্যবোধের সাথে ত্বকের সম্পর্ক যে কতটা নিবিড় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কেবল ত্বকের সংবেদশীলতা রক্ষাই নয় ত্বকের বর্ণও মানব সমাজে একটা বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থান করে। ত্বকের বর্ণ কেমন তার উপর অনেকক্ষেত্রে শুধু সামাজিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক অবস্থানই নয়। পরিবার-পরিজনের কাছ থেকেও নানা বঞ্জনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। বর্ণ স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে স্পর্শকাতর করে তোলে।

এই ত্বকের বর্ণ নিয়ে পৃথিবীময় কত হানাহানি মারামারি কত নির্যাতন-নিপীড়ন হয়েছে এবং এখনো চলমান তা সকলেই জানা। ত্বকের বর্ণ সাদা হলে তারা অভিজাত, উচ্চশ্রেণী, সম্মানের যোগ্য বলে সাধারণ ভাবে সর্বত্রই বিবেচিত হয়।

যাকে এই শতাব্দি কাগজ কলম ততটা না মানলেও মনে মনে ফর্সা ত্বককে প্রায় সকলেই মূল্যায়ন করে থাকে।

অন্যদিকে ত্বক যদি হয় কৃষ্ণবর্ণ তাহলে তারা নিম্নবিত্ত, নিম্নশ্রেণী এবং দাস হিসেবে চিহ্নিত হয় আজকের এই সভ্য সমাজেও। কোথাও কোথাও কেবল কৃষ্ণবর্ণের জন্য মানুষ হয় ‘অচ্ছুত’। অর্থাৎ যাকে ছুঁলে জাত-ধর্ম নাশ হবে।

কেবল তৃতীয় বিশ্ব বা পিছিয়ে পরা মানুষরাই ত্বকের রং নিয়ে মেতে থাকে বিষয়টা তেমনটা নয়। ত্বকের বর্ণ নিয়ে বৈষম্য উন্নত বিশ্বেও এখনো বলবদ আছে।

আজকের তথাকথিত সভ্য দেশগুলো আফ্রিকা থেকে কালো মানুষদের হাতেপায়ে শেকল পড়িয়ে পশুর মতো বন্দি করে দাস হিসেবে যেভবে নিয়ে গিয়েছিল তার ইতিহাস এখনো যে কোনো বিবেকবান মানুষকে কাঁদায়।

এই দাসপ্রথা নিয়ে পৃথিবীতে কত করুন গাঁথা গল্প-উপন্যাস-গান-চলচ্চিত্র যে নির্মিত হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে সেই নির্মমতার চিত্রটাই এমনই যে এতো শত শিল্প-গাঁথার মাঝেও প্রকৃত চিত্র আদৌ উঠে এসেছে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

অবশ্য এই ত্বকের বর্ণ নিয়ে সামাজিক বিভাজন যে কেবল পশ্চিমা বিশ্বের মানুষরাই করেছে তা নয়। পৃথিবী ব্যাপী সর্বত্রই সাদা বর্ণের জয় জয় কার। কেবল গায়ের বর্ণের জন্য কত মানুষকে যে প্রতিনিয়ত এখনো নিগ্রীহিত হতে হয়, কত মানুষ যে এই ব্যথা বুকে চেপে প্রতিনিয়ত পথ চলে সে কথা বলতে গেলে এই লেখার গতিপথ পাল্টে যাবে। যাক সে কথা।

ত্বক ফর্সা করার উপকরণের বিক্রির কাটতির পরিসংখ্যান দেখলে হয়তো অনেকেই ভিমড়ি খাবে। কারণ এর বাণিজ্য এখনো প্রসাধন শিল্পের সর্বাগ্রে অবস্থান করে। বর্ণ বিদ্বেষ মনে না পুষলেও প্রায় সকলেই গোপনে হলেও চায় ফর্সা ধবধবে সাদা চামড়া।

যাতে সেও জাতে উঠতে পারে। সকলের সামনে নিজেকে বিশেষ মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে পারে। এটাকে কেউ কেউ হীনমন্যতা বলে উল্লেখ করলেও। যারা বর্ণের কারণে ভুক্তভোগী তারই হয়তো এর অর্ন্তনির্হিত গল্পটা ভালো বলতে পারবে।

এর বিপরীতে থাকা মানুষও পৃথিবীতে বসবাস করে। যারা ত্বকের বর্ণকে অগ্রধিকার দেয় না। আবার অনেকেই আছেন যারা কৃষ্ণবর্ণেই সুন্দরের স্বরূপ বলে মনে করেন। কৃষ্ণবর্ণ দিয়ে দুনিয়া তাক লাগিয়ে দেয়া মডেলও পৃথিবীতে আছে।

তারা আদৌ অন্যদের মতোই সমান সম্মান পায় নাকি কৃষ্ণবর্ণ বা সংখ্যালঘু বলে করুনা পায় সেটাও ভিন্ন আলোচনা।

একেবারে কৃষ্ণবর্ণই যে কেবল বর্ণবাদের স্বীকার হয় তাও না। একেবারে সাদা আর কালোর মাঝেও যারা রয়েছে তারাও বর্ণবাদের স্বীকার হয়। কারণ সাদা চামড়াই নিজেদের উৎকৃষ্ট বলে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে জগৎময়। যদিও প্রগতীশীল চিন্তাধারা বলে বর্ণে নয় কর্মেই মানুষের বিচার।

