-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: স্পর্শ : স্পর্শের কাতরতা: পঞ্চম পর্ব
যদি আপনি বুদ্ধের হাত এই অভয় মুদ্রাটিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করেন তাহলে ধীরে ধীরে এক ধরণের প্রশান্তি অনুভব করবেন। স্পর্শের কাতরতা ধীরে ধীরে তীব্র হবে। আপনার মধ্যে এক ধরনের ভরসার আবেশ ভাব জাগ্রত হবে। সুরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি পাবে, গভীর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অনুভূতি বোধ করতে শুরু করবেন।
যদি আপনি নিজে স্থির মনে এই মুদ্রা শিখে এই ভঙ্গির অনুশীলন করেন; তাহলে আপনাকে দেখেও মানুষ এমনটাই অনুভব করবে। বিষয়টি সত্য কিনা পরীক্ষা করতে চাইলে, আপনার তর্জনীকে দুই চোখের মাঝে একটু সময় ধরে থাকুন। দেখবেন অল্প সময় পরই আর সেখানে তাকিয়ে থাকতে পারছেন না।
তর্জনীতে থাকে বায়ু বা বাতাস তত্ত্ব। এই তত্ত্ব দুই চোখের মাঝে ভ্রূ’মধ্য আগ্যাচক্রের দিকে ধরলে সেখানে ক্রিয়া করতে শুরু করে। বায়ু আগ্যাচক্রকে তার নিজ স্বভাব অনুযায়ী ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। তাই আমরা অল্পে অস্থির হয়ে উঠি। তাকিয়ে থাকতে পারি না।
অনুরূপ ভাবে দেখবেন অন্য কোনো আঙ্গুল তুলে কাউকে কিছু বললে সে যতটা না প্রতিকৃয়া দিবে। তর্জনী তাক করে কিছু বললে তার থেকে বেশি প্রতিকৃয়া দেখায়। কারণ বায়ু তত্ত্ব আমাদের অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে দেখবেন, সনাতন মতে বোন যখন ভাইয়ের কপালে তিলক দেয় তা দেয় অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে।
অনামিকা হলো মাটি তত্ত্ব অর্থাৎ স্থিরতার প্রতীক। বোন ভাইকে স্থির হওয়ার প্রেরণা দেয়। আবার বিবাহ বন্ধনের জন্যও অনামিকায় আংটি পড়ানোর রেওয়াজ। কারণ মাটি তত্ত্ব যাতে সম্পর্কেকে স্থির করে-স্থায়ীত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি বহন করে। এসব অনেক ব্যবহারই আমরা প্রত্যাহিক জীবনে করে থাকি।
কিন্তু অজ্ঞতা বা আমাদের মুনিঋষিদের জ্ঞানকে অবজ্ঞার কারণে পেছনের কারণগুলো জানি না বা জানতে চাই না। আর এই না জানতে চাওয়ার ফলে অনেক সংস্কারও আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে কু-সংস্কার।
এসব কথা বেশিভাগ মানুষের কাছেই স্রেফ গাঁজাখুরি গল্প মাত্র। কু-সংস্কারকে সংস্কার বানানোর অপচেষ্টাও বলবেন অনেকে। কিন্তু এর পরের কথাগুলো জানলে চমকে না উঠলেও কিঞ্চিৎ হলেও অবাক আপনি হবেন।
কারণ সাংকেতিক ভাবে কোনো কিছু বোঝাতে আপনি আঙ্গুলের যে ব্যবহার করে থাকেন; তার পেছনে রয়ে গেছে এই ‘পঞ্চতত্ত্ব তরঙ্গ ত্ত্ত্ব’। যা আমরা প্রত্যাহিক জীবনে প্রতিনিয়তই নিজের অজ্ঞাতেই ব্যবহার করে আসছি।
যেমন আমরা প্রকৃতির ডাকে জল ত্যাগ করার সাড়া দেয়ার জন্য অর্থাৎ প্রস্রাব করার জন্য সংকেতিক চিহ্ন হিসেবে কনিষ্ঠা অঙ্গুলি তুলে ধরে বোঝাই। আর যোগ বলে এই কনিষ্ঠাতেই জল তত্ত্ব বিরাজ করে। আবার আমার বিজয় চিহ্ন দেখাতে বাকি তিন অঙ্গুলি বেঁধে নিয়ে কনিষ্ঠা আর মধ্যমা ঊর্দ্ধে তুলে ধরি।
এখানে তত্ত্ব অনুযায়ী বায়ু ও আকাশ তত্ত্ব তুলে ধরা হয়। কথায় বলে না আকাশ জয়। এখানেও তাই আকাশ ও বায়ু অর্থাৎ সম্পূর্ণ আকাশ জয় মানে সমগ্র জয়ের চিহ্ন এই মুদ্রা। এছাড়াও বহু মুদ্রা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে থাকি।
কোন আঙ্গুলে কোন তরঙ্গ প্রবাহিত হয় সেটুকু বুঝে একটু গভীরে ভাবলে আপনিও পেয়ে যাবেন তার বিশাল তালিকা। সে সবে না যেয়ে আবার মূল আলোচনা স্পর্শে ইন্দ্রিয় সম্পর্কিত আলোচনায় ফিরি বরঞ্চ-
