ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ

-ড. এমদাদুল হক

৪৬
ধর্ম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে- ঈশ্বরকে ভালোবাসো, মানুষকে ভালোবাসো, বাবা-মা, ভাই-বোন, সঙ্গী, সন্তানকে ভালোবাসো। কেউ নিজেকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়নি- বরং এটি শিখিয়েছে যে, নিজেকে ভালোবাসা স্বার্থপরতা।

ফলে কি হয়েছে? ঈশ্বরকে ভালোবাসার জন্য আমরা ধর্মযুদ্ধ উৎপন্ন করেছি। মানুষকে ভালোবাসার জন্য রাষ্ট্র উৎপন্ন করেছি, বাবা-মাকে ভালোবাসার জন্য বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করেছি, সঙ্গীকে ভালোবাসার জন্য ‘হালাল পতিতালয়’ বানিয়েছি, সন্তানকে ভালোবাসার জন্য ‘বেবি ডে কেয়ার সেন্টার’ গড়ে তুলেছি।

কেন এমন হলো? কারণ নিজেকে যে ভালোবাসতে জানে না- সে জানেই না ভালোবাসা কাকে বলে! নিজেকে যে বিশ্বাস করে না, সে জানেই না বিশ্বাস কাকে বলে!! নিজেকে যে সম্মান করে না, সে জানেই না সম্মান কাকে বলে!!!

যে নিজেকে সম্মান করে সে বুঝতে পারে আমি যেমন সম্মান, বিশ্বাস, ভালোবাসা চাই তেমনি সকলেই সম্মান, বিশ্বাস, ভালোবাসা চায়। তাই সে কাউকে অসম্মান করে না, কারো সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে না, কাউকে ঘৃণা করে না।

নিজেকে ভালোবেসেই মানুষ বুঝতে পারে, আমি পৃথক নই জগৎ থেকে। আমি যেমন ক্ষুধায় কষ্ট পাই, তুমিও তেমনি। আমি তুমি- এক।

যে যেরকম পণ্যের দোকান খুলে তার কাছে সেরকম পণ্যই সরবরাহ করা হয়। যে ভালোবাসার দোকান খুলে তার কাছে ভালোবাসাই আসে। ভালোবাসার দোকান খোলা মানে নিজেকে ভালোবাসা- নিজের ভালো করা, নিজেকে ভালো রাখা এবং ভালোতে বাস করা।

নিজেকে ভালোবাসা মানে দ্বন্দ্বের নিরসন। বৃহৎ আমিতে ক্ষুদ্র আমির সম্মিশন। ক্ষুদ্র আমিতে রয়েছে তুলনা, পরশ্রীকাতরা, ঈর্ষা, আবেগ, ক্রোধ, অহংকার, লোভ, স্বার্থপরতা। বৃহৎ আমিতে রয়েছে বিনয়, সহযোগিতা, ত্যাগ, দয়া, করুণা, শ্রদ্ধা, প্রেম।

মানুষকে ভালবাসা নিশ্চয়ই মহৎ গুণ। আমিও মানুষ। তাই ভালোবাসাটি শুরু হোক আমি থেকে। আগে নিজে মানুষ হই, তাহলে কষ্ট করে মানুষকে ভালোবাসতে হবে না- এমনিতেই হয়ে যাবে। পুষ্প নিজের জন্য প্রস্ফুটিত হয় না।

পুষ্প প্রেমের দোকান খুলে- নিজেকে ভালোবেসে সম্পন্ন করে আপন প্রস্ফুটন। ফলে জগৎ প্রেম প্রকাশের ভাষা পায়। পুষ্প থেকে যেমন সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তেমনি যে নিজেকে ভালোবাসে তার অস্তিত্ব থেকে ভালোবাসার সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

আনন্দ কাকে বলে? আনন্দ হলো নিজের সঙ্গে নিজের ‘পবিত্র সম্পর্ক’। আমার সঙ্গে যদি আমার সম্পর্ক ‘পবিত্র’ না হয়, তবে কি আমি আমাকে ভালোবাসতে পারবো? যে নিজেকে ভালোবাসে না তার পক্ষে কি ধ্যান করা আদৌ সম্ভব? চোখ বন্ধ করলেই যদি নিজের কুৎসিত চেহারা চোখে ভেসে উঠে, তবে ধ্যান হয় কি?

