-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: স্পর্শ : স্পর্শের কাতরতা: নবম পর্ব
স্পর্শ বড়ই বিচিত্র এক অনুভূতি। স্পর্শের কাতরতা এক নতুন অভিজ্ঞতা প্রতি নিয়ত। যা আমাদের অন্তকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক ধরণের স্পর্শের ব্যাখ্যা আমাদের থাকে না। বিশেষ বিশেষ মুর্হূতে আমরা সেসব অনুভব করি মাত্র।
মায়ের স্পর্শ, বাবার স্পর্শ, ভাইয়ের স্পর্শ, আত্মীয়-স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশীর স্পর্শ, বন্ধু-বান্ধবের স্পর্শ, পরিচিত-অপরিচিতের স্পর্শে আছে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি, অনুভব ও আবেদ। কোনটা ভরসা, কোনটা বিশ্বাস, কোনটা সৎ, কোটা অসৎ স্পর্শ ইত্যাদি ইত্যাদি।
শিশুর কাছে যেমন মায়ের স্পর্শ সবচেয়ে কাঙ্খিত। আবার প্রেমিকের কাছে প্রেমিকার স্পর্শ ভিন্ন মাত্রা দেয়। নর-নারীর পারস্পরিক প্রেমময় স্পর্শে-সংস্পর্শে উদিত হয় গভীর আবেগ। জন্ম নেয় নব প্রজন্ম। স্পর্শের ধারায় চলতে থাকে জন্মান্তরের লীলা।
আবার স্পর্শের বাড়াবাড়িতে হয় বিচ্ছেদ। একে অন্যকে আঘাত করায় ব্যবহার করে স্পর্শকে। তখন স্পর্শ হয়ে হয়ে মারাত্মক-মর্মান্তিক-নির্মম। মানুষ শাসন করার জন্য যেমন একে অপরের গায়ে হাত তোলে। তেমনি পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাত বা আধিপত্য বিস্তারের জন্যও আঘাত করে।
শাস্তি দেয়ার জন্য এই স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। এই স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের শাস্তির যে কত বিচিত্র সব পদ্ধতি জগৎ জুড়ে আছে সে বিষয়ে না লেখাই উত্তম। সেই নির্মমতা-পৈচাশিকতায় নাই বা গেলাম।
কেউ কেউ উপমা পায়, ‘গণ্ডারের চামড়া’ হিসেবে। অর্থাৎ যাদের চরম অপমান করলেও কোনো প্রতিকৃয়া দেয় না। সমাজে অনেকেই দুর্বলকে অপমান করে আনন্দ পায়। দুর্বল হলেও অনেকে তার প্রতিবাদ করে। কিন্তু অনেকেই তা নিরুপায় হয়ে সহ্য করতে করতে এমন একটা পর্যায় নিজেকে নিয়ে যায়।
তাতে করে তার আর প্রতিকৃয়া হয় না। আবার যে কোনো কথায় গা করে না বা গুরুত্ব দেয় না তাকেও ‘গণ্ডারের চামড়া’ বলা হয়। অর্থাৎ সে তার স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। বা তার স্পর্শ ইন্দ্রিয় ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে।
স্পর্শের আরেকটা প্রয়োগ হচ্ছে ঘর্ষণ। আর এ ঘর্ষণ সম্পর্কে বলতে গেলে সবচেয়ে আগে যে গল্পটি চলে আসে তা হলো, ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’। প্রাচীন এই গল্পে যুবক আলাদিন ঘটনাক্রমে পেয়ে যায় আশ্চর্য এক প্রদীপ। যে প্রদীপ ঘষলেই হাজির হয় অতিকায় দৈত্য।
যার ঘর্ষণে প্রদীপ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে তারই গোলাম হয় সেই দৈত্য। আর গোলাম হয়ে মালিকের সকল হুকুম তামিলই তার কর্ম। এ গল্প আমাদের সকলেই জানা।
এই ঘর্ষণ আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে প্রতিনিয়তই ব্যবহৃত হয়। দেহের ত্বক তথা স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে স্বতেজ করতে ঘর্ষণ একটি অন্যতম প্রয়োগ। প্রাচীনকাল থেকেই ত্বকের যত্নেই শুধু নয় সুস্বাস্থ্যের জন্যও ত্বক ঘর্ষণ বা মালিশের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
