ভবঘুরেকথা
রামদাস বাবাজী

ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত কুমারপুর গ্রামে ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন রামদাস। পিতার নাম দূর্গাচরণ গুপ্ত। রামদাসের বাল্যকালের নাম ছিল রাধিকারঞ্জন। ছেলেবেলা থেকেই হরিনাম সংকীর্তনের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ ছিল রাধিকারঞ্জনের। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৈষ্ণবীয় প্রেমভক্তির একটি বলিষ্ঠ বীজ তাঁর বালক হৃদয়ে এসে আপনা হতেই উপ্ত হয়ে যায়, তা বুঝতে পারেননি তিনি।

হরিনামের তত্ত্ব কি, কে গৌরাঙ্গ, এসব কিছুই তিনি জানতেন না। বৈষ্ণবীয় প্রেমধর্মের মর্মকথা কেউ তাঁকে বলেনি। তবু হরিনাম সংকীর্তন তাঁর কর্ণের ভিতর দিয়ে মর্মদেশকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে এক আধ্যাত্ম জিজ্ঞাসার প্রবল আলোড়ন জাগত তাঁর অন্তরে। পুলকের রোমাঞ্চ জাগত সারা অঙ্গে। প্রথাগত লেখাপড়ার প্রতি সব আকর্ষণ তাঁর লোপ পায়।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের সময় পাটুরিয়া গ্রামে এক টোল খোলেন। সেই থেকে তাঁর সেই স্মৃতিতে মাঘী পূর্ণিমার দিন থেকে এক মাস ধরে সে গ্রামে মেলা বসে। রধিকারঞ্জন একবার এক বন্ধুর সঙ্গে সেই মেলা দেখতে যান। সেখানে বাউল ও বৈষ্ণবদের ভিড় দেখে প্রেমভক্তির ভাব জাগল তাঁর অন্তরে।

এক জায়গায় দেখলেন গৌরাঙ্গদেবের মূর্তির সামনে আরতি হচ্ছে। আর কোন বিগ্রহ সেখানে নেই। এক সাধু বললেন, এটি হলো গৌড়বাদী সম্প্রদায়ের আখড়া। এই সম্প্রদায়টি বিশুদ্ধ বৈষ্ণবের।

পরদিন দেখলেন, কয়েকজন সাধু মহানন্দে মত্ত্ব হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করছে। তারা আবার অন্য সম্প্রদায়ের। আর এক জায়গায় দেখলেন, একদল বৈষ্ণব বৈষ্ণবী হরিনাম করতে করতে ভিক্ষা করছে। রধিকারঞ্জন প্রশ্ন করে জানলেন, তারা বাউল সম্প্রদায়ের। যোগ আর তন্ত্রমার্গেই তাদের সাধনা চলে।

এইসব সম্প্রদায়গত ভেদ দেখে বিস্মিত হলেন রধিকারঞ্জন। এক-একদল গৃহত্যাগী হরিভক্ত এক একটি সম্প্রদায়কে অবলম্বন করে সাধনা করে চলেছে এবং প্রত্যেকেই বলছে তারা বিশুদ্ধ বৈষ্ণব। রধিকারঞ্জন বুঝতে পারলেন না, সকলের আরাধ্য দেবতা যদি এক হয়, তবে এত উপাসনাগত ভেদ কেন? যাই হোক, সকল সম্প্রদায়ের প্রতি প্রণাম জানিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানালেন, অচিরে যেন তাঁর গৃহবন্ধন ছিন্ন হয় এবং অখণ্ড সংশয় যেন তাঁর দূরীভূত হয়।

এইভাবে প্রকৃত সাধুসঙ্গের মাধ্যমে ঈশ্বরের কৃপালাভের বাসনা প্রবল হয়ে উঠল রধিকারঞ্জনের চিত্তে। এরপর থেকে একজন শক্তিমান বৈষ্ণব সাধকের কাছে দীক্ষাগ্রহণ করে গৃহত্যাগের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলেন তিনি। অবশেষে গুরুর সন্ধান পেলেন তিনি। সেই গুরু হলেন পাবনার প্রবীণ বৈষ্ণব দীনবন্ধু দাস। তিনি রধিকারঞ্জনকে দীক্ষা-দান করে তাঁর নতুন নামকরণ করলেন, রামদাস।

