ভবঘুরেকথা
স্পর্শের কাতরতা ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: স্পর্শ : স্পর্শের কাতরতা: অষ্টম পর্ব

কথায় বলে, ‘পরশ পাথরের স্পর্শে লোহাও সোনা হয়’। অর্থাৎ স্পর্শের কাতরতা নতুন অনুভূতি-অভিজ্ঞতা জাগ্রত করে। তেমনি গৌতম বুদ্ধের সংস্পর্শে আম্রপালীর জীবনেও আসে পরিবর্তন। এই হচ্ছে সাধুগুরুদের দৃষ্টি। তারা দেখতে পান কার ভেতরে কি আছে। বাইরের ব্যাপ্তি নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই।

অন্য একটি ঘটনায় বলা হয়, বর্ষাজাপনের জন্য বুদ্ধের শিষ্যরা যখন আশ্রয় খুঁজছিল। তখন এক শিষ্যকে এক বেশ্যা তার গৃহে বাস করার আমন্ত্রণ করে। সেই শিষ্য এ কথা বুদ্ধকে জানালেন। বুদ্ধ বলেন, এতে সমস্যার কি আছে তুমি সেখানে বাস করো। এতে অন্য সকলে হায় হায় করতে লাগলো।

অনেকেই ভাবলো সেই ভক্তের সাধন-ভজন সবই গেলো। ভক্তরাও বুদ্ধের কাছে তাদের আপত্তি জানাতে লাগলো। তখন বুদ্ধ তাদের থামিয়ে বললো, ‘তোমরা কি মনে করো আমাদের জীবনযাপনের দর্শন অপেক্ষা সেই নারীর জীবনযাপনের দর্শন বেশি শক্তিশালী? যার দ্বারা আমাদের প্রভাবিত হওয়ার সম্ভবনা আছে?

আর যদি তার দর্শন আমার দর্শন থেকে অধিক প্রভাবশালী হয় তাহলে আমিও তার দলেই যোগ দিবো এতে সন্দেহ নেই।’

কিন্তু বর্ষা জাপনের পর শিষ্য আনন্দ যখন ফিরলো তখন সকলে দেখলো তার সাথে একজন ভিক্ষুণী এসেছে। সেই বেশ্যা ভিক্ষুণীতে পরিণত হয়েছে। সকলেই তখন তাদের ভুল বুঝতে পারলো। সাধুর গুণে সবই হয়। ফকির লালন সাঁইজি এ প্রসঙ্গে বলেছেন-

ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
হিন্দু কি যবন বলে জাতের বিচার নাই।।

ভক্ত কবির জেতে জোলা
শুদ্ধ ভক্তি মাতোয়ালা,
ধরেছে সেই ব্রজের কালা
দিয়ে সর্বস্ব ধন তাই।।

রামদাস মুচি ভবের পরে
ভক্তির বল সদাই করে,
সেবায় স্বর্গে ঘণ্টা পড়ে
সাধুর মুখে শুনতে পাই।।

এক চাঁদে হয় জগৎ আলো
এক বীজে সব জন্ম হলো,
লালন বলে মিছে কলহ
ভবে দেখতে পাই।।

স্পর্শে আরেক প্রতিশব্দ হলো পরশ। আর পরশের সাথে জড়িয়ে আছে ‘পাথর’ নামটি। যা মিলে হয় ‘পরশ পাথর’। অর্থাৎ যা স্পর্শে পাথরেও প্রাণ পায়। সে পরশ পথরের পরশ এমনই পরশ যা ছুঁইয়ে দিলে লোহাও সোনা হয়ে যায়।

মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি, ‘প্রতিটা আত্মাই সোনা হয়ে যায়, যখন প্রিয়তমার স্পর্শ পায়।’

বাইবেলে উল্লেখ আছে, “…পরে একজন ফরীশী তাঁকে বার বার তার সঙ্গে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে লাগল। তাই, তিনি সেই ফরীশীর বাড়িতে প্রবেশ করে টেবিলে খেতে বসলেন। আর দেখো! সেই নগরে একজন মহিলা ছিল, যাকে সবাই পাপী বলে মনে করত।

সে যখন জানতে পারল, যীশু সেই ফরীশীর বাড়িতে খেতে বসেছেন, তখন সে একটা শ্বেতপাথরের বোতলে সুগন্ধি তেল নিয়ে এল। পরে সে যীশুর পিছনে তাঁর পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগল এবং তার চোখের জলে যীশুর পা ভিজিয়ে দিতে লাগল আর সে তার মাথার চুল দিয়ে যীশুর পা মুছে দিল।

এরপর সে তাঁর পায়ে কোমলভাবে চুম্বন করল এবং সুগন্ধি তেল ঢেলে দিল। তা দেখে যে-ফরীশী তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, সে মনে মনে বলতে লাগল, ‘এই ব্যক্তি যদি সত্যিই একজন ভাববাদী হতেন, তা হলে তিনি জানতেন, তাঁকে যে স্পর্শ করছে, সে কে এবং কেমন মহিলা আর তিনি বুঝতে পারতেন, এই মহিলা পাপী।’

কিন্তু, তার চিন্তা বুঝতে পেরে যীশু তাকে বললেন, ‘শিমোন! আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।’

এতে শিমোন বললেন, ‘গুরু, বলুন!’

-‘দু-জন ব্যক্তি একজন মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল; একজন ৫০০ দিনার এবং আরেকজন ৫০ দিনার। যেহেতু তাদের ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য ছিল না, তাই মহাজন তাদের ঋণ পুরোপুরিভাবে ক্ষমা করে দিলেন। তাহলে, সেই দু-জনের মধ্যে কে তাকে বেশি ভালোবাসবে?’