ইন্দ্রিয় স্পর্শ অর্থাৎ স্থূলদেহে যে বিশাল অঙ্গটিকে ঘিরে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা মানুষ থেকে মানুষকে যেমন পৃথক করে তোলে। বর্ণবাদী করে তোলে। আবার এই ইন্দ্রিয়ই সহায় হয়ে মানুষ হয়ে মানুষের পিঠে হাত দিয়ে ভরসা জোগায়।

সুস্বাস্থ্যে ও সৌন্দর্য রক্ষার জন্য যেমন ত্বকের যত্ন নিতে হয়। তেমনি এই স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে দৃষ্টিনন্দন করতে এতে আঁকা নয় নানা আঁকিবুকি। সেই প্রাচীনকাল থেকে নগর সভ্যতা বা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড সর্বত্রই ত্বককে ঘিরে বা ত্বককে আকর্ষণীয় করতে নানা প্রসাধান যেমন ব্যবহার করা হয়েছে।

তেমনি ত্বকের উপর আঁকা হয়েছে নানা বিচিত্র সব নকশা, চিত্র, আঁকিবুকি। এর সাথে স্পর্শের সরাসরি খুব বেশি সম্পর্ক না থাকলেও। এ সকল নানা বর্ণের নানা নকশার চিত্র গায়ে এঁকে ত্বক ইন্দ্রিয়কে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায় মানুষ।

তবে কেবল সাজসজ্জার জন্যই যে মানুষ দেহে নানা আঁকিবুঁকি করে তা কিন্তু নয়। অনেকক্ষেত্রে এ সকল নকশা আঁকা বা কাটা হয় ধর্মীয় বা মতাদর্শের ভিত্তিতে। আদিবাসীদের অনেক গোত্রে গায়ে নির্দিষ্ট নকশাকাটা বাধ্যতামূলক।

অনেকক্ষেত্রে এসব নকশা দেখে গোত্র-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় যেমন নির্ধারণ করা যায়। তেমনি আবার একই গোত্রে কার কোন অবস্থান তাও নির্ণয় করা যায়। আজকের আধুনিক কালে যেমন রোগ প্রতিরোধের জন্য নানা টিকার আবিষ্কার করেছে। তেমনি আদিম সমাজব্যবস্থার নানা রোগ প্রতিরোধের জন্যও এই নকশা কাটা হতো ত্বকে।

অনেকক্ষেত্রে নিজেকে আড়াল করার জন্যও অনেক এই নকশা কাটে। অনেকে অন্যদের থেকে পৃথক হওয়ার জন্য করে। অনেকে ত্বকের বিভিন্ন উপসর্গ আড়াল করতেও নানান বাহারি সব নকশা আঁকে।

আবার আদিম অনেক সমাজে সামাজিক অবস্থা বোঝাতেও এসব নকশা ছিল নির্দিষ্ট। ঐতিহ্যের একটা ব্যাপার রক্ষা করা হতো কঠোর ভাবে। সকলে সকল নকশা করার যোগ্যতা রাখতো না। যা এখনো কোনো কোনো গোষ্ঠির ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়।

অনেকে শখের বশে গায়ে ট্যাটু আঁকে। অনেকে বিভিন্ন গুপ্তসংঘের সদস্যের প্রতীক হিসেবে দেহের ত্বকে নকশা বহন করে। আবার একসময় ক্রীতদাশদের গায়ে লোহার নকশা ফলক গনগনে গরম করে জোর করে ছাপ দিয়ে তাদের চিহ্নিত করা হতো। এখনো অনেক জায়গায় পশুদের যেমন করা হয়।

অন্যদিকে কেবল লজ্জা নিবারণের জন্যই নয়, ত্বককে রক্ষার জন্যও মানুষ বিভিন্ন আবহাওয়া-জলবায়ুতে বিভিন্ন পোশাক পরিধান করে। বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহার করে। ত্বককে বিভিন্ন আবহাওয়া থেকে রক্ষার জন্য নেয়া হয় নানা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

সাধারণ মানুষ যেমন স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের স্পর্শকাতরতা রক্ষার্থে নানা উপকরণ ব্যবহার করে। তেমনি তপস্যার ফলে সাধুগুরুরা উষ্ণতা-শীতলতা সহ্য করার সক্ষমতা লাভের দিকে অগ্রসর হন।

তারা তীব্র শীত বা অসহ্য গরমেও সামান্য বা বিনা কাপড়ে অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারে। আবার অনেকে ঠিক উল্টো। তারা কি গরম, কি শীত সারা বছরই গায়ে একাধিক ভারি ভারি পোশাক চাপিয়ে ঘুরে বেড়ান। তারা আদতে স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির প্রাথমিক ক্রিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দেন।

তারা স্পর্শকে নিয়ে খেলা করেন। প্রকৃতির তাপের সাথে তাপমাত্রা মিলিয়ে নেয়ার যোগে নিজেকে যুক্ত করে নেন। নাগা সন্ন্যাসীরা যেমন বস্ত্র ত্যাগ করে। তেমনি অঘোরী তান্ত্রিকরা ত্বকে শশ্মানের ছাই-ভস্ম মেখে সাধনায় সমর্পিত হন।

তবে যে যে মতেই সাধন ভজন করুক না কেনো। প্রায় প্রত্যেক মত-পথেই সাধনের পূর্বে স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে পবিত্রজ্ঞান করে নেয়ার বিধান দেখতে পাওয়া যায়।

(চলবে…)

………………….
আরো পড়ুন:
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-২
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৩
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৪
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৫
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৬
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৭
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৮
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৯
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!