স্পর্শ এমন একটি অনুভূতি যা পরস্পরের সম্পর্কে ধারণা সুদৃঢ় করে। তাই পরিচয়ের শুরুতে বা প্রতিবার সাক্ষাতে একে অন্যকে ছুঁয়ে দেখবার নানাবিধ রীতি প্রচলিত আছে জগতজুড়ে।
কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে সম্ভাষণের যেমন বিশেষ বিশেষ ‘শব্দ’ নির্দিষ্ট আছে। তেমনি আছে স্পর্শের নানা কায়দা। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সম্ভাষণে অভিনব সব স্পর্শের ভাষা সংযোজিত হয়েছে।
এ রকম অসংখ্য সম্ভাষণের স্পর্শের ভাষা থেকে তথাকথিত সভ্য সমাজে যে কায়দাটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেটি হলো ‘করমর্দন’।
করমর্দন অর্থাৎ পরস্পর হাত মিলিয়ে সামান্য ঝাঁকুনির মাধ্যমে প্রীতি জ্ঞাপন। সাহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই কায়দায় দুই জন মানুষের সাক্ষাতে পরস্পর সাধারণত একে অন্যের ডান হাত ধরে প্রীতি বিনিময় করে থাকে। তবে এটি পশ্চিমা সংস্কৃতি যা আমরা গ্রহণ করেছি অনেক পরে।
ভারতবর্ষে পরস্পরের সাক্ষাতে একে অপরকে প্রথমে দুই হাত অর্থাৎ দুই হাতের পঞ্চতত্ত্বের তরঙ্গ একসাথে করে ভক্তিভরে উচ্চারণ করে ‘নমস্কার’। সাধককুল বলে, এই কায়দায় দুই হাতের তালুর আঙ্গুলের অগ্রভাগ একে অন্যের সাথে মিশে থাকে।
ফলে পঞ্চতত্ত্বের তরঙ্গ দেহ থেকে বেড়িয়ে না গিয়ে দুই হাতের মাঝে চক্রাকারে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এতে যিনি এমন ভঙ্গি করেন তার মাঝে পঞ্চতত্ত্বের সমতা সৃষ্টির আবহ তৈরি হয়। ফলে তার মাঝে ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি এক ধরনের নমনীয়তা ভাবের উদয় হয়। আর এই ভাব তাকে সৃষ্টির প্রতি সম্মানপূর্বক নত হতে শেখায়।
পরবর্তিতে ভারতবর্ষে মুসমানদের প্রবেশের পর ডান হাত কপালে তুলে সালাম দেয়ার বিধান চালু হয়। এতে যিনি সালাম দিচ্ছেন তিনি হাতের আঙ্গুলের পেছনের অংশ কপালের অংশে ছুঁয়ে পঞ্চতত্ত্বের তরঙ্গ সামনের জনের দিয়ে ছড়িয়ে দেন।
এতে যাকে সালাম দেয়া হচ্ছে পঞ্চতত্ত্ব তরঙ্গ তার দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে তার মাঝে প্রশান্তির ভাব প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
অন্যদিকে যিনি সালাম গ্রহণ করেন তিনি বেশিভাগ সময় একই কায়দা করেন। আবার অনেক সময় যিনি গ্রহণ করেন তিনি পাশাপাশি পঞ্চ আঙ্গুল এক সাথে করে হাতের তালুর অংশ নিজের দিকে করে দুই ভ্রূ জুগলের মাঝে ঠেকান। এতে তিনি সামনের জনের তরঙ্গকে নিজের দিকে আরো আকৃষ্ট করেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার নীললোহিত ছদ্মনামে ‘কয়েকটি ছোটখাটো জরুরি বিষয়’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- “হিন্দু পরিবারভুক্ত বাঙালীরা সদ্য পরিচয়ের পর হাত তুলে বলে, নমস্কার। করতল দুটি যুক্ত হয়ে, কপাল বা বুকের কাছে চলে আসে।
…কিন্তু লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে হাত জোড় করে নমস্কার প্রথা সাধারণভাবে প্রচলিত নেই। কেউ কেউ আমার নমস্কারের উত্তরে ঐ ভঙ্গিতে প্রতি নমস্কার করেননি।
তারপর থেকে আমি পূর্ব বাংলার সদ্য পরিচিত মুসলমান বন্ধুদের দেখাদেখি শুধু ডান হাতখানা কপালের কাছাকাছি তুলে সেলামের ভঙ্গি করতাম সম্প্রীতির বিনিময় একই প্রকারের না হলে ঠিক সাবলীন হওয়া যায় মাঝখানে একটু ব্যবধান থেকেই যায়।
সাহেবদের সঙ্গে পরিচয় হলে আমরা তাদেরই প্রথায় শেক হ্যান্ড করি। পশ্চিম বাংলার অনেক মুসলমান বন্ধু আমাদের সঙ্গে ঠিক একইভাবে হাত তুলে বলেন, নমস্কার।”