উত্তরে শিমোন বললেন, ‘আমার মনে হয়, যে-ব্যক্তির বেশি ঋণ ক্ষমা করা হয়েছিল, সে।’

যীশু তাকে বললেন, ‘তুমি সঠিক উত্তর দিলে।’

এরপর তিনি সেই মহিলার দিকে ঘুরে তাকালেন এবং শিমোনকে বললেন, ‘তুমি কি এই মহিলাকে লক্ষ করেছ? আমি তোমার বাড়িতে প্রবেশ করেছি; তুমি আমাকে পা ধোয়ার জন্য জল দাওনি। কিন্তু, এই মহিলা তার চোখের জল দিয়ে আমার পা ভিজিয়ে দিয়েছে এবং তার চুল দিয়ে পা মুছে দিয়েছে।

তুমি আমাকে চুম্বন করনি, কিন্তু আমি আসার পর থেকে এই মহিলা আমার পায়ে কোমল­ভাবে চুম্বন করছে। তুমি আমার মাথায় তেল ঢেলে দাওনি, কিন্তু এই মহিলা আমার পায়ে সুগন্ধি তেল ঢেলে দিয়েছে। তাই, আমি তোমাকে বলছি, তার পাপ বেশি হওয়া সত্ত্বেও তা ক্ষমা করা হল, কারণ সে বেশি ভালোবেসেছে। কিন্তু, যাকে কম ক্ষমা করা হয়, সে কম ভালোবাসে।’

পরে তিনি সেই মহিলাকে বললেন, ‘তোমার পাপ ক্ষমা করা হল।’

যারা তাঁর সঙ্গে টেবিলে খেতে বসেছিল, তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘এই ব্যক্তি কে, যে এমনকী পাপও ক্ষমা করে?” (লূক ৭:৩৭-৪৯)

স্বামী পরমানন্দ বলেছেন- ‘কেবলমাত্র সাধুসঙ্গেই বিবেক জেগে ওঠে। একটা জ্বলন্ত প্রদীপই পারে অসংখ্য অন্য প্রদীপকে জ্বালাতে। সাধু হলেন সেই আলোকবর্তিকা যাঁর জাগ্রত বিবেকের স্পর্শে অপরের বিবেক জেগে ওঠে।’ আর ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-

ভজোরে আনন্দের গৌরাঙ্গ।
যদি ত্বরিতে বাসনা থাকে
ধর রে মন সাধুর সঙ্গ।।

সাধুর গুণ যায় না বলা
শুদ্ধচিত্ত অন্তর খোলা,
সাধুর দরশনে যায় মনের ময়লা
পরশে প্রেমতরঙ্গ।।

সাধুজনার প্রেম হিল্লোলে
কত মানিক মুক্তা ফলে,
সাধু যারে কৃপা করে
প্রেমময় দেয় প্রেম অঙ্গ।।

এক রসে হয় প্রতিবাদী
এক রসে ঘুরছে নদী,
এক রসে নৃত্য করে
নিত্যরসের গৌরাঙ্গ।।

সাধুর সঙ্গগুণে রঙ ধরিবে
পূর্ব স্বভাব দূরে যাবে,
লালন বলে পাইবে প্রাণের গোবিন্দ
কররে সৎসঙ্গ।।

আমরা যখন অসুস্থ হই তখন চাই কেউ আমাদের ছুঁয়ে থাকুক। আমাদের যখন ভালোবাসা পায় তখনো আমরা চাই কেউ আমাদের স্পর্শ করুক। জন্মের পর শিশু সব সময়ই কিছু একটা ধরতে চায়। আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। ধরে থাকা-স্পর্শ একটা ভরসার ভাষা। আশ্রয়ের আশ্বাস।

ঘুমের মাঝেও শিশু কাউকে স্পর্শ করে বা ধরে রাখতে চায় হাতের মুঠোয়। পাশাপাশি পায় পরিচিত-প্রিয়জন বা আশ্রয়দাতার দেহের স্পর্শ। বিশেষ করে মা-বাবা-ভাই-বোন পরিজন কেউ একজন তাকে স্পর্শ করে রাখলে সে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে।

শিশু যতই বড় হতে থাকে স্পর্শ ইন্দ্রিয় তার কাছ গুরুত্ববহ হয়ে উঠতে থাকে। সে চোখে যা দেখে, কানে যা শোনে তাই ছুঁয়ে দেখতে চায়। ছুঁয়ে তার অনুভূতি নিতে চায়। সর্বক্ষণই চায় প্রিয়জনের স্পর্শ। কেউ তাকে কোলে নিক, চুমু খাক, তাকে জড়িয়ে রাখুক সবই সে চায়।

বড় হতে হতেও সে যার উপর ভরসা করতে শেখে বিশেষ করে ভয় পেলে তাকে আকড়ে ধরে। আমরা বড়রাও তেমনি আনন্দে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে-আলিঙ্গন করে। স্পর্শের অনুভব নিতে চাই। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের পর সাক্ষাত হলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরার যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

আবার মন খারাপ হলে, হতাশ হলে, ব্যথিত হলেও অন্যকে স্পর্শ করে মানুষ কাঁদতে চায়। সমব্যথী হয়েও মানুষ স্পর্শ করে ভরসা জোগায়।

(চলবে…)

………………….
আরো পড়ুন:
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-২
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৩
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৪
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৫
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৬
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৭
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৮
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৯
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!