ধ্যান হলো নিজের সঙ্গে নিজের পবিত্র সম্পর্ক। ধ্যান হলো নিজের সঙ্গে নিজে আনন্দে নৃত্য করা। সুতরাং নিজের দেহকে পবিত্র রাখি, নিজের মনকে পবিত্র রাখি, নিজেকে ভালোবাসি- এটিই ধ্যান। নিজেকে ভালোবাসি- এটিই ইবাদতের পূর্বশর্ত বা ওজু। নিজেকে ভালোবাসি- এটিই প্রেমের প্রথম সূত্র।

৪৭
তিনি বললেন ‘হও’, আর সব হয়ে গেল? এখনও তো হচ্ছে। ছোট খাটো জিনিস না- গ্যালাক্সি হচ্ছে, গ্রহ নক্ষত্র হচ্ছে, কৃষ্ণ গহব্বর হচ্ছে। এখানো তিনি হয়ে চলেছেন- বিরামহীন। হওয়া একটি প্রক্রিয়া- অন্তহীন প্রক্রিয়া। সম্ভবত, তিনি বলেছিলেন ‘হতে থাকি’। মানুষ বুঝতে পারেনি সেকথা।

বাস্তবে ‘হও’ বললে কিছুই হয় না। শক্তি নিয়োগ করতে হয়। তিনিও তা-ই করছেন। তাঁর অস্তিত্বের সবটুকু ঢেলে দিচ্ছেন সৃজন প্রক্রিয়ায়। তাঁর সমস্ত ভালোবাসা, সমগ্র শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন সৃষ্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

বিশ্ব শব্দটি বিশ্ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। বিশ্ অর্থ হলো প্রতিটি বস্তুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করা। কে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন প্রতিটি বস্তুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে? দেহের প্রতিটি কোষে, প্রতিটি রক্ত বিন্দুতে, প্রতিটি লোমকূপে কে প্রবিষ্ট রয়েছেন? একটি মাত্র চুল থেকেও নাকি ডিএনএ শনাক্ত করা যায়। কে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন চুলে? তিনি।

কেউ তাকে দেখে না। তিনি সবাইকে দেখেন। প্রতিটি অনু-পরমাণুতে- চিন্তার প্রতিটি অলিগলিতে তাঁর অবস্থান। অন্তরে তিনি। অন্তস্থলে তিনি। বাহিরেও তিনি। পাপীর অন্তরে তিনি। সাধুর অন্তরে তিনি। সতীর অন্তরে তিনি। পতিতার অন্তরে তিনি। হিন্দুতে তিনি, মুসলিমে তিনি, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানে তিনি। তিনিই শূদ্র, তিনিই ব্রাহ্মণ।

প্রত্যেক সৃষ্টি একটি মাস্টারপিস। প্রত্যেক সৃষ্টি গোটা মহাবিশ্বের মতো অপার রহস্যময়। কি বিস্ময়কর সুন্দর এই জগৎ! প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ফুল, প্রতিটি ফল যথোচিত দীপ্যমান। প্রতিটি পাখি, সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ, বাতাসের প্রতিটি স্পর্শ, আকাশের প্রতিটি তারা যেন- প্রেম নিকষিত হেম।

সুন্দরের এই অপার রহস্য লুকিয়ে আছে সংযোগে। দেহের ৭৩ লক্ষ কোটি কোষ যেমন একটি অপরটির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলছে তেমনি সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি কণা একটি অপরটির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলছে। এই সমুদয় সংযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি- শ্রী কৃষ্ণ।

উইকিপিডিয়া বলছে, মহাবিশ্বের মূল উপাদান কৃষ্ণ। কৃষ্ণশক্তি বিশ্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে এবং মহাবিশ্ব প্রসারণে মূল ভূমিকা রাখছে। কৃষ্ণশক্তির পরিমাণ ধরা হয় ৭৪% ভাগ, মোট বস্তুর পরিমাণ ধরা হয় ২৬%। ২৬% বস্তুর মধ্যে আবার ২২% কৃষ্ণ বস্তু এবং ৪% দৃশ্যমান বস্তু। ৪% দৃশ্যমান বস্তুর প্রতিটি কণায় রয়েছে ৯৯.৯৯৯৯% কৃষ্ণশক্তি।

কোনো হৃদয় নেই কৃষ্ণ ছাড়া। হৃদয়ের একটি স্পন্দনও নেই কৃষ্ণ ছাড়া। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে রয়েছেন কৃষ্ণ। এই কৃষ্ণকে যে হৃদয়ে অনুভব করে সে হয় কবি, শিল্পী, সুরকার কিংবা প্রেমিক। এই কৃষ্ণকে যে মস্তিষ্কে ধরতে পারে সে হয় বিজ্ঞানী, গবেষক।

আমরা স্বীকার করি বা না করি, প্রতিটি বালুকণা মেনে চলে কৃষ্ণবিধান। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান কৃষ্ণকথা। কানপেতে যখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনি, মনে হয় যেন অর্কেস্ট্রা শুনছি। কেন তারা এতো মধুর গান করে? তারাও কি কৃষ্ণকে খুঁজে?