রমদাসের বয়স তখন মাত্র সতের। সেই বয়সেই গৃহত্যাগ করে সাধনার জন্য বৃন্দাবনধামে যাবার সংকল্প করলেন। দীনবন্ধু দাস দীক্ষাগুরু হলেও তার আধ্যাত্মসাধনার প্রকৃত পথপ্রদর্শক ছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবসাধক প্রভু জগদ্বন্ধু।

এবার থেকে এই নামপ্রচারকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করলেন রামদাস। বরিশাল জেলার অন্তর্গত বাটাজোরা গ্রামনিবাসী হুসেন আলি মুসলমান হয়েও হরিনাম করে। এজন্য মুসলমানরা তাকে প্রায়ই মারধর করে। তারা তার হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। একটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। তবু সে হরিনাম ছাড়েনি এত পীড়ন সত্ত্বেও।

রামদাসের প্রাণের কথা জানতে পেরে প্রভু জগদ্বন্ধু একখানি চিঠি দিয়ে তাকে নির্দেশ দেন, রামদাস! তুমি একাকী বৃন্দাবনে যাবে। বৈরাগীরা একাকীই যাওয়া-আসা করে। তারা কারো অপেক্ষা করে না। কারো সঙ্গে তাদের বিরোধ হয় না। তারা সর্বদা সহজ সত্যবস্তু উপলব্ধি করে।

প্রভু ঈশ্বরের অনন্ত বিভূতির মধ্যে ছয়টি প্রধান। আবার বৈরাগ্য তাদের মধ্যে প্রধান। তুমি সেই বৈরাগ্য পেয়েছ। সর্বদা নির্ভয় নিরপেক্ষ হয়ে থাকবে। মাধুকরী করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করবে। কোথাও স্থূল ভিক্ষা করবে না।

প্রথমে শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবনধামে গিয়ে কিছুকাল সাধনা করেন রামদাস। তারপর ফেরার পথে অনেক তীর্থ পরিক্রমা করেন। অবশেষে নবদ্বীপধামে ফিরে এসে একমাত্র নাম গানকেই তাঁর ধর্ম সাধনার সারবস্তু বলে গ্রহণ করেন। কলিযুগের শ্রেষ্ঠ ধর্ম হরিনাম সংকীর্তন।

বৈষ্ণব মহাজনরা বলেছেন, যে নাম সেই কৃষ্ণ। নাম এবং নামী অভেদ। যেখানেই নামকীর্তন, সেখানেই অবস্থান করেন শ্রীহরি। তিনি নামের সঙ্গে সঙ্গেই ফেরেন সর্বদা।

এরপর সিদ্ধ বৈষ্ণব চরণদাস বাবাজীর সংস্পর্শে আসেন রামদাস। এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় রামদাসের জীবনে। শুধু নিজে নাম করলেই হবে না। শুধু নিজে শ্রদ্ধা-ভক্তি লাভ করলেই হবে না। অসংখ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই নাম প্রচার করতে হবে। পাপীতাপীদের উদ্ধার করতে হবে তাদের মধ্যে হরিভক্তি জাগিয়ে।

এবার থেকে এই নামপ্রচারকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করলেন রামদাস। বরিশাল জেলার অন্তর্গত বাটাজোরা গ্রামনিবাসী হুসেন আলি মুসলমান হয়েও হরিনাম করে। এজন্য মুসলমানরা তাকে প্রায়ই মারধর করে। তারা তার হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। একটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। তবু সে হরিনাম ছাড়েনি এত পীড়ন সত্ত্বেও।

বরিশালের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত হুসেন আলিকে রামদাস বাবাজীর কাছে পাঠান। কারণ তিনি জানতেন, নিরাশ্রয় হুসেনকে পরম বৈষ্ণব রামদাসই আশ্রয় দিতে পারেন। সেদিন রামদাস শ্রীখণ্ডের বড়ভাঙ্গার বার্ষিক উৎসবে ভক্তদের নিয়ে নামগান করছিলেন।