আধুনিক দেহ পরিচর্যায় এটি অনেক বিচিত্র সব নামে পরিচিত। তবে দেহ মালিশ বা ঘর্ষণে দেহ মন চাঙ্গা যেমন হয় তেমনি স্পর্শ ইন্দ্রিয় পায় নতুন উদ্দীপনা। কথায় বলে, বহু স্পর্শে ব্যবহৃত বস্তু হয় চকচকে-মসৃণ-তেলতেলে। তেমনি স্পর্শহীন সম্পর্কও অব্যবহারে ফিকে হয়ে যায়।
আবার অধিক স্পর্শও সম্পর্কে নিয়ে যায় ভিন্ন পথে। আমাদের সঞ্চিত সংস্কারে জমা থাকা স্পর্শের অনুভূতি অনেক সময় আমাদেরকে নতুন স্পর্শের সঠিক মানে বুঝতে দেয় না। আমরা আবেগে ভেসে যাই। চাতুরিটা ঠিক ধরে উঠতে পারি না।
ঠকে যাই সম্পর্কের বিশ্বাসে। তাই আধুনিক সময়ে দুটি শব্দের বহুল ব্যবহার শুরু হয়েছে। শব্দদুটি হলো- ‘ভালো স্পর্শ’ আর ‘খারাপ স্পর্শ’। অর্থাৎ বিশেষ উদ্দেশ্যপূর্ণ স্পর্শ থেকে সতর্ক করতে এর প্রচলন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ অনেক সময় বড়রা খারাপ বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত স্পর্শ টের পেলেও ছোটরা তা বুঝতে পারে না।
মানুষের মাঝে কাম আর ক্রোধ এ দুটি নিজে নিজেই জন্ম নেয়। এরজন্য তাকে বিশেষ কোনো ক্রিয়া করতে হয় না। সে মানুষ সভ্যতার চূড়ায় থাকুক বা নিভৃত কোনো পল্লীতে কিংবা বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে। আর এই কাম-ক্রোধের চূড়ান্ত বর্হি প্রকাশই হয় স্পর্শে।
এই কাম ক্রোধকে বশে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে সভ্য সমাজ যেমন নানা আইনকানুন প্রণয়ন করে সমাজে। তেমনি ধর্ম-দর্শনও নানা বিধিবিধান-শাস্তির কথা বলে।
সাধুগুরুরাও বিভিন্ন পন্থার কথা বলেন। সর্বোপরি স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের অযাচিত ব্যবহারে যেমন নিজের মন মানুষিকতা নষ্ট হয়। তেমনি সমাজ-ধর্ম-দর্শনের কাছেও হতে হয় অপরাধী।
তবে সকল সমাজ সকল স্পর্শকে অন্যায় না পাপ বলে মানা হয় না। কোনো কোনো সমাজে যা স্বাভাবিক স্পর্শ তা অন্য কোনো সমাজে হয়তো ঘোরতর অপরাধ বলে বিবেচ্য। আর এই স্পর্শের ভাষা যে জেনে বুঝে নিতে পারে সেই পারে সামনের মানুষটার সাথে সহজে সম্পর্ক তৈরি করতে।
অনেক সাধকদের মাঝে দেখা যায়। নতুন কেউ তাদের কাছে গেলে তারা তার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘসময় বসে থাকে। বিশ্বাসীরা বলেন, এতে তারা আগন্তুকের সম্পর্কে এক ধরণের ধারণা তৈরি করে নেয়। আবার অপরাধী শনাক্ত করতেও প্রশাসন হাতের ছাপের সাহায্য নেয়।
বলা হয়ে থাকে প্রত্যেক মানুষের আঙ্গুলের ছাপই ভিন্ন। কারো সাথে কারো হাতের ছাপের মিল এখনো পাওয়া যায়নি। ১৮৮০ সাল থেকে গবেষণা শুরু করে ১৮৯২সালে ইংল্যান্ডে স্যার ফ্রান্সিস গোল্ট ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট’ আবিষ্কার করেন।
তবে অনেকে দাবী করেন, আঙুলের ছাপের প্রকৃত আবিষ্কারক আসলে বাংলাদেশের খুলনার কাজি আজিজুল হক। আজিজুল হক যখন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, তখন তাঁকে আঙুলের ছাপসংক্রান্ত একটা প্রকল্পে কাজ করার জন্য মনোনীত করা হয়।
ব্রিটিশরাজের অধীন বাংলার পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল স্যার অ্যাডওয়ার্ড হেনরির নেতৃত্বে প্রকল্প শুরু হয়। প্রাথমিক গবেষণার পর আঙুলের ছাপ নেওয়া কাগজপত্র ফাইলভুক্ত করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।
এর সমাধানে আজিজুল হক বিশেষ পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন। যা তার নামের পরিবর্তে তার ঊর্দ্ধতন কর্তা ‘হেনরি সিস্টেম’ বা ‘হেনরি পদ্ধতি’ নামে পরিচিতি পায়।