কোকিলের গান কেন এতো মধুর! কারণ কোকিল তো রাধা হয়ে ডাকছে তার কৃষ্ণকে। মনুষ্যের সৃষ্টি জোড়ায় জোড়ায়। একা একজন মানুষ অর্ধেক মানুষ। মানুষ সারাজীবন বাকি অর্ধেকটা খুঁজে। দুষ্ট কৃষ্ণ লুকোচুরি খেলা করে মানুষের সঙ্গে।

এই আছে, এই নাই। একবার বলে আমি এখানে, মানুষ ছুটে যায়। ক্ষণিক পরই হতাশ!- নাহ! এতো কৃষ্ণ নয়! এতো আমার মতোই রক্ত মাংসের মানুষ! কোথায় কৃষ্ণ? আবার চলতে থাকে খোঁজাখুঁজি।

বারবার আমরা প্রতারিত হই- তবু খুঁজি। আমরা বুঝতেই পারি না যে- কৃষ্ণ মানুষ না, পাখি না, সমুদ্র না- কৃষ্ণ হলো সংযোগ- কৃষ্ণ হলো সম্পর্ক, কৃষ্ণ হলো প্রেম।

সকল পাখি, সকল জীবজন্তুর সৃষ্টি জোড়ায় জোড়ায়। একা কেউ পূর্ণ না, একা কেউ সুখী না। সুখের জন্য চাই সম্পর্ক, পূর্ণতার জন্য চাই সম্পর্ক।

ফুল ও প্রজাপতি এক তো নয়! কিন্তু ফুল প্রজাপতির অপেক্ষায় থাকে। কোথায় চাঁদ আর কোথায় সমুদ্র, কিন্তু সমুদ্রের জল ফুলে উঠে চাঁদের টানে।

পাখিরা শুধু পাখিদের কথা ভাবে। কিন্তু মানব হৃদয়ে যখন প্রেম আসে, তখন সমগ্র প্রকৃতি মানুষের ভাবনায় আসে- ভিন্ন রূপে।

তাই মানুষ যখন মানুষের সঙ্গে পবিত্র সম্পর্ক গড়ে তুলে তখন স্বর্গ মর্ত্যের সবকিছুতে ছড়িয়ে পড়ে মঙ্গল স্পন্দন। প্রেমিকের চোখে সমগ্র প্রকৃতি যেমন ধরা দেয় ভিন্ন রূপে, তেমনি প্রকৃতিও সাজে ভিন্নরূপে প্রেমের ঐশ্বর্যে।

একটি চুল ধরে টান দিলে যেমন গোটা দেহ নড়ে উঠে তেমনি কেউ যদি পবিত্র সম্পর্ক ধরে টান দেয় গোটা ব্রহ্মাণ্ড নড়ে উঠে।

যেখানে প্রেম আছে সেখানে আনন্দ আছে। যেখানে আনন্দ আছে সেখানে নৃত্য আছে। নৃত্য কীভাবে আমাদের হলো? প্রেমের ভাবে। সঙ্গীত কীভাবে আমাদের হলো? প্রেমের ভাবে। কাব্য কীভাবে আমাদের হলো? প্রেমের ভাবে।

যদি প্রেম না থাকে, তবে সুর থাকবে না, নাচ থাকবে না, কবিতা থাকবে না। কৃষ্ণের প্রমাণ কি? জোড়ায় জোড়ায় তার প্রমাণ। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার প্রমাণ। যা কিছু আছে সবই তাঁর প্রমাণ। প্রত্যেক মানুষ তার প্রতিনিধি। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান তাঁর শিল্পকর্ম। যে শিল্পকে ভালোবাসে না সে শিল্পীকে ভালোবাসবে কেমন করে?

আস্তিক-নাস্তিক, হিন্দু-মুসলিম, সাদা-কালো সবই তাঁর শিল্পকর্ম। জগতের প্রত্যেক মানুষ, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান ভালোবাসার পাত্র। ভালোবাসার জন্য নিখুঁত পাত্র দরকার নাই। ভালোবাসা নিখুঁত হলেই হলো।

৪৮
কতকিছু শিখি আমরা জীবনে! বসতে শিখি, হাঁটতে শিখি, কথা বলতে শিখি, লিখতে শিখি, পড়তে শিখি, গাইতে শিখি, নাইতে শিখি। শৌচকর্মও আমাদের শিখতে হয়।

ভালোবাসাও কি শিখতে হয়? এমন কোনো মা-বাবা কি আছে পৃথিবীতে যে সন্তানকে ভালোবাসা শিক্ষা দেয়? মাতা-পিতা কি কারো কাছ থেকে সন্তানকে ভালোবাসতে শিখে?