বরাহনগর পাঠবাড়ির সংস্কার ও উন্নতিসাধন রামদাস বাবাজীর শেষ জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই পাঠবাড়িতেই ১৯৫৩ সালে তিনি মরদেহ ত্যাগ করে নিত্যধামে গমন করেন। আজও বহু ভক্ত এই পাঠবাড়িতে রামদাস প্রবর্তিত পথে নিয়ত নামগান করে নামপ্রচারের ধারাটিকে অক্ষুন্ন রেখে চলেছেন। আজও বহু পাপী তাপী এই পাঠবাড়িতে আশ্রয় লাভ করে নামের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন সর্বসমক্ষে।

এমন সময় হুসেন আলি দরবেশের বেশে এসে লুটিয়ে পড়ল বাবাজীর পায়ে। তার পরনে ছিল মাত্র একখানি ছেঁড়া চট। মাথায় রুক্ষ চুল। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। হুসেন আলিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে করুণায় হৃদয় বিগলিত হলো বাবাজীর অন্তর। দুই নয়নে ঝরতে লাগল স্নেহের অশ্রুবিন্দু।

সেদিন থেকে মুসলমান হুসেন আলি বাবাজীর বৈষ্ণব ভক্তমণ্ডলীতে স্থান পেল। শুধু নিঃস্ব নিপীড়িত হুসেন আলি নয়, কত পাপী তাপীকে উদ্ধার করেন রামদাস বাবাজী।

মানকুণ্ডুর খুনী মাতাল উপেন দত্তকে উদ্ধার করে তাকে স্বাভাবিক সৎ মানুষে পরিণত করেন শুধু হরিনামের অমৃত সিঞ্চনে। কলকাতার পটুয়াটোলার দাম্ভিক জমিদার রায়বাহাদুরের মনের পরিবর্তন ঘটান। রূপসী পতিতা উর্মিলা দাসীকে বৈষ্ণমন্ত্রে দীক্ষাদান করে তার জীবনের পরিবর্তন সাধন করেন।

একবার আরামবাগ শহরের ভক্তদের আমন্ত্রণে সেখানে রামদাস বাবাজী শিষ্যদের নিয়ে অষ্টপ্রহর উপলক্ষে নামগান করতে যান। সেই শহরের ষাট বছরের এক পতিতা বৃদ্ধার ঘরে গিয়ে তাকে নামদীক্ষা দিয়ে তার নতুন নামকরণ করেন সত্যদাসী। সত্যদাসী পরে বৃন্দাবনে গিয়ে রোজ এক লক্ষ নাম জপ করত। একমাত্র নামগানই সিদ্ধসাধক রামদাস বাবাজীর আরাধ্য ও যোগ সাধন পদ্ধতি। তাঁর একান্ত বিশ্বাস, নাম থেকেই সর্বসিদ্ধি হয়।

শুধু নামগানের মধ্য দিয়ে সর্বসিদ্ধি লাভ করে সেই সিদ্ধি জীব উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত করেন রামদাস বাবাজী। জীব উদ্ধারের সঙ্গে বহু দেবস্থানের উদ্ধার ও সংস্কার দ্বারা ধর্মজগতের মহাকল্যাণ সাধন করেন রামদাস বাবাজী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কাজ তিনি এক পরমব্রত হিসেবে করে যান।

বরাহনগর পাঠবাড়ির সংস্কার ও উন্নতিসাধন রামদাস বাবাজীর শেষ জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই পাঠবাড়িতেই ১৯৫৩ সালে তিনি মরদেহ ত্যাগ করে নিত্যধামে গমন করেন। আজও বহু ভক্ত এই পাঠবাড়িতে রামদাস প্রবর্তিত পথে নিয়ত নামগান করে নামপ্রচারের ধারাটিকে অক্ষুন্ন রেখে চলেছেন। আজও বহু পাপী তাপী এই পাঠবাড়িতে আশ্রয় লাভ করে নামের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন সর্বসমক্ষে।

………………………..
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………
আরও পড়ুন-
যোগীবর শ্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়
মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী
ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কিছু কথা
গাঁধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি
তারা মায়ের আদরের দুলাল ‘বামাক্ষেপা’
মহর্ষি মহেশ যোগীর কথা
স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরের দর্শনলাভ : যোগী-কথামৃত থেকে
‘বাবাজী’ আধুনিক ভারতের মহাযোগী
বিনিদ্র সাধু
রামদাস বাবাজী
সীতারাম
তারাপীঠের ‘বামদেব’
বহুবর্ষজীবি শ্রীশ্রী বরফানী দাদাজি
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: এক
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: এক
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!