আবার আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও এই আঙ্গুলের ছাপ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এক সময় যেমন ‘চিকিংফাঁক’ বললে গুপ্তধনের বন্ধ দরজা খুলে যেত। কালক্রমে আজ হাতের ছাপে খুলে যায় গুপ্ত ভাণ্ডার। নিরাপত্তার খাতিরে এমনি মানুষকে শনাক্তে এই স্পর্শ ইন্দ্রিয় তাই বিজ্ঞানের কাছেও বিশেষ গুরুত্ববহ।
বিজ্ঞানে যেমন স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের গুরুত্ব আছে তেমনি আছে ধর্ম ও বিশ্বাসে। পৌরাণিক কাহিনীর জনপ্রিয় চরিত্র ফিনিক্স পাখিকে ঘিরেও আছে স্পর্শের এক গাঁথা। বলা হয়ে থাকে, জীবের মৃত্যু অনিবার্য হলেও অলৌকিক ফিনিক্স পাখি চিরঞ্জীবী।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, পবিত্র অনল প্রভা থেকে ফিনিক্স পাখির সৃষ্টি। ফিনিসীয় পুরাণ, চাইনিজ পুরাণ, গ্রিক পুরাণ, প্রাচীন মিসরীয়, রাশিয়া, তাইওয়ানসহ বহু পৌরাণিক বর্ণনায়ও ফিনিক্স পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে ফিনিক্স হল এক পবিত্র ‘অগ্নিপাখি’। কিংবদন্তি মতে, ফিনিক্স যখন মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তখন তার চোখ থেকেও জল গড়ায়, আর তার স্পর্শে মানুষ হয়ে ওঠে মৃত্যুঞ্জয়ী বা অমর।
আর এই অমরত্বে আশায় অলৌকিক ফিনিক্স পাখির স্পর্শ পাওয়ার জন্য কত সাধক যে সাধনায় লীন হয়েছে তার হিসেব মালা ভার। কারণ অরমত্বের স্বপ্ন সকল মানুষের মাঝেই অল্প বিস্তর বাসা বেঁধে থাকে।
অন্যদিকে নানা ধর্ম-বিশ্বাসে বিশেষ বস্তু-প্রাণী-বৃক্ষ-প্রতীক-প্রতিমা-স্থাপত্য স্পর্শ করে মানত করার বিধান দেখতে পাওয়া যায়।
বিশ্বাসীরা বলেন, পবিত্র স্থানে-পবিত্র মনে-পবিত্র বস্তু স্পর্শে সকল মনো বাসনা পূর্ণ হয়। আর এই স্পর্শ করার জন্য বিশ্বাসীরা কত পথ চলে, কত সাধ্য-সাধনা-তপস্যা যে করে তা তো অল্প বিস্তর আমরা সকলেই জানি।
পুরীর জগন্নাথের রথ প্রসঙ্গে ইন্দ্রনীলময় পুরাণ বলছে, ‘জগন্নাথের রথের রশি সামান্য স্পর্শ করলেই পুনর্জন্ম হয় না।’
আবার কপিল সংহিতায় আছে- ‘গুন্ডিচাখ্যং মহাযাত্রা যে পশ্যন্তি মুদনিতাঃ সর্বপাপ বিনির্মুক্তা তে যান্তি ভুবন মম।’ স্বয়ং জগন্নাথদেব বলছেন, গুন্ডিচা মহাযাত্রায় যে ব্যক্তি আমাকে দর্শন করবে সে কালক্রমে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আমার মধ্যে আশ্রয় পাবে।
তবে পবিত্র বস্তু চাইলেই যে কেউ.. যে কোনো সময়… যে কোনো ভাবে… স্পর্শ করতে পারে না। তার জন্যও বিভিন্ন মত-পথে বিভিন্ন নিয়ম প্রচলিত আছে। মনোবাসনা পূরণের জন্য বিশ্বাসীরা তার মান্যতা বজায় রেখে ভক্তিভরে আবেগে আপ্লুত হয়ে স্পর্শে জীবন স্বার্থক করে।
মুসলমানদের পাঁচটি অবশ্য পালনীয় কর্মের একটি হলো মক্কায় হজ ব্রত পালন। আর এই পাঁচদিনের হজে কাবা শরিফের চারপাশে সাত বার হাঁটা এবং সেটিকে স্পর্শ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে।
(চলবে…)
………………….
আরো পড়ুন:
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-২
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৩
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৪
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৫
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৬
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৭
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৮
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৯
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১০