এমন কোনো নারী কি আছে, যে কারো কাছ থেকে পতিপ্রেম শিখেছে? এমন কোনো প্রেমিক কি আছে পৃথিবীতে যাকে প্রেম করা শিখতে হয়? সাপ কার কাছ থেকে প্রেম করা শিখে? সাপ কিন্তু বেশ ভালোভাবেই প্রেম করতে জানে।

জগতে এমন কোনো স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখান থেকে প্রেমের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এই একটি মাত্র বিষয়ে প্রশ্ন ছাড়া, পরীক্ষা ছাড়া, প্রতিযোগিতা ছাড়া সকলেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।

এই একটি মাত্র বিষয়ে যে যত আনাড়ি সে তত নিখুঁত।
এই একটি মাত্র বিষয়ে যে কিছুই জানে না- সে সব জানে।
এই একটি মাত্র বিষয়ে যে যত অশিক্ষিত- সে তত শিক্ষিত।
এই একটি মাত্র বিষয়ে যে যত অনভিজ্ঞ- সে তত পবিত্র।

প্রেম শেখা যায় না, শেখানোও যায় না। যার সন্তান নেই তাকে বাৎসল্য প্রেম যতই শিক্ষা দেওয়া হোক না কেন, সে তার কিছুই বুঝবে না। যার প্রেমিক নেই তাকে কখনো বুঝানো যাবে না, মধুর প্রেম, কতো যে মধুর। যার ঈশ্বর নেই তাকে ঈশ্বর প্রেম বুঝানোর প্রচেষ্টা বৃথা।

প্রেমের সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্পর্ক এই যে, পবিত্র প্রেম স্বয়ং সুন্দর, তাই এটি দৈহিক সৌন্দর্যের উপর নির্ভর করে না। পৃথিবীতে এমন কোনো সন্তান নেই যে মাতাপিতার দৃষ্টিতে অসুন্দর। পৃথিবীতে এমন কোনো মাতাপিতা নেই যে সন্তানের দৃষ্টিতে অসুন্দর। এর রহস্য হলো সৌন্দর্য দেহে থাকে না, মনেও থাকে না- সৌন্দর্য থাকে সম্পর্কের পবিত্রতায়।

রহস্যজনকভাবে পবিত্র ভালোবাসায়, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ উক্তিটি অনুপস্থিত। মাতা তার পুত্রকে বলে না- ‘আই লাভ ইউ’। পিতা তার কন্যাকে বলে না- ‘আই লাভ ইউ’। এখানে শব্দ নেই- আছে প্রযত্ন। প্রযত্ন ছাড়া প্রেম- কথার কথা মাত্র।

৪৯
জীবনের কোনো বিধান নেই। নদী যেমন মানচিত্র মেনে চলে না, জীবন তেমনি বিধান মেনে চলে না; চলে না কারণ চলতে পারে না। জীবন প্রতিটি ক্ষণে অভিনব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।

জীবন জীবিত, আর কাগজের বিধান মৃত। তথাকথিত জীবনবিধানগুলো বিশেষ সময়ে, বিশেষ ঘটনার প্রতি, বিশেষ ব্যক্তির সাড়া। সেই সময় আর নেই, সেই ঘটনাও আর নেই। সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই। তবে রামায়নের কর্তৃত্ব থাকবে কেন?

আরেকজনের জ্ঞানপ্রাপ্তির গল্প আবৃত্তি করে আমাদের কি লাভ? জ্ঞানপ্রাপ্তির যেই ধারা ‘খতম’ হয়ে গেছে, তা নিয়ে বিলাপ করলে অজ্ঞতার দিকে যাওয়া যাবে, জ্ঞানের দিকে তো অবশ্যই নয়।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মশাস্ত্রগুলো ধর্মপ্রবর্তকের অভিজ্ঞতা এবং তৎকালের কিছু সামাজিক সমস্যার সমাধান। এগুলোর চর্চা জীবনকে আলোকিত করতে পারে না- পারে শুধু মানুষে-মানুষে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব তৈরি করতে।

