নীলাচল থেকে দাক্ষিণাত্য পরিব্রাজনের পথে বিদ্যানগরে চৈতন্যদেবের সঙ্গে রায় রামানন্দের সাক্ষাৎকার এবং কথোপকথন ইতিহাসের এক স্বর্ণঅধ্যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের সাধ্যসাধন তত্ত্বের পরিক্রমা সেই সাক্ষাৎকার ও কথোপকথনের সার্থক ফলশ্রুতি। রাজা প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম ভট্টাচার্যের অনুরোধে মহাপ্রভু মিলিত হয়েছিলেন রায় রামানন্দের সঙ্গে।
বিদ্যানগরের শাসনকর্তা রায় রামানন্দ জাতিতে ছিলেন অব্রাহ্মণ। তাঁর জন্মক্ষণ এবং জন্মস্থান সম্পর্কে সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। ভবানন্দ রায়ের পাঁচ পুত্রের মধ্যে রায় রামানন্দ অন্যতম। সৃজনশীল কবি, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ রূপে তাঁর প্রসিদ্ধি। নৃত্যশিল্পে ছিল তাঁর সুচারু দক্ষতা।
মহাপ্রভুগণের মধ্যে রায় রামানন্দ এক বিদগ্ধ ভাগবত ও সারস্বত ব্যক্তিত্ব। তত্ত্বজ্ঞ দার্শনিক রামানন্দের চিত্ত ছিল বৈরাগ্যে প্রতিষ্ঠিত। ভক্তিপথের যোগ্য অধিকারী রায় রামানন্দকে মহাপ্রভু সাধ্যবস্তু নির্ণয় প্রসঙ্গে বলতে অনুরোধ করলে তাঁর ইচ্ছানুসারে রামানন্দ সাধ্যবস্তুর আলোচনা এবং রাধাকৃষ্ণ প্রেমের স্বরূপ ব্যাখ্যা করলেন।
রায় রামানন্দ স্বধর্মাচরণে বিষ্ণুভক্তি, কৃষ্ণে কর্মার্পণ, স্বধর্মত্যাগ, জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি, জ্ঞানশুন্যা ভক্তি, প্রেম ভক্তি, দাস্য প্রেম, সখ্য প্রেম, বাৎসল্য প্রেম ও কান্তাপ্রেমের কথা বর্ণনা করে কান্তাপ্রেমকে সর্বোচ্চ আসনে স্থাপন করলেন।
এহো বাহ্য, এহো হয়, এহোত্তম প্রভৃতি স্তরবিন্যাসের মধ্য দিয়ে সাধ্যসাধনতত্ত্বের স্বরূপ হয়েছে উন্মোচিত। মহাপ্রভু কর্তৃক আরো কিছু বলবার জন্য অনুরুদ্ধ হলে রায় রামানন্দ যথাক্রমে প্রেমবিলাসবিবর্ত এবং কৃষ্ণতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, শক্তিতত্ত্ব এবং রসতত্ত্বকে সূচারুভাবে করলেন বিশ্লেষণ।
শক্তিতত্ত্ব প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত— গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ ব্রহ্মের শক্তি স্বীকার করেন। এই স্বীকৃতি শ্রুতির উপর প্রতিষ্ঠিত।সচ্চিদানন্দ শ্রীভগবানের তিনটি শক্তি প্রধান—স্বরূপশক্তি, মায়াশক্তি ও জীবশক্তি। স্বরূপশক্তি, অন্তরঙ্গা রূপে অভিহিত, মায়াশক্তি বহিরঙ্গা রূপে চিহ্নিত, জীবশক্তি তটস্থা রূপে বিদিত।
তাঁর অনুরোধের কারণেই, তাঁর তিরোভাব, সমুদ্রে স্নানের পর সমাধি এবং এরপরে কীর্তন ও ভোজন, এই অপূর্ব লীলাগুলি উদযাপিত হয়েছিল। হরিদাস ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন যে ভগবান চলে যাবার পর অবস্থান করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়বে।