পশ্চিমা বিশ্ব এই করমর্দনকে অনেকভাগে ভাগ করেছেন। অনেকগুলোর আছে নির্দিষ্ট নামও। আবার বিশেষজ্ঞরা এই করমর্দনের ভঙ্গি থেকে ব্যক্তির চরিত্র পর্যন্ত অনুসন্ধান করার প্রয়াস করেন। সাহেবদের কয়েকটা করমর্দনের নাম বলতে গেলে বলতে হয়-
করমর্দন যদি জোর না থাকে অর্থাৎ নিথর করমর্দন হয় তাহলে তাকে বলা হয় ‘ডেড ফিশ হ্যান্ডশেক’। এটি ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের অভাব ভাব প্রকাশ করে। করমর্দনের সময় যদি কোনো কারণে নার্ভাস হয়ে কারো হাত ঘেমে যায় তাহলে তাকে ‘সোয়েটি হ্যান্ডশেক’ বলে।
স্পর্শে একে অপরকে কতটা চাপ দিচ্ছে-কিভাবে দিচ্ছে, তার ধরনের উপর ভিত্তি করে পরস্পরের প্রতি অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। স্নেহ, ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ স্পর্শে ধরা পরে।
করমর্দনের সময় অনেকে অন্যের হাত নিজের দিকে টেনে নেয়। কেউ কেউ হাত ধরেই রাখে ছাড়তে চায় না। আবার অনেকে ক্রমাগত ঝাঁকাতেই থাকে। এভাবে করমর্দনে নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশ করে থাকে।
আবার অনেকে অন্যের এরূপ আচরণে নিজেও পুনরায় হাত শক্ত করে চাপ দিয়ে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে। অনেকক্ষেত্রে দুইজনই একই রূপ অর্থাৎ শক্ত হাতে করমর্দন বা উভয়েই শীতল হাতে করমর্দন পরস্পরের সমমনষ্কতা প্রকাশ করে।
বেশিভাগক্ষেত্রে করমর্দনকালে অল্প সময় পরস্পর পরস্পরের হাত স্বাভাবিকভাবে ধরে আলতো চাপ দিয়ে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়াই রীতি। অনেকে আবার সর্বশক্তি দিয়ে করমর্দন করে। সাধারণত ডিফেন্সের লোকরা এই ধরনের করমর্দনে তাদের সমর্থ অন্যকে বোঝাতে চায়।
অনেক বলশালী লোকও শক্ত হাতে করমর্দন করে। আবার রাজনৈতিক করমর্দনে প্রথমে ডান হাতে পরস্পর করমর্দনের সময় সাথে বাম হাতও জুড়ে দিয়ে বন্ধুত্ব অটুট আছে বা থাকবে এটা বোঝাতে চান।
বয়সে বড় বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্মারা অনেক সময় করমর্দনের সময়কালে অন্য হাত দিয়ে পিঠে হালকা আলতো করে কয়েকবার চাপড়ে দিয়ে অভয় বা সাহস দেন।
আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে কথোপকথনের সময় পরস্পর একে অন্যের হাত ধরে ঝাঁকাতেই থাকে কথা বলবার সময়। একজন ঝাঁকুনি বন্ধ করলে তবেই অন্যজন কথা বলার সুযোগ পায়। এভাবে কথা বলার সময় তারা পরস্পর পরস্পরের হাত ধরেই থাকে।
আবার আফ্রিকার মাসাইয়ের পুরুষরা একে অপরকে তাদের হাতের তালুর খুব সংক্ষিপ্ত মুহুর্তের জন্য স্পর্শ করে শুভেচ্ছা জানায়।
অন্যদিকে ইথিওপিয়ায় করমর্দনে বাম হাতের ব্যবহার করা অসভ্যতা বলে বিবেচিত হয়। প্রবীণ, প্রভাবশালী বা সম্মানিতদের শুভেচ্ছা জানানোর সময়, ধনুক এবং বাম হাত ডানদিকে মুখ করে করমর্দন করার প্রথা কঠিন ভাবে পালন করা হয়।
(চলবে…)
………………….
আরো পড়ুন:
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-২
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৩
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৪
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৫
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৬
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৭
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৮
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৯
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১০