পক্ষে বললেও দ্বন্দ্ব, বিপক্ষে বললেও দ্বন্দ্ব। এটি বললেও ভুল- ওটি বললেও ভুল। অথচ, আমরা সম্মোহিত হয়ে আছি এইসব দ্বন্দ্ব উৎপাদক শাস্ত্রের গণ্ডিতে। নিজের কোনো দলিল নাই, তাই আমরা পরের দলিল নিয়ে টানাটানি করি।

নিজের কোনো অভিজ্ঞতা নাই, তাই আমরা আরেকজনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লাফালাফি করি। আমরা বুঝতে চেষ্টা করি না যে, এইসব সমস্যা এখনকার না। আমাদের জীবন কোনোভাবেই এসব কাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত না।

যদি প্রকৃতই কেউ জীবনবেদ বুঝতে চায়, তবে শুরু করা চাই নতুনভাবে- বাস্তব জীবনের আলোকে। আমাদেরকে ভাবতে হবে, আমাদের বাস্তব জীবনের সমস্যা নিয়ে। পাখির সৈন্যবাহিনী আর আসবে না আমাদের সমস্যা সমাধান করতে। আমাদের লাঠিগুলো আর কোনোদিন সাপ হবে না।

জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো বর্তমানের সংঘর্ষ। ডগমার গুরুত্ব ডগমাটিস্টদের কাছে। কৌতুহল মেটানোর জন্য মাঝেমধ্যে ডগমা চর্চা করা যেতেই পারে। কিন্তু ডগমার সঙ্গে জীবন মিলাতে গেলে ধ্বংসাত্মক পরিণতি অপরিহার্য।

৫০
ভালোবাসা কি? বাস্তবেই ভালোবাসা বলতে কিছু আছে কি? নাকি সব কথার শিল্প? ঈশ্বরকে ভালোবাসা বলতে কি বুঝায়? ঈশ্বর একটি ধারণা। ঈশ্বরকে ভালোবাসা মানে কি তবে ধারণাকে ভালোবাসা? নাকি এটিও একটি কথার শিল্প?

বাস্তবতা কি বলে? আমরা কাকে ভালোবাসি, কেন ভালোবাসি, কীভাবে ভালোবাসি? আমাদের ভালোবাসার গল্পগুলোতে ভিলেন তো একজন থাকেই। আর কি থাকে? থাকে ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা এবং ভালোবাসার মানুষটিকে দাস বানানোর পাঁয়তারা, তার চলাফেরা, কথাবার্তা এমনকি চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা।

আমাদের প্রেমের কবিতাগুলোর সারমর্ম- “সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে”।

যতক্ষণ তুমি ঐ যুবকের সঙ্গে কথা না বলো, যতক্ষণ তুমি ‘আমার’ থাকো ততক্ষণই আমি তোমাকে ভালোবাসি। যতক্ষণ দিতে পারো, ততক্ষণ তুমি খুব ভালো- ‘আই লাভ ইউ’।

এর নাম যদি ভালোবাসা হয়, তবে ব্যবসা কাকে বলে? হারানোর ভয়, উদ্বেগ, অস্থিরতা, ঈর্ষার সঙ্গে কি ভালোবাসা থাকতে পারে? কিংবা বিষের সঙ্গে মধু? অথচ আমরা বিষ মিশ্রিত মধুকেই ভালোবাসা বলি!

আচ্ছা, অতীতের সঙ্গে কি প্রেম করা যায়? তাঁকে ভালোবাসা উচিত, এজন্য ভালোবাসা যায় কি? উপন্যাসের একটি চরিত্র ভালো লাগতেই পারে, কিন্তু ঔপন্যাসিক চরিত্রের সঙ্গে প্রেম করা সম্ভব কি?

আচ্ছা, তুমি তাঁকে যেভাবে ভালোবাসো, আমিও কি তাকে সেভাবে ভালোবাসতে পারি? যদি এটি সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা অনুসরণ করি কেন?

এমন কোনো ভালোবাসার অভিজ্ঞতা কি আমাদের আছে, যেখানে ঈর্ষা নাই, হারানোর ভয় নাই, অস্থিরতা নাই, ক্রোধ নাই, দাস বানানোর প্রবণতা নাই? যদি থাকে, তবে তা ঐশ্বরিক ভালোবাসা হতে পারে, পবিত্র ভালোবাসা হতে পারে।

যদি না থাকে, তবে ঈশ্বর যেমন একটি ধারণা তেমনি ঐশ্বরিক ভালোবাসাও একটি ধারণা। ধারণা সত্য নয় এবং সত্য ধারণা নয়।

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!