সন্ধিনী, সংবিদ্ এবং হ্লাদিনীভেদে স্বরূপশক্তির তিনটি প্রকারভেদ। সন্ধিনীশক্তি অস্তিত্ববাচক। সংবিদ্শক্তি চৈতন্যবাচক এবং হ্লাদিনীশক্তি আনন্দবাচক। যে শক্তির দ্বারা অনাদি অনন্ত কাল ধরে ভগবান বিরাজিত। তাই সন্ধিনীশক্তি। যে শক্তির দ্বারা ভগবান স্বয়ং চৈতন্য বা জ্ঞানবাচক তা সংবিদ্শক্তি এবং যে শক্তির দ্বারা ভগবান নিজে আনন্দিত হন এবং যে শক্তি ভক্তচিত্তে আনন্দ দান করেন তা হ্লাদিনী শক্তিরূপে প্রসিদ্ধা।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রামানন্দ রায়কে জিজ্ঞাসা করলেন যে কোন ব্যক্তি এই পৃথিবীতে ভোগ করতে পারে এমন সবচেয়ে বড় কষ্ট কী? রামানন্দ রায় বললেন, “একজন শুদ্ধ ভক্তের আরেকজন শুদ্ধ ভক্তের প্রতি বা আরেকজন শুদ্ধ ভক্তের বিরহের জন্য যে কষ্ট, সেটিই সবচেয়ে বড় কষ্ট। বিরহই সবথেকে বেশি, অত্যন্ত গভীর কষ্ট।
প্রকৃতপক্ষে ধরিত্রী মাতা হচ্ছেন একজন মহান ভক্ত এবং তিনি সর্বদা তাঁর দেহে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মধূলি লাভের কারণে অত্যন্ত ভাগ্যবতী। অন্যরা কিছু সময় কৃষ্ণের বিরহে ছিলেন এবং কিছু সময় কৃষ্ণের সান্নিধ্যে ছিলেন।
কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলার সম্পূর্ণ সময় জুড়েই ধরিত্রী মাতা তাঁর পাদপদ্মের স্পর্শ লাভ করেছেন। আপনারা উপলব্ধি করতে পারেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চলে যাওয়ার পর কেমন তীব্র বিরহই না তিনি অনুভব করছেন।
এটি বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই ধরাধাম যখন ছেড়ে গিয়েছিলেন, তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তদের কী অবস্থা হয়েছিল। ভগবান যখন পৃথিবী ত্যাগ করেন তখন কেউ যে তীব্র বিরহ অনুভব করেন, সেটি অনুধাবন করে হরিদাস ঠাকুর চৈতন্য মহাপ্রভুকে অনুরোধ করেছিলেন যে তিনি তাঁর আগে চলে যেতে চান।
তাঁর অনুরোধের কারণেই, তাঁর তিরোভাব, সমুদ্রে স্নানের পর সমাধি এবং এরপরে কীর্তন ও ভোজন, এই অপূর্ব লীলাগুলি উদযাপিত হয়েছিল। হরিদাস ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন যে ভগবান চলে যাবার পর অবস্থান করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়বে।
রামানন্দ রায় রসাশ্রিত প্রেমভক্তির থেকেও উন্নত স্তরের দাস্যভক্তির কথা বলতেন, “দাস্য-প্রেম সর্ব-সাধ্যসার।” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সে কথা স্বীকার করতেন কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতেন, “এহো হয়, কিছু আগে আর।”
রামানন্দ রায় বললেন, “সখ্য-প্রেম–সর্ব-সাধ্যসার।”
মহাপ্রভু বললেন, “এহো উত্তম, আগে কহ আর।”
রামানন্দ রায় বললেন, “বাৎসল্য-প্রেম–সর্ব-সাধ্যসার।”
মহাপ্রভু বললেন, “এহো উত্তম, আগে কহ আর।”
রামানন্দ রায় তখন বললেন, “কান্তভাব প্রেম-সাধ্যসার। কৃষ্ণপ্রাপ্তির বহুবিধ উপায় আছে, এবং কৃষ্ণপ্রাপ্তির তারতম্যও বহু প্রকার রয়েছে, কিন্তু যাঁর যেই রস, তাঁর কাছে সেটিই সর্বোত্তম, কিন্তু তটস্থভাবে বিচার করলে তাদের মধ্যে তারতম্য আছে।”
রসের তারতম্য বোঝাবার জন্য তিনি একটি প্রাকৃত উদাহরণ দিলেন–আকাশ, বায়ু, আগুন, জল ও মাটি এই পঞ্চ মহাভূতে যেমন ক্রমশ গুণের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, আকাশে কেবল শব্দগুণ, বায়ুতে শব্দ ও স্পর্শ, অগ্নিতে শব্দ, স্পর্শ ও রূপ, জলে শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস এবং মাটিতে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ।
তেমনই শান্ত, দাস্য, সখ্য,বাৎসল্য ও মধুর রসে ক্রমশ গুণ বৃদ্ধি হয়ে মধুর রসে পাঁচটি গুনই পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ পায়। অতএব পরিপূর্ণ কৃষ্ণপ্রাপ্তি “মধুর” বা “শৃঙ্গার” রসরূপ প্রেমেই পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত হয়েছে যে মধুর রসোৎফুল্ল-প্রেমে কৃষ্ণ নিতান্ত বশ হন।
শান্তরসে কৃষ্ণৈকনিষ্ঠতারূপ গুণটি দাস্যরসে মমতা যুক্ত হয়ে অধিক সমৃদ্ধ, আবার সখ্যরসে কৃষ্ণৈকনিষ্ঠতা ও মমতা বিশ্রম্ভের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অধিকতর প্রফুল্ল হয়েছে; বাৎসল রসে শান্ত-দাস-সখ্য রসের গুণ তিনটি স্নেহাধিক্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতীয়মান হয়।
সেখানে তিনি নিজে অসংখ্য মূর্তিতে প্রকাশ করে দুজন গোপীর মধ্যে এক কৃষ্ণরূপে নৃত্য করছিলেন, কিন্ত মাঝখানে তিনি একা শ্রীমতী রাধারণীর সঙ্গে নাচছিলেন। তারপর যখন অভিমান করে শ্রীমতী রাধারণী রাসমন্ডলী ছেড়ে চলে গেলেন তখন সেই শতকোটি ব্রজগোপীদের ছেড়ে রাধার অন্বেষণে বিলাপ করতে করতে বনে বনে তাঁকে খুঁজতে লাগলেন।
কান্তভাবরূপে মধুর রসে ঐ চারটি গুণ সঙ্কোচশূণ্য হয়ে অত্যন্ত মাধুরী লাভ করে। এইভাবে গুণাধিক্যের ফলে স্বাদাধিক্য বৃদ্ধি হয়। সুতরাং তটস্থ বিচারে মধুর রস সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
কৃষ্ণ যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যেভাবে তাঁকে ভজনা করবেন, তিনিও তাঁকে সেইভাবে ভজনা করবেন। কিন্তু এই প্রেমের অনুরূপ ভজনা শ্রীকৃষ্ণ করতে পারেন না।
তিনি সেই ভক্তের কাছে তাই ঋণী হয়ে থাকেন। মহাপ্রভু বললেন, “মধুর রসে এই কৃষ্ণপ্রেম অবশ্যই সাধ্যের চরম সীমা। কিন্তু এরও আগে যদি কিছু থাকে তা হলে কৃপা করে আমাকে বল।”
রামানন্দ রায় বললেন, “এরও আগে আর কিছু আছে কি না সে প্রশ্ন করতে পারে এমন কেউ এই জগতে আছে বলে আমি জানতাম না। মধুর রসামৃত সমস্ত প্রেমিকাদের মধ্যে শ্রীমতী রাধারাণীর প্রেম সর্বশ্রেষ্ঠ। রাসলীলায় শ্রীকৃষ্ণ শতকোটি গোপীদের সঙ্গে নৃত্য করেছিলেন।
সেখানে তিনি নিজে অসংখ্য মূর্তিতে প্রকাশ করে দুজন গোপীর মধ্যে এক কৃষ্ণরূপে নৃত্য করছিলেন, কিন্ত মাঝখানে তিনি একা শ্রীমতী রাধারণীর সঙ্গে নাচছিলেন। তারপর যখন অভিমান করে শ্রীমতী রাধারণী রাসমন্ডলী ছেড়ে চলে গেলেন তখন সেই শতকোটি ব্রজগোপীদের ছেড়ে রাধার অন্বেষণে বিলাপ করতে করতে বনে বনে তাঁকে খুঁজতে লাগলেন।
অতএব শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীমতী রাধারাণীর প্রেমই সর্বশ্রেষ্ঠ। এইভাবে শ্রীল রামানন্দ রায়ের মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভগবদ্ভক্তির পরম উৎকর্ষতা প্রদর্শণ করে শ্রীমতী রাধারাণীকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত বলে প্রমাণ করলেন।
………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন
1 Comment