-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: স্পর্শ : স্পর্শের কাতরতা: সপ্তম পর্ব
বিশ্বাসীরা তো ভগবানের প্রতিমাকে না ছুঁইয়ে কিছুই গ্রহণ করেন না। ভগবান বা ইষ্ট দেবতার পরশে বিষও অমৃত হয়ে উঠে ভক্তের বিশ্বাসে। স্রষ্টার স্পর্শের কাতরতায় ভক্তের মাঝে সঞ্চায় হয় নতুন অনুভূতি।
তেমনি গুরুবাদীদের কাছে গুরু হচ্ছেন সর্বোচ্চ আরাধ্য মানুষ। যার সাধন-ভজন করলে পরমের সন্ধান তথা নিজের সন্ধান লাভ করা যায়। তাই গুরু ভক্তি একটা বিশাল ব্যাপার। আর গুরু ভক্তি বা গুরুজন ভক্তির সাথে ‘কদমবুচি’ বলে একটা স্পর্শ জড়িয়ে আছে।
শ্রীশ্রী সীতারাম কথামৃতে উল্লেখ আছে- ‘গুরু শক্তি ক্ষণিক স্পর্শের আনন্দ দান করেন না। তিনি কুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে দেন। তখন সাধক কৃতার্থ হয়। আধার অনুযায়ী গুরুশক্তিই সকলকে নিয়ে চলেছেন। প্রারব্ধ কর্ম ক্ষয় করতে করাতে শ্রীগুরুই সকলকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।’
ভারতবর্ষে হাত তুলে ভক্তি-নমস্কার-সালাম দেয়ার যেমন বিধান আছে তেমনি আছে বড়দের পায়ে ছুঁয়ে আর্শিবাদ নেয়ার প্রথাও। এই প্রথাও বেশ প্রাচীন। মুসমানদের শরিয়ত এটিকে সরাসরি সমর্থন না করলেও অনেক জায়গাতেই পায়ে ছুঁয়ে আর্শিবাদ নেয়ার বিষয়টি দেখা যায়।
পরিবারের বড়দের, বিশেষ করে বাবা-মা সহ শিক্ষকরা পায়ে ছুঁয়ে সালামের অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। বিষয়টি ‘কদমবুচি’ নামে অধিক পরিচিত।
এই নত হয়ে পা ছুঁয়ে ভক্তি দেয়ার বিষয়টি সাধনপথে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং ভিন্ন তাৎপর্যও বহন করে। যোগ যেমন বলে, হাতের আঙ্গুল দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডে মৌলিক পঞ্চতত্ত্ব তরঙ্গ রূপে যাতায়াত করে। তেমনি বলে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে সেই তরঙ্গ কেবল বের হয় প্রবেশ করে না।
তাই গুরুর চরণে ভক্ত যখন তার হাত ছুঁয়ে দেয়। তখন গুরুর ইতিবাচক-স্থির-প্রশান্ত-আনন্দময় তরঙ্গ ভক্তের মাঝে প্রবেশ করে। অন্যদিকে ভক্ত যখন গুরুর কাছে নত হতে শিখে তখন তার মাঝে সমর্পণ ভাব জাগে-ভক্তি ভাব জাগে।
অহংবোধ কমে। নিজের গড়িমা ভেঙে খান খান হয়ে ভক্ত সহজ হতে শুরু করে। আর গুরু যখন নিজের হাত ভক্তের মাথায় বা পিঠের উপর রাখে ভক্ত তখন পায় ভরসা বা আশ্রয়ের আশ্বাস।
সাধুগুরুরা বলেন, এই নত হয়ে ভক্তি মূলত গুরুকে নয়। গুরু-মুর্শিদ রূপে মূলত সেই পরম, পরমেশ্বর বা পরওয়ারদিগারকেই করা হয়। তিনিই একমাত্র ভক্তি পাওয়ার যোগ্য। তাই সকল ভক্তি মূলত তাকেই করা হয়। গুরু কেবল দেহধারী মাধ্যম মাত্র।
আবার বিষয়টি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয়, জীবের মাঝেই বাস করে পরমেশ্বর। অর্থাৎ পরমের অংশই জীব। তাই সেই জীবকে ভক্তি দিলে তা পায় সেই পরমেশ্বরই। তাই গুরুবাদী প্রায় সকল মতাদর্শেই নত হয়ে চরণ ছুঁয়ে ভক্তি দেয়ার বিধান দেখতে পাওয়া যায়।
ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-
গুরুর চরণ অমূল্য ধন
বাঁধো ভক্তি রসে,
মানব জনম সফল হবে
গুরুর উপদেশে।।
হিংসা নিন্দা তমঃ ছাড়ো
মরার আগেতে মরো,
তবে যাবে ভবপারে
ঘুচবে মনের দিশে।।
ষোলকলা পূর্ণরতি
হতে হবে ভাবপ্রকৃতি,
গুরু দেবেন পূর্ণরতি
হৃদকমলে বসে।।
পারাপারের খবর জানো
মহর গুরুকে মানো,
লালন কয় ভাবছো কেন
পড়ে মায়ার ফাঁসে।।
অনেক মতে, গুরু বা গুরুজনের পায়ে হাত ঠেকিয়ে তা কপালের মধ্যখানে যেখানে আগ্যাচক্রের স্থান অর্থাৎ ভ্রূ’মধ্যে ঠেকিয়ে ভক্তি শেষ করা হয়। আবার অনেক প্রথায় চরণে চুমু খেতেও দেখা যায়। আসলে বিষয়টি নানা মতে, নানা পথে, নানা বিধি প্রচলিত আছে। আর প্রত্যেকের কাছেই সেই আলাদা আলাদা স্পর্শের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে।
তবে ভারতবর্ষে কে কাকে আগে নমস্কার করবে এ নিয়ে কম দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়নি। জাত-পাত-গোত্র-সম্প্রদায়-ধর্ম-দর্শন-বড়-ছোট কত কিছু নিয়ে যে এই দ্বন্দ্ব তার হিসেব রাখা মুশকিল।
ধর্মীয় সংস্কারে দেখা যায় অনেক সম্প্রদায় অন্যের ছোঁয়াকে এড়িয়ে যায় সচেতন ভাবে। এমনকি কারো ছায়া পর্যন্ত পড়তে দেয় না গায়ে। সনাতন সম্প্রদায়ে জাতভেদ প্রথা যখন প্রবল ছিল তখন এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। এখনো তা অনেক জায়গায় বলবদ থাকলেও আগের মতো এর জন্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা তেমন হয় না।
তবে স্নান করে পুজায় বসা পর্যন্ত মুর্হূতে কারো ছোঁয়া থেকে বিশ্বাসীরা নিজেদের বাঁচিয়ে চলে। এটিকে এখনো কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। মুসলমানরাও অজুর পর নামাজ পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের দেহের বার্হিক পরিত্রতা রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
অন্যান্য মতেও তাই। কারণ স্পর্শ আপনাকে মুর্হূতে কেবল চিন্তা-চেতনায় নয় সমগ্র মানুষিকতায় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে।
সাধুগুরুদের মাঝেও এই স্পর্শের বিষয়টি বেশ লক্ষণীয়। সাধুগুরুরা সকলের ছোঁয়া গ্রহণ করেন না। আবার সকলের ছোঁয়া পত্রে আহার বা জল পানও করেন না। তার অবশ্য এক গূঢ় কারণ আছে। সাধুগুরুরা সকল সময় একটা স্থিতিতে থাকতে চান। সেই স্থিতি থেকে বিচ্যুত হলে তাদের উপলব্ধির ধারার ব্যাঘাত ঘটে।
তাই তারা এমন কারো স্পর্শ হঠাৎ করে নিতে চান না যাদের সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। তিনি তাদের স্পর্শই প্রত্যাশা করেন যাদেরকে তিনি তার সাধন মতে প্রস্তুত করেন দীর্ঘ দিন ধরে। তাহলে চিন্তা-চেতনার তরঙ্গে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে না।
ধরুন আপনি একটি ভাবনার মাঝে আছেন। বা স্রষ্টার ধ্যানে আছেন। এমন সময় এমন একজনের সাথে সাক্ষাৎ হলো তিনি প্রচণ্ড বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করছেন, বা বিক্ষিপ্ত ভাবনায় ডুবে আছেন। তাকে ছুঁয়ে দিলে হয়তো সাধক যে ভাবনায় অনেকটা এগিয়ে চলেছেন তা মাঝ পথেই মোড় ঘুড়ে যেতে পারে।
এসব কারণে সাধুগুরুরা সাধনকালে নিজ ভক্ত বিনে অন্যের স্পর্শ বিশেষ করে হাতের স্পর্শ নিতে চান না। এটা জাত-পাত-গোত্র-সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ থেকে নয়। এ কেবলই নিজ উপলব্ধির ধারাকে সঠিক পথে চালানোর জন্য। সে কারণে সাধুগুরুদের নিকটে যারা অবস্থান করেন সাধুগুরুরা তাদের সেভাবে গড়ে তুলেন।
যাতে তারাও সাধুগুরুর মতো সমান স্থিতিতে অবস্থান করতে পারে। আবার সাধুগুরুদের রান্না যারা করেন পরিবেশন যারা করেন তাদেরকেও সেই শিক্ষাই দেয়া হয়। কারণ স্পর্শ দিয়েই ভোজন পাকানো হয়। তা রান্না হয়ে গেলেও তার মাঝে সেই স্পর্শ থেকেই যায়।
যে যেমন স্থিতিতে রান্না করেন তাতে তার পরশ ঠিকই থাকে। তাই তো আমরা বলি মায়ের মতো রান্না আর কেউ করতে পারে না। এ কথার মানে এই নয় যে মা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাধুনী। এর মানে হলো মায়ের মতো মমতার স্পর্শ দিয়ে সন্তানের জন্য আর কেউ রাঁধতে পারে না।
এটাই হলো স্পর্শের শক্তি। আর এই মমতার স্পর্শ-স্থিতির স্পর্শ- ভালোবাসার স্পর্শ-বিশ্বাসের স্পর্শ-ভরসার স্পর্শ ইত্যাদি ইত্যাদিই সাধুগুরুরা অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে। তাই যখন নতুন কোনা আগন্তুকের মাঝেও এসব গুণ লক্ষ করেন তাকে জড়িয়ে ধরতেও দ্বিধা করেন না।
তার গৃহে আহার-বিহার করতেও পিছপা হন না। কথিত আছে, প্রাচীন ভারতের বৈশালী নগরের বারবণিতা আম্রপালী গৃহে সশিষ্য আমন্ত্রণে সম্মতি প্রদান করেন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ। একথা শুনে বৈশালীর মানুষ হতবাক। ঘটনা শুনে বৈশালীর রাজা উপস্থিত হলেন বুদ্ধের কাছে।
রাজা বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন আম্রপালীর নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে রাজ পরিবারের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে। আম্রপালীকেও নানা প্রলোভন দেখালেন কিন্তু তিনিও প্রত্যাখ্যান করেন। বৈশালীর মানুষদের বিস্মিত করে নির্ধারিত দিনে গৌতম বুদ্ধ সশিষ্য আম্রপালীর গৃহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন।
(চলবে…)
………………….
আরো পড়ুন:
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-২
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৩
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৪
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৫
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৬
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৭
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৮
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